STORYMIRROR

Manasi Ganguli

Fantasy

4  

Manasi Ganguli

Fantasy

পরীর ডানায় মেঘের দেশে

পরীর ডানায় মেঘের দেশে

7 mins
480


 পরীর ডানায় মেঘের দেশে 

     রাত অনেক হল। কিন্তু মিমির ঘুম আসছে না কিছুতেই। সময়মতোই শুয়েছে। যেমন রোজ গল্পবই পড়তে পড়তে ঘুমায় আজও হাতে একটা রূপকথার গল্পবই নিয়ে শুয়েছে ও। একটা পরীর গল্প পড়ছে কিন্তু গল্পে বেশ মনোযোগ দিতে পারছে না। আগে মা আর বাবার মাঝখানে রাজকুমারীর মত শুয়ে ঘুমাত ও। দুজনেই কত আদর করত ওকে। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব, মাকে খুব মিস করছে ও। মনে মনে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে আসছে। "মা কি পরী হয়ে গেছে? নাকি ঠাকুর? নাকি তারা?" মা-ই ছিল ওর জগত। খাওয়ানো, শোয়ানো, পড়ানো সব মা, এমনকি মা-ই ছিল ওর খেলার সাথী। সেই মা হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে মারা গেলে মিমি প্রকৃতই অনাথ হয়ে পড়ে। ওর তখন চারবছর বয়স। ঠাকুমা মারা গেছেন তার বছরখানেক আগে। ছোট্ট মিমিকে নিয়ে বাবা বড় অসহায়। কার কাছে ওইটুকু মেয়েকে রেখে নিজের কাজকর্ম করবেন! সকলে পরামর্শ দিল, "রঞ্জিত, একটা বিয়ে কর। ওই মেয়েকে নিয়ে তো তুমি বাড়ি বসে থাকতে পারবে না। আর তাছাড়া তোমার আস্তকাল পড়ে আছে। যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না। তোমায় সুস্থভাবে বাঁচতে হবে। নিজের জন্য, মেয়ের জন্য।" বাবাও ভেবে দেখলেন, "কথাটা ভুল বলেনি সবাই"। তাই মিমির মা মারা যাবার একবছর পার হলে মায়ের বাৎসরিক কাজকর্ম মিটিয়েই বাবা আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। মিমির নতুন মা এল বাড়িতে। ক'দিন বাড়িতে খুব হইচই চলল। সব মিটে গেলে যে যার মত বাড়ি চলে গেলে বাড়িতে এখন মিমির বাবা, নতুন-মা আর মিমি। বাবা আর নতুন-মা পাশের ঘরে শুয়েছে। মিমি একা একটা ঘরে। মা মারা যাবার পর নতুন-মা আসার আগে পর্যন্ত ও বাবার পাশেই শুত। বাবা কত আদর করত ওকে। আজ থেকে ও একা। এখন থেকে রোজই ওকে একা শুতে হবে।

মিমির মনে পড়ছে মা ওকে কত আদর করত, গান শোনাত, গান শেখাত, মিমিও মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইত, হাসত খিলখিল করে। সেইসব আনন্দের দিনগুলো ওর হারিয়ে গেল। মিমি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। "কেন গো মা চলে গেলে আমায় একা ফেলে?" চোখ দিয়ে ওর জল গড়িয়ে পড়ল। দু'হাত দিয়ে চোখ মুছে দেখে জানালার কাচের বাইরে কেউ যেন এসে দাঁড়াল। জানলার কাচে ঠকঠক করতে লাগল। মিমি ভাবল মনের ভুল। কিন্তু না, তারপরও ঠকঠক আওয়াজ বন্ধ হল না। ও প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। এই দোতলার ঘরের জানালায় কী করে কেউ এসে দাঁড়াবে? চোর নয় তো? খাটে উঠে বসল, তারপর ভাল করে তাকিয়ে দেখল জানলার দিকে। মনে হল যেন কোনো মহিলা। ও আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শাটার খুলতেই অবাক হয়ে দেখল একটা পরী জানলার বাইরে ওর সামনে দাঁড়িয়ে। ও আবারও চোখ কচলে নিল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি সত্যি একটা পরীই তো। সাদা ফিনফিনে শাড়ি তার পরনে। সে শাড়ি যেন মাকড়সার জালের চেয়েও পাতলা। পিঠে দুটো ফিনফিনে সাদা ডানা, মাথায় সাদা জালের মত ওড়না। ওড়নাটা মুখের ওপর পড়ে এক আলোছায়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাতে মুখটা পরিষ্কার বোঝা যায় না। পূর্ণিমার রাত। আকাশভরা জোছনা। সেই জোছনায় সাদা পোশাকপরা পরীকে অপরূপ দেখতে লাগছে। মিমি নির্নিমেষে সেইদিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের যেন পলক পড়ে না ওর। মিমিকে আদর করে মিষ্টি স্বরে বলল পরী, "অমন করে কি দেখছ? চল আমার সঙ্গে বেড়াতে চল। আমি তোমায় ঘুরতে নিয়ে যাবো বলেই তো এসেছি।" শুনে মিমির মনটা ছটফট করে উঠল বেরোবার জন্য। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, "যাব কি করে? বাবা যদি উঠে আমায় খোঁজে? নতুন-মা খুঁজে না পেয়ে যদি রাগ করে?" পরী বলে, "এ মা, বোকা মেয়ে, এখন তো সবাই ঘুমাচ্ছে, কেউ টেরও পাবে না। আর আমি তো তোমায় সকাল হবার আগেই আবার পৌঁছে দিয়ে যাবো।"

"ঠিক তো, কেউ টের পাবে না তো?"

"একদম ঠিক, দেখো না কত জায়গায় নিয়ে যাবো তোমায়। মেঘের দেশে, চাঁদের দেশে,আকাশভরা তারার দেশে তোমায় নিয়ে ঘুরে বেড়াবো।"

মিমি হাততালি দিয়ে উঠল, "কী মজা, আমি যা-বো, আমি যা-বো।"

এরপর জানলার পাশে মিমি ওর পড়ার টেবিলের চেয়ারটা টেনে আনল। জানালার কাচের কাছে পরী তার ডানা বাড়িয়ে দিল। অত পাতলা ডানা দেখে মিমি ভয় পেয়ে গেল। বলল, "আমি ডানায় চাপবো না, চাপলে তো ডানা ছিঁড়ে যাবে।" পরী মিষ্টি হেসে বলল, "পাগল মেয়ে, চেপেই দেখো না এ কেমন শক্তপোক্ত ডানা।" পরীর আশ্বাস পেয়ে মিমি খুব সাবধানে তার ডানায় চেপে বসল।

পরী উড়তে শুরু করল। মিমি ভয় পেয়ে শক্ত করে চেপে ধরল পরীর ডানা। পরী হেসে ফেলল। "কোনো ভয় নেই মিমি, তুমি শুধু আনন্দ করে ওড়ার মজা নাও, মেঘের রাজত্বে ঘুরে সব দেখো।" পরী প্রথমে উঁচুতে উড়ল। সব বাড়ির ছাদ ছাড়িয়ে ক্রমে এরোপ্লেনের মত বেশ অনেকটা উঁচুতে উঠে উড়তে লাগল। সেখান থেকে নিচে শহরের রাস্তার আলোগুলো তারার মতো দেখাচ্ছে। মিমি হাততালি দিয়ে উঠল, "কী মজা, ওপরে একটা আকাশ, নিচে একটা আকাশ, তারায় তারায় ভরা।" পরী বলল, "কী মিমি, কেমন লাগছে বল।" "দারুণ দারুণ, আমার খুব আ

নন্দ লাগছে", উত্তরে মিমি বলল। এরপরই পরী টুক করে মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়ল। গায়ের ওপর দিয়ে, নিচ দিয়ে, চারপাশ দিয়ে মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও থেকে তারাদের দেখা যাচ্ছে, কোথাও শুধুই ধোঁয়ার মত মেঘ। হঠাৎ মিমি দেখল, মেঘের ফাঁক থেকে যেখানে তারা দেখা যাচ্ছে, পরী হাত বাড়িয়ে টুক করে সেখান থেকে একটা তারা নিজের হাতে নিয়ে নিল। বলল, "চলো, আর কোনো চিন্তা নেই। এই তারার আলোয় আমরা এখন সারা আকাশ ঘুরে বেড়াবো। আর কোথাও অন্ধকার লাগবে না। মিমি অবাকের পর অবাক। ভাবে, "আমরা যেমন টর্চ হাতে নিয়ে ঘুরি, পরীরা তেমনি তারা হাতে নিয়ে ঘোরে।" আর কী উজ্জ্বল তার আলো। একটা তারায় এত আলো থাকে মিমির তা জানা ছিল না। দূর থেকে আকাশ পানে চেয়ে ও ছোট থেকে দেখেছে একটা আলোর বিন্দু যেটা মিটমিট করে জলে আর নেভে সেটাই তারা। এত কাছ থেকে তারা কোনদিন দেখেনি যে ও, তাই ওর চোখের ঘোর যেন আর কাটছে না কিছুতে।

এবার পরী ওকে যেখানে নিয়ে গেল, মিমির দু'চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। এ যে পরীদের রাজ্য। কত পরী আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির মত। মিমি পরীকে জিজ্ঞেস করল, "এত পরী কোথায় থাকে? ওরা রাতে ঘুমায় না?" "এটা তো পরীদের রাজ্য, সব পরীরাই এখানে থাকে। আর আমরা পরীরা রাতে ঘুমাই না, আমরা দিনেরবেলায় ঘুমাই।"

     ঘুরতে ঘুরতে আকাশের কোন প্রান্তে যে পরী নিয়ে গেল, সেখান থেকে মাটির পৃথিবীতে দিনের আলো, ঝকঝক করছে আকাশ, আর সারা আকাশ জুড়ে বিশাল বড় রামধনু। তার আগেই বোধহয় সেখানে বৃষ্টি হয়েছিল। মিমি রামধনু দেখেছে একবার, কিন্তু অত বড় রামধনু ও দেখেনি কখনও আগে। হয়তো দূর থেকে বলে ছোট দেখেছে। অতবড় রামধনু দেখে ওর যে কী আনন্দ হয়েছে। ও দু'চোখ ভরে দেখে চলেছে। মুখে ওর রা টি নেই। পরী বেশ অনুভব করতে পারছে ওর অবস্থা। কিন্তু দিনের আলোয় মিমি পরীকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। পরীর সব কথা শুনতে পাচ্ছে, নড়াচড়া টের পাচ্ছে, ডানায় বসে আছে কিন্তু অন্ধকারে যেমন পরিষ্কার দেখচিল চাঁদের আলোয়, সূর্যের আলোয় তা আর পরিষ্কার নয়। পরী বলে, "কী মিমি চাপবে নাকি রামধনুর ওভারব্রিজে?" মিমি ভাবে পরী ওর সঙ্গে মজা করছে। তাই বলে, "ধুর, রামধনুর ওপর চাপা যায় নাকি?" "হ্যাঁ তো, চাপা যায় বৈকি। চলো চাপাই তোমায়।" পরী হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে রামধনুর একদম উঁচুতে উঠে পড়ল মিমিকে ডানায় চাপিয়ে। মিমির যে কী মজা লাগছে! রামধনুর একদম উপরে উঠে পরী মিমিকে ডানা থেকে নামিয়ে দিল মাঝখানে। বলল, "এবার তোমার যেদিকে খুশি নিজে নিজেই নামতে পারবে।" মিমি খুব ভয় পেয়ে যায়। "পড়ে যাবো তো!" শুনে পরী বলে, "আমি তো আছি, আমি কি তোমায় পড়ে যেতে দিতে পারি? তুমি এখানে বসে পড়। যেমন করে পার্কে স্লিপে চড়ে স্লিপ খাও, তেমনি করে নামতে থাকো। যেই রামধনু শেষ হয়ে যাবে আমি আবার তোমায় ডানায় চাপিয়ে নেবো।" "ঠিক তো? পড়ে যাবো না তো?" "মোটেই না, আমি যেমন যত্ন করে তোমায় বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি, তেমনি যত্ন করে আবার তোমায় ডানায় তুলে নেবো। তুমি আনন্দ পাবে, তাই বললাম। যদি বেশি ভয় করে থাক, আমি তোমায় ডানায় চাপিয়ে নিচ্ছি।" "না না, আমি স্লিপ খাবো, তুমি আমায় ধরে নিও।" মিমি গড়িয়ে পড়ল। খুব মজা লাগছে ওর। খিলখিল করে হাসছে, হাততালি দিচ্ছে। রামধনু শেষ হতেই ও আবছা দেখতে পেল পরী ডানা পেতে ওর অপেক্ষায়। ও আবার পরীর ডানায় চেপে বসল। "কী, কেমন লাগল?" পরীর কথার উত্তরে মিমি বলে, "ভারী সুন্দর, কেমন নরম নরম স্লিপ, পার্কের মত শক্ত নয়। আমার দারুণ লেগেছে। তুমি খুব ভাল, আমায় কত আনন্দ দিচ্ছ।" "তুমিও খুব ভাল মিমি, তাই তো তোমায় আনন্দ দিতে উড়িয়ে নিয়ে এলাম আমি।" পরী উড়তে উড়তে আবার ওকে নিয়ে এল অন্ধকারের দেশে, রাতের দেশে। যেখানে মাথার ওপরের আকাশ তারায় ভরা, নিচের পৃথিবীর পথের আলো জ্বলছে তখনও তারার মত। মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। আকাশে অন্ধকারের ঘোর কাটছে। তারাগুলো আবছা হচ্ছে। পুব আকাশে লালচে আভা। ভারী মনোরম সে দৃশ্য। মিমির মনটা খুশিতে ভরে উঠছে। নিচে শহরের রাস্তার আলোগুলোও আবছা হচ্ছে। দিনের আলো ফুটে উঠছে। এবার ওকে ফিরতে হবে কিন্তু ওর মোটেই ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে আবার অন্ধকার হোক। তাহলে ও আকাশে পরীর ডানায় চেপে উড়ে বেড়াতে পারবে। কিন্তু তা যে হবার নয়। তাই পরী আবার ওকে ওর জানালায় নামিয়ে দিল। যাবার সময় পরী ওর দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে একটা চুমো ছুঁড়ে দিল। ভোরের আবছা আলোয় মিমি দেখল পরীর মুখটা ওর মায়ের মতো। "তার মানে মা পরী হয়ে গেছে? আমি মায়ের কথা মনে করে কাঁদছিলাম বলে মা আমায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। আর এতক্ষণ আমি টেরই পেলাম না! তাহলে মাকে কিছুতেই ছাড়তাম না।" মিমি "মা" করে চিৎকার করে উঠল। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরে। নতুন-মা ছুট্টে এসে মিমিকে জড়িয়ে ধরল। "এই তো মিমি, আমি তোমার কাছেই আছি।" মিমিও নতুন-মাকে জড়িয়ে ধরলো দু'হাত দিয়ে। নতুন-মা কেবল দেখতে পেল না মিমির দু'চোখ ভরা জল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy