Paula Bhowmik

Tragedy Inspirational Thriller

3  

Paula Bhowmik

Tragedy Inspirational Thriller

পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (৩)

পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (৩)

5 mins
13


দর্পনারায়নকে স্বপ্নে দেখার পরের দিন হঠাৎ করেই তারকনাথের মনে পড়ে গেল বহুদিন আগের এক রাতের কথা। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীর চাঁদ ছিল সেদিন আকাশে। বাঁশের পাতাগুলো দিয়ে যেন জোৎস্না চুঁইয়ে নেমে আসছে এই পৃথিবীতে। 


জায়গাটা রায়ডাক নদীর তীরের সেই চিকলিগুঁড়ির মহাশ্মশান। রাতে খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবার পর পিসির বাড়ি থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে তারকনাথ রোজই চলে যেতো শ্মশানে, সেই তান্ত্রিক অসিত গিরির সাথে সাক্ষাতের টানে।


পিসির বাড়িতে ঘরগুলো বেশ ছাড়া ছাড়া । উঠোনের পেছনদিকে একটা খিড়কি দুয়ার ছিল যা পাটকাঠি আর বাঁশের বাঁতা দিয়ে তৈরি। আর সুতলির দড়ি দিয়ে আটকানো। এতে করে রাতের শেয়াল কুকুরেরা ঢুকতে না পারলেও কোনো মানুষের বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে কোনো বাধা ছিল না।


কে জানে চোর সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো কি না, তবে তারকনাথ বেরোনোর আগে বারান্দার ঐ ছোটো ঘরটায় একটা ছোটো টিপতালা‌ লাগিয়ে তবেই বেরোত, যেটার চাবি আটকানো থাকতো ওর ঘুনসিতে।


এর আরেকটা বিশেষ কারনও অবশ্য ছিল । অসিত গিরি শিক্ষাদান পর্বের মাঝেই তাঁর এই একনিষ্ঠ ভক্তকে বলে রেখেছিলেন,


"সবসময় কাছে একটা ছোটো হলেও লোহা রাখবি। এতে করে দেহ বন্ধনের কিছুটা কাজ হয়। 

তাতে কোনোরকম অপশক্তি সহজে তোর কিছু ক্ষতি করতে পারবে না।"


কথাটা তখন থেকেই মাথায় গেঁথে নিয়েছিল তারকনাথ। পিসির বাড়ি থেকে নিজেদের বাড়িতে ফেরার পরে, এভাবেই সেই ট্রাঙ্কটার চাবিও সকলের চোখের আড়ালে ঘুনসিতেই ঝোলানো থাকত। 


এমনকি ট্রাঙ্কটাকে মা আর বাবা‌, শঙ্করের সহায়তায়‌ কালজিনি নদীতে বিসর্জন দেবার পরেও সেই চাবিটা ঘুনসিতে বাঁধা থাকতো বহু বছর। পালা পার্বনে বা পুরোনো হয়ে গেলে কখনও ‌লাল, কখনও কালো রঙের নতুন ঘুন্সি জুটতো চাবিটার।


তারকনাথের পিসি নিত্যকালী সোনামনীদের মামা অম্বরীশ ঘোষের প্রথম পক্ষের স্ত্রী। সন্তান হয়নি বলে জোর করেই হাতে পায়ে ধরে স্বামীর আবার বিয়ে দিয়েছিলেন জলপাইগুড়ি শহরের অদূরে কাদোবাড়ির মেয়ে অনামিকার সাথে। 


অনামিকার নিজের বাবা-মা ছোটোবেলা তেই মারা যায় বলে জটেশ্বরের বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে এসে কাদোবাড়িতেই প্রাইমারী স্কুলে ভর্তী করে দেন মামা। মামার মনে দয়া মায়া যথেষ্টই ছিল, কিন্তু মামীমা এই অনামিকাকে মন থেকে নিজেদের সংসারের সদস্য হিসেবে মেনে নিতে পারেননি কোনোদিনই।


কাজে কাজেই দুটো ভাত কাপড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে অনামিকাকে। হাইস্কুলে পড়াশোনা করার স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি। তারপর থেকে খাওয়ার বিনিময়ে নিজের শ্রম দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছে মামীমার মন যোগাতে। তাতে করে ফল হয়েছে এই যে, মামীমা প্রকাশ্যে কখনো খারাপ আচরণ করেন নি। আর অনামিকার ভালো চিন্তা করে, দোজবর অম্বরীশের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন একটু তাড়াতাড়িই।


সতীনের ঘর করতে হবে ভেবে প্রথমে অনামিকার মামা মুখে একটু আপত্তি প্রকাশ করতেই মামীমা ওনার ছোটোবেলার বান্ধবী নিত্যকালীর এত প্রশংসা করেছিলেন যে মামা মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হন। 


সংসার করতে গিয়ে অনামিকা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে যে নিত্যকালী আসলেই খুব ভালো মানুষ।

সতীনের হিংসে অথবা দিদির শাসন কোনোটাই ওনার মধ্যে দেখা যায় নি। উনি বয়সে বড় হয়েও অনামিকার সাথে প্রাণের বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। নিজে চোখে না দেখলে এমন ব্যাপার মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন বৈকি ।


সুস্থ মানুষের শরীরে হৃৎপিণ্ড আর মস্তিষ্ক যেমন একটি সামঞ্জস্য বজায় রেখে কাজ করে যায়, অম্বরীশের এই দুই সতীনের সংসারটাও এই দুটো রথের চাকার ওপর দিয়ে সর্বদা গড়গড় করে গড়িয়ে চলতো। 


তাতে করেই বড় বৌ এর আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও ছোটোবৌ বা ছোটো পিসিমা অনামিকার তরফ থেকেও যথেষ্ট যত্ন পেতো তারকনাথ। শুধু তাই নয় ওর আবদার গুলোও হাসি মুখে মেনে নিতেন অনামিকা। তার মধ্যে একটি আবদার ছিল দুই বেলা কাল এর জন্যে একটি করে রুটির ব্যবস্থা করা।


প্রথম প্রথম অবশ্য তারক নিজের খাবার থেকে রুটি সরিয়ে রাখতো চুপি চুপি। নিজের পিসিমা নিত্যকালী ব্যাপারটা লক্ষ্য না করলেও বুদ্ধিমতী অনামিকার চোখে ব্যাপারটা ঠিক ধরা পড়ে যায়।


একটু চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করাতে তারক সবটাই খুলে বলে। আসলে ও নিজেও আগে এতকিছুর খবর রাখার চেষ্টা করেনি কখনো। কিন্তু অসিত গিরির সংস্পর্শে এসেই জানতে পারে যে ওর জন্মের সময় রাহু আর শনি মিলে নাকি পিশাচ যোগ সৃষ্টি হয়েছিল। 


রিষ্টি কাটানোর জন্যে যতদিন সম্ভব কুকুরকে রুটি খাইয়ে যেতে হবে ওর। কুকুর প্রানীটাকে অবশ্য ওর বন্ধু বলেই মনে হয়। আর পুঁচকে কুকুর ছানা দেখলে তো একেবারে কোলে তুলে নিতেই ইচ্ছে হয়। কিন্তু ওদের মায়ের ভয়ে সে কাজটা করে ওঠার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি কোনোদিন।


শ্মশানে অসিত গিরির সর্বক্ষনের সঙ্গী কাল, প্রথম প্রথম অবশ্য তারককে খুব একটা পছন্দ করতনা। শুধুমাত্র অসিত গিরির আদেশেই চুপ করে থাকতো । আসলে উনি ঐ কাল কে হয়তো বশ করে রেখেছিলেন মন্ত্র এবং চিতা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া হাড় মাংস যোগান দিয়েই। কাল এর নামটা এমন হলেও ওর রঙ কিন্তু কালো ছিল না। অনেকটাই হালকা, প্রায়‌ সাদা, তবে একদম সাদা নয়। একটু ছাই ছাই রঙ যেন মেশানো ছিল ঐ সাদা লোমগুলোর সাথে।


কাল অর্থে ভৈরব বোঝায় কি না সে কথাটা লাল চোখ ওয়ালা রোগা, কৃষ্ণবর্ণের অসিত গিরিকে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে কাল কোথা থেকে এসেছে তা জিজ্ঞেস করাতে অসিত গিরি বলেন,


"আসাম থেকে। মায়োং এর নাম জানা আছে ?"


দুই দিকে ঘাড় নাড়িয়ে নীরবে না জানায় তারক।

তখন অসিত গিরি মুখ খোলেন।


মা কামাক্ষ্যার মন্দিরে রেলে করে বিনা ভাড়ায় অসিত পৌঁছে গিয়েছিল অম্বুবাচীর সময়ে অন্য অনেকের সাথে। কিন্তু সেখানে পরিচয় হয় নিধিরাম শীল বলে একজনের সাথে। পরিচয় থেকে ক্রমেই খুব শিগগিরই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দুজনের। তারপর নিধিরাম গল্প করে তার গুরুদেব পরিমল নাগ এর কথা। তাঁর বাড়ি ছিল মায়োং । গৌহাটি থেকে হাঁটা পথে ঘন্টা দশেকের পথ। 


আশ্চর্য সব ঘটনার কথা শুনে অসিত একদম অবাক হয়ে যায়। বন্ধুকে বলে,


"ভাই আমাকে নিয়ে যাবে তোমার গুরুদেবের কাছে। খুব ইচ্ছা করছে একবার তাঁর দর্শন পেতে।"


নিধিরাম তো মহা খুশি। একটু কষ্ট করে হেঁটে যেতে পারলে পথখরচও লাগবে না। বরং সেই পয়সা দিয়ে মাঝে কোথাও, দুই বন্ধু মিলে কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে । তাই সে বলে ওঠে, 


"তোমার যদি হাঁটতে অসুবিধে না থাকে তাহলে এক বেলাতেই পৌঁছানো যায় ঐ গ্ৰামে।"


অসিত তো এক পায়ে খাড়া। সাথে সাথেই রাজি হয়ে যায় নিধিরামের প্রস্তাবে।

ভোরের বেলা রওনা দিয়ে দুপুরে ভক্তগাঁও বলে একটা জায়গায় শিবমন্দিরের দেওয়া ভোগ দুজনেই পেট পুরে খেয়ে নিল। 


নিধিরাম খুশি ওর টাকা-পয়সা বেঁচে গেল বলে, আর অসিত খুশি হলো, নিধিরামের কাছে খাবারের জন্য ঋণী হতে হলো না বলে। 


"জীব দিয়েছেন জিনি, আহার জোগান তিনি"


কথাটা ভেবে জগদীশ্বরের উদ্দেশ্যে কপালে হাত ঠেকায় অসিত। অসিতের বয়স তখন বছর পঁচিশ।

নতুন জায়গা দেখার, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হবার, আর তন্ত্র সম্মন্ধে নতুন কিছু শেখার আগ্ৰহ তার অপরিসীম। 


কে জানে, হয়তো পরিমল নাগ যোগবলে সব জানতে পেরেই রাস্তায় আহারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন !


পরিমল নাগের বাড়িতেই অসিতের প্রথম দেখা কাল এর সাথে। সাধারণত কাল নাকি অচেনা লোকদের খুব একটা পছন্দ করে না, কিন্তু অসিত কে দেখেই এমন ভাবে দৌড়ে আসে যেন বহুদিনের চেনা কাউকে দেখতে পেয়েছে। এমন কাণ্ড দেখে নিধিরাম তো অবাক হয়ে যায়। 


পরিমল নাগের কন্যা, বন্যা, খিলখিল করে সুমিষ্ট স্বরে হেসে ওঠে। আর মেয়ের মুখের হাসি যেন নীরব হাসিতে ছড়িয়ে পরে কন্যার পিতার মুখে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy