প্রথমা
প্রথমা
-- এই অলিভিয়া পরশু দিন কলেজ আসবি তো?
---- পরশু তো শনিবার!
---- কাম অন ভুলে গেলি! ওইদিন ভ্যালেন্টাইনস ডে।
---- হুমম বাট ওইদিন স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে একটা প্ল্যান আছে রে…
---- পুরোনো বন্ধুদের সাথে স্কুলে দেখা হবে সেই নিয়ে ভাবছিস আর এদিকে তোর অরিনকে যদি অন্য কেউ তুলে নিয়ে চলে যায় তখন কি হবে?
---- ধ্যাত আমার অরিন আবার কি রে!
---- ওমা মেয়ে কেমন লজ্জা পাচ্ছে দেখো।
---- উফফ তুই না একটা যা তা…
---- আরেহ ওই তো অরিন আসছে।
---- কই?
অলিভিয়ার চোখ দ্রুত বেগে ক্যান্টিনের বাইরের দিকে ছুটল। সত্যিই অরিন আসছে এদিকেই। কিন্তু অরিন অলিভিয়ার কাছ অবধি পৌঁছানোর আগেই সেই মেয়েটা এসে ধাক্কা খেলো অরিনের সঙ্গে। মেয়েটার হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল থেকে খানিকটা ড্রিংক্স চলকে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল, খানিকটা লাগল অরিনের গায়ে। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে অপ্রস্তুতে পড়ে অরিনের দিকে একটা রুমাল বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইতে লাগল বারবার।
---- ঢঙ দেখলে বাঁচিনা।
---- ঠিকই বলেছিস রিশা। আমার তো মনে হয় মেয়েটা ইচ্ছে করে এরকম কান্ডগুলো করে। আসলে ওর মনে মনে ক্রাশ আছে অরিনের ওপর।
---- আমারও তাই মনে হয় রে। নয়তো ও বেছে বেছে অরিনকেই পায় ধাক্কা খাওয়ার জন্য!!!
---- বিরক্তিকর। অরিনকেও দেখ, কেমন ভ্যাবলার মতন চেয়ে আছে ওর দিকে। দু একটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে পারে না!!
---- অরিন ভদ্র ছেলে রে। এইসব মেয়েদের ট্রিকসগুলো বোঝেনা। বাট তুই চাপ নিচ্ছিস কেন? তোর কি মনে হয় মেয়ে রুপী এই অদ্ভুত প্রাণীটার সাথে তোর কোনো তুলনা হয়?
---- হুঁ?
---- আরে বাবা ওই দিন একটা সিফনের লাল সালোয়ার পরে বেশ একটু মানানসই মেকআপ করে তুই শুধু কলেজে আয়, অরিন কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে তাকায় দেখবি তখন।
---- ধুরর সেদিনও দেখবি এই হিজড়াটার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে।
---- আরে সেদিন এটা আসবে নাকি! আচ্ছা এই মাসলওয়ালা ছেলেলি চেহারায় ওকে শাড়ি বা সালোয়ার পরে কেমন লাগবে…!!! উফফ,হিজড়া… পারফেক্ট হিজড়া লাগবে। এখানে না এসে বরং রাস্তায় তোলা আদায় করলে পারে।
---- সিরিয়াসলি। এ কেমন মেয়ে বুঝে পাইনা। মেয়ের মধ্যে লাবণ্য বলে একটা জিনিস থাকবে না! এমন পুরুষালি চেহারা ওর যেন মনে হয় ভগনবান ভুল করে একটা ছেলের শরীরে ফিমেল অর্গান দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে!!!
---- লল। তুই এতো চাপ নিসনা। অরিন কেন কলেজের কোনো ছেলেই ভ্যালেন্টাইনস ডে'র দিন ওটার দিকে তাকাবেনা। ইন ফ্যাক্ট কোনোদিনও তাকাবেনা।
★★★★★
কলেজ থেকে ফিরে রুমের দরজাটা সজোরে লাগিয়ে দিল প্রথমা। তারপর পরনের পোশাকগুলো খুলে মেঝেতে ফেলে দিল। সামনে একটা বিশাল আয়না, তাতে প্রতিফলিত হল একটা উন্মুক্ত নারী শরীর। পেশী বহুল ফর্সা শরীরের ওপর শক্ত ভাঁজ। প্রথমা শুনেছে মেয়েদের শরীরের অন্যতম আকর্ষণ হল কোমরের কাছের কার্ভ, কিন্তু নাহ সেরকম কোনো কার্ভ প্রথমা খুঁজে পেল না তার শরীরে। কেউ পায়না। নীচের দিকটায় শুধু নিয়মিত শরীর চর্চার সাক্ষীস্বরূপ কয়েকটা এবস। শরীরের ওপর থেকে দুলছে ফর্সা দুটো মাংসপিন্ড। দুহাতের তালু দিয়ে নরম মাংসপিন্ড দুটোকে ধরে ফেলল প্রথমা, তারপর আঙ্গুল দিয়ে সজোরে চেপে ধরল তাদের, "কি লাভ তোদের থেকে! তোরা থাকা সত্ত্বেও লোকে আমার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করে, উল্টোপাল্টা কথা শোনায় আমায়!!
প্রথমা চায়, প্রথমা মনে প্রাণে চায় অন্য কিছু নিয়ে না ভাবতে। নিজের জীবনটাকে নিয়েই বেশি না ভাবতে। কিন্তু কি করবে প্রথমা, লোকে যতই তাকে অন্য কিছু ভাবুক কিন্তু তার ওই পেশীবহুল পুরুষালি শরীরটার নীচেও তো একটা মন আছে, একটা কোমল নারী হৃদয় আছে। লোকে যতই উল্টোপাল্টা কথা বলুক, কিন্তু প্রথমা কি করে পারে তার ওই কোমল নারী হৃদয়টাকে অস্বীকার করতে!! আজ অরিনের সাথে ধাক্কা লাগাটাও নেহাৎ কাকতলীয় ছিল। কিন্তু তাও অলিভিয়া আর রিশা কিভাবে অপমান করল প্রথমাকে!!!
সন্ধ্যে নামছে হুড়মুড়িয়ে। হিম পড়ছে অল্পস্বল্প। ব্যালকনি থেকে রুমে ফিরে এলো প্রথমা। খাটের উপর রাখা মোবাইলের স্ক্রিনটা জ্বলছে, কলেজ থেকে ফিরে লাউড মোডে দিতে ভুলে গেছে সে। তড়িঘড়ি ফোনটা তুলে দেখল একটা অচেনা নম্বর থেকে মিসড কল। একটা নয়, দুটো নয়, পুরো ন'টা। ভীষণ অবাক হল প্রথমা, মনে অনেকখানি দ্বিধা নিয়ে নম্বরটা ডায়াল করল সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওপ্রান্ত থেকে একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে এলো, "বলি ফোনটা রাখা হয় কিসের জন্য?"
"মানে? কে বলছেন আপনি?"
"কে বলছি আমি! আমি সেই দুর্ভাগা যার ইকোনমিক্স পাসের নোটসগুলো নিয়ে আপনি আর ফেরত দেননি।"
"ওহ সমুদ্র তুই।"
"হুমম। কলেজে থাকা অবস্থায় কতবার ফোন করলাম, তারপরেও করলাম কিন্তু তোর তো পাত্তাই নেই।"
"আসলে আমি…"
"আসলে তুই অপমান গিলছিলি তখন তাই না?"
"কি!"
"ওই তোদের ডিপার্টমেন্টের বিশ্ব সুন্দরী দুজন তোকে যা তা বলছিল আর তুই অম্লান বদনে সেগুলো গিলছিলি। বাই দ্য ওয়ে এই অরিনটা কে? তোর ক্রাশ?"
"তুই কি করে জানলি এসব?"
"সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল ওই মেয়েগুলোর সামনে মিউ মিউ করছিলি কেন? তার মানে কি ধরে নেব ওরা তোর সম্বন্ধে যা বলছিল সেটা তুইও মনে মনে বিশ্বাস করিস?"
সমুদ্রের কথা শুনে মাথাটা গরম হয়ে উঠল প্রথমার। সে চিৎকার করে বলল,
"জাস্ট শাট আপ। ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট সমুদ্র। তোর কোনো অধিকার নেই আমাকে জাজ করার। আর শোন আমি রূপসী না হতে পারি, ছেলেদের মত দেখতে হতে পারি কিন্তু আমি যা আমি তাই। তোদের কি সমস্যা হচ্ছে আমাকে নিয়ে! তোরা কে হে আমাকে বিচার করার?"
"শোন…"
"তোর কোনো কথা শুনতে চাইনা আর আমি। তোর সাথে কোনো কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার। তোর নোটস ফেরৎ চাই তো? কাল দিয়ে দেবো আমি।"
"আমি কাল যাচ্ছিনা। পরশু যাবো, ওইদিনই আমার চাই।"
"কিন্তু পরশু তো ভ্যালেন্টাইনস ডে! আমি কলেজ যাবোনা।"
"যাবি কি যাবিনা সেটা আগেই ভেবে ফেরৎ দেওয়া উচিৎ ছিল। এখন তো আর উপায় নেই, আমার নোটস আমার চাই। দ্যাটস অল।"
"কিন্তু…"
প্রথমার উত্তর শোনার আগেই ফোনটা কেটে দিল সমুদ্র। ফোনটা খাটে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল প্রথমা। তিক্ত সত্যিটা শুনলে বোধহয় এমনই লাগে। ঝগড়া করলেও প্রথমা তো জানে সমুদ্র আসলে ভুল কিছু বলেনি, ছেলেটা ঠিকই ধরতে পেরেছে তার দুর্বলতা।
★★★★★
আজ কলেজে অনেক বাইরের ছেলে মেয়েরাও এসেছে। সবার সাজের বাহার দেখার মত। কলেজ ক্যাম্পাসটায় মনে হচ্ছে যেন প্রজাপতির মেলা বসেছে। স্কুটিটা নিয়ে স্ট্যান্ডে এলো প্রথমা, তাড়াতাড়ি গাড়িটা রেখে সমুদ্রকে ফোন করবে সে। এখানেই তারপর নোটসটা দিয়ে আবার সোজা বাড়ি। পরিকল্পনা মত স্কুটিটা দাঁড় করিয়ে ফোনটা বের করতে যেতেই স্ট্যান্ডের পেছন দিক থেকে কয়েকটা গলা কানে এলো প্রথমার। এই গাড়ি স্ট্যান্ডটা কলেজের একধারে একটু নির্জন জায়গায়। এমনিতে কেউ এদিকে আসেনা, তাই কৌতূহল বশে একটু সরে এসে আওয়াজের উৎস লক্ষ করে উঁকি দিল প্রথমা। সামনের দৃশ্য দেখে রক্ত জল হয়ে গেল ওর। তিনটে ছেলে ঘিরে ধরেছে দুটো মেয়েকে, মেয়ে দুটো আর কেউ নয়, স্বয়ং অলিভিয়া আর রিশা। অলিভিয়ার পরনের লাল শাড়ির আঁচল এখন একটা ছেলের মুঠোয়, কোনো মতে মেয়েটা দু হাত দিয়ে নিজের লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করছে। আর কিছু ভাবতে পারল না প্রথমা। ব্যাগটা ওখানেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে গেল ওদের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে আঁচল ধরা ছেলেটার চোয়ালে নেমে এলো একটা মোক্ষম লাথি। ছেলেটা যন্ত্রনায় চিৎকার করে আঁচল ছেড়ে দিল। ওরা এরকম অকস্মাৎ আক্রমণের কথা মাথাতেও আনেনি, তাই প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছিল কিন্তু পরক্ষণেই নিজেদের সামলে নিয়ে তেড়ে এলো। ওরা ভেবেছিল একটা মেয়ে হঠাৎ করে এসে লাথি মেরে দিয়েছে মাত্র, ব্যাস আর কিছুনা। এবার মেয়েটাকে কুপোকাত করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা ওরা মেয়েটাকে ধরতে যেতেই মেয়েটা এমন মাত দিলো যে আরেকজনের নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট প্রথমা ছেলে তিনটেকে ধরাশায়ী করে ফেলল। চিৎকার শুনে ততক্ষণে অনেকেই এসে জড়ো হয়েছে সেখানে। তাই ছেলেগুলো পালাতে যেতেই বাকিরা ধরে ফেলল ওদের।
"সাব্বাশ প্রথমা, তোকে আমরা ইয়ার্কি করে পুরুষ বলতাম কিন্তু আজ সত্যিই একজন পুরুষের কাজ করেছিস। উই আর প্রাউড অফ ইউ।"
নিজের শরীর থেকে ধুলো ঝাড়তে ব্যস্ত প্রথমার কানে কথাগুলো যেতেই মুখ তুলে তাকাল সে। দেখল অলিভিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে অরিন। আজ প্রথমা প্রথমবার আর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল না, সে ধীরে পায়ে এসে দাঁড়াল অরিনের সামনে। তারপর মুখে একঝলক হাসি টেনে বলল, "তোর কোথাও ভুল হচ্ছে অরিন। আমি তো মেয়ে, ছেলের কাজ কি করে করব! আমার মতে আত্মরক্ষা এবং অপরকে রক্ষা এই কাজ দুটোর জন্য ছেলে বা মেয়ে হতে হয়না, মানুষ হলেই চলে।"
"না মানে…"
প্রথমা দেখল অরিনের মুখটা থমথমে হয়ে গেল নিমেষে, অলিভিয়া আর রিশার মুখদুটো নামানো, হয়তো ইগোর আধিপত্যে "ধন্যবাদ" শব্দটা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে ওদের। অবশ্য ওদের ধন্যবাদের প্রয়োজনও নেই প্রথমার। বরং অন্য আরেকজনকে তারই ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ, যার জন্য আজ প্রথমা প্রথমবারের জন্য নিজের স্বপক্ষে বলতে পেরেছে। আর আজ তাই তো তার মনটা হালকা লাগছে অনেক। উল্টো দিকে ঘুরে এগোতে যেতেই কার সাথে যেন সজোরে ধাক্কা খেলো প্রথমা। চমকে উঠে সে দেখল সমুদ্র দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে ছেলেটা দেখছে ওকে। বুকটা আবার ঢিপঢিপ করতে শুরু করেছে প্রথমার, সেদিন ওর সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করা হয়ে গেছে। একটা জোরে শ্বাস নিয়ে প্রথমা বলল,
"আমি তোর খোঁজই করছিলাম কিন্তু তার আগেই…"
"ওহ।"
সমুদ্রের উত্তরে খানিকটা দমে গেল প্রথমা, এতকিছু ঘটে গেল তবুও ছেলেটা এমন নিরুত্তাপ!!!
"তোর নোটস এনেছি।"
"ওকে। আর?"
"হুঁ? আর… আর সেদিনের জন্য সরি। আমি একটু ডিস্টার্ব ছিলাম, তাই অন্যের রাগ তোর ওপর ঝেড়ে ফেলেছি। আর এরকম হবে না, আয়াম সরি.." কথাগুলো বলেই মুখটা নামিয়ে নিল প্রথমা।
"কিন্তু আমি যে চাই তোর এই সব রাগ, অভিমান, কষ্ট সব কিছু ঝেড়ে ফেলার কেন্দ্র হতে?"
"কি?" চমকে উঠল প্রথমা। দেখলো সমুদ্রের হাতে উঠে এসেছে একটা বড় সূর্যমুখী ফুল। সেটা প্রথমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল,
"জানতাম এমনি বললে তুই আসবিনা, তাই নোটসের কথাটা বলেছিলাম।"
"কিন্তু…"
"আমি জানি তোকে প্রটেক্ট করার জন্য তোর কাউকে প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাও আমাকে প্লিজ তোর পাশে হাঁটার অধিকারটা দিবি?"
"তা বলে সূর্যমুখী দিয়ে প্রপোজ!" পাশ থেকে ফোড়ন কাটল অরিন। মৃদু শব্দ করে হেসে জোর গলায় সমুদ্র বলে উঠল,
"যাকে আমি ভালোবাসি সে গোলাপের মত নরম নয়, সে সূর্যের মত তেজী, সূর্যমুখীর মত উজ্জ্বল। তাই তার জন্য এই সূর্যমুখী আর আমার হৃদয়খানি রইল।"
সকাল থেকে কুয়াশায় ঢেকে ছিল আকাশ বাতাস। হঠাৎ করে কুয়াশা সরিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়ল প্রথমার মুখে। সে অবাক চোখে সমুদ্রের চোখের নীলে হারিয়ে গেল মুহূর্তে… এই চোখের কাছে তার পুরুষালী চেহারা কি তবে তুচ্ছ!! এমনও তবে অপেক্ষা করছিল তার জন্যে!!