পুনর্ভবা পর্ব:-১০
পুনর্ভবা পর্ব:-১০
সকালে উঠে খুকু দেখে বাবা আর কাকুমণি উঠোনের উত্তর পূর্ব কোনটা এড়িয়ে চলছে। জায়গাটা সুন্দর করে গোবর দিয়ে লেপে দেওয়া। দুজনে মিলেই ওকে সাবধান করে দিল যেন যায়গা টা পা দিয়ে মাড়িয়ে না দেয়। একটা সময় ঘুরঘুর করতে করতে বাইরের উঠোনে এসে দেখে কি কান্ড!
ইয়া বড় দুটো কলা গাছ কেটে এনে ওখানে রেখেছে লালমোহন কাকা। কলা গাছের খোল গুলো খুলে খুলে কেটে কুটে, দুদিকে দুটো ছোটো টুকরো গুঁজে একরকমের চারকোনা বাটি তৈরি করে চলেছে।
একটা বাঁশের চাটাইয়ের ওপর ঢিপ করে রাখছে ওগুলো।
_______ লালমোহন কাকা, তুমি চারকোনা বাটি বানাচ্ছো?
গাল ভরে নীরবে হাসে লালমোহন।
______বাটি! বেশ বলেছো, তবে এগুলোকে বলে কলার খোলের ডোঙা। সন্ধ্যে বেলায় লোকজনকে এতে করেই প্রসাদ খেতে দেওয়া হবে। সবাই মাটিতে পাতা চটে সার দিয়ে বসে এতে করেই তো প্রসাদ খাবে। এতে সিন্নি প্রসাদ গড়িয়ে যেতে পারে না।
_______বাঃ ভালোই বুদ্ধি তো ! আমি বানাবো?
______আচ্ছা আমি কাটি, ঐ গুলো দিয়ে তুমি বানাও ।
বলে কাটা টুকরো গুলো দেখিয়ে দেয়। খুকুও বসে পড়ে অসীম আগ্রহে। লালমোহনের ছটা ডোঙা বানাতে যে সময় লাগে সেই সময়ে খুকু একটা ডোঙা কোনোমতে দাঁড় করায়।
_____ও মোহন কাকা, দেখো তো আমারটা হয়েছে?
______হ্যাঁ, এই তো, বেশ হয়েছে।
দারুণ উৎসাহে খুকু আরও কয়েকটা বানিয়ে চলে গভীর মনযোগ দিয়ে।
গীতার মা থাকায় অনেকটা সুবিধা হয়েছে শংকরীর।
নইলে উপোস শরীরে এত কাজ সামাল দেওয়া যেতোনা।
বিকেলেই ঠাকুর মশাই এসে উপস্থিত। নতুন দিদি ভাই ডেকে খুকুর সাথে বেশ গল্পও করেছেন কিছুক্ষণ।
কিন্তু পূজো করতে বসেই একেবারে অন্য মানুষ। পূজোর শেষে আলোচাল ও আলু কাঁচকলার ভুজ্যি বাগে পুরে, দক্ষিণার টাকা ট্যাঁকে গুজে রওনা দেওয়ার আগে নিখিলেশকে বলেন,
_________. দেখ বাবা, গতিক তো সুবিধার নয়। পূর্ব পাকিস্তানের খবর কিছু কিছু আমার কানেও আসে।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব শিক্ষিত মুসলমান ঐ দেশে গেছিলো শান্তির আশায়, তারাও তো রেহাই পাচ্ছে না ঐ দেশে।
এই ভারতে এখনও চাকরির অভাব নেই। তোমার মতো শিক্ষকের এখানেও খুব দরকার। বীরগন্জের মাষ্টারী ছেড়ে তুমি বরং গঙ্গারামপুর চলে আসতে পারো। শিব বাড়িতে তো তোমার শ্বশুর মশাইও আছেন। গঙ্গারামপুর হাই স্কুল আরও অনেক পুরোনো। খুব ভালো পড়াশোনাও হয়। এখানকার অনেক ছাত্র-ছাত্রী ভালো রেজাল্ট করে দেশ বিদেশে নানা জায়গায় আজ প্রতিষ্ঠিত।
_______সেটাই তো মুশকিল কাকা। আমাদের স্কুটার বয়স মাত্র সাত বছর। আমি তো প্রথম থেকেই আছি। ওদের এখন আমাকে বেশি দরকার। আর বেশিরভাগ মানুষ ওখানে মুসলমান ধর্মাবলম্বী হলেও আমাকে তো সবাই খুবই ভালোবাসে।
_______দেখ যা ভালো বোঝো।
হনহন করে আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে যান তুলাতের দিকে। সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দটা সুমধুর সঙ্গীতের মতো মনে হয় নিখিলেশ এর কাছে। একটু হয়তো ক্ষুব্ধ হয়েছেন কিন্তু ভেতরের ভালোবাসা টা উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে নিখিলেশ এর চোখে।
সারা বছর বাঙাল ভাষা সহ্য না করতে পারলেও এই একটা দিন পূজোর হাঁক দেওয়াটা মেনে নিয়েছেন অনুপমা দেবী। এখানকার বেশীরভাগ মানুষই ১৯৪৭ এর পরে পূরবঙ্গ থেকে আসা। কাজে কাজেই লালমোহনকে বলেন হাঁক দিতে। লালমোহন তো মহা খুশি। আসলে ওতো বাঙাল, কিন্তু কর্তামা'কে ভালোবেসে, সম্মান করে অথবা ভয়ে একদম বাঙালভাষায় কথা বলেনা। হেলতে দুলতে বাইরের উঠোনে গিয়ে তিনবার তিনদিকে মুখ করে জোরে জোরে বলে ওঠে
________ " যার যার মনের সা-------ধ,
আউগ্যায়া লন শনির প্রসাদ।"
