পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (১)
পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (১)
কামাক্ষ্যাগুড়ির দক্ষিন তেলিপাড়াতেই সোনামনির বাপের বাড়ি। মস্তবড় উঠোন ঘিরে ছয়খানা আধা কাঁচাপাকা ঘর ছড়িয়ে রয়েছে। তবে একমাত্র ঠাকুরঘর ছাড়া কোনো ঘরের ওপরেই পাকা ছাদ নেই। সব ঘরগুলোর ওপরেই টিনের চালা। তার মধ্যে অবশ্য দক্ষিন দিকে একখানা গোয়ালঘর, দক্ষিন-পূর্ব কোনায় একটা রান্নাঘর আর পূবের ভিটায় একটা পুরোপুরি পাকা ঠাকুর ঘর, যার ওপরটায় একটা চূড়ো, আর সেখানে একটা ত্রিশূল । উত্তর দিকে বড় ঘরের লাগোয়া আরো দুটো ঘর রয়েছে ঐ বড় ঘরটার দুই পাশে।
বড় ঘরে চৌকিতে দুটো বিছানা পাশাপাশি পাতা থাকে বছরভর। একটা চৌকি অবশ্য ছোটো, যাতে একাই থাকে সোনামনির ফুলদা বিধান। আসলে ওর নাম বিধান চন্দ্র ঘোষ। এখন অবশ্য বিধান বলে ডাকার লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গ্ৰামের লোকে সকলেই ওকে বিনু বলে ডাকে। আড়ালে কেউ কেউ বিনু পাগলাও বলে থাকে।
তা_____ লোকজনকে দোষ দিয়ে আর কি হবে ! আসলেই তো বিনু এখন প্রায় পাগল ই বলা চলে। অকারণেই মাঝে মধ্যে যখন ওর মেজাজ গরম হয়ে যায়, তখন ঐ রোগা শরীরেও অযথা চিৎকার করে নিজের গলা ফাটায়। সারা দিনরাত নিজের বিছানায় মশারি টাঙিয়ে রাখে। টিভি দেখতে দেখতে চেয়ারে বসে বসেই ঘুমায় দুপুরবেলা। পেয়ারা, কিংবা লেবু সকলের চোখের আড়ালে এমনভাবে লুকিয়ে রাখে যেন সেগুলো মহামূল্যবান সম্পদ। মোটকথা ওর কোনো আচরনই তো আর স্বাভাবিক নয় । তাই ওকে কেউ পাগল বললে কি করে আর তার দোষ দেওয়া যায় !
আগে গোয়ালঘরটায় আট দশখানা গরু থাকলেও এখন মোটে দুটোতে এসে ঠেকেছে। এক লালমনি আর দুই টুংলি। লালমনির রঙটা লাল হলেও টুংলির গায়ে সাদা আর কালো রঙের ছোপ ছোপ। দুজনের কপালেই একটা করে সাদা টিপ আঁকা। যেন ঠিক চাঁদমামা এসে টিপ এঁকে দিয়ে গেছে।
সোনামনিদের মামার বাড়ি চিকলিগুড়ির পাশ দিয়ে রায়ডাক নদী বয়ে গেলেও ওদের বাড়ির পাশে কোনো নদী নেই । হয়তো সেই কারণেই ওদের মায়ের ইচ্ছাতেই একটা পুকুর কাটিয়েছিলেন বাবা, বাড়ির ঠিক পশ্চিম দিকে। চিকলিগুড়ির ঘোষবাড়ির ছোটো মেয়ে রাজলক্ষ্মী নূপুর পায়ে ছমছম করে যখন পুকুর ঘাটে যাওয়া আসা করতো নিজের সংসারের নানা কাজে, তখন তো ওর দুচোখে অনেক স্বপ্ন আঁকা ছিল।
একে একে চার ছেলে এক মেয়ের মা হলো। তিন ছেলের পরে সোনামনি, আর তারপরেই কোলপোঁছা খোকন, যার ভালো নাম অরুণ। বড় ছেলে স্বপন শিলিগুড়ির এক সোলার প্যানেল তৈরির ফার্মে কাজ করে। ওখানেই সুভাষপল্লিতে ভাড়াবাড়িতে থাকে বৌ ছেলেমেয়েদের সাথে। মেজো ছেলে তরুণ ছেলে আর বৌ নিয়ে থাকে মধ্যপ্রদেশে, ও মিলিটারিতে কর্মরত।
আর বিধানের বেঁচে থাকাটাই তো রাজলক্ষ্মীর জন্যে সান্তনা। এর বেশি ওর কাছ থেকে আর কিছু উনি আশা করেন না। ছোটো ছেলে অরুণ গ্রাজুয়েশন শেষ করে এখন বাড়ির জমিজমা দেখাশোনা ও চাষবাস করে মন দিয়ে। পরিশ্রম করে সংসারের দায়িত্ব নিজে থেকেই তুলে নিয়েছে নিজের কাঁধে।
যদিও আগেকার মতো গরু দিয়ে লোক লাগিয়ে নাঙল দিয়ে চাষ করানোর ঝামেলা নেই এখন, ট্রাকটর ভাড়া নেওয়া যায় চুক্তি হিসেবে। তাতে করে সময় যেমন বাঁচে, তেমনই ঝামেলাও কম।
তবে এদিকে বৃষ্টিটা একটু বেশিই হয় বলে রোপা বোনার সময় মেয়েদের দল মনের খুশিতে কাদায় পা ডুবিয়ে চটপট লাগিয়ে ফেলে ধানের গুছি। ওদের হঠাৎ চোখে পড়ে পুকুর ঘাটে লাল ওড়নায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের রোপা লাগানো দেখছে সোনামনি। একজন গলা তুলে জিজ্ঞেস করে,
"কি রে সোনা, কবে আইলি ?"
"কাইল বিকালে আইছি। তুমরা ভালা আছ তো ?"
"হ, আমরা তো ভালাই আছি, আর তুই ?"
চিৎকার করে সোনামনিও বলে ওঠে,
"হ, আমিও খুব ভালা আছি, আমার বর লগে লইয়া আইছে, আইজ বিকালে বাইর হমু । "
সোনামনির বর তারকনাথ যখনই শ্বশুরবাড়ি আসে, প্রতিবার পুরো গ্ৰামটা টহল দিয়ে ঘোরে সোনামনিকে নিয়ে। সোনামনির সাথে তারকনাথের বয়সের পার্থক্য বারো বছর হলে কি হবে ! ওরা একজন আরেকজনকে চোখে হারায় । অথচ তারকনাথের কোনোদিন বিয়ে করার কোনোরকম প্ল্যানই ছিল না একটা সময়ে। এখন সেকথা ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে তারকনাথের।
তারাদাস ভট্টাচার্য্য বানারহাট টি এস্টেটের এ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন একসময়। ওনার দুই ছেলের কেউ ই পড়াশোনা খুব বেশিদূর করেনি। বড় ছেলে তারকনাথ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর পিসির বাড়ি চিকলিগুড়িতে ছুটি কাটাতে এসে থেকেছিল কিছুদিন। ব্যাস, ওখানেই পড়াশোনার ইতি। চিকলিগুড়ির শ্মশানে অসিত গিরি বলে এক তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়ে তার চ্যালাগিরি করা শুরু করেছিল গোপনে। মরা মানুষের মাংস খাওয়া থেকে শব সাধনা, কিছুই আর বাকি নেই।
আমবাড়ির গ্ৰামের বাড়িতে যখন ফিরল, তখন একমুখ দাঁড়ি গোঁফ সহ যেন এক অন্য মানুষ যে বাড়ির ও গ্ৰামের সকলের কাছেই অপরিচিত। সাথে একটা তালাবন্ধ ঢাউস টিনের ট্রাঙ্ক । মাঝে মাঝেই ঘর বন্ধ করে ট্রাঙ্ক খুলে কি সব নিয়ে নাড়াচাড়া করতো। বানারহাট থেকে তারাদাসবাবু ফিরে এলে এ কথা তিনি শোনেন ওনার গিন্নির মুখে।
তারকনাথের অনুপস্থিতিতে ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে দেখা গেল ট্রাঙ্ক ভর্তি মানুষের হাড়গোড় । বাড়িতে তো কান্নাকাটি পড়ে গেল। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যে সমস্ত হাড়গোড় কালজিনি নদীর জলে বিসর্জন দেওয়া হলো। জানার পরে তারকার অবশ্য অনেক চেঁচামেচি করেছিল, কিন্তু মায়ের চোখের জলের বন্যায় সব সংকল্প ভেসে গেল। শেষপর্যন্ত মাতৃশক্তির কাছে হার তাকে মানতেই হলো। তারকনাথের পুরোপুরি সন্ন্যাসী হওয়া আর হলো না। সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল।
তবে বিয়ে তাই করে সংসারী যদিও হয়েছে, কিন্তু তারকনাথ আর সোনামনি নিঃসন্তান। যদিও বিয়ের পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু ওদের দুজনের কারোরই এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
আগে লোকজনেরা কৌতুহলবশত জিজ্ঞেসাবাদ এবং অযাচিত পরামর্শ দানের চেষ্টা অবশ্য করতো, কিন্তু এখন সকলেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে মনে হয়। তাই অনেকদিন পরেও কারোর সাথে দেখা হলে, সেও এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়।
আসলে তারকনাথের ব্যক্তিত্বকেও মনে হয় কিছুটা ভয় পায়, এবং দেখতে সাদাসিধা শিশুর মতো মনে হলেও এই লম্বা-চওড়া লোকটি যে কিছু বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী সে কথা এখন অনেকেই জেনে গেছেন।
প্রথম প্রথম লোকে অবাক হয়ে ভাবতো ভট্টাচার্য বামুনের ছেলে এই তেলি পাড়ার ঘোষের মেয়েকে বিয়ে করলো কেন ? আর মেয়েটাই বা এতবড় বয়স্ক লোকটাকে হঠাৎ বিয়ে করতে গেল কেন ?
আর এদের দুজনের মধ্যে এতো প্রেমই বা আসে কোত্থেকে ! তাহলে কি কোনোরকম বশীকরণ মন্ত্র কাজে লাগিয়ে তারকনাথ বিয়ে করেছে সোনামনিকে ? কে জানে বাপু ! এদেরকে বেশি না ঘাঁটানোই মঙ্গল। কিসের থেকে কি হয়, কিছুই কি আর ঠিক করে বলা যায় !
সম্মোহন শক্তি কি না জানা নেই, তবে বড় হবার পর প্রথম দেখাতেই সোনামনির কপালের দিকে চোখ পড়েছিল তারকনাথের। সমুদ্রবিদ্যাবলে চিনে নিতে একটুও দেরি হয়নি নিজের সাধনসঙ্গিনীকে। আর নিজের অজান্তেই হয়তো সোনামনিও কোনো ইঙ্গিত পেয়েছিল ।
সোনামনির ফুলদাকে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে দিয়েছিল তারকনাথ। সেজন্যে হয়তো কিছুটা কৃতজ্ঞতাও কাজ করেছিল সোনামনির মনে। ওদের মা রাজলক্ষ্মী নিরূপায় হয়েই তারকনাথের শরণাপন্ন হয়েছিলেন বাপের বাড়ি চিকলিগুড়িতে গিয়ে।
সোনামনির মামীই গল্প করেছিলেন তারকনাথের কথা। ততদিনে চিকলিগুড়ির শ্মশানের সাধু অসিত গিরি আরো উচ্চমার্গীয় সাধনায় লিপ্ত। কারোর সাথে কথা বলার মতো পরিস্থিতি ওনার তখন ছিল না । কাজে কাজেই মামীমার মনে পড়ে যায় ওনার সুযোগ্য শিষ্য তারকনাথের কথা।