STORYMIRROR

Paula Bhowmik

Tragedy Inspirational

4  

Paula Bhowmik

Tragedy Inspirational

অলকানন্দা

অলকানন্দা

4 mins
250

সূর্যাস্ত দেখলে অনেকেরই নাকি মন খারাপ হয়, কিন্তু আমার হয় না। আমার মনে তো আরেকটি সূর্যোদয় দেখার আশা জাগে। এমনিতেও কারো কষ্ট দেখলে তখন মনে মনে কষ্ট পেলেও কোনো খারাপ মানুষকে, বা মানুষের কোনো খারাপ কাজকেও ঘেন্না করতে পারি না। বড় জোর সেখান থেকে নিজে সরে আসি। হয়তো এড়িয়ে যেতে ভালোবাসি, এটাও নিজেকে ভালো রাখতেই...........


প্রতিটি শিশু জন্মের সময় থাকে সূর্যের মতোই পবিত্র। সারাটা জীবন নানান রকম পরিবেশ আর পরিস্থিতি মানুষের জীবনে নানা প্রভাব ফেলে বলেই, মানুষের প্রকৃতি আলাদা আলাদা হয় বলেই আমার মনে হয়। ভালো মানুষ ও তার ভালো কাজ, খারাপ মানুষ ও তার খারাপ কাজের বিচার করতে বসি আমরা তার ব্যাকগ্ৰাউন্ড না জেনেই। কখনও মেঘ সূর্যকে ঢেকে দেয়, আবার কখনও মধ্যাহ্নের প্রখর সূর্যালোক অনেক কিছুই ঝলসে দেয়।


কিন্তু জীবনের অন্তিম ক্ষণে মানুষের মন, দিনের শেষে যে সূর্য ডুবে যায় তার মতোই পবিত্র। কোনো মালিন্য আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না । তাই সূর্যোদয় যেমন ভালোবাসি, ঠিক তেমনই ভালোবাসি সূর্যাস্ত।


আজ অলকানন্দা আর ওর বোনের কথা খুব মনে পড়ছে। হাত পা কাঠি কাঠি শ্যামলা মুখের সাধারন দেখতে দুই বোন। অথচ ওদের মৃত জ্যাঠামশাই আর জেঠিমার মেয়ে অপূর্ব সুন্দরী। কাকা-কাকীমার কাছেই সে মানুষ, পড়াশোনা কতদূর তা জানিনা, তবে প্রেম করে এক উদ্যোগী পুরুষকে বিয়ে করতে পেরেছিল। কাজে কাজেই অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল থেকে তখন আরও ভালো হবার পথে।


কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে সব কাজকর্ম সামলে,শান্তি বজায় রেখে কাকাতো বোনেদের উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখা ছিল কঠিন। আর বোনগুলির বয়েস সাত,নয় হলেও কাকার বয়েস তখন অনেকটাই বেশি, বৃদ্ধপ্রায়। হয়তো ওনারা বাংলাদেশের রিফুজি, রোজগারপাতি করে বিয়ে দেরিতে করেছিলেন উনি।

ভদ্রলোকের কিন্তু বেশ গালভরা একটা নাম ছিল। অলকানন্দাদের বাবার চেয়ে বেশি ওনাকে দাদু বলেই মনে হতো।


আমার সাথে পরিচয় পিজিতে থাকার সূত্রে। আমাদের শহরে এখন স্টাইলবাজার, এম বাজার, বিগ বাজার, থেকে শুরু করে বিশাল মার্ট, জিও মার্ট থাকলেও সেই সময়ে একটা কম্পিউটার শেখার ইনস্টিটিউট পর্যন্ত ছিল না। কাজে কাজেই আমাকে সেই দূরের শহরে থাকতে হয়েছিল পিজি তে। কিন্তু যেখানে খেতাম তাদের ঘর বেশি ছিলনা বলে উল্টো দিকের এক বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিতে হয়েছিল। সেই বাড়ির উঠোনের এক পাশেই ছিল ওনার একতলা স্কুল বিল্ডিং এর মতো বারান্দাওয়ালা বাড়ি। প্রাচির দিয়ে ঘেরা একই উঠোনে ওনার ভাইঝির ঐ রকম আরেকটি বাড়িতে আমার সেই ভাড়া নেওয়া ঘর। 


কোনো দোকানে সামান্য বেতনে কাজ করতেন সেই ভদ্রলোক, বিশ্রাম নেবার বয়েস হলেও উপায় ছিল না। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর কয়েক আগেই। 


অলকানন্দা আর তার বোন সরকারি প্রাইমারী স্কুলে পড়তো। পড়া দেখিয়ে দিতে অনুরোধ করায় যখন আমি ওদের পড়াতে শুরু করি তখন লক্ষ্য করেছি, পড়ায় ওদের তেমন মন নেই। মা নেই বলে বাড়িতে জলখাবারের পাট প্রায় নেই বললেই চলে। সারাক্ষণ তাই পেট খুচ খুচ করে। পড়ায় মন বসবে কি করে !

এখন সরকারি স্কুলে মিড-ডে মিল নিয়েও যখন সমালোচনা হয় তখন অবাক হয়ে যাই। আসলে অভাব জিনিসটা যে কতখানি সর্বগ্ৰাসী, তাই অনেকেরই জানা নেই মনে হয়। ন্যায়, নীতি, বিবেচনা বোধ, এসব তৈরি হবার অনেক আগেই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয় এই অভাবের কারণে। 


আমার পাশের ঘরে আরো এক রিফুজি পরিবার ভাড়া থাকতো। প্রত্যেকের চেহারা ফর্সা, কাটা কাটা নাকমুখ। অন্যদের সাথে আচরণ স্বাভাবিক হলেও নিজেদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া আর গালিগালাজ চলতো। আমার ভালোমন্দ বোঝার বয়েস হলেও, অলকানন্দা আর ওর বোনের তো সেটা শেখার বয়েস। কি শিখছিল ওরা তা আমার জানা নেই।


আজ ইউটিউবে এক দিদি আমাকে জানিয়েছেন আমার জানাশোনা কোনো মেয়ে যদি টাকার অভাবে পড়াশোনা না করতে পারে তাহলে ওনার কাছে পাঠিয়ে দিতে, উনি শিক্ষা আর সংস্কার দুটোই দিয়ে তাকে মানুষ করে দেবেন। অবশ্য এখন সরকারি সাহায্য জুটছে অনেক মেয়েরই ..........


তবু এত ভালো লাগলো ! এমন মনের মানুষ আজকালকার দিনেও আছে, ভাবতেও ভালো লাগছে। যদি সময়টা ফিরে পেতাম তাহলে আমি অবশ্যই অলকানন্দা কে পাঠাতে চাইতাম । কিন্তু অলকানন্দা কি ওর বৃদ্ধ বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইতো ! কি জানি !


অভাবে স্বভাব নষ্ট, কথাটা খুব সত্যি । তাই কষ্ট হয়।

সামান্য গমভাজা কাড়াকাড়ি করে খেতে গিয়েও তুমুল ঝগড়া হতে, ছেলের পড়াশোনা ছাড়িয়ে দোকানে কাজে লাগিয়ে দিতে, কম বয়সেই মেয়েকে নামমাত্র টাকার বিনিময়ে বিহার কিংবা ইউ পিতে বিয়ে দিতে দেখেছি। কারোর জন্যে কিছু করার কথা ভাবতেও পারিনি । কতজন যে এখনও কষ্ট পায় তার খবর আর রাখতে চাইনা ........


কি জানি, হয়তো আমি কিছুটা হলেও স্বার্থপর। কষ্ট দেখলে কষ্ট হয়, চোখ দিয়ে জল পড়ে, শুধু এইটুকু মাত্র। নিজে নিরাপদে থাকতে পারলেই হলো। তার চেয়ে বেশি ভাবতে গেলে অনেক বড় বুকের পাটা চাই, যা আমার নেই । যারাই কিছুমাত্র উপকার করতে পারেন শিক্ষা, সংস্কার, আশ্রয় আর খাবার দিয়ে, তাদের সকলকেই জানাই আমার প্রণাম। 🙏



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy