STORYMIRROR

Sayani Saga

Drama Romance Tragedy

4.5  

Sayani Saga

Drama Romance Tragedy

Dwitwo

Dwitwo

10 mins
9





সকাল দশটা বাজে প্রায়... এই ভিড় বাসে লেডিস সীটে বসে রীতিমত ঘামছে আত্রেয়ী, এবার গরম টাও জাকিয়ে পড়েছে ... আজ সাড়ে এগারোটার মধ্যে স্কুলে পৌছতেই হবে, তাড়া আছে যথেষ্ট.. তার মধ্যে বাসে এত ভিড় যে গায়ের ওপরও ঝুকে পড়েছে কিছু মহিলা যাত্রী... হাতঘড়ি টা বারবার দেখছে...আনমনে বা দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারের সামনের বিস্তৃত কাচে চোখ রেখেই বসেছিল.. পাশে আচমকাই বেশ জোরে ধাক্কা লাগে ...এপাশে তাকাতেই মনের সাথে মুখটাও তেতো হয়ে উঠলো আত্রেয়ীর... অনেক বছরের পুরোনো বন্ধ বাক্সের ডালা খুলে গেলো মনের ভেতর, আর ওমনি মনময় ছড়িয়ে পড়লো মন খারাপের বিষাদ গন্ধ... এই ভিড় বাসে ফাকা সীট পেয়েই তাড়াহুড়ো করে ওর পাশে এসে বসেছে বিদিশা.. আত্রেয়ী ভাবে ওকে নিশ্চই খেয়াল করেনি.. করলে কি ওর পাশে এরকমই সাবলীল হয়ে বসতে পারত....তবে অপেক্ষা করতে হয়না আত্রেয়ীকে, এই প্রশ্নের উত্তর আসে ক্ষণিকের তফাতেই.. চোখে-চোখ পড়ে ওদের.. বিদিশার মুখটা হঠাৎ কেমন দিশাহীন হয়ে পড়ে,অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নেয়... আত্রেয়ীও আবার ওপাশে তাকায়.. সামনের স্বচ্ছ কাচের দিকে তাকিয়ে শূন্য দৃষ্টি মেলে আপনা থেকেই পিছিয়ে যায় অতীতে.. অনেক বসন্ত আগে.....


সেই মেয়েবেলা থেকে বন্ধুত্ব দুজনের, আত্রেয়ী আর বিদিশার .. কিশোরীবেলায় গিয়ে তা আরও ডালপালা বিস্তার করে শক্ত শেকড় গেড়ে বসে...ফিল্ম, রেস্তোরাঁ, এই উৎসব, ওই মেলা এসব কিছুই বাদ যেতো না ওদের... কোনো কথাই বলতে বাকি রাখতো না দুজন দুজনকে... বিদিশা ছিলো বুদ্ধিমতি, আর আত্রেয়ী রূপবতী.. এক্ষেত্রেও ছিলো দুজন দুজনের পরিপূরক... স্কুলে সারাজীবন পাশাপাশি বসেছে... একজন কামাই করলে আরেকজনও যে আসবে না তা, স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা পর্যন্ত জানতেন....
এরকম নিশ্চল, বাধা-ধরা নিয়মের ব্যতিক্রম হল যখন দুজন একই কলেজে অন্য শাখায় ভর্তি হলো... অন্য সময় ক্লাস, আর তাই অবসর টাও পৃথক.... তবুও এক সাথে বাড়ি ফেরার সময় সমস্ত জমানো কথা দুজন দুজনকে বলে স্বস্তি পেতো... কতো যে মন কেমন করা খুশি আনন্দে ভরা সময় দু বান্ধবীতে কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই....
ফার্স্ট ইয়ার তখন.. কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার পাশে ফুচকা খেতে খেতে আত্রেয়ীই বলেছিলো কথাটা... না খুব সিরিয়াসলি বলেনি.. মনের উপরিতলের ভাসমান কথাটা ভাগ করে নিয়েছিলো মাত্র....
"সায়েন্সএর নৈঋত এর তাকানো টা সবার থেকে বেশ আলাদা.. না রে? টান আছে একটা "..
বিদিশা প্রায় বিষম খায় আরকি!.. " ওর তাকানোর মধ্যে টান.. না তোর মনে টান..কবে থেকে চলেছে? আমাকে লুকিয়ে গেলি?.."
"আরে ধুর.. কোনো লুকোনো কিছুই নেই.. তুই তো জানিস অনেকদিন ধরেই পেছনে ঘুরঘুর করছে, সুযোগ পেলেই তাকায় ...আমি খেয়াল করেছি অনেকবার.. আমার আজই কথাটা মনে হলো.. তাই তোকেই প্রথম বললাম.. "..
"সে তো কলেজের স্টার বয় রে,আর তুইও দেখতে নায়িকার মতো.. শুনেছি ডিবেটে তো কতো প্রাইজ টাইজ পেয়েছে.. আবার পড়াশোনাতেও তুখোড়, বেছে বেছে তো হীরেটাই তুলেছিস ....!"বলে বিদিশা খুব হেসেছিলো একচোট..
বিদিশা আবার এসব ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে, অনেক সপ্রতিভ.. সেদিনের পর থেকে বিদিশাকে আর থামানো যায়নি.. নৈঋত এর সামনে পড়ে গেলে গান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইঙ্গিত, অর্থপূর্ন হাসি কিছুই বাদ ছিলো না... বসন্ত উৎসবে যেদিন কলেজে একাকী ঘরে, সামনে এগিয়ে এসে
নৈঋত আত্রেয়ীকে রাঙিয়ে দিয়েছিলো.. আর চোখে চোখ রেখে বলেছিলো..
"কতো দেহ এলো,- গেল,- হাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দিয়াছি ফিরায়ে সব,- সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নক্ষত্রের তলে বসে আছি,- সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নিয়া তুমি কি আসিবে কাছে..."..
এত আবেগ ভরা জীবনানন্দ শুনে কিছুক্ষণ সব ভুলে তাকিয়ে ছিলো আত্রেয়ী নৈঋতের দিকে... মুখের সাথে সাথে সেদিন মনেও যে রং লেগেছিলো, তা নৈঋত বুঝেছিল.. আর বুঝেছিল বাইরে থেকে হাসিমুখে লুকিয়ে জানলা থেকে উঁকি দেওয়া বিদিশা...
সেই শুরু... পরে নৈঋত জানিয়েছিল বিদিশাই নাকি যেচে ওকে আত্রেয়ীর মনের কথা জানিয়ে সম্পর্কটাকে নতুন দিশা পাইয়ে দিয়েছিলো...
এরপর থেকে ওরা দুজনই মজেছিলো দুজনের মধ্যে..দুজনেরই বইয়ের প্রতি ঝোঁক, লাজুক স্বভাব অজান্তেই ওদের অনেকটাই কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলো... কখনো কখনো বিদিশাও যোগ দিত ওদের সাথে... তিন জনে মিলে কতো সন্ধ্যে কাটিয়েছে, কতো প্রোগ্রাম ফাংশন হৈ হৈ করে উপভোগ করেছে...
সব ভালোই ছিলো, ছন্দপতন হলো সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকে... জীবনানন্দ ভেজা আবেগে ভাটা পড়লো নৈঋতের...আর আগের মতো আর ওর জন্য ব্যাকুল অপেক্ষা নেই..তার বদলে এসেছে অজুহাতের আধিক্য.. কথার মধ্যে কোনো উষ্ণ টান নেই... আত্রেয়ী কেমন অশনি সংকেত পায়, তবুও সবটা নিজের মধ্যেই রেখেছিলো আত্রেয়ী, ভেবেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে...
কিন্তু যখন ওর জন্মদিনও ভুলে গেলো.. সারাটা দিন একটা ফোন পর্যন্ত এলো না, আর ঠিক থাকতে পারেনি আত্রেয়ী... সাত তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলো বিদিশার বাড়ি..
খুলে বলেছিলো সব.. বিদিশা শুনেই থ... এই অধঃপতনের শুরু কবে থেকে, কেনো ওকে কিছু আগে জানায়নি আত্রেয়ী এরকম হাজারটা অভিযোগ করার পর ওকে জড়িয়ে ধরেছিল আন্তরিকতায় .. উচাটন মনে হঠাৎ স্নেহের ছোঁয়া পেয়ে আত্রেয়ীও সব কষ্ট উজাড় করে সেদিন কেঁদেছিল ওর কাছে....
এরপর বিদিশাই স্বচক্ষে দেখে এক সন্ধ্যায় ফোন করে আত্রেয়ীকে জানিয়েছিল নৈঋতের জীবনের নবাগতার কথা... ফোনেই সব শুনতে শুনতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো আত্রেয়ী..
আত্রেয়ী তারপরেও আলাদা করে খুলে সব জানতে চেয়েছে নৈঋতের কাছে.. যদি বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারে... কিন্তু ও যে ইচ্ছে করে হারিয়েছে, যে স্বেচ্ছায় হারায় তাকে যে আর খুঁজে পাওয়া যায় না... সেদিন তা টের পেয়েছিলো আত্রেয়ী..


বিদিশাই তখন ওই সময়টায় ওকে সামলেছিলো... আত্রেয়ীর কষ্টের অন্ধকার দিনগুলোতে বিদিশাই ছিলো এক ফালি আলো... বিদিশাও আগলেছিলো ওকে পরম মমতায়... বলেছিলো, "এমনিতেই বেশ পপুলার ,তার ওপর bright future..এসব ছেলেরা এক মেয়েতে সন্তুষ্ট থাকে না.. তোর দোষ নেই.... তুই তো সত্যি ভালোবেসেছিস, ভুল টা কোথাও আমারও ছিলো, চিনতে পারিনি, নাহলে কখনো ওই scoundrel টার সাথে তোকে ওভাবে মিশতে দিতাম না! ... "..


এরপর থেকে নৈঋত আত্রেয়ীর সামনে পড়ে গেলেও আত্রেয়ী ওকে না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতো.. তাতে বরং নৈঋতের সুবিধাই হয়েছিলো,ওকে মিথ্যে ভনিতা করতে হয়নি.. ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যেও বলতে হয়নি আত্রেয়ীর সামনে.. ভাবটা এমন যেন ভালোই হয়েছে,বাচা গেছে...আত্রেয়ী নৈঋতেকে এড়িয়ে গেলেও আড়ালে যে চোখের জল ফেলতো, তা বিদিশার নজর এড়িয়ে যেতে পারেনি.. একদিন বিদিশা ফাকায় নৈঋতেকে সামনে পেয়েই বেশ কড়া কথা শুনেছিল, ব্যাপারটা আরো দূর গড়াতো যদি না আত্রেয়ী গিয়ে বিদিশাকে টেনে নিয়ে আসত..


থার্ড ইয়ারের শেষের দিক... পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আত্রেয়ীর মনের ক্ষত বেড়েছে ছাড়া কমেনি.. সময়ের সাথে তা আরও গভীর হয়েছে... প্রথম কাউকে ভালোবেসেছিলো ও... তা কখনোই পদ্ম পাতায় জলের মতো করে নয়, বরং যুগের পর যুগ কেটে গিয়েও নিজের অস্তিত্ব সগৌরবে জানান দেওয়া জীবাশ্মের মতো করে..কিন্তু আগের থেকে সামলে নিয়েছে অনেকটাই.. এখন আর যখন তখন কেঁদে ফেলে না, অনুভূতি গুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে....


দিনটা ছিল শুক্রবার, সকাল সকাল বিদিশার ফোন "কিরে আজ কলেজ আসছিস তো?"..
"না রে, কালই তো বললাম তোকে... দিম্মাকে দেখতে যাব.. সেই শরীর খারাপ শোনার পর তো আর দেখতে যেতে পারিনি.."..
"আজই ফিরবি তো..?"
"হ্যা, সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরব, বেশিক্ষণ থাকবো না...."
"তাহলে আজ কলেজ আমিও যাচ্ছি না.. সন্ধ্যার পর বরং তোর বাড়িতে যাবো একবার.."..
"আচ্ছা, তাই করিস.. ".. মৃদু হেসে ফোন রেখে দেয় আত্রেয়ী..
কিন্তু সেদিন আর যাওয়া হলো না, ওর মায়েরই জন্য.. ওর মাও যাবে ভেবেছে.. কিন্তু রবিবার ছাড়া সম্ভব নয়.. ঠিক হলো আজ আত্রেয়ী একা না গিয়ে রবিবারই বরং মা মেয়েতে একসাথে যাবে.. তাহলে আত্রেয়ী মনস্থির করলো কলেজেই যাবে.. এমনিতেই ফাইনাল পরীক্ষা সামনেই..ভাবলো বিদিশাকেও জানাতে হবে, নাহলে বেচারীর শুধু শুধু আজ কলেজ কামাই হবে .. কয়েকবার চেষ্টা করেও ফোনে পেলো না, নট রিচেবল্ বলছে...
অগত্যা একাই গেলো আত্রেয়ী.... কলেজে গিয়ে ক্লাস না থাকলে আত্রেয়ী ওই ঘরেই বই নিয়ে একা বসে পড়ে যে ঘরে ওর শরীরে, মনে বসন্তের রং লেগেছিলো.... আজও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েকটা ফাকা ঘর পেরিয়ে ওই ঘরের দিকেই এগিয়ে গেলো ও ... ক্লাস শুরু হতে এখনও পৌনে এক ঘন্টা মতো দেরী...ভাবে, ততক্ষণ ওখানে বসে পড়ে নেওয়া যাবে...
দরজার সামনে দাঁড়াতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো আত্রেয়ীর, হাতদুটো নিজে থেকেই ধীরে শিথিল হয়ে গেলো.... মোটা বইটাও তাই পড়ে গেলো হাত থেকে শব্দ করে ... নৈঋতের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে বসে আছে বিদিশা.. হাতে হাত রেখে কি যেন বলছে..বিদিশার মুখে কি এক অজানা দীপ্তি, মুখের হাসিতে কি সুন্দর তৃপ্তিময় অনুরাগের ছোঁয়া...আত্রেয়ীর পা দুটো টোলে যেতে পাশের দরজা টা ধরে দাঁড়ায়.. কিছুই অনুভব করতে পারছেনা, অবশ হয়ে গেছে বোধ হয় ইন্দ্রিয়গুলো ...শুধু চোখ থেকে গলগল করে জল বেরোচ্ছে, ঝাপসা অস্পষ্ট চোখে আত্রেয়ী দেখে বসন্তের রং ধীরে ধীরে বিশ্রী কালো হয়ে ঢেকে দিচ্ছে এই ঘরটাকে ... দেহটাও কাঁপছে, আত্রেয়ী বোঝে স্নায়ুগুলো আর ওর নিয়ন্ত্রণে নেই....


বই পড়ার শব্দ পেয়েই দরজার দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো বড় বড় করে নৈঋতের হাতটা জোরে চেপে ধরে ভুত দেখার মতো করে চমকে ওঠে বিদিশা... ওরা চরম বিব্রত হয়ে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে.. আত্রেয়ী আর পারেনি.... তাড়াতাড়ি ছুটে বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন কলেজ থেকে ...
আর ওদের জীবন থেকেও... নৈঋতের হারিয়ে যাওয়ার থেকেও বিদিশার ছুড়িকাঘাত করাটা ওর পায়ের নিচের মাটি কেড়ে নিয়েছিল...... মনের ভেতরের যাবতীয় নরম, আলতো, সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো ..বিশ্বাস, প্রত্যয় জাতীয় ব্যাপারে অনীহা, এক বিষাদ মাখা কালিমা,বীতশ্রদ্ধ অন্ধকার সম্পূর্ণ গ্রাস করেছিলো আত্রেয়ীকে.....এই দুই আত্মিক সম্পর্কের এরকম সাংঘাতিক পরিণতি ভেঙে দিয়েছিলো আবেগপ্রবন, সংবেদনশীল আত্রেয়ী কে, এই আঘাত অসুস্থ করে তুলেছিল ওকে .. কাউন্সিলিং করাতে হয়েছিলো রীতিমত ..বেশ কয়েকটা সিটিং নিয়ে মুঠো মুঠো ওষুধ খেয়ে স্বাভাবিক হতে পেরেছিল আত্রেয়ী অনেক পরে ...জীবনের সেই অন্ধকারময় দুঃস্বপ্নের মতো পর্বের কথা মনে পড়লে এখনও ওর গায়ে কাঁটা দেয়....


তারপর স্থিতধী হওয়া... এবং মা বাবার পছন্দে স্বাভাবিক নিয়মেই বিয়ে এবং সেই থেকে ওর সফল ন বছরের মানিয়ে নিয়ে গুছিয়ে নেওয়া সংসার, এখন বেশ পাকা গিন্নী সে....


আবার হাতঘড়ি টা দেখেনিলো.. নাহ বেশি সময় নেই..কি মনে হতে এদিকে ফিরে তাকালো আত্রেয়ী...দেখে বিদিশা মাথা নিচু করে কাঁধের ব্যাগটা সামনে রেখে তার একটা কোনা চেপে ধরে বসে আছে.. যেন বিপরীত কিছুর সাথে যুঝতে হচ্ছে, কোনরকমে এখন বাস থেকে নেমে পালাতে পারলে বাচে... মনে মনে হাসে আত্রেয়ী, একসময় নৈঋতও এভাবেই পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো ওর থেকে, আর আজ বিদিশাও তাই চাইছে.. তফাৎটা হলো তখন ও অন্ধকারে ছিলো, আর আজ.. ওরা বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে....


আত্রেয়ী খেয়াল করে বিদিশা অনুঢ়া...কেমন উত্তরণ হয় আত্রেয়ীর.. ভাবে, যে গল্পটা এতবছর আগে অসম্পূর্ণ রেখে চলে গিয়েছিলো নীরবে, কষ্টে....আজ যেন হঠাৎ করেই তার শেষ কয়েক পাতা পড়ার সুযোগ এসেছে... হাতছাড়া সে করবে না..


"কেমন আছিস তোরা.. ?".. ধীর গভীর কন্ঠে প্রশ্নটা করেই ফেলল আত্রেয়ী..
তোরা কথাটা একটু জোরের সাথেই বলে আত্রেয়ী...
ওর দিকে কালো মুখে একআকাশ যন্ত্রনা নিয়ে তাকালো বিদিশা.. তাকানোতে এত ব্যথা, এত কথা থাকতে পারে বিদিশাকে আজ এভাবে না দেখলে তা অজানাই থেকে যেতো আত্রেয়ীর...
জিজ্ঞাসু ভাবটা আরো বেশি করে ফুটে ওঠে আত্রেয়ীর মুখে..
" আমরা একসাথে নেই রে.."
"কেনো.." একটু থেমে আত্রেয়ী আবার বলে "তোদের রাস্তা পরিষ্কার করেই তো চলে গিয়েছিলাম.. তাও কেন...."
চোখ জলে ভোরে ওঠে.. সাথে সাথে মুছে নেয়.. ভিড় বাসে চারপাশটা দেখে নিয়ে চাপা ক্ষীণ স্বরে বলে, "নৈঋতের সাথে ছিলাম, বিশ্বাস কর সত্যি ভালোবেসেছিলাম ওকে , এতটাই যে তোকে পর্যন্ত তখন ঘৃণা হতো আমার... তুই চলে যাওয়াতে মিথ্যে বলবো না, খুশিই হয়েছিলাম জানিস...আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয় সময়ের সাথে... আমি এত তলিয়ে গিয়েছিলাম"... বলে একটু শ্বাস নেয়..যেন খুব যন্ত্রণা চেপে কোনোমতে কথাগুলো বলছে.."ভালোবেসে.. শয্যাসঙ্গিনী হতেও দ্বিধা করিনি আমি..কিন্তু হঠাৎ ওর ট্রান্সফার অর্ডার আসতেই সব পাল্টে গেলো ,চলে গেলো নৈঋত বাইরে, তাও আজ প্রায় চার বছর হলো .. ব্যাস.. আর জানিনা.. " আবার তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে কায়দা করে কৌশলে চোখ মোছে বিদিশা..
" প্রতারক কখনো এক প্রতারণায় থেমে থাকে না রে.. সেদিন আমার বেলা তুই ইন্ধন দিয়েছিলি, আজ তোর বেলায় অন্য কেউ দিচ্ছে.."ধীরে উদাস গলায় বলে আত্রেয়ী.." জানিস বিদিশা... মানুষ ফুরিয়ে গেলেও পাপচক্রের হিসেবের খাতা ফুরোয় না, সে সবটা বুঝে নেয় .. যে মানুষ নিজে হাতে তার চাকা ঘোরায়, একদিন সেই চাকার নিচে তাকেও পড়তে হয় রে... অব্যাহতি নেই "...
আত্রেয়ীর নিচু মৃদু স্বরে বলা কঠিন কথাগুলো শুনে ঠোঁট চেপে কোনোরকমে নিজেকে সামলায় বিদিশা..
গলা বুজে আসে কান্নায়.. কিছুটা সময় নেয়..
" ক্ষমা করে দিস.. আমি.. "শেষ করতে পারেনা, গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে যায়..
" অনেকপরে যখন বুঝেছিলাম, এক প্রতারককে আমার জীবন থেকে সরিয়ে নিয়ে চলে গেছে আমারই খুব কাছের এক ছদ্মবেশী বিশ্বাসঘাতক... সেদিনই ক্ষমা করে দিয়েছিলাম তোদের... বুঝেছিলাম, ইশ্বরের কৃপায় শাপে বর হয়েছে.."...


জোরে ব্রেক কষলো বাসটা.. তাড়াতাড়ি সীট ছেড়ে উঠে, বাস থেকে নেমে গেলো আত্রেয়ী.. নাহ্ এখন আর অবাঞ্ছিত কারো চোখ মুখের ভাষা পড়ার সময় নেই...
দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে অটো থামিয়ে তাতে উঠে পড়ে আত্রেয়ী.. আজ ছেলের স্কুলে প্যারেন্ট-টিচার মিটিং আছে.. হাতঘড়িটা দেখে নেয় তাড়াতাড়ি একবার,আগের বার দেরি হওয়ায় কি যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিলো, এবার সময়ের মধ্যে পৌঁছতেই হবে ওকে.......


*********সমাপ্ত********



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama