প্রথম সাক্ষাৎ-অধ্যায় ২
প্রথম সাক্ষাৎ-অধ্যায় ২
[পূর্ব প্রকাশিতের পর...]
...স্ত্রীর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন সমগ্র পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি মহারাজ রাবণ। একদারব্রত রাবণ মনে প্রাণে ভালোবাসেন তাঁর স্ত্রীকে। অসামান্য ব্যক্তিত্বময়ী, বিদুষি মহিলা ইঁনি, এমন একজন রমণী যিনি শুধু গৃহপত্নী নন, রাজকার্যেও যার নানান পরামর্শ পুষ্ট করে এই বিশাল সাম্রাজ্যকে। দয়া-মায়া-ভালোবাসা তাঁকে অভিনয় করতে হয় না, এই প্রকৃতি তাঁর জন্মগত। গোটা জগৎটা যদি এমনটি হত! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রাবণের মুখ দিয়ে।
-“’ইক্ষকু’র করের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আগ্রহ আছে ওদের অবস্থানের প্রতি। বড়ই সুবিধাজনক অবস্থান যোগাযোগ ব্যবস্থার সাপেক্ষে। কেন? বলছি।
‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যূহ’-র অন্তর্ভূক্ত পাঁচটি মূল স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভগুলি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়ানো রয়েছে। পাঁচটির মধ্যে চারটির অবস্থান কোন না কোন দ্বীপভূমিতে, চরম সুরক্ষার ঘেরাটোপে। কিন্তু একটিই আছে যার অবস্থান কোন দ্বীপে নয়, বরং সামনে যে মূল ভূখণ্ড দেখতে পাচ্ছেন, এর সমুদ্র সন্নিহিত অঞ্চলে, একটু ভিতরের দিক করে। ঐ যে, ঐদিকে; এখান থেকে দেখা কোনমতেই সম্ভব নয় কিন্তু ঐদিকেই ওর অবস্থান। পারষ্পরিক সংকেত বিনিময়ের মাধ্যমে এরা একই যোগসূত্রে আবদ্ধ থাকে, এরই ফলে সমগ্র বিশ্বের আকাশ সুরক্ষাজালে আবদ্ধ। আমাদের পিছনে ‘অস্ত্রালয়’ প্রদেশেও একটি মূল স্তম্ভ আছে। খুবই উচ্চ শক্তির সংকেত আদান-প্রদান হয় এদের মধ্যে। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?
কিন্তু শুধু মূল স্তম্ভ থাকলেই হল না, সংকেত ব্যবস্থা প্রবল করবার জন্য দরকার হয় কয়েকটি উপ-স্তম্ভ। এদের কাজ, মূল স্তম্ভের সংকেত আদান-প্রদানে সহায়তা করা। আবার অনুরূপভাবে, এই সকল উপ-স্তম্ভগুলিকে সংকেত আদান-প্রদানে সহায়তা দানের জন্য দরকার হয় নিম্নবর্গের কয়েকটি প্রতিস্তম্ভ। এইভাবে, সংকেত আদান-প্রদানের সুবিধার্থে একটি বিপুল জাল সৃষ্টি করা হয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে যার মূল ভিত্তি পাঁচটি স্তম্ভ।
সংকেতকে আরও শক্তিশালী করে তোলবার জন্য দরকার হয় আরও বেশি করে সংকেতবাহী স্তম্ভ স্থাপনার। এখানে বলে রাখি যেকোন জায়গায় এই স্তম্ভ নির্মাণ করলেই হয় না, দরকার সঠিক অবস্থান চয়নের, আর এর মূল ভিত্তি জটিল গণিত। গণনায় দেখা যাচ্ছে যে ইক্ষকু হল সেই আদর্শ জায়গা যেখানে স্তম্ভ স্থাপন করলে সংকেত গ্রহণ ও প্রেরণ সহজ হবে।
আমরা অনেকবার এই গন্ধর্ব রাজ্যটিকে বোঝাতে চেয়েছিলাম এখানে আমাদের একটা স্তম্ভ নির্মাণ করতে দেওয়া হোক। তারা কখনোই রাজি হয় নি। ফলতঃ আমাদের হাতে আর অন্য কোন উপায় ছিল না। তবে এরা এখনো যদি আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে তবে মহাসেন যেমন রাজা ছিলেন তেমন থাকবেন, আমরা শুধু এখানে একটি সংকেতবাহী স্তম্ভ নির্মাণ করব আর তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু অধিকর্তা ও সেনা রেখে আসব ঐ রাজ্যে। এর থেকে বেশি কিছু আমাদের কাম্য নয়। দেবতাদের ঠেকিয়ে রাখতে গেলে স্তম্ভ নির্মাণ আবশ্যিক।“
-“কিন্তু দেবতাদের প্রতি আপনার এই রাগ কেন? দেবতারা আমাদেরও সৃষ্টিকর্তা – এই সত্যকে এতে উপেক্ষা করা হচ্ছে না?”
এই কথায় সামান্য আহত হলেন মহারাজ রাবণ। এটি এমন একটি সন্দেহ যা তিনি আপাতত প্রমাণ কিছু করতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে একটা সন্দেহ ভীষণই তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই সন্দেহ যদি সত্যি না হয়, তবে ইতিহাসে তিনি পরিচিত হবেন চক্রান্তকারী খলনায়ক হিসেবে, কিন্তু যদি সত্যি হয় তবে কিন্তু…
নাহ্। এ বিষয়ে আপাতত কাউকে কিছু বলা যাবে না। নিজের স্ত্রীকেও নয়।
স্বামীর মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মন্দোদরি। অবশেষে তিনি বুঝলেন, এ বিষয়ে অন্যান্য দিনের মত স্বামী আজকেও নিরুত্তর থাকবেন। এ বিষয়টা আগেও খেয়াল করেছেন তিনি, এই প্রসঙ্গ উঠলেই মহারাজ চুপ করে যান। বিষয়টা নিয়ে তিনি আর কোন প্রশ্ন করলেন না।
মৃদু চন্দ্রালোকের নীচে উদ্ভাষিত রৌরব নগরী তার স্বর্ণখচিত গৌরব নিয়ে তখন গভীর ঘুমে নিদ্রামগ্ন।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দুই মাসের মধ্যে এক ভালো বিপর্যয় ঘনিয়ে এল আশ্রমের বুকে।
বেশ ভালোই কাটছিল দিনগুলি, আশ্রমের আবাসিক হিসেবে। রোজ সকাল থেকে দুপুর অবধি টানা অনুশীলন, তারপর দ্বিপ্রাহরিক অবকাশে স্নান, খাওয়া-দাওয়া; বিকেলবেলা বিভিন্ন জাগতিক বস্তু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান ও তাৎক্ষণিক নীতি প্রয়োগ, আরও কত কি? তবে দৈনন্দিন অভ্যাসগুলির মধ্য দিয়ে অনেক নতুন যুদ্ধরীতি সম্পর্কে অজানা দিকগুলি উন্মোচিত হল।
এর সঙ্গে বলে রাখা ভাল, মানসিক সংযোগ বিধানের মাধ্যমে কিভাবে উন্নত মারণাস্ত্রগুলিকে লাভ করা যায় এ রহস্য একদিন শিখিয়ে দিয়েছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। সে বিষয়ে বরঞ্চ একটু আলোকপাত করা যাক।
‘আলোকপাত’? হ্যাঁ, বিষয়টা অনেকটা তাই বটে। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের মতে, পৃথিবীর কক্ষের বাইরে দেবতাদের প্রথিত করা একটি কৃত্রিম উপগ্রহ আছে যাকে দেখতেও অনেকটা আমাদের চাঁদের মতই। সেখানে কর্মরত আছেন বেশ কিছু দেবতা, আর আছেন স্বয়ং ব্রহ্মাদেব, পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণসৃষ্টিতে যার ভূমিকা সবচাইতে বেশি। রাবণের তৈরি ‘আকাশ-সুরক্ষা’র জন্য এঁরা নীচে নামতে পারেন না পৃথিবীতে, যেমন একই কারণে নীচে থাকা শুলিন ওপরে উঠে যোগাযোগ করতে পারেন না এঁদের সঙ্গে। তবে, সংকেতের মাধ্যমে এরা যোগসাধন করতে পারতেন নিজেদের মধ্যে।
এদিকে পৃথিবীর বুকে একটি দেবতাদের একটি অস্ত্রভাণ্ডার লুকিয়ে রাখা আছে। কোথায় সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেই মহর্ষি বিশ্বামিত্র সজোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন – “এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন আমায় করবে না। মিথ্যা আমি বলতে পারি না, আর সত্য আমি বলব না!” কেউ আর কিছু প্রশ্ন করতে ভরসা পায় নি।
-“মানসিক সংযোগ বিধানের মাধ্যমে অস্ত্রলাভ করতে গেলে কোন একজন উচ্চস্তরের দেবতার সঙ্গে আগে সংযোগ করতে হয়, এবং একটি নির্দিষ্ট মারণাস্ত্র কামনা করতে হয়। এইভাবে সেই দেবতা তখন আলোক সংবাহন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গুপ্তস্থান থেকে ঐ নির্দিষ্ট অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং তা পৌছিয়ে দেয় তাঁর প্রাপকের হাতে, একইরকম আলোক সংবাহন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকে যতক্ষণ যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধান্তে যাচঞা করা সমস্ত অস্ত্র প্রত্যর্পিত হয় তাদের নিজ নিজ স্থানে, যেখানে তারা ছিল। এছাড়াও, কি কি অস্ত্র তুমি লাভ করতে পার তার একটি সম্ভাব্য তালিকা প্রদর্শিত হয় তোমার মণিবন্ধের কাঁচের পর্দার গায়ে। যেটিকে তুমি ব্যবহার করতে চাইছ সেটিকে একবার কণীনিকা দিয়ে স্পর্শ করলেই,ব্যাস!
আকাশ থেকে আলোক সম্পাত হয় প্রাপকের ওপর। সেই আলোকের পথ ধরে সুক্ষ্ম, অদৃশ্য মারণাস্ত্রগুলি এসে স্থূল আকার ধারণ করে প্রাপকের হাতে। কাজ মিটে গেলেই সেই আলোক নিভে যায়। এইভাবে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি শেষ হয় কয়েক পলের মধ্যেই।”
গোটা অংশে খুব কঠিন কার্য একটিই। সেটি হল মহাকাশের গর্ভে লুকিয়ে থাকা নির্দিষ্ট দেবতার সঙ্গে নির্দিষ্ট অস্ত্রের জন্য মানসিক সংযোগ বিধান। কোন কোন অস্ত্রের জন্য কোন কোন দেবতাকে স্মরণ করতে হবে সেই বিষয়ে মহর্ষি একটি তালিকা দিয়েছিলেন দুই ভাইকে মুখস্থ করবার জন্য। যাই হোক, কষ্ট করলে সব মেলে, একদিন দুইভাইই সফলকাম হলেন পরিষ্কার মনোঃসংযোগ সংস্থাপনে। দৈব অস্ত্রপ্রাপ্তিতে আর কোন বাধা থাকে নি। একটা নির্দিষ্ট সময় পর দেখা গেল দুই ভাইই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন দৈব অস্ত্র সঞ্চালনে, বাকি সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়ে। তবে গণ্ডগোলটি প্রথম বাঁধল অন্যদিক দিয়ে, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে।
আগেই বলা ভাল যে হনুমন্ত ও সুগ্রীবেরও অনুশীলন চলছিল, তবে একই শিবিরে নয়, আলাদা শিবিরে, আলাদা ভাবে। দুজনেই ব্যূৎপত্তি লাভ করেছে ‘গদা’ নামক স্থূল অস্ত্র সঞ্চালনে, এরকমই সব খবর কানে আসছিল; শিবিরের কেউ কেউ নাকি নিজের চোখে দেখেওছে। যাই হোক, ‘মৃত্যু উপত্যকা‘ অভ্যাসের দিন এই দুই মানবকে যোগ করা হয়েছিল গন্ধর্বদের সঙ্গে....