পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (৪)সমাধি
পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (৪)সমাধি
কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থীতে চিকলিগুড়ি শ্মশানের ভাঙাচোরা সেই মন্দিরে সেদিন ধূমাবতী দেবীর পূজার আয়োজন একদম সুসম্পন্ন। মদ ও মাংসের সাথে অসিত গিরি এক কালো পাথরের বাটিতে রক্ত পর্যন্ত জোগাড় করে রেখেছিলেন।
তাঁর আদেশেই পূজোর আসনে বসেছিল তারকনাথ। এই সাধনায় সাফল্য লাভ করতে পারলেই তন্ত্র সাধনার এক অতি উচ্চ প্রাকার ভেদ করা সম্ভব হবে তারকনাথের পক্ষে। অসিত গিরি কথায় কথায় সাবধান করে দেন,
"খুব সাবধান। নানারকমের বিপত্তি হতে পারে একমনে ধূমাবতীর বীজমন্ত্র জপ করার সময়ে।
ভয় পাসনা, তোর ওপরে আমার আশীর্বাদ আছে, এতে তোর কোনো বিপদ হবে না। তবে আমারও কাছে পিঠে থাকা চলবে না। কারণ এই পূজোর সময় যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে তবে আশেপাশে তে থাকবে তার ওপরেই নেমে আসবে বিপর্যয়।"
পৌরাণিক কথা অনুযায়ী একদা পার্বতী প্রচণ্ড খিদেতে অস্থির হয়ে নাকি তাঁর প্রাণ প্রিয় পতিদেবতা শিবকেই ভক্ষণ করে ফেলেছিলেন।
শিবঠাকুরকে খেয়ে হজম করে ফেলা তো আর সহজ কথা নয় ! প্রতিক্রিয়া হিসেবে পার্বতীর দেহ থেকে প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হয়ে দেবীকে ম্লান করে দিয়েছিল। দেবীর এই ধোঁয়াময় রূপের নাম ই ধূমাবতী। দুটি হাতের একহাতে তার কুলো আর আরেক হাতে ঝাঁটা।
ওনার আশীর্বাদ একজন পিশাচসিদ্ধের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী। কারণ কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে থেকে পিশাচ তাড়াতে কাজে লাগে দেবীর সেই কুলোর বাতাস আর ঝাঁটার বাড়ি। অত্যাচারিত পিশাচ তখন নিজেকে বাঁচাতে তড়িঘড়ি পালাতে বাধ্য হয়।
মানুষের উপকারে লাগতে পারার জন্যেই তো তারকনাথের এই পথে আসা। অমূল্য এই জীবনের বাজি রাখতেও তাই তারকনাথের আপত্তি নেই তখন। তার ওপরে গুরুদেব অভয় দিয়েছেন ওর কোনো বিপদ হবে না। কাজে কাজেই তারকনাথ একমনে জপ করতে শুরু করে,
"ওঁম ধূম ধূম ধূমাবতী দেব্যায় স্বাহা.....ওঁম ধূম ধুম ধূমাবতী দেব্যায় স্বাহা....... ওঁম ধূম ধূম ধূমাবতী দেব্যায় স্বাহা........ওঁম ধূম ধুম ধূমাবতী দেব্যায় স্বাহা......ওঁম ধূম ধূম ধূমাবতী দেব্যায় স্বাহা !"
ক্রমশ চারিদিক যেন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে । নিঃশ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হতে থাকে তারকনাথের। আশে পাশে কোথাও কোনো গাছের পাতা নড়বার শব্দ নেই। শ্মশানে আসবার পথের ধারের বাঁশঝাড়ের কথা অবশ্য বোঝার উপায় নেই।
জোড়া ছাতিম গাছের তলের মন্দিরে পূজোর যায়গা থেকে বাঁশঝাড়ের দূরত্ব বেশ খানিকটা। চোখে দেখা গেলেও শব্দ শোনা খুব কঠিন ব্যাপার।
কে জানে গুরুদেব এখন ঐ বাঁশঝাড়ের মধ্যেই রয়েছেন কি না ।
আর তারকনাথের চোখ তো বন্ধ। মনও জপে মগ্ন।
শুধু নিঃশ্বাসের কষ্টটাই মারাত্বক হয়ে উঠছে। তবে গুরুদেব যখন আশ্বাস দিয়েছেন আর যাই হোক এতে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই তখন অনেক কষ্ট সহ্য করে তার জপ চালিয়ে যেতে থাকে।
ঘন্টা দুয়েক পরে একটা কুকুরের করুণ আর দুর্বল আর্তস্বর তারকনাথের কানে আসে। কিন্তু গুরুদেব অসিত গিরি বলেছিলেন যে নানান রকম উৎপাত হতে পারে, তাই কাল এর কথা একদম মাথায় আসেনি তারকনাথের।
রোজ দুইবেলা তারকনাথের হাতে মোটে একটা করে রুটি খেয়ে কাল যে কতখানি ভক্ত হয়ে উঠেছিল সে আন্দাজ শুধু যে তারকনাথের কল্পনাতে ছিল না তাই নয়, ওর গুরুদেব অসিত গিরিও আন্দাজ করতে পারেননি।
কতটা দূর থেকে কাল এর কান্নার আওয়াজ অসিত গিরির কানেও পৌঁছায় নি। তাহলে হয়তো তিনি তক্ষুণি ছুটে এসে তারকনাথকে ঠেলে পূজোর আসনে থেকে উঠিয়ে দিতেন। কারন তারকনাথের থেকে কাল কে উনি কম ভালো বাসতেন না। বলা যায় না, হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসতেন ।
ওনার গুরুদেব এর মেয়ে বন্যা'র খিলখিল হাসি, তার বাঁধভাঙা চোখের জল সবকিছুর স্মৃতি নিয়ে কাল সর্বদা ঘিরে ছিল অসিত গিরির উদয় অস্ত।
কচ এর দেবযানীর রূপ যেন এই বন্যা। ভালোবেসে ফেলেছিল বেচারী এই নির্মম অসিত কে। তার কাছে তন্ত্র সাধনার কাছে প্রেম তো ছিল অতি তুচ্ছ।
তাই অবহেলা ভরে বন্যার হৃদয়ের আবেদনকে দূরে ঠেলে সহজেই ফিরে আসতে পেরেছে নিজের উদ্দেশ্য সাধন হবার পর।
তবে খুব সহজেই কি ? তা না হলে কেন কাল কে ভিক্ষে চেয়েছিল দেবযানী বন্যা, আর তার বাবা পরিমল নাগের কাছে ? ছোটোবেলায় মাতৃ হারা বন্যার আবদার মেটাতে ইচ্ছে করলেই পরিমল নাগ তাঁর শক্তি কাজে লাগিয়ে অসিত কে বশ করে রাখতে পারতেন। কিন্তু সেরকম ইচ্ছে বন্যা বা ওর বাবা কারোরই হয়নি। জোর করে ভালোবাসা আদায় করা কোনো কাজের কথা নয়। এভাবে হয়তো ওদের বিয়ে এবং সংসার করা হতো, কিন্তু তবুও মনের মধ্যে দুজনেরই একটা আক্ষেপ থাকতো যে সামান্য প্রেমের জন্যে একটা ছেলে নিজের জীবন আহুতি দিয়েছে।
তাই বিনা শর্তে অসিত কে ওরা মুক্তি দিয়েছেন।
এমনকি নিজেদের অতি প্রিয় কাল কেও অসিতের হাতে সারাজীবনের জন্যে তুলে দিতে আপত্তি করেন নি। আর কাল ও দিব্যি অসিতের সাথে চলে এলো আসাম থেকে বাংলায়।
তারপর থেকে কাল কে নিয়ে ভালো ই আছে অসিত। বন্যার সরল নিস্পাপ মুখ, নির্মল ভালোবাসা ভুলতে দেয়নি কাল। দূরে থেকেও মনে মনে আশীর্বাদ পাঠায় বনলতার উদ্দেশ্যে। আশীর্বাদ না বলে, সেটাকে বরং পূজো বলাই ভালো। বন্যা যেন অসিতের কাছে দেবী ললিতা, দশমহাবিদ্যার ষোড়শী রূপ। হয়তো এতদিনে বিয়ে তাই করে সংসার করছে। রাজরানী হয়ে থাকে যেন সে স্বামীর ঘরে। বন্যা অসিতের মনে রাজরাজেস্বরী রূপেই পূজিতা। ওকে মনে পড়লেই এখনও____ নিজেকে শান্ত রাখতে জপ শুরু করে দেয় মনে মনে,
"ওঁম এইম হ্রীম শ্রীম ত্রিপুরসুন্দরায় নমঃ.....
ওঁম এইম হ্রীম শ্রীম ত্রিপুরসুন্দরায় নমঃ......
ওঁম এইম হ্রীম শ্রীম ত্রিপুরসুন্দরায় নমঃ....."
অথচ এই কৃষ্ণা চতুর্থীর জোৎস্না রাতে কাল এর আর্তস্বর তখন ধীরে ধীরে থেমে আসছে। ক্রমশ নীর্জীব হয়ে চোখের পাতা বুজে এলো কাল এর। না তারকনাথ, না ওর গুরুদেব অসিত গিরি, কেউ কাল এর মৃত্যুর সময়ে দু ফোঁটা জল দিতে এগিয়ে আসতে পারলো না। আর্ত কন্ঠে তৃষ্ণা আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে কাল কে বিদায় নিতে হলো নিজের শরীর থেকে।
আর সেই মুহুর্তে ই হোমের কাঠগুলো নিজে থেকেই জ্বলে উঠলো দাউ দাউ করে। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেও তারকনাথ তার অনুভব করে বুঝতে পারল যে, দেবী ধূমাবতী ওর ওপরে প্রসন্ন হয়েছেন।
পূজো সম্পন্ন হয়েছে। চোখ খুলে যজ্ঞের আগুন ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করল তারকনাথ, নিজের প্রাপ্ত শক্তিকে কোনোদিন উপার্জনের পাথেয় করবে না, কোনোদিন কোনো মানুষের অমঙ্গল করার চিন্তাকে মনে ঠাঁই দেবে না।
মাটিতে লুটিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করছে তারকনাথ এমন সময়ে শ্মশানে ফিরে অসিত গিরি দেখলেন, কাল এর মৃত শরীরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে পুরোনো এই মন্দিরের সামনে বাঁ পাশে পড়ে আছে ।
এতদিন গুরুদেবের অট্টহাসি শুনে এসেছে তারকনাথ, এবারে শুনতে পেলো হৃদপিন্ড কাঁপানো কান্নার হাহাকার। চমকে উঠে বাইরে ছুটে আসে তারকনাথ। এসে দেখে গুরুদেব কাল এর শরীরের ওপর হুমরি খেয়ে পড়ে কাঁদছেন অঝোর ধারায়।
কিছুই বুঝতে আর বাকি থাকে না তারকনাথের।
গুরুদেবের সাবধান বাণীর ভাষা কাল বুঝেছিল কি না সেকথা জানার তো আর উপায় নেই। কে জানে,
হয়তো সব বুঝে শুনেই নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেল প্রিয় জনের সাধনা সম্পূর্ণ করতে ।
গুরুদেবের কান্নায় বাধা না দিয়ে মাথা নিচু করে পিসির বাড়ি থেকে একটা শাবল নিয়ে এসে নদীর ধারের বালি-মাটি উঠিয়ে একটা কবর খুঁড়তে শুরু করে। ঘন্টা খানেক পরে এসে দেখে গুরুদেবের কান্না থেমেছে। উনি চুপ করে বসে বসে কাল এর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অসিত গিরি সবটাই বুঝে যান। মুখ ফুটে কিছুই বলার দরকার হয় না। দুজনে মিলে ধরাধরি করে কাল এর দেহটা নামিয়ে দেয় কবরে। তারপর ধীরে ধীরে মুঠো মুঠো মাটি আর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে থাকে কাল এর শরীর।