প্রিয় তিলোত্তমার শহরে (২য়)
প্রিয় তিলোত্তমার শহরে (২য়)
(দ্বিতীয় কিস্তি)

ট্রেনে উঠে প্রথম বিপত্তিটা ঘটে গেল এক মধ্যমা সুন্দরী, অল্প বয়সি, মুখরা রমনীর সাথে। আমরা তিন জন একই সীটে বসে পড়ি পাশাপাশি তবে দুটো সীটের নাম্বার ভুল করে। ট্রেন ছাড়তেই ইয়া বড় পাচ টি ব্যাগ নিয়ে এসে চেচামেচি শুরু করে দেয় মহিলা। কেন আমাদের সীটে বসেছেন, কেন বসেছেন? একদম মুহুর্তে উত্তাল ঢেউ শুরু করে দিল। তারপর টিকিট বের করে দেখি সত্যিই আমরা ভুল করেছি। আমাদের দুটো টিকেট পাশের সীটের। দ্রুত দিলীপ কাকা আর কাকিকে বসিয়ে দিলাম। এবার সেই মহিলা, তার নিরিহ বর আর আমার সীট আর তাদের কোলের বাচ্ছা। আমার জানালার পাশে সীট তাই সেখানে বসে আছি। কি দ্রুত সে নিজেকে বদলাতে পারে, নারীর যত ঢং আকাশের তত রঙ " তাই হয়তো বলে। অসুস্থ বাচ্ছাটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। না। আর পারলাম না। অবশেষে সীট টা ছেড়ে দিয়ে একেবারে বাম পাশে এসে বসলাম। এবার সেই রমনীর ব্যাগ টানাটানি শুরু হলো। গুনে গুনে দেখলাম পাচ টি বিশাল বিশাল ব্যাগ।
দাদা। প্লিজ জানালার পাশের সীট টা আমাকে দিন না। বাচ্চাটা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। মহিলার মুখের দিকে না তাকিয়ে আর থাকতে পারলাম না। এবার সত্যিই অবাক হচ্ছি, তিনি তার প্রয়োজনে শীতল কণ্ঠে ও বলতে পারেন দেখছি।
দিন না দাদা জানালার পাশে সীট টা আপনার। আমি এমনিতেই ভীষণ ফুলে আছি আর সেই নারীর গরম নরম ব্যবহার নিয়ে ভাবছি। কি আর করি কখনো নির্মম শাসকের মতো আঁকড়িয়ে থাকতে চাইনা। সরে এসে জানালার সীট টা ছেড়ে দিলাম। খুব একটা মিস্টি হাসি দিলেন মহিলা। আমি জানি এটা তার জয়ের হাসি। এর পুরোটা ভর্তি ছলনায়।
কোথায় যাবেন?
বললাম কলকাতা।
এই প্রথম দাদা? জ্বি। আচ্ছা আচ্ছা একসাথে ই যাব দাদা। আমরা অবশ্য মুম্বাইয়ে যাব ট্রেনে করে। মহিলার বর তখনো দাঁড়িয়ে আছেন আর আমাদের দিয়ে মাঝে মাঝে আর ব্যাগের দিকে তাকিয়ে আছেন। বেশ গল্পো পটু মহিলা। তেত্রিশ ছোয়া ছোয়া বয়স। ভীষণ জটিল বয়স এটা। গায়ের রঙ ইষত পরিমার্জিত ময়লা। তবে সুন্দর। বড় বড় চোখ। আর ভীষণ চঞ্চল।
জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়?
পার্বতীপুর। একদম স্টেশনের কাছে। ও তো ব্যবসা করে। পুরাতন বাজার আছে না, সেখানে ই।
আচ্ছা আচ্ছা।
ছেলে টার ক্যান্সার খুব ছোট করে আমার কানের কাছে মুখ দিয়ে ফিসফিস করে বল্লো। তবে সে এখন ভালো প্রায়। চেক আপ এ যাচ্ছি।
এই বার ভগবান দয়া করলে আর হয়তো যেতে হবে না। ছেলে টার বয়স ৭ বছর মতো। খুব মায়া হচ্ছিলো শুনে। আসলেই অসুখের কোন বয়স লাগে না হয়তো।
আচ্ছা এই বড় বড় ব্যাগ কিভাবে সামলাতে পারবেন বলুন তো, জিজ্ঞেস না করে আর পারলাম না। আমার ঘাড়ে আড়াই কেজির ব্যাগটা আমার কাছে উপদ্রপ লাগছে।
কি করবো বলুন? এর আগে তিন মাস থাকতে হয়। জানিনা এবার কতদিন থাকতে হবে। ব্যাগের ভেতর চাউল, কলাই, মরিচ, আদা, লবণ, আলু, সব্জি সব আছে। পুরো সংসার একটা।
আমি খুব মনোযোগ ঢেলে কথা গুলো শুনছি। এমন জীবনের গল্প আর কখনো পাইনি।
এক প্রিচ সব্জীর দাম মুম্বাইয়ে ১৫০ টাকা।
বলেন কি!অবাক হলাম তার কথা শুনে।
এভাবে কি কিনে খাওয়া সম্ভব বলুন? না না ঠিক আছে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
ট্রেন চলছে তার নিয়মের গতিতে। কয়েক বার এই পথে যাওয়া আসা করেছি। একে একে পরিচিত স্টেশন গুলো পেরিয়ে যাচ্ছি। লম্বা পথ আমরা আগামীকাল সকাল পাচটায় যশোর স্টেশনে নেমে পড়বো। যাত্রাপথে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। আমার পাশে থাকা মহিলার বর একটা সময় এসে বসে পড়ে সিটে। তবে বেচারা বড় ভালো মানুষ। স্ত্রী যে নির্ভার তা বোজাই যাচ্ছে। মাঝে মাঝে চোখ দুটো বন্ধ করে থাকে। নারীর ঘুমন্ত মুখ অনেক সুন্দর হয়। হালকা ট্রেনের ঘোলাটে আলোয় মুখের চারপাশে আরো সুন্দর করে তুলেছিল সেদিন। আমি নিমগ্ন তখন মোবাইলে। একটা পর একটা লিখছি আপন খেয়ালে। ভাবলাব সেই নারীকে নিয়ে ক টা লাইন লিখি না। কবির কলম তো স্মৃতি ধরে রাখার জন্য। তাই লিখে ফেললাম।
তার পায়ের আংগুলের ডগায় ডুবে আছে এক খনি অনাবিষ্কৃত কামনার বিষ।
ঠোঁটের নড়াচড়া উথলায় পড়ছে থরো থরো চেরির মতো ঝোপা ঝোপা কথার ফুল।
আর যখন তাকায়,
কি দ্রুত সরলা চোখ,
আপনার বিশ্বাসই হবে না,
অথচ এই মাত্র ছিলো ভীষণ রক্তিম।
সফেদ চূর্ণ দাঁতের ঝিলিক মাখা হাসি,
কি মসৃণ বাহানা,
দাদা এখানে বসি?
(চলবে)