Latifur Rahman

Romance Tragedy Fantasy

4.0  

Latifur Rahman

Romance Tragedy Fantasy

বসবাস

বসবাস

6 mins
155



বসবাস



গ্রামের ছেলে অবিনাশ। বছর দুয়েক থেকে শহরে থাকছে। কলকাতার মত বড় শহরে কুড়ি হাজার টাকার বেতনের সস্তা চাকুরির জীবন। দারিদ্র্য আর বেকার এর সাথে যুদ্ধের চেয়ে এটা মন্দের ভাল। প্রতি মাসে পাচ হাজার টাকা বাড়িতে পাটিয়ে না দিলে মায়ের চিকিৎসা আর সপ্তাহে দুবেলা মাছ মাংসের সংস্থান হয়না। এভাবেই ত বেশ চলছে। কারো প্রতি অভিযোগ নেই অবি নাশের।

এম এ পাশ করা কতজনকে রাজ্য চাকরি দিয়েছে? কতজনই ত অফিসে অফিসে ঘুরছে। চাকরি পাচ্ছে কই?

"ব্যাচেলর দের ভাড়া দেওয়া হয়না। "

প্রতিটি মহল্লার ভাড়া বাড়ির দেয়ালে সাঁটান বিজ্ঞাপন। অসম্ভব একটা দেশ। এমনিতেই নতুন চাকরি, তার উপর এখনই বিয়ে করে আর একটা সদস্য বাড়ালে যে কঠিন মুস্কিল হবে এটা অবিনাশ কেন সব নতুন চাকুরে বোজে। ভাল কোন প্রাইভেট ফার্মে চাকরি জুটলে এই চাকুরী সে ছেড়ে দিবে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ও বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল না, ব্যচেলর এর অপরাধে।

চার রাস্তার মোড়ে ব্যাচেলর ম্যাচ।

নামকরা ম্যাচটা। শুনেছি এই ম্যাচের মালিক প্রিয়া দেবী। সারাজীবন ব্যাচেলর ছিলেন। ব্যাচেলর দের প্রতি তার দরদের অন্ত নেই। বেচে থাকতে এই ম্যাচটা গড়ে তোলেন, এখনো সেটা চলছে। ভাড়া মাসে চারশ তিরিশ। সব মিলিয়ে ছয় সাত হাজারের বেশী পড়েনা। আয়ের সাথে ব্যয় এর সংগতি রাখাটা যে কত জরুরী সেটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ভাল বোঝে।

 প্রিয়ন্তি রায়। বয়সটা পঁচিশ ছুঁয়ো ছুঁয়ো। গেল মাসেই অবি নাসের অফিসে জয়েন করেছে। বাড়ি যাদবপুর। ট্রেনে যেতে চার ঘন্টার পথ।

মেয়ে মানুষ হাজারো সমস্যা তার। অফিসের কাছাকাছি ভাড়া বাড়ি না হলে তার চলবে কিসে? সে কি কম হন্যে হয়ে বাড়ি খুজে নি। কিন্তু ব্যচেলর মেয়ে। যুবতি। তার উপর সৌন্দর্য। খুবি বিপদজনক প্রতিনিয়ত।

সুন্দরী নারীরা দুনিয়ায় সবচেয়ে অনিরাপদ প্রাণী। প্রতি মুহূর্তে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। পথে, ঘাটে,প্রান্তরে, অফিস, আদালত সর্বত্রই। অফিসের বড় বাবু বয়স্ক না হলে, সুন্দরী নারীদের কাজ করার ঝুঁকিটা যেন আরও বেশী। প্রিয়ন্তি কে অন্তত এটা নিয়ে ভাবতে হবেনা। বড় বাবু প্রিয়রঞ্জন ঠাকুর। সত্তর ছুঁয়ো ছুঁয়ো। প্রবাদ আছে-না, তিনটা জিনিস মানুষের ক্ষতি করতে পারে না তা হল, বয়সী মানুষ, পুরাতন মদ আর ঠান্ডা চা।

অফিসের প্রথম দিনেই বড় বাবু জিজ্ঞেস করে প্রিয়ন্তি কে

বাড়ি পেয়েছ?

না। পাইনি। ব্যচেলর কে বাড়ি দিবে-না। তাদের সোজাসাপ্টা কথা বাড়ি ভাড়া দিয়ে তারা চিন্তায় থাকতে পারবেনা। এমনিতেই তারা তাদের মেয়ে কন্যা নিয়ে ভাবনায় আছে।

পাশাপাশি একটা মেস আছে সেখানেই থাকতে পারবে।

জি, সেখানেই উঠে গেছি।

অবিনাশ খুবই মেধাবী আর সততার জন্য বিশেষ ভাবে পরিচিত। প্রচন্ড-রকম আত্মসম্মান বোধ তার। সপ্তাহে দুটি মিথ্যা বলে কি না বলা মুস্কিল। কাজের ব্যাপারে খুবই তৎপর, আর সচেতন।

বড় বাবুর পাসের বড় রুমটাতে সে বসে। হাত দশেক দূরে আর একটা টেবিল, কাচে ঘেরা। খুব পরিপাটি আর বিস্তৃত।

গতকাল থেকে প্রিয়ন্তি সেই টেবিলে বসছে। গ্লাসের ভিতর দিয়ে মাথা তুললেই চোখাচোখি হয়। গ্লাসের ভিতর দিয়ে বাতাস যেতে না পারলেও দৃষ্টি বাধা মানে কই?

অবিনাশ খুবই লাজুক প্রাণী। চরিত্রের গুন আর বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষ গ্রহণ করে পরিবার থেকে। খুব বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে সে। বংশপরম্পরায় তার পরিবারের সম্পত্তির অনেক ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছে সত্যি কিন্ত বংশমর্যাদা আর উচ্চ মানসিকতা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যর মতো সমান অংশ সেও পেয়েছে।

অফিসে প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া অবিনাশ প্রিয়ন্তির সাথে তেমন কথাই বলেনা।

সেদিন সোমবার। সকালে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আরম্ভ হলে আর থামে না বিকাল অবধি। অফিসে লোকজন নেই বললেই চলে।

স্যার আসব?

হাত দশেক দূর থেকে কাচের টেবিল থেকে অনুমতি নিতে হয় অবিনাশ এই প্রথম শুন-লো। মাথা তুলে চোখের ঈশারায় বলে আস।

দুজন মুখোমুখি।

প্রিয়ন্তি ভীষণ সাহসী মেয়ে। চটপটে আর মুখে হাসি লেগেই আছে। হাসি যে নারীর কতবড় অস্ত্র, সেটা সবাই জানলেও অবিনাশ সেটা ভুলতে বসেছে।

অন্তু।

পুরোনাম অন্ত নীলা রায়।

স্কুল জীবন থেকে অবিনাশ কখনো তাকে চোখের আড়াল করেনি। কলেজে পড়তে এসে একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেল। অন্ত নীলা রায় কে অবিনাশ অন্ত বলেই ডাকতো। দু পরিবারের বহু-বছরের বিরোধ অন্তুকে অবিনাশ থেকে আলাদা করে দেয়।

অন্তুর সাথে অবিনাশ এর দেখে হয়না গত দশবছর হল। থাক সে কথা। অবন্তির মুখের হাসির সাথে অন্তুর বড়ো মিল।

স্যার বাড়ি পেয়েছেন?

কই পাব বলেন?

ব্যচেলর দের ভাড়া কেউ দেয়না।

আপনার কি অবস্থা?

মেসে থাকছি। রান্না খুব খারাপ। খেতে খুব কস্ট হয়। শুধুমাত্র বাচার জন্য খেতে হয়। আমার পেট ত সহ্য করতে পারছে না।

নিজে ত রান্না করতে পারেন।

সেখানে সুযোগ তেমন নাই। নানাবিধ সমস্যা। নিজের বাড়িতে হলে অনেক সুবিধা।

বিয়ে করে নিন।

না স্যার এখন সেভাবে ভাবছি না।

বৃষ্টি বুজি থেমেছে?

হুম থেমেছে।

চলেন যাই।

শুরুটা এভাবেই।

রোজ রোজ কথা হয় দুজনের একটু একটু করে।

একে অপরের পরিবার, পরিজনের খবর জেনেছে।

অন্তু আর প্রিয়ন্তি র সমরেশ।

সমরেশ কে কখনো ক্ষমা করেনি প্রিয়ন্তি। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছিল সে। এরপর ধিরে ধিরে সমরেশ যেন বদলাতে থাকে প্রতিনিয়ত। মানুষ যে এত সহজে বদলে যায় আগে প্রিয়ন্তি বিসসাস করতো না।

ভালবাসা যখনই শারীরিক সম্পর্কে গড়াবে তখন ভালবাসা ফ্যাকাসে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কল্পনা যখন বাস্তবে রুপ নেয় তখন মানুষ আনন্দহীন হয়ে পড়ে। কল্পনার এক বিশাল শক্তি আছে। কল্পনা মানুষকে বেচে থাকার সপ্ন দেখায়।

এতদিনে প্রিয়ন্তি আর অবিনাশ একে অপরকে অনেক বেশি চিনেছে জেনেছে। এখন সম্পর্ক তুমি তে গড়িয়েছে।

তবে প্রেম নয় দুজনের।

দুজনের অতীত অভিজ্ঞতা আছে। প্রেম নিয়ে দুজনের অনাগ্রহ এখন বড়ই প্রকট। বলতে পারেন একটা চমৎকার বিশ্বস্ত সম্পর্ক,। ভালবাসার একটা দেনা পাওনার হিসাব থাকে। বিয়ে সাদীর বিষয় থাকে। সন্তান সন্ততির সপ্ন থাকে। ভালবেসে বিয়ে করে ঘরসংসার করার সপ্ন না দেখা মানুষ পাওয়া বড়ই বিরল। তবে বন্ধুতার সম্পর্ক সত্যিই সুখের। বন্ধুতার সম্পর্ক লাভ ক্ষতির হিসেব করে হয়না।

এই প্রথম দুজনে পার্কে হাটছে।

কলকাতার এই পার্ক কত মানুষের স্মৃতি বহন করে জানো?

জানিনা প্রিয়ন্তির সরল উত্তর।

এখানকার প্রতিটি ঘাসে মানুষের স্পর্শ লেগে আছে। পার্ক যদি কথা বলতো তাহলে শুনতে, কত মানুষের স্বপ্ন এখানে ভেঙেছে, কত মানুষ জীবনে প্রথম বার সাহস করে বলেছে "আমি তোমাকে ভালবাসি "।

গাছের বাকল গুলো দেখেছ? মেয়েদের নামের আদ্যক্ষর খোদিত বাকলের শরীরে।

মেয়েদের নাম কিভাবে বুজলে?

আমি যে ছেলেমানুষ। তাই বুজি। এটা ছেলেরাই করে। মেয়েরা তাদের প্রেমিক এর নাম হৃদয়ে খোদাই করে, গাছে খোদাই করেনা। ছেলেরাও হৃদয়ে কোথায় করে কিন্তু হৃদয়ে খোদাই করতে করতে যখন জায়গা শেষ হয়ে যায়, তখনই সারা দুনিয়ায় খোদাই করে চলে।

এটা ছেলেদের পাগলামি নয় বহিঃপ্রকাশ। ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। নারীরা ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় চোখের জলে। আর,,,,,,,,।

তুমি অনেক ভালোই বলতে পারো অবিনাশ।

তা জানিনা।

আচ্ছা অবিনাশ আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আমি জানিনা তুমি রাজি হবে কিনা।

কি? বলো।

আমরা একটা বাড়ি ভাড়া নিতে পারি।

কিভাবে? তুমি বলছ কি?

স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে?

বলো কি?

অবাক হচ্ছো কেন? আমি তো তোমার কাছে আমার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছি না। এই যে এতটা সময় আমরা খুব কাছাকাছি আছি কই তুমি তো আমার হাতটা ধর-নি। আমার শরীরের উষ্ণতা কখনো ছুয়ে দেখেছ? আমরা দুজনেই পরিনত। আমাদের মনের বিকাশ ঘটেছে, আমরা আমাদের ভাল মন্দ সবই বুঝি। গোটা ভারতবর্ষে কত মানুষ লিভ টুগেদার করে জানো? আমরা তো তা করতে যাচ্ছি না। শুধু পাশাপাশি একঘরে থাকা বলতে পারো।

কিন্তু আমাদের সমাজ?

এর কিছুদিন পর অবশেষে অবিনাশ রাজি হয়ে যায় । দুজনে একটা ছোট ভাড়া বাড়িতে থাকে। এটা নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দুজনেই। ঘরে একটা ছোট খাট। পাশে কিচেন আর বাথরুম। বালিশ আর একটা কম্বল নিয়ে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ে অবিনাশ। প্রিয়ন্তি মুচকি হেসে ঘুমিয়ে পড়ে খাটে। এভাবেই রাতগুলো শেষ হয়।

দক্ষিণে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখা যায়। জ্যোৎস্নার রাতে দুজন উপরে ছাদে উঠে। পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসে থাকে অনেকটা রাত পর্যন্ত। রাতের কোলকাতা তখন ঘুম ঘুম। শহরের মানুষ গু-লো যখন ঘুমিয়ে পড়ে অবিনাশ আর প্রিয়ন্তি খোলা আকাশের নীচে। এভাবেই কত রাত, কত অতীত স্মৃতি, নিঃশব্দে, অলক্ষ্যে চোখের জল মুছে প্রিয়ন্তি।

অবিনাশ আর প্রিয়ন্তি এখন বেশ আছে। এক অলিখিত সম্পর্ক নিয়ে। প্রিয়ন্তি নিজেই রান্না করে, একটা পুরোদস্তুর সংসারের মত। প্রতিটি মুহূর্ত কেটে যায় গল্পগুজব আর টিভিতে।

নভেম্বরের দশ তারিখ। খুব তাড়াতাড়ি প্রিয়ন্তি বাড়ি ফিরে। অবিনাশ অসুস্থ, আজ সে অফিসে যায়নি।

কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি?

মুখে কোন কথা নেই প্রিয়ন্তির।

মন খারাপ?

না। কাল আমি চলে যাচ্ছি।

কই?

দেখ।

বদলির চিঠি অবিনাশ হাতে নিয়ে পড়তে থাকে।

কিন্তু?

কালই চলে যাচ্ছি সকালে। সময় করে দেখা করতে আসিও। আমি খুব মিস করবো তোমাকে। আমার খুব হয়তো কষ্ট হবে কিন্তু হয়তো আমার নতুন পরিক্ষা এটা। বাড়ির মালিককে বলিও বউ মরেছে। অচিরেই নতুন বিয়ে করে নিব।

অবিনাশ কিছুই বলে না।

প্রিয়ন্তি সারারাত কাপড় চোপড় ব্যাগে গুছিয়ে নেয়।

সকাল ছয়টায় ট্রেন।

সকালে প্রিয়ন্তি ব্যাগ নিয়ে রেডি। ভ্যানের উপরে সবকিছু তুলে দিয়ে অবি নাশের খুব শরির ঘেঁষে দাঁড়ায়।

এটা আমাদের জন্য কষ্টের সময় অবিনাশ। অবিনাশ এর হাতটা চেপে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ন্তি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা।

ভাল থেক। প্রিয়ন্তি চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।

অবিনাশ চেয়ারে বসে পড়ে।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance