Prem Prarabdha
Prem Prarabdha
পাড়ার অঙ্কন মিত্রের বেশ সুখ্যাতি,এককালের নাম করা উকিল ছিলেন তিনি.... তার একমাত্র ছেলে লেখন মিত্র, পাড়ার সবার আদরের দীপ দা.. মাত্র ছাত্র জীবন শেষ করে বাবার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে প্র্যাক্টিস শুরু করেছে.....
কিন্তু এখনও সেই একইরকম রয়ে গেছে 'পাড়ার দাদা, দীপ দা'... না দাদা বলতে বর্তমানে টিভি সিরিয়াল বা ফিল্মের কল্যাণে যে রকমের দাদাদের দেখানো বা বোঝানো হয়.. এই যেমন হাতে লোহার বালা, কপালে ছোটো টিকা, চোখে রঙিন চশমা আর বাইকে চড়া হাবভাবে বড়ো হোতা বা বড় রাঘব বোয়ালের হামবড়া ছোটো ছানা......পাড়ার সবার চোখের মণি দীপ দা সেইরকম কিন্ত একেবারেই নয়... বরং ঠিক উল্টোটা...
সবসময় পাড়ার সবথেকে ভালো ছেলে, সবথেকে ভালো ছাত্র,এমনকি খুব ভদ্রস্থ চেহারা নিয়ে যুব সমাজের আদর্শ উদাহরণ পর্যন্ত...এ হেন দীপ দা প্র্যাক্টিসের পাশাপাশি পাড়ার ছেলে মেয়েদের পড়ানোটা কিন্তু এখনও ছাড়েনি... পাড়ার কাকু, কাকিমা, জেঠু, জেঠিমার অনুরোধ না ফেলতে পারার ফলাফল হিসেবে তা চালিয়ে যাচ্ছে নিয়ম করে ঠিক, তাতে উৎসাহেরও ঘাটতি নেই এতটুকু.....
আর তার সাথে পরোপকার তো আছেই.... কারো কোনো বিপদ? তো সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে দীপ দা, আবার কারো আর্থিক অসুবিধা তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সবার আগে তার সামনে সমাধান নিয়ে হাজির হয় এই দীপ দা..... পাড়ার কোনো অনুষ্ঠান, তো তার আয়োজনের তালিকায় প্রথম নাম এই দীপ দার....
এত কিছুর মধ্যে দীপ দার যেদিকটা সবচেয়ে ভালো লাগে রোমির, তা হলো দীপ দার দৃঢ় কন্ঠের আত্মপ্রত্যয়ী বক্তৃতা... যখন বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে দীপ দা মঞ্চে দাঁড়িয়ে, সব মিথ্যে সামাজিক বন্ধন ছিড়ে, সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বক্তৃতা দেয়, তখন কখনো সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে, কখনো বা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মাইকে ভেসে আসা শব্দে কান পেতে, সবটুকু একমনে শোনে রোমি..... শুনতে শুনতে ওর শরীরের প্রতিটা রোম দাঁড়িয়ে যায়, দীপ দার বলা প্রতিটা কথা ওর মনবীনায় তীব্র ঝংকার তুলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রূপ নেয়....
রোমিরা ভাড়া এসেছে মিত্রদের পাশের ভট্টাচার্যদের বাড়িতে..... ভাড়া এসেছে তাও তিন বছরের কাছাকাছি, মাকে বছর চারেক আগে হারিয়ে এখন রোমির পরিবার বলতে ও আর ওর বৃদ্ধ বাবা...
ভাড়া আসার পর বাড়িওয়ালা জেঠুর মুখে দীপ দার কথা প্রথম শোনে রোমি, শুনেছে তিনি বয়সের ভারে এদিকে ওদিকে ছুটোছুটি করতে পারেন না এখন আর, দীপই নাকি সময় সুযোগ বুঝে কাজগুলো করে দেয়, সামলে নেয় সবটা.... ধীরে ধীরে পাড়ার আশেপাশের সবার মুখেই শুনেছে পাশের বাড়ির ছেলেটার কথা...শুনে কৌতুহল হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু ওই পর্যন্তই.....
একদিন সন্ধ্যের পর বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ দেখা....প্রথম দেখায় চোখের সামনে দেখা অবয়বের সাথে মনে তৈরি প্রতিকৃতি মিলিয়ে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি রোমির... জ্বলতে থাকা ল্যাম্প পোস্টের হলদে আলোর নিচে দাঁড়ানো ছেলেটা কেমন যেন সহজাত ভাবেই নজর কেড়েছিলো রোমির, বুঝেছিলো এরকম ব্যক্তিত্ব আজকালকার দিনে বিরল যেখানে আজকাল নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অর্ধেকের বেশি মানুষ সচেতনই নয়, অধিকাংশ মানুষ সুবিধা খুঁজতে ব্যক্তিত্ব হারিয়ে এর তার ওর পদলেহনে ব্যস্ত....
সেই শুরু, এরপরে আরো যতো সময় গড়িয়েছে ছেলেটার সাদামাটা শান্ত ভদ্র চেহারার মধ্যে লুকিয়ে থাকা দৃপ্ত, সাহসী অথচ সংবেদনশীল স্বভাব আরো বেশি করে আকর্ষণ করেছে রোমিকে.....না চাইতেও এক অদ্ভুত ভালো লাগার খনির সামনে নিয়ে গিয়ে রোমিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বারবার..... শুধু যেন দরজায় কড়া নাড়ার অপেক্ষা..... কিন্তু ও ভয় পেয়েছে বারবার, পিছিয়ে এসেছে ওর ঘৃণা জড়ানো ঘুনে ধরা জীবন নিয়ে....
কিন্তু না এগিয়ে গিয়ে উপায় কি... দীপ দা যে নিজে প্রশ্রয় দিয়েছে ওকে, ওর নারী প্রেমপিপাসু মন খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে সেটা প্রথম থেকেই..... দীপ দার চোখে ও দেখেছে সেই আবেগ মাখা নরম দৃষ্টি, যার জন্য ওর মনের শুকনো খটখটে জমি আজ শুধু যে সিক্ত তাই নয়, পুষ্ট হয়ে প্রেমের ফসলে পরিপূর্ণ....
এর মধ্যে যেদিন পাড়ার মাধু দি গায়ে কালশিটের দাগ নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসলো কাঁদতে কাঁদতে, সেদিন রোমি দেখেছিলো, মাধুদির বাড়ির লোকজন যখন ভয়ে জুজু... কেউ যেতে চাইছে না থানায় অভিযোগ দায়ের করার জন্য, দীপ দা কিরকম দায়িত্ব নিয়ে সঙ্গ দিয়েছিলো মাধুদির, সাহস যুগিয়েছিলো থানায় যেতে... নিজে গিয়েছিলো থানায় মাধুদির সাথে.....এরপর বহু ঝামেলার পর মাধুদির ডিভোর্স হওয়ার পর, বিয়ের তোড়জোড়ও করেছিলো এই দীপ দা, বিয়ে দিয়েছে নিজের উকিল বন্ধুর সাথে... তাই সে মানুষটার হাতছানি আর উপেক্ষা করতে চায়নি রোমি...
আর সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনি ও.... কতবার যাওয়া আসার পথে সময়ে অসময়ে পাশের বাড়ির ছেলেটার চোখে চোখ পড়ে গেছে , আবার কখনো লাজুক হালকা হাসি হেসেছে পরস্পর পরস্পরকে দেখে...ছাদে নির্দিষ্ট সময় উঠে গেছে দুজন, কেউ দেরি করলে অপেক্ষা করেছে, না আসলে অভিমান করেছে...আবার মান ভাঙিয়েছে চিঠি লিখে... সেই যে শুরু হয়েছে চিঠির লেনদেন, মনের ভাব বিনিময়ের সাথে চিঠির বিনিময়, তা হয়ে চলেছে আজও সমান গতিতে......আজও চিঠির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে ওরা নিজেদের যাবতীয় ভাবানুভূতিকে....এই সুন্দর অকৃত্রিম সাবলীলতার মধ্যে ওরা স্থান দেয়নি কৃত্রিম যান্ত্রিকতাকে.... তাই মোবাইল থাকতেও নাম্বার আদান প্রদানের ইচ্ছে মনে আসেনি কারোরই.....
নিজের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রথম প্রথম সত্যি আমল দিতে চায়নি রোমি, কড়া ধমক দিয়ে আটকেছিলো নিজেকে.... কিন্তু সমাজের বেড়াজাল কেটে বেরোনোর বার্তা দিয়ে দীপ দার একের পর এক বক্তৃতা, একের পর এক সাহসী পদক্ষেপ মুগ্ধ করেছে ওকে, সাহসী করেছে, অন্যভাবে ভাবতে শিখিয়েছে....ওর মন বলে উঠেছে, "হ্যা, সৌরসেনী দত্ত, এভাবেও হয়....শুধুমাত্র অপেক্ষা করতে হয়, সঠিক সময়ে সঠিক মানুষটার আসার জন্য...তুমি ভাগ্যশালী সৌরসেনী যে তোমার জীবনের ছক মিলিয়ে সে সত্যি অযাচিতভাবে এসে ধরা দিয়েছে তোমার কাছে ...."...
রোমি ভেবেছে দীপ দার মতো সাহসী, উন্মুক্তমনা, প্রকৃত শিক্ষিত ছেলেই পারবে ওকে আপন করে নিতে....একেক সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে রোমি," পারবে না সে?".. নিজের চোখে ও তখন দেখে ওর দীপ দার জ্বলন্ত দৃষ্টির প্রতিফলন.... নিজেকে চিনতে পারে না... আনন্দে ভরে যায় ওর মন, দীপ দার মতোই আত্মবিশ্বাসী গলায় বলে ওঠে, "পারবে... পারলে ওই পারবে...."....
দীপ দাকে দেখে রোমি তল পেতে চেষ্টা করে একটা মানুষের উপলব্ধির গভীরতা কতটা গভীর হলে সে এরকম একটা মানুষ হয়ে উঠতে পারে, যতো দেখে যতো ভাবে ততোই মুগ্ধতার সাগরে ডুবে যেতে থাকে...
.........................
আজ অনেক করে বলে ছুটি নিয়েছে রোমি, শরীরটা বিশেষ ভালো নেই.... আজ অনেকদিন পর বাবার সাথে বসে গল্প করেছে রোমি, বাবাও মেয়েকে সারাটা দিন পেয়ে খুব খুশি... একবার ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন শুধু, "কিরে, ছুটি পেলি? তোদের তো আবার যখন তখন ডাকে..."... আবার কিছুক্ষণ থেমে বলেন, "কতবার বলেছি সময়ের ঠিক ঠিকানা নেই, ছেড়ে দে... তুই তো কানেই তুলিস না রে মা.... দেখ না আরো ভালো অফিসে, তুই তো লেখাপড়ায় ভালো ছিলি... হয়ে যাবে নিশ্চয়ই...তার ওপর তোর চিন্তায় আজকাল আর কিছু ভালো লাগে না... কি যে হবে তোর, একজন ভালো ছেলে দেখে তার কাছে তোকে দিতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হই....".... মেয়েকে আজ অনেকটা সময় কাছে পেয়ে ভেতরের চিন্তাগুলো স্তরে স্তরে বেরিয়ে আসে, তিনি তা সাজিয়ে সযত্নে পরিবেশন করে মেয়ের সামনে....
সব শুনে শুনে রোমি এক গাল হেসে বলেছে, "আচ্ছা বাবা ছুটি নিয়ে আমার কি লাভটা হলো বলো? সেই তো তুমি পাত্র, বিয়ে, অফিস আর কাজের কথাই বলছো.... তার থেকে আজ ছুটি পেয়েছি, বলো কি খাবে....? ".....
" রান্না করবি? কেনো মিনতি.... "...
"আরে বাবা, মিনতি মাসির হাতেই তো খাও রোজ... আজ আমার হাতেরও খেয়ে দেখো... মনে আছে বাবা... মা আলুপোস্ত করতো? আর তার সাথে ঝাল ঝাল কষা করে ডিমের কারী.... তুমি কি ভালোবাসতে খেতে!... আজ আমি তোমার জন্য সেটাই করবো....কিন্তু মায়ের মতো অত ভালো পারবো না আগেই বলে রাখছি....".... রোমির উচ্ছল উৎসাহী মুখের হাসি দেখে হাসেন ওর বাবাও....
"তাহলে তাই কর... অনেকদিন সেরকমটা খাওয়া হয়নি... তোর মা রান্না করলে মুখে লেগে থাকতো... তুই তো তারই মেয়ে... ঠিক পারবি... "...বাবার মৃদু হাসি মাখা আশ্বাস পেয়ে হাসি মুখে রোমি উঠে চলে যায় রান্নাঘরে....
রান্না করতে করতে ও আজ হারিয়ে যায় স্বপ্নরাজ্যে....মনে পড়ে, ওপরের বাড়িওয়ালা জেঠুর কাছে যখন একবারে গিয়েছিলো দরকারে, তখন হঠাৎ চোখ পড়ে গিয়েছিলো পাশের জানালায়, মিত্রদের রান্নাঘরের দিকে.... আর চোখ সরাতে পারেনি রোমি... দেখতে পেয়েছিলো, রান্নাঘরে দীপ দা কি যেন করছিলো খুব সিরিয়াস হয়ে, খেয়াল করেনি রোমির দু জোড়া মুগ্ধ চোখ ওকেই দেখেছিলো, পাশের জানলা দিয়ে...... খুব ইচ্ছে করেছিলো রোমির, তখন এক ছুটে গিয়ে শান্ত, নরম হাতের উষ্ণ ছোয়ায় পেছন থেকে জাপটে ধরতে ওর দীপ দাকে, খুব কাছ থেকে ভালোবাসাকে অনুভব করতে ইচ্ছে করছিলো রোমির.... খুব ইচ্ছে করছিলো ভালোবাসাকে ছুয়ে দেখতে, তার পাল্টা স্পর্শ পেতে....রোমি ভাবে, ওর মতো মেয়ের ভালোবাসার স্পর্শ পাওয়ার জন্য মনের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যায় কি করে... মন বারবার কেনো আছড়ে পড়তে চায় তার বুকে... কেনো আচড়ে কামড়ে পেতে ইচ্ছে করে তাকে... আবার কখনো শুধুই শান্ত শীতল স্পর্শে যেন যুগের পর যুগ ধরে ভোগা অনিদ্রায় উত্তেজিত স্নায়ুও শিথিল হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায় নিমেষে....... আনমনে আবেগী হাসি হাসে রোমি........
এইসব সুখ ভাবনার মধ্যে ডুবে থেকেই রোমি তৈরি করে বাবার পছন্দের খাবার....তারপর একসাথে খাওয়া দাওয়া... কিন্তু বাবা আর আজকাল বসে থাকতে পারেন না বেশিক্ষণ... খেয়ে টুকরো কিছু কথা বলে উঠে শুতে চলে যান তিনি.....
রোমি চলে আসে বাবার ঘরের সাথে লাগোয়া পাশের ঘরে..
এটাই গত তিন বছর ধরে ওর ঘর....
দুপুরে অনভ্যাসে ঘুম আসতে চায় না রোমির.... বিকেল গড়িয়ে যায়.... টুকটাক কাজ করতে করতে ঘড়ি দেখে রোমি,ছাদে যাওয়ার সময় হয়ে এলো......আনমনে হাসে... চেয়ার থেকে উঠে খুব যত্ন করে রাখা বাক্সটা নিয়ে এসে বসে আবার......বাক্সটা খুলতেই একরাশ মন কেমন করা গন্ধ পায় ও..... চোখ বন্ধ করে বাক্সটা নাকের কাছে ধরে তার ঘ্রাণ নেয় প্রাণ ভরে....অনুভব করে, আজও এই কাগজ গুলোতে দীপ দার গন্ধ মিশে আছে, ঠিক যেমন প্রথম দিন ছিলো..... তৃপ্তিতে চোখ খোলে রোমি...হেসে আলতো হাতে চিঠি গুলো এক এক করে আনমনে খোলে....
চোখ রাখে....
"সর্পিলতার জালে যখন আমার পৃথিবী আষ্টেপৃষ্টে বাধা, তার মাঝে আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার সরলতায়.... আমার পৃথিবী যে সময় মুগ্ধ হয়ে শ্বাস নেয় রুক্ষ অমেধ্য বাতাসে, তখন আমি ভালোবেসেছি তোমার অনাবিল কোমলতাকে....আমার ধূসর নিষ্প্রাণ পৃথিবী যখন রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে ব্যস্ত ইট, কাঠ,পাথরে তৈরি গহীন অরন্যের মধ্যে.....সেই অরন্যের মাঝে আমি আমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছি এক ফোটা সবুজ সতেজতা..... সজীবতা....কারণ খুঁজে পেয়েছি, তোমাকে..... ".. লাজুক হেসে সরিয়ে পরেরটায় চোখ রাখে রোমি.....
চোখ রেখেই মনে পড়ে, সময়টা ছিলো ফাল্গুনের দুপুর... রোমি আলোকদের গলিতে ঢুকেছে মোড়ের দোকানে যাওয়ার জন্য, একটা সুবিধা যে সারাটা দিন খোলা থাকে তোতা কাকুদের দোকানটা.... হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখে নির্জন গলিতে দূর থেকে হেঁটে আসছে দীপ দা... শরীরে হালকা ঘাম দিয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়েছিলো ওর, কেমন অজানা অদ্ভুত অনুভূতিতে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলো তখন রোমি.... হাঁটতে হাঁটতে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো দীপ দা.... তাই আর পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি রোমিও....
দীপ দার চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারে নি সাথে সাথে... নীচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রোমি...
"কোথায় যাচ্ছো...?".... দীপ দার যত্ন মাখা গলার স্বরে গলে গিয়েছিলো রোমির ভেতরটা....
কোনোমতে বলেছিলো, "মোড়ের দোকানে..."....
"কি আনতে যাচ্ছো.. বলো, আমি এনে দিচ্ছি... তুমি বাড়ি যাও, আমি পৌঁছে দেব সব....".... ব্যস্ততার সুর কানে বাজতেই দীপ দার দিকে চোখ তুলে তাকায় রোমি....
দৃষ্টি উদাস, নীরস, গভীর.... একটু থেমে জিজ্ঞেস করেছিলো, "কেনো দায়িত্ব নিতে চাইছো দীপ দা.... সবার দায়িত্ব নিজের করে নেওয়াটা অভ্যেস হয়ে গেছে...তাই? ..."..জিজ্ঞাসু ভাবে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে রোমি, যেন এই সুযোগে এক নিমেষে জেনে নিতে চায় দীপ দার মনের অলি গলির খবর, কিংবা চায় প্রত্যাশার পরিণতি....
রোমির দীঘল অপেক্ষারত চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে থেকে ওর মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলো দীপ দা, তাই স্মিত অর্থপূর্ণ হেসেছিলো দীপ দা....
বলেছিলো, "পৃথিবী প্রবীণ আরো হ’য়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে;
বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।
ও-প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই— সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে
নড়িতেছে— জ্বলিতেছে— মায়াবীর মতো জাদুবলে।
সে-আগুন জ্ব’লে যায়— দহেনাকো কিছু।
সে-আগুন জ্ব’লে যায়
সে-আগুন জ্বলে’ যায়
সে-আগুন জ্ব’লে যায় দহেনাকো কিছু।
নিমীল আগুনে ওই আমার হৃদয়
মৃত এক সারসের মতো।
পৃথিবীর রাজহাঁস নয়—
নিবিড় নক্ষত্র থেকে যেন সমাগত
সন্ধ্যার নদীর জলে এক ভিড় হাঁস ওই— একা;
এখানে পেল না কিছু; করুণ পাখায়
তাই তা’রা চলে যায় শাদা, নিঃসহায়।
মূল সারসের সাথে হ’লো মুখ দেখা।.. ".......
শুনতে শুনতে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো শুধু রোমি.... উত্তর পেয়ে খুশির সাগরে ভেসে যাচ্ছিলো ও.... বলে ওঠে," কিন্তু আমার অদূর, অতীত, বর্তমান যে সুখকর নয় দীপ দা... সে ভয়ংকর... তুমি কি.... ".....
আবার ঘোরের মধ্যে একইরকম ভাবে বলে ওঠে দীপ দা...
“কি কহিলি বাসন্তী, পর্বত গৃহ
ছাড়ি বাহিরায় যাবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশ্যে
কার যেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
দানব নন্দিনী আমি, রক্ষঃ কুল বধূ
রাবন শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী
আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে?”......
হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো দীপ দা.... রোমিও হাত রেখেছিলো সে হাতে, সেই প্রথম স্পর্শ করেছিলো নিজের পুরুষকে....কি দুর্দমনীয় সে অনুভূতি... কি অপ্রতিরোধ্য সে আকর্ষণ.... দীপ দা ওর চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই ওর অন্য হাত থেকে ছোটো ব্যাগ টা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো....
"কি আনতে হবে... বললে না...?"....
লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলো রোমি..... বাড়িয়ে দেওয়া হাতে ব্যাগ না দিয়ে সে তুলে দিয়েছে নিজেকেই....তাড়াতাড়ি দীপ দার হাত থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলেছিলো, "দোকানে আগে থেকেই লিস্ট দেওয়া আছে... শুধু নিয়ে আসতে হবে, আর এই যে টাকাটা....."....বলে দীপ দার দিকে এগিয়ে দিয়েছিলো টাকা.....
"সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না... তোমার তো জিনিস পেলেই হলো...."....
"না... দীপ দা... আমি নতুন করে আর ঋণী হতে চাই না তোমার কাছে... এমনিতেই যা দিয়েছো তার ভার অনেক... "...
" একটু আগেই তো অর্ধেক শোধ করে দিলে, নিজেকে প্রকাশ্যে আমার করে দিয়ে... বাকিটা না হয় যেদিন তোমাদের বাড়ি যাবো বাবা, মা কে নিয়ে.... সেদিন শোধ করে দিও.... ততদিন পর্যন্ত একটু সহ্য করো... পারবে না...? ".... আর কিছু বলতে পারেনি রোমি.... চোখে জল এসে গিয়েছিলো..... ভেবেছে, এতটা কি সত্যি ওর প্রাপ্য.....
বুঝেছিলো ওর মনের কথা দীপ দা... চোখের জল মুছে দিয়ে ওর দিকে আবেগ ভরে তাকিয়ে কেমন ভরাট গলায় বলেছিলো, "যাও... আমি দিয়ে আসবো জিনিস বাড়িতে....".... ইতস্তত করে সম্মতি জানিয়ে উল্টো পথে পা বাড়িয়েছিলো রোমি.... হঠাৎ কি মনে হতে গলির শেষে পৌঁছে একবার পেছনে ফিরে তাকাতেই রোমি আবার অনুভব করেছিলো মনের প্লাবন..... দেখে, তখনও দীপ দা ওখানেই দাঁড়িয়ে... দু জোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো ভরপুর আবেগ নিয়ে....
এখানেই ভাবনার গতি রোধ করে রোমি নিজে নিজেকে শুধরে দেয়.... মৃদু স্বরে বলে ওঠে, "না যে আবেগের কথা তুমি বলছো, একেই বলে ভালোবাসা সৌরসেনী দত্ত..... সত্যকে অনুভব করছো অহরহ... অথচ তার মুখোমুখি হতে এত ভয়... তাকে বেঁচে চলেছো রাত দিন অথচ তাকে স্বীকার করে নিতে এত দ্বিধা.....কেনো সাহসী হতে পারো না তুমি? কেনো হয়ে উঠতে পারো না তুমি মধুসূদনের 'প্রমিলা'?...".......
সেদিন বিকেলের পর ছাদে গিয়ে দেখা হলে একটা কাগজ এসে পড়েছিলো রোমির ছাদে.... তুলে নিয়ে সেটা পড়েছিলো ওখানে দাঁড়িয়েই.... পড়ে চোখ ছলছল করে উঠেছিলো, কেঁপে উঠেছিলো রোমি.....
" না, আমি কিছুই জানিনা.... তোমাকে জানার পর আর নতুন করে কিছু জানতে চাই না..... তুমি যে আমার কৌতুহলের, আমার তৃষ্ণার শেষ ঠিকানা ছিলে সেটা যে মুহুর্তে অনুভব করেছি.... তখন থেকে একটা কথাই আমি জানি, যে আমি পূর্ন......"...... আজও কাগজটায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে একইভাবে চোখ ভিজে যায় রোমির.... মনে মনে ভাবে, 'বৃথাই মাঝে মাঝে বুকে টনটনে ব্যথা করে... ভয় হয় যদি হারিয়ে ফেলে জীবন সিন্ধুতে কুড়িয়ে পাওয়া পুরুষশ্রেষ্ঠকে....'....
চোখের জল মোছে রোমি... হাসে একগাল.... আবার ভাবে, 'যে মানুষটা এতটা ভালোবাসতে পারে সে আমাকে গ্রহণ না করে থাকতেই পারবে না, কক্ষনো পারবে না আমি জানি, আমার অন্তরাত্মা জানে....'.....
একবার ঘড়ির দিকে তাকায়.... না সময় হয়ে এলো, কাগজ গুলো আবার এক এক করে বাক্সে ভরে রাখে রোমি.... রাখতে রাখতে কখন যেন আপন মনে ভাবনার সাগরে তলিয়ে যায় ও.......
অলস সময় চিন্তা খোরাক পেয়ে কেমন যেন আরো অলস, বিলাসী হয়ে যায় এই মুহুর্তে..... ফেলে আসা অতীতের খাতার কিছু পৃষ্ঠা রোমির চোখের সামনে তুলে ধরে ওর বাঁধন ছাড়া চিন্তারা.....
এইতো মনে হয় সেদিনের কথা, ওকে একা ফেলে চলে গেলো মা.... মা চলে যাওয়ার পরই কাজে ঢোকে রোমি, তার আগে পর্যন্ত ও-ও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতো ওর বয়সী আর পাঁচটা মেয়ের মতো করে....মনে মনে বলে, "ভাগ্যিস! তখন তুমি আসোনি দীপ দা.... তখন আসলে কি তোমার মতো পাকা, পরিণত সোনাকে আমার মতো কাঁচা, খাপছাড়া পিতলের পাত্র ধারন করতে পারতো সেই সময়.... এখন হাসি পায় তখনকার আমি'র কথা ভাবলে.... কিন্তু আজ আমি তোমাকে বুঝি,তাই বুঝি তোমাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরে আমি ধন্য.... ভালোবাসি তোমায় দীপ দা..."....
ভাবনার গতি ফের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলে, মনে পড়ে মায়ের কথা... মায়ের অসুখের কথা... তার জন্য বাবার জমানো টাকা জলের মতো বেরিয়ে গেছে তখন, কিন্তু তাও শেষ রক্ষা হয়নি... মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে রোমিকে সংসার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে বিদায় নেয় রোমির মা.. বর্তমানে জমানো টাকা একেবারে তলানিতে,তার ওপর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়েছে ওর ওপর.... কারণ বাবাও এখন প্রায় শয্যাশায়ী, কিডনিতে সমস্যা..... তবে রোমির মা যাওয়ার পর থেকে সমস্যা শুধু কিডনিতে থেমে নেই, তা বাসা বেঁধেছে মনেও.... বড্ড বেশি ভেঙে পড়েছেন ভীষণ মানসিক ভাবে.... এই অবস্থায় ধাক্কা সামলাতে না পেরে জেরবার হয়ে প্রথমে চারিদিকে অন্ধকার দেখেছিলো রোমি.... আর তখনই যখন ও সংসারের ঘানি কাঁধে নিয়ে দিশেহারা, হঠাৎ করে দেখা হয়ে গিয়েছিলো একদিন ছোটবেলার বান্ধবী শ্রেয়সীর সাথে, ওর ইউনিভার্সিটির বাইরে...প্রথমটায় ছোট্টবেলার সেই হাসিখুশি প্রাণবন্ত মনখোলা, সাদাসিধে শ্রেয়সীকে দেখে চিনতে পারেনি রোমি, খুব বেশি প্রসাধনে মোড়া মুখ, অথচ শরীরের আচ্ছাদন খুবই কম....
শুরুটা তাই ওদিক থেকে হয়েছিলো... "এই.. সৌরসেনী না? কিরে চিনতে পারছিস না? আরে আমি শ্রেয়সী রে...."... তারপর আলাপচারীতা এগোয় সাবলীলভাবে.... কিন্তু সবকিছুর মধ্যে ওর অপ্রতুল অবস্থা নজর এড়িয়ে যায়নি শ্রেয়সীর....
শ্রেয়সী ওকে একটা ক্যাফে তে নিয়ে গিয়ে সামনে বসিয়ে জানতে চেয়েছিলো সবটা.... রোমিও সহানুভূতির স্পর্শ পেয়ে ওর কাছে নিজের অবস্থার কথা সব খুলে বলেছিলো, তখন সব কথা বলতে বলতে ওর মনে হয়েছিলো ও যেন এরকম কাউকেই খুঁজছিলো অসচেতন ভাবে, অবচেতনে... মনে হচ্ছিলো মনের সব ভার নেমে যাচ্ছে একটু একটু করে..... সব খুলে বলতে পেরেছিলো সেদিন রোমি, চেয়েও ছিলো বলতে... কারণ লুকোনোর মতো তো কিছুই ছিলো না, বরং ভেবেছিলো বললে যদি কিছু উপায় বের হয়.... সত্যি বলতে, শ্রেয়সীই শেষ পর্যন্ত উপায়টা বলে দিয়েছিলো... ওই তো এই কাজের কথা বলেছিলো আর তারপর থেকেই.....!
সমস্ত ভাবনারা আপাতত ছুটি নেয় রোমির কাছ থেকে...বাক্সটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে আওয়াজটা শুনেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রোমি...একটা ভালো লাগাময় চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত মন জুড়ে... ও জানে, এই পরিচিত আওয়াজটা দীপ দার ছাদের দরজা খোলার শব্দ.... এর জন্যই তো অপেক্ষা করছিলো এতক্ষণ.... ওর পা আর মন সমান তালে ছুটলো ছাদের দিকে..... ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা করে রোমি.... তারপর ধীর পায়ে দরজা পেরিয়ে পা রাখে ছাদে..... এগিয়ে যেতে যেতে চোখ তুলে তাকায়..... দেখে রোজকার পরিচিত দৃশ্য.... দীপ দা বই হাতে পায়চারি করছে... রোজ দেখে রোমি তাও যেন মন ভরে না ওর..... হালকা হাসে....
হঠাৎ প্রিয় দুচোখে চোখ পড়লে,পা থেমে যায় রোমির.... মনে মনে ভাবে, "কি সুন্দর দেখতে লাগছে আজ তোমায় এই গাঢ় লাল টি-শার্টে..... কেনো ওই ধূসর রঙে মুড়ে রাখো নিজেকে..... তোমাকে রঙে কি যে মানায়! হবে নাই বা কেন.... যে নিজে মানুষের জীবন রঙিন করে তোলে... জীবনের সাদা ক্যানভাসে রংয়ের আচড় কাটে উথালপাথাল হাতে... এমন শিল্পীর থেকে দূরে সরে থাকে কার সাধ্য....!... এই যে আমি... আমারও সাধ্য নেই... "....
দীপ দার চোখে তাকিয়ে হারিয়ে যায় রোমি.... কি অনিবার, অপ্রতিরোধ্য এই ভাষা......দীপ দার চোখে নিজেকেই দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যায় রোমি.... সম্বিৎ ফেরে পাথর ঢুকিয়ে কুন্ডলী পাকানো কাগজটা পায়ের কাছে এসে পড়াতে.... দীপ দার আবেগ মাখা হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে তুলে নেয় কাগজটা রোমি....
পড়ে হেসে একবার দীপ দার মুখের দিকে তাকায় আর দাড়ায় না লজ্জায়.... নিচে নেমে যায় রোমি.... পরশু দিন রবিবার গঙ্গার ঘাটে ডেকেছে দীপ দা, এতদিনের চাওয়া সব পূর্ন হতে চলেছে... খুব ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে গিয়ে দীপ দাকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রেখে বলতে , "আজ আমি পূর্ন....আমার এই শূন্য জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছো তুমি, শুধু তুমি!"......
.............................
আজ রবিবার, আজও রোমির ছুটি ছিলো না, কিন্তু অনেক কাকুতি মিনতি করে আজকের দিনটা ম্যানেজ করেছে....
আজ শাড়ি পড়েছে রোমি... প্রতিদিনই সাজে কাজে যখন যায়, কিন্তু নিতান্ত অনীহায়, ভীষণ অনিচ্ছায়... আর আজ ও সাজছে মনের ইচ্ছেতে, ওর মনে হয় শেষ মা জীবিত থাকতে এরকম সেজেছিলো বোধ হয়.... তারপর এত বছর পর এই প্রথম...... লাল শাড়িতে এক কথায় অনন্যা লাগছে শ্যামলা, সুশ্রী রোমিকে.... তবে আজ যখন ধরা দেবে তখন ও-ও ঠিক করে নিজের না বলতে পারা কথাগুলো, বলতে গিয়েও ওপাশ থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা কথাগুলো একটা ছোট কাগজে লিখে নিয়ে যাবে, কিছু বলার আগেই দীপ দার হাতে ধরিয়ে দেবে ঠিক......
গন্তব্যে পৌছে রোমি দূর থেকে দেখতে পায় দীপ দাকে.... সাদা টি-শার্ট আর ডেনিমে কি স্মার্ট অথচ ভদ্র দেখাচ্ছে.... হাসি মুখে এগিয়ে যায় রোমি.... হ্যা আজ বলবে, মনের সব কথা উজাড় করে.... না আর ভয়, লজ্জা কিচ্ছু নেই... যে নিজের তার কাছে আবার ভয় বা লজ্জা কিসের..... ভালোবাসা স্বাধীনতা দেয়, সাহস দেয়.... আর কেড়ে নেয় সংকোচ, সংকীর্ণতা... দীপ দার মতো মানুষকে ভালোবেসে তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করেছে রোমি, তাই তো আজ রোমিও সবকিছুর পরেও এত সাবলীলভাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসতে পেরেছে......
রোমি দেখে, আজ দীপ দার চোখও অসম্ভব উজ্জ্বল, মুখে কি অদ্ভুত দীপ্তি... কাছে যেতেই হেসে দীপ দা ওকে কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময় রোমি এগিয়ে দেয় কমলা খামটা.... প্রায় সাথে সাথেই বেজে ওঠে দীপ দার মোবাইলটা......
ওর হাত থেকে খামটা নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দীপ দা বলে ওঠে, "আজ সন্ধ্যায় একটা ডিবেট আছে জাগ্রত সঙ্ঘের...সমাজে মেয়েদের সুরক্ষা, সমাজে মেয়েদের স্তর.. ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে.... Confirmation এর জন্য call করেছে মনে হয়.... আমি confirm করে দিয়েছিলাম তাও হয়তো শেষবারের মতো sure হতে চাইছে..."......সবসময়ের মতো পরিচিত মৃদু শান্ত কন্ঠে বলে দীপ দা.....
শুনে গর্বে ভরে যায় ওর বুক, লুকিয়ে রাখতে পারে না, উপচে পড়ে চোখে, ঠোঁটের কোণে....রোমিও মৃদু স্বরে উত্তর দেয়, "ঠিকাছে... কথা বলে নাও... "..... সুন্দর হেসে অনুমতি দেয় রোমি.... দীপ দা ওর দিকে তাকিয়ে একবার হেসে ফোন রিসিভ করে..... " হ্যা, বল শুভ্র.... "....
দীপ দা ফোনে কথা বলতে বলতে ওদিকে এগিয়ে গেলে বেঞ্চটাতে বসে পড়ে রোমি.... গঙ্গার দিকে তাকায় ও... দেখে গঙ্গায় জোয়ার এসেছে, ও টের পায় তার সাথে সাথে জোয়ার এসেছে ওর মনেও....
বেশ কিছুক্ষণ হলো দীপ দা আসছে না... এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে পড়ে রোমি... কথা বলতে বলতে কি এগিয়ে গেলো ওদিকে অনেকটা.... এখন রোমির মনে হয়, ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখলে ফোন করতে পারতো একটা...
এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখ যায় কমলা মন্ডটার দিকে... মনে ভয়াবহ আশঙ্কার মোচড় লাগে, তার তীব্রতায় চোখে জ্বালা করে ওঠে রোমির....
দৌড়ে গিয়ে তুলে নেয়,দেখে হ্যা..ওর দেওয়া সেই খামই তো.....তার সাথে কুঁচকে লেপটে আছে ওর লেখা ছোট কাগজটা...
" আমি জানি.... তুমি আমাকে ভালোবাসো... তোমার ভালোবাসাই আমায় সাহস দিয়েছে দীপ দা, তোমার কাছে ধরা দেওয়ার জন্য..... তোমায় ভালোবেসে আমার বারবার মনে হয়েছে তুমি সেই পুরুষ.. যে আমাকে অবলীলায় গ্রহন করতে পারে, তুমি এমন এক পুরুষ যার ভালোবাসার সমানে সামাজিক স্বীকৃতিও খুব ক্ষুদ্র, তাই তোমার মতো পুরুষের কাছে মাথা নত করে আমি ধন্য, আমি পূর্ণ... তাই বলা বাহুল্য,তবু বলতে চাই... আমি কি কাজ করি জানো দীপ দা? এক কথায় যাকে বলে 'call Girl'....বলো, তুমি কি তোমার জীবনদর্শনকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে, নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারবে না...বলো? জীবন ঋতুর খর তাপে, ঝাপিয়ে আসা বৃষ্টিতে আমার এই নির্জন একলা পথের এক ধারে, এক কোণে তুমি কি নীরবে আমার জন্য ছাতা নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে না..... বলো.... "..... আর পড়তে পারে না রোমি.... বসে পড়ে সামনের বেঞ্চটায়.... এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দেখে গঙ্গা জুড়ে ভাটা........... কিন্তু রোমির মনে এতক্ষণে বাধ ভেঙে বাণ এসেছে... উপচে পড়ছে তা চোখ বেয়ে....
হঠাৎ হেসে ওঠে রোমি.... শব্দ করে... হাসির বেগ ক্রমে বেড়ে চলে... আশেপাশের সবাই সন্দেহের অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে..... রোমির ভ্রুক্ষেপ নেই....ওর মনে উচ্চারিত হয়ে চলেছে সজোরে....
"হে পুরুষ, তুমি দীর্ঘ দেহি
বলিষ্ঠ তোমার পেশী, শক্ত তোমার চোয়াল
তুমি সৃষ্টির আদি, রূপে তুমি ভয়াল।
তুমি রুদ্র প্রতাপ, বৈশাখ খর তাপ
আগুনের মতো জ্বলন্ত তুমি - তুমি বিনাশের অভিশাপ।
সৃষ্টিকে আগলে রেখেছে, সে তোমার প্রকান্ড প্রকাশ
থর থর কাপে চৌদিক, হারিয়ে ভাষ
মাথা নত করে থাকে নিশ্চুপ পরিহাস।
সকলি শান্ত, সকলি ভীত, তোমার রুদ্র এমন - তুমি যে প্লাবন -
তোমার কারণে পৃথিবী সবুজ - হওয়ায় দোলে সবুজ বন।
তুমি করেছো শেষ নতুনের রচনায় কত কতবার,
তুমি ধ্বংস, তুমি ঝড়, তবু তুমি পুরুষ আমার ॥"
হাসতে হাসতে বলে ওঠে রোমি..." হে পুরুষ... তুমি কার? "....
সন্ধ্যাবেলায় আবার সেজেছে রোমি, রেডি হয়েছে... call এসেছে,বেরোতে হবে.... বাবাকে জানিয়েছে, হঠাৎ urgent দরকার তাই অফিসে ডেকেছে....
শুনে বাবা বলে ওঠে," দেখ, সেই ডাকলোই... আর কি যা... সাবধানে যাস মা...তাড়াতাড়ি ফিরিস...চিন্তা হয়, যা দিনকাল পড়েছে আজকাল...."... বলে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে বৃদ্ধ... শেষবারের মতো আয়নায় দেখে ফোলা ফোলা লাল চোখে যত্ন করে লাইনারটা টেনে নেয় রোমি....
ভাবে, মাঝে মধ্যেই বেশ কয়েকদিন ছুটি নিয়েছে ও, সময় করে ছাদে ছোটার জন্য... শুধু শুধু নিজের চূড়ান্ত বোকামির কারণে বাবার কয়েকটা ওষুধের টাকায় টান পড়েছে খামোখা.... আর ছুটি নেবে না, ছাদে ছোটার প্রয়োজনও যে ফুরিয়েছে...... বেরিয়ে যায় রোমি....
বাইরে বেরোতে অস্পষ্ট আওয়াজটা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে ধাক্কা দেয় ওর কানে....
পথে যেতে যেতে শুনতে পায় মাইকে বাজছে পরিচিত দৃঢ় কণ্ঠস্বর... "মেয়েরা শুধু অবহেলিতই নয়, তারা দলিত... বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন,কিন্তু তা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি? নিজের ছেলেকে বিধবা মহিলার সাথে বিয়ে দিয়ে....! আর আমরা কি করতে পেরেছি?.... একটা অসহায় পতিতা মেয়ে দেখলে নাক সিটকে, চোখ কুঁচকে তার থেকে ছিটকে সরে গেছি... নিজেদের জীবনে কি গ্রহণ করতে পারি না আমরা তাদের, স্থান দিতে পারি না....?! কখনো ভেবে দেখেছেন, লোক আপনার কথা কেনো মানবে আপনি যদি নিজেই নিজের set করা principles না মানেন.....? Because, I firmly believe that charity begins at home... তাই আগে নিজেকে দিয়ে শুরু করুন, see yourself in the mirror first!.... And remember every one deserves a second chance..... হ্যা, সেই অসহায় পতিতাও...! "....
এতক্ষণে হেঁটে মোড়ের মাথায় এসে পড়েছে রোমি, অটো থামিয়ে উঠে পড়ে..... যাত্রা শুরু করে অনন্ত অন্ধকারের যাত্রী হয়ে......দ্রুত পেছনে ফেলে আসা শব্দ গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ...কিন্তু রোমির মুখে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে বাঁকা তাচ্ছিল্যের হাসি......
সমাপ্ত

