পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (২)রসিক বিল
পিশাচসিদ্ধ তারকনাথ (২)রসিক বিল
তারকনাথের সেই টিনের ট্রাঙ্কটা কালজিনি নদীতে বিসর্জন দেবার পর যখন ওর প্রচণ্ড মনখারাপ, তখন থেকেই মন ভালো করার জন্য শুরু হলো ওকে ভালো ভালো খাবার খাওয়ানোর তোড়জোড়।
সকালে কচুরি আর আলুর দমের সাথে যোগ হলো দু-চারটে রাজভোগ অথবা খান দুই ছানার জিলিপি। আর দুপুরের খাবারের মেনুতে রোজ রোজ মাছ, মাংস, ডিম ছাড়াও দই, চাটনি, পায়েস যখন যা জুটে যায়।
আর বিকেল বেলা কোচবিহারের যত দীঘি আর পুকুর রয়েছে সেগুলোতে গিয়ে পাড়ে অথবা সিঁড়ির ধাপে বসে বসে হাঁসেদের সাঁতার কাটা দেখা ছিল আর একটি শখ। এভাবে যে বিকেলটা কিভাবে কেটে যেতো, বোঝাই যেতো না।
বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে বসে পুরোনো খাতার বেঁচে যাওয়া শেষের দিকের পাতাগুলোতে দিঘীর সেই দৃশ্যের ছবিগুলো আঁকার চেষ্টা করতেও বেশ লাগতো।
ছবি আঁকতে আঁকতে একদিন নিজের অজান্তেই পৌঁছে গেল এক অতীত সময়ের কালখণ্ডে......
মাথায় সোলার হ্যাট, পরণে গ্যালিস দেওয়া চোঙা প্যান্ট, পায়ে পাম্প শু, আর গায়ে সাদা ইটালিয়ান স্টাইলের ফুলহাতা জামা পরা ঘোষবাবু তখনকার কোচবিহারের পি ডাব্লিউ ডি র এ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার, পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে জিপে করে হাজির হয়েছেন রসিক বিল এ । সাথে আরো তিন সদস্যের মধ্যে একজন তার পোষ্য এ্যালসেশিয়ান দর্পনারায়ন। না, না, এই কুকুরটি তার আগের জন্মে যে প্রদ্যুন্ম ঘোষের প্রাণের বন্ধু জমিদার দর্পনারায়ন ছিলেন, সে কথা তাঁর স্মরণ ছিল না। মানে সেই সব ঘটনা, তাঁর স্মৃতি থেকে পুরোপুরিই মুছে গিয়েছিল ।
আর দর্পনারায়নের সে সব কথা মনে ছিল, কি ছিল না, সে কথা তো শুধু মাত্র সেই এ্যালসেশিয়ান রূপী দর্পনারায়নের পক্ষেই জানা সম্ভব। আর কুকুরের ভাষা যেহেতু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না, তাই হয়তো সেই কথা ইতিহাসের গভীরেই প্রোথিত থেকে যাবে ।
প্রদ্যুন্ম বাবু চাকরি সূত্রে যখন বহরমপুরে পোষ্টেড ছিলেন তখন ফাদার গোমেজ ওনাকে একটা এ্যলসেশিয়ানের বাচ্চা উপহার দেয়। আর সেই পোষ্যটার নাম কেন যে তিনি দর্পনারায়ন রাখেন সেকথা তো ওনার ও অজানা।
আসলে মানুষ নিজের অবচেতনে এমন কিছু কাজ করে বসে, যার সত্যিই কোনো ব্যখ্যা হয় না। ধীরে ধীরে এ জন্মেও দর্পনারায়ন আর প্রদ্যুন্মের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। প্রভু আর ভক্ত দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসতো।
ঘোষবাবুর ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে দর্পনারায়নের শিকারের দক্ষতা হলো দেখার মতো। যেন আগের জন্মের পারদর্শিতাও এসে যোগ দিল এই কুকুরের ক্ষেত্রে। আকাশ থেকে গুলিতে আহত কোনো পাখিকে শূণ্যে ঝাঁপ দিয়ে শিকার করে প্রভুকে খুশি করতে ওর জুড়ি মেলা ভার । সঙ্গে আসা সরকার বাবু এবং দাসবাবুও আজকাল একটু একটু হিংসে করে এই কুকুর রূপি দর্পনারায়ানকে।
চারজনে মিলে সেদিন হৈ হুল্লোড় করে খান দশেক বালিহাঁস, তিতির আর সারস মেরে চারটে পাখি তুলে দেন বোচামারি স্কুলের পাশেই এক সূত্রধর পরিবারের হাতে। লোকটার নাম শান্তনু সূত্রধর। কন্ট্রাক্টরের অধীনে দরজা জানালা তৈরির কাজগুলো দেখাশোনা করার সূত্রেই দাস বাবুর সাথে ওর পরিচয়।
আসলে দূপুরের লাঞ্চটা এবাড়িতে ই সেরে নেবার কথা হয়ে আছে আগে থেকেই। বাড়ির কলাগাছের মোচার ঘন্ট, মাষকলাইয়ের ডাল আর আমের অম্বল রান্না হয়ে গিয়েছিল আগেই। এবারে বালিহাঁস আর তিতির দুটোর পালক ছাড়িয়ে, কেটেকুটে ঝটপট করে রান্না করে ফেললো বাড়ির দুই জা। শান্তনুর ছোটো ভাই সুশান্ত অবশ্য বাড়িতে ছিল না। ওর একটা বইয়ের দোকান রয়েছে আলিপুরদুয়ারে।
রোজ যাতায়াত করতে হয় এই বোচামারী থেকে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়েই যায়। আজ অবশ্য বাজার বন্ধ বলে দোকান ও বন্ধ, কিন্তু বই কেনাকাটার কাজে শিলিগুড়িতে গিয়েছে ট্রেনে করে। আজ হয়তো ফিরতে আরো বেশি রাত হবে।
ছবি আঁকতে আঁকতে আর ভাবতে ভাবতে কেমন যেন একটা আবেশে চোখ বুজে আসছে তারকনাথের। চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক অমাবস্যার গহীন কালো রাতের ছবি। রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটার কাছাকাছি হবে। ওম ওম করে বৃষ্টি হচ্ছে আকাশ ভরে। সুশান্ত ছাতা মাথায় ফিরছে বোচামারির পথ দিয়ে।
হঠাৎ এই বৃষ্টির মধ্যেও দেখতে পায় চোখের সামনে পথের ওপর দুটো সবুজ রঙের চোখ জ্বলজ্বল করছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়না সুশান্তর ।
পড়ি মরি করে ছুট লাগায় বাড়ির দিকে। টিনের দরজার হুকটা খুলে ঢোকার সময় একটা জীবন্ত ভারি কিছু যেন ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাফ হাতা জামা পড়ে ছিল বলেই হয়তো একটা আঁচড় বসিয়ে দেয় ওর ডান হাতে।
চেঁচামেচি শুনে টর্চ নিয়ে এগিয়ে আসে শান্তনু। পেছনে পেছনে ঘোমটা দিয়ে দুই বৌ। দুই বৌকে কিছু না বলে সুশান্ত হঠাৎ করেই ওর দাদা শান্তনুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিমেষেই ফালাফালা করে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলে শান্তনুকে।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই দুজনের প্রাণহীন শরীর উঠোনের জল কাদায় লুটিয়ে পড়ে। দুই বৌ এর তখন ব্যাপারটা বোধগম্য হয়। দুজনেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। মধ্যে বৃষ্টির মধ্যে সারাটা গ্ৰামে যেন ছড়িয়ে পড়ে একটা কুকুরের গর্জন এবং আর্তনাদ।
ঐ অদ্ভুত কুকুরের আর্তনাদ শুনতে পেয়ে দুই বৌ মুখে আঁচল চাপা দেয়। এই গভীর রাতে, বৃষ্টির মধ্যে জোড়া মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব বুঝেই ওরা আর কাউকে ডাকতে যায় না রাতের বেলা।
কিন্তু এই অবস্থায় বিছানায় গিয়ে ঘুমানোর চিন্তাও কারো মনে উদয় হয় না। মা হবে কাল সকালে দেখা যাবে। মানুষ দুটোর প্রাণ ই যখন চলে গেল, কি আর হবে মরা বাসি আর তেসি হলে ! কিছু ক্ষণ সময় দুজন মানুষ পাশাপাশি থাকলে খুব বেশিক্ষণচুপ করে থাকা অসম্ভব। আর মেয়েদের ওপরে তো অভিশাপ আছেই যে, মেয়েরা কোনো কথা গোপন করতে পারে না। সূতরাং সেই নিয়মের বশবর্তী হয়ে বড়বউ চন্দনা মুখ খোলে ছোটো জা পারুলের কাছে।
তাতে করেই আসল সত্যটা উঠে এলো। দর্পনারায়ন একটা কুকুর হলেও দাসবাবু এবং সরকারবাবু। ওনাদের ধারণা ঘোষবাবুর কাছে ওরা কেউ তে ততটা প্রিয় হয়ে উঠতে পারছেনা, তার প্রধান কারণ এই এ্যালসেশিয়ান কুকুর টা। চায় আবার ওর ঐ গালভরা নাম ! শুনলেই ফিরতি জ্বলে যায় ।
ওরা প্ল্যান করে দর্পনারায়ন কে রান্না মাংসের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে মেরে ফেলার। নিজেদের তো সাহস নেই, কায়দা করে বাগে এনে ফেলে শান্তনুকে। শান্তনু প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু যেখানে জীবিকার প্রশ্ন সেখানে কি আর ওর কোনোরকম আপত্তি ধোপে টিকছে পারে ! কাজে কাজেই ওকে রাজি হতেই হয়। তবে কাজটা করে ফেলার পরে তখন চোখের সামনে ছটফট করে দর্পনারায়ন এর সাথে সাথে ঘোষবাবুর দর্প ও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারেনি শান্তনু। সকলের সামনে হাপুস নয়নে কেঁদে ওঠে ও ।
তবে সত্যি কথাটা ঘোষবাবুকে বলেনি কিছুতেই। ওনারা চলে যাবার পরে স্বীকার করেছে চন্দনার কাছে।
সব কথা শোনার পরে পারুল বুঝতে পারে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন, কেন ঘটল এমন অঘটন। কিন্তু অবাক হয়ে একথাটা ও চিন্তা করে যে, এতে ওর স্বামী সুশান্তর অপরাধটা কোথায় ! ও তো এসবের বিন্দুবিসর্গও জানে না, তাহলে !
পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না, কথাটা শুধু যে বাপ ব্যাটার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তার হয়তো নয়। আসলে কোনো অন্যায় তখন মানুষ করে ফেলে, তাই বুঝে হোক বা না বুঝে, মানুষটির ভালোবাসার মানুষদের ওপরেও তার প্রভাব পড়ে বৈকি !
আধো ঘুমের মধ্যে কুকুরের করুণ আর্তনাদ শুনতে পায় তারকনাথ।
