পুনর্ভবা (অন্তিম পর্ব)
পুনর্ভবা (অন্তিম পর্ব)
এক দুই দিন তরু সামলে নিলেও ওকে তো আর সবসময় এখানে থাকলে চলবেনা। তবে দু বাড়ির মাঝখানের দরজাটা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবহার হয়। রুকসানা বেগম ও তরু মাঝে মাঝেই আসে এ বাড়ি বেড়াতে।
খুকুকে নিয়ে সোনাও যায় ওদের বাড়ি। তরুর কাছে সূঁচ সুতো দিয়ে ফুল তোলা শেখে সোনা। মাকে এনে দেখায় কেমন হয়েছে। খুশি হয় সুলতা। সবে হেম, রান, বখেয়া আর চেইন এই চারটে ফোর শিখেছিলো সোনা। তারপর তো আর সেরকম অবসর জোটেনি। হাতে ধরে খুব যত্ন করে যেটুকু শিখিয়েছিলো, চর্চার অভাবে তাও হয়তো ভুলে যেতো মেয়েটা। তরু ওকে ডাল, ক্রস আর আরো কি কি সব শেখাচ্ছে। গুজরাটী ফোর ও শেখাবে বলেছে। ঐ ফোরটা তো সুলতাও জানেনা। অথচ দেখতে বেশ লাগে।
খুকু স্কুলে ভর্তি হয়েছে। শুধু সোনার ভরসায় পুরো সংসার সামলানো সম্ভব নয়। কাজে কাজেই পুঁথির মাকে বলতে হয়েছে দিনের বেলাটা যেন পুঁথিকে নিয়ে সারাদিন এ বাড়িতেই থাকে। টাকা নাহয় আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়া যাবে। আর দুপুরের খাবার টা ঘোলা এবাড়িতেই খেয়ে যাবে। এটাই সব দিক থেকে ভালো। পুঁথির মায়ের ঐ একটাই চিন্তা ছিল, ঘোলার রান্না বান্না কখন করবে। তাই কথাটা শুনে ঘোমটা পড়া মাথাটা কাত করে বলে,
___________আচ্ছা দাদাবাবু !
দেখতে দেখতে শীত এসে যাচ্ছে। নভেম্বর এর মাঝামাঝি সময়। হঠাৎ শুরু হলো প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি!
দুরন্ত হাওয়ায় উড়ে গেছে বেশীরভাগ খড়ের চালা।
মাটির বাড়ি গুলোও ধ্বসে গেছে প্রচুর। এই উত্তরের জেলাগুলোর চেয়ে দক্ষিণের জেলাগুলো বেশি সহ্য করছে ঝড়ের দাপট। সুন্দর বন এলাকায় আছড়ে পড়েছে বঙ্গপোসাগর থেকে ধেয়ে আসা মহাবেগবান এক ঝড়।
ভয়ানক শোচনীয় অবস্থা চট্টগ্রাম এর। কক্সবাজারের পথঘাট নাকি একমিটার জলের তলায়। ভোলা আর হাতিয়ার নামে দ্বীপের সাথে সাথে আরও অনেক ছোটোখাটো দ্বীপ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে।
পাকিস্তান রেডিও থেকে তেরোটা দ্বীপের কথা বলা হয়েছে যেখানে আর কোনও জনপ্রানী জীবিত আছে বলে মনে হয়না। ফসল বিশেষ করে যত ধানের জমি ছিলো ওদিকে, সব ধান জলের তলায়।
মাছ ধরার হাজার হাজার নৌকো, মাঝি-মাল্লা ও জেলে সহ সমস্ত তলিয়ে গেছে সমুদ্রে। আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, পূর্ব - পাকিস্তান এমনকি আন্দামানও বন্যা কবলিত।
পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে যেটুকু সাহায্য পাঠানো হয়েছে তা খুবই নগন্য। অপ্রতুল সাহায্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সরকার ব্যর্থ।
ইয়া ইয়া খানের বিরুদ্ধে ফুসছে রিলিফের খাবার না পাওয়া, আধপেটা খাওয়া স্বজন হারানো মানুষ জন।
প্রায় তিন থেকে পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই "ভোলা" নামের সাইক্লোনে। ভোলা মহেশ্বরের প্রলয় নৃত্য কি একেই বলে!
খুকুর মাথাতেও গেঁথে গেছে এই "সাইক্লোন" কথাটা।
জীবনে প্রথম দেখলো নিখিলেশ - সুলতাও এমন মারাত্মক ঝড়। ভাগ্যিস এদিকে এখনো টিনের ঘর কম। ছুটে আসা চালার টিনের আঘাতে মানুষের ধর থেকে মুন্ডু আলাদা হয়ে যাবার ঘটনাও কানে এসেছে।
একদম ছোট্ট শিশু এখন উমা। কিন্তু আর যারা দূর থেকেও কিছুটা হলেও এই সাইক্লোন এর প্রভাব কিছুটা হলেও প্রত্যক্ষ করলো, পুনর্ভবার ফুঁসে ওঠা
দেখলো তারা ঝড় - জলের শক্তি সম্মন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা পেলো। আর যাই হোক তারা জীবনে কখনো প্রকৃতির লীলাকে, ধরিত্রী মায়ের বুকে আছড়ে পড়া বৃষ্টি হোক বা নদীর জল, অবহেলা করার দুঃসাহস স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবেনা।