রাতের রহস্যময়ী
রাতের রহস্যময়ী


শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রাত 8টা 30 মিনিটে ছাড়ল কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস।আজকে অবাক করার মতো ব্যাপার ,যাত্রী খুবই কম। আমি অরূপ আইচ, সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এক নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মচারী। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের এসি থ্রি টায়ারে চলেছি হ্যামিলটনগঞ্জ। নিজের প্রেমিকা সুস্মিতার সাথে দেখা করতে। সুস্মিতা ভৌমিক, আলিপুরদুয়ারের একজন স্কুলশিক্ষিকা। দেশের বাড়ি হ্যামিলটনগঞ্জে। আমার সাথে প্রথম আলাপ হয় ফেসবুকে। সেখান থেকে আসতে আসতে বাড়তে থাকে অন্তরঙ্গতা। ক্রমশ সময়ের সাথে সাথে আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ি। সুস্মিতার স্কুলে এখন গ্রীষ্মাবকাশ চলছে। সুস্মিতা এখন আছে হ্যামিলটনগঞ্জে। প্রেমিকার সাথে প্রথমবার দেখা করতে হ্যামিলটনগঞ্জ যাচ্ছি আমি।মনের মধ্যে প্রেমিকাকে প্রথমবার দেখার উত্তেজনা, শরীরে জেগেছে পুলক, একে অনেকদিন পর ট্রেনজার্নির উত্তেজনা , তারপর প্রেমাস্পদার সাথে প্রথমবার দেখা করতে যাওয়া, আজ হয়তো রাতে হবেই না ঘুম।কিন্তু, এখন গরমকাল। নর্থ বেঙ্গল যাবারই তো সিজন! তো এই কামরার যাত্রী এতো কম কেন!
ও একটা কথা তো বলাই হল না, সুস্মিতার সাথে দেখা করতে যাওয়া ছাড়াও হ্যামিলটনগঞ্জ যাবার মূল উদ্দেশ্য হল ডুয়ার্স। হ্যাঁ, মনোরমা ডুয়ার্সের প্রেমে পড়েছি আমি। সুস্মিতার ফেসবুক প্রোফাইলে ডুয়ার্সের গহন শাল অরণ্য আর মূর্তি নদীতে রক্তিম সূর্যাস্তের লালিমা মন কেড়ে নিয়েছে আমার। সেই দেখার মুহূর্ত থেকে আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে যে, কখন এই চিত্তাকর্ষক ডুয়ার্সের মন মাতাল করা ল্যান্ডস্কেপের সৌন্দর্যকে নিজের চোখে উপভোগ করতে পারব!
গভীর রাত। ট্রেনের সব আলো নিভে গেছে। নাইটল্যাম্পের হালকা নীলাভ আলো ট্রেনের কামরার পরিবেশকে মায়াময় করে তুলেছে। গভীর রাতে নিদ্রাহীন চোখে বসে আছি আমি। আর আমার সামনে ত্রয়ী। আমি শুনছি ত্রয়ীর মুখে এক মায়াবী কাহিনী! বা সেটা তার জীবনের বাস্তব।
হু হু করে ফরাক্কা ব্যারেজের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। আজ হয়তো অমাবস্যা। তাই চারিপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুহূর্তের জন্য নদীর ওপর আলোকসজ্জা গুলি দৃশ্যমান হলো। ত্রয়ীর শরীর থেকে একটা অপরূপ মায়াবী গন্ধ ভেসে আসছে। সেই মায়াবী গন্ধে আমার মন ভাসছে। ওর ঘনকাজল পরা চোখের কুহকময় দৃষ্টিতে ডুবে যেতে ইচ্ছা করছে। ত্রয়ীর হাতের আঙুল স্পর্শ করে চমকে উঠলাম আমি। ইশ্, ওর আঙুল যে বরফের মতো ঠাণ্ডা। চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে মায়াবী নীল আলো। ত্রয়ী বলে উঠল,"তুমি ডুয়ার্সে যাচ্ছ ,তাই না অরূপ। জান , এককালে তোমার মতো আমিও ডুয়ার্সকে খুব ভালোবাসতাম। এমনকি এখনো ভালোবাসি। আর এই টানেই তো রাতের ট্রেনে বারবার ছুটে চলি ডুয়ার্স । তাও তো মেটে না মনের সাধ।" আমি মাথা নেড়ে বললাম,"তুমি ঠিকই বলেছ ত্রয়ী। ডুয়ার্স সত্যিই অনবদ্য। ডুয়ার্স মানেই পড়ন্ত বিকালে মূর্তি নদীতে সূর্যাস্তের মায়াবী রক্তিমা, ডুয়ার্স মানেই বৃষ্টিভেজা ঘন সবুজ শাল-সেগুনের অরণ্য, ডুয়ার্স মানেই জলদাপাড়া জঙ্গলে একশৃঙ্গ গণ্ডার,ডুয়ার্স মানেই দিগন্তে ধূসররঙা পাহাড়শ্রেণীর হাতছানি। এক কথায়, আমার কাছে ডুয়ার্স সত্যিই মধুময়।আর এখন আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। বড়ো অমোঘ এই টান।" মুখে হাসি ফুটল ত্রয়ীর। ট্রেনের আলো আঁধারির পরিবেশে সেই হাসিকে রহস্যময় দেখালো। ত্রয়ী বলল,"জান তো এই টানেই প্রতিবার যেতাম ডুয়ার্সে। গরমের সময়। আমার কবিতা লেখার খুব শখ ছিল। আর ফটোগ্রাফি ছিল আমার প্যাশন। নিক্কনের ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যেতাম ডুয়ার্স।"
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ত্রয়ী। ওর উষ্ণ শ্বাস অনুভব করল আমার ইন্দ্রিয়। কি যেন এক অদ্ভূত সম্মোহনী শক্তি আছে ওর মধ্যে। ওর শরীর যেন হাতছানি দিয়ে টানছে আমাকে। সমস্ত স্নায়ু উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বুঝলাম, জার্নি করার আগে এতো বেশি মদ খাওয়া উচিত হয় নি।
দেখলাম,ত্রয়ী আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ফিসফিস করে বলল,"কামনাকে দমন করো অরূপ। এই কামনা শয়তানের সৃষ্টি। এই কামনা আমাদের জীবনে নানা বিপদ, নানা অনর্থ ডেকে আনে।" আশ্চর্য হলাম,মেয়েটা কি মনের কথা পড়তে জানে নাকি!
গভীর রাত। তুরীয় গতিতে ছুটে চলেছে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। ত্রয়ী বলে চলল, "সেবার ইচ্ছা হল অ্যাডভেঞ্চার করার। তাই বয়ফ্রেন্ড ইন্দ্রকে নিয়ে শ্রাবণে চললাম ডুয়ার্সে। কে না জানে,বর্ষাকালে ডুয়ার্স কতোটা অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে ওঠে!"
রাত সাড়ে তিনটে বাজে। মালদা টাউন স্টেশন পার করে ট্রেন ছুটছে উত্তরবঙ্গ তথা ডুয়ার্সের দিকে।ত্রয়ী কোকিলকন্ঠী গলায় বলে চলল,"সেবার গেলাম ফালাকাটার কাছাকাছি পূর্ব দেওগাঁও গ্রামের কাছাকাছি। ডুয়ার্সের ওয়াইল্ডলাইফ সত্যিই অ্যাডভেঞ্চারাস। সকালে ঘুম ভাঙত Green Billed Malkoha, Pygmy Woodpecker এর ডাকে। শোনা যেত হাতি আর গণ্ডারের ডাক। সেই ডাকে রাতে ফরেস্ট গেস্টহাউসে ঘুমাবার সময়ে শিহরিত হয়ে উঠতাম।
কাছাকাছি একটা পরিত্যক্ত চার্চ ছিল। বলা হয় যে, সেই চার্চের এক পাদ্রীকে ইনফিডেল করা হয়েছিল। কারণ নাকি সে ক্ষমতা লাভ করার জন্য স্বয়ং শয়তানের কাছে নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দিয়েছিল, ধর্মের পথ ছেড়ে ঈশ্বরকে ভুলে শয়তানের ক্রীতদাস হয়ে গিয়েছিল। অমাবস্যার রাতে গ্রামের নিরীহ শিশুদের রক্ত দিয়ে তার মনিবকে তুষ্ট করার চেষ্টা করত।
গ্রামবাসীরা সব জানতে পারলে তারা ডেকে আনে শিলিগুড়ির কনভেন্টের ফাদার জন ডি ক্রুজ কে। ফাদার জন ফাদার ডি কোস্টা(যিনি শয়তানের দাসে পরিণত হয়েছিলেন) তার দিকে পবিত্র ছাই বা holy ash ছুড়ে মারেন। আর তাতেই শয়তানের অন্ত হয়।
ফাদার ডি কোস্টাকে সমাধিস্থ করা হয় চার্চের পেছনদিকে কবরস্থানে। কিন্তু , বলা বাহুল্য, এখনো ফাদার ডি কোস্টার অতৃপ্ত আত্মা প্রতি অমাবস্যার রাতে নিজের শিকারকে খুঁজে বেড়ায়।"
একটু থামল ত্রয়ী। তারপর আবার শুরু করল,"সেদিন ছিল অমাবস্যা। বিকালে আমি আর ইন্দ্র গেলাম চার্চের দিকে বেড়াতে। হঠাৎ আকাশ কালো করে উঠল।উঠল অকস্মাৎ ঝড়। কালো মেঘের বুক চিরে চমকে উঠল ক্ষণপ্রভা। মুষলধারে শুরু হল বৃষ্টি। আর আমরা আশ্রয় নিলাম সেই অভিশপ্ত চার্চে। "
আমি বললাম-"তারপর?"
ত্রয়ী হেসে উঠল-"দিনের আলো পড়ে এল। পৃথিবীর বুকে নেমে এল সন্ধ্যার আঁধার। আর তখনি বদল শুরু হল ইন্দ্রের মধ্যে। বেশ বুঝতে পারছিলাম ডি'কোস্টার শয়তানী আত্মা ওর মধ্যে ভর করেছে। লাল হয়ে উঠেছে চোখ,মুখের দু কষ বেয়ে ঝরছে লালা,ঘামছে সারা শরীর,চোয়ালের দু কষ থেকে বেরিয়ে আসছে সাদা ধারালো শ্বদন্ত।"
আমি তখন সম্মোহিত। বললাম-"তারপর?"
ত্রয়ী এক অদ্ভূত গলায় বলে উঠল,"না সেদিন আর বাঁচি নি আমি। ইন্দ্র তথা ডি কোস্টার অশুভ আত্মার হাতে খুন হতে হয়েছিল আমায়। তবুও আজও আমায় টানে এই ডুয়ার্সের প্রকৃতি। তাই তো,বারেবারে ছুটে আসি এখানে।"
হতবাক হয়ে গেলাম আমি। মেয়েটা বলে কি,পাগল হয়ে গেল নাকি!
আমাকে অবাক করে ত্রয়ী খিলখিল করে হেসে বলে উঠল,"আমার আত্মা মুক্তি পায় নি। আজ 15ই এপ্রিল ,তায় অমাবস্যা। পাঁচ বছর আগে এই দিনেই আমি শয়তানের পূজারী ইন্দ্রের হাতে মারা গিয়েছিলাম। আর আজও অমাবস্যা। ইন্দ্র এখন আছে ডুয়ার্সের হ্যামিলটনগঞ্জে। আমি চলেছি প্রতিশোধ নিতে। না হলে আমার যে মুক্তি নেই!"
সারা কামরা ভরে উঠল অদ্ভূত এক কুয়াশায় আর সেই কুহকে আমি যা দেখলাম শিউরে উঠলাম,রক্ত জল হয়ে গেল। উদ্ভিন্নযৌবনা ত্রয়ী আমার সামনে শূন্যে মিলিয়ে গেল। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকলাম আমি।
দুঃস্বপ্নের রজনী শেষ হল। পুবাকাশকে আবীর আলোয় রাঙিয়ে উঠল অরুণ। ট্রেন ঢুকল বেলাকোবায়। আমি তলিয়ে পড়লাম ঘুমে।