Harem & Women
Harem & Women
আচ্ছা, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের তো আকর্ষণ চিরন্তন, শুধু তাই নয় প্রবলও... আর যদি সেই নিষিদ্ধ বা বারণের নাম হয় 'হারেম'... তাহলে তো কথাই নেই.. অসীম আগ্রহ আর কৌতুহলের সাথে সাথে যেন এক মায়াবী নিষিদ্ধ আতরের সুবাস মাখা বাতাস এসে আমাদের মুখে, চোখে, নাকে ঝাপটা দিয়ে যায়.....
সাধারণ মানুষের অনুপ্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিলো বলেই হয়তো এই হারেম বা হেরেম সব যুগেই মানুষের কাছে দুর্দমনীয় কৌতূহল এবং আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অন্যতম মুখোরোচক আলোচ্য বিষয় ছিলো এবং আছে....
কেউ বলেন এটি তুর্কি শব্দ আবার কারো মতে, হারেম শব্দটি এসেছে আরবী ‘হারীম’ থেকে যার অর্থ নিষিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় সীমারেখা...হিব্রু এবং গ্রীক ভাষা অনুযায়ীও এই কথাটির অর্থ একই প্রায়.... এটি হলো মহিলাদের জন্য নির্ধারিত পবিত্র স্থান যেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ... তুর্কি সাম্রাজ্যেই প্রথম হারেমের উল্লেখ পাওয়া যায় যা পরবর্তীতে মুঘল সম্রাটদের মাধ্যমে উপমহাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব স্থান লাভ করে...
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইবরাহিম লোদীর বিরুদ্ধে বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়... মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্ক-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত.. মুঘল সাম্রাজ্য এমনিতেই পারস্য ও মধ্য এশিয়ার ভাষা ,শিল্প ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল, ফলে হিন্দুস্তানে অর্থাৎ ভারতে তাদের আগমন সমগ্র ভারতবর্ষের সংস্কৃতিতে অজস্র উপাদান যোগ করে....
সুদীর্ঘ শাসনকালে মুঘলরা শুধুমাত্র সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাগ্যই নিয়ন্ত্রণ করেনি, হিন্দুস্তানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক , শৈল্পিক সকলক্ষেত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিতও করেছিলো... 'মুঘল হারেম' তেমনই এক সংযোজন.....
হারেমের উল্লেখ প্রায় সকল রাজপরিবারের ভেতরেই পাওয়া যায়... এটি সেই স্থান যেখানে বসবাসের জন্য কেবল মাহরামের( ইসলামি পরিভাষায় 'মাহরাম' এর অর্থ, যাদের বিবাহ করা হারাম) প্রবেশাধিকার আছে... হারেমে সম্রাটদের একাধিক স্ত্রীরা তো থাকতই, আরো থাকত উপপত্নী, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা, আত্মীয়া এবং দাসীরা... অর্থাৎ হারেমে বসবাসকারী সবাই যে রাজরক্তের ছিলো না, তা নিয়ে কোনও অস্পষ্টতা নেই...
তখনকার সময়ে রাজার অনেক পত্নী আর উপপত্নী থাকবে এটাই ছিলো অত্যন্ত স্বাভাবিক... নিজেদের দাস-দাসী আর পত্নীদের সম্রাট নিজের ইচ্ছেনুযায়ী ব্যবহার করবেন সেটাও অবাক করার মতো ব্যাপার ছিলো না একেবারেই... হারেমে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব পেতো আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা....
অন্তঃপুরের একাংশে থাকতো বাদ্যযন্ত্র এবং হাতি, ঘোড়া ও রথের সাজসজ্জা... এগুলোর বিশেষ প্রয়োজন পড়তো পুরনারীদের ভ্রমণের সময়ে... সম্রাটের বিনোদনের জন্য হারেমে প্রায় সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রাখা হতো.. তাই সম্রাটের আত্মীয়-পরিজনের পাশাপাশি থাকত সঙ্গীতশিল্পী আর নৃত্যশিল্পীরাও.. মাঝে মাঝেই বসতো নৃত্যগীতের আসর.....
পৃথিবীর সমস্ত যুদ্ধপ্রিয় সম্রাটদের বিরুদ্ধে যেসব অপবাদ শোনা যায় তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য হলো যুদ্ধে জয়লাভ করার পর বিভিন্ন প্রদেশ কিংবা অঞ্চল থেকে নানান ধর্ম ও বর্ণের মেয়েদেরকে অধিগ্রহণ করে এনে নিজেদের হারেমে রাখা.... মুঘল হারেমেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি... কখনো কখনো নাকি হারেমে মেয়েদের সংখ্যা সাত আট হাজার ছাড়িয়ে যেতো... সম্রাট আকবরের হারেমেই নাকি প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি বেগম এবং সেবিকা ছিলো...!
হারেম নিয়ে মজার তথ্যেরও অভাব নেই.. সম্রাজ্ঞী, রাজকন্যা কিংবা সম্রাটের রক্ষিতারা সকলে নাকি প্রায় একভাবেই সাজগোজ করে থাকতো... বেণী করে আটকে রাখতো নিজেদের কেশ , ঝলমলে পোশাক আর মণিমুক্তার অলংকারে সজ্জিত হয়ে চারপাশ আলোকিত করে রাখতো তারা...সকলেই বুড়ো আঙ্গুলে ছোট্ট আয়না বসানো আংটি পরে থাকতো যার মধ্য দিয়ে তারা নাকি নিজেদের অতুলনীয় রূপের মোহিত করে দেওয়া প্রতিবিম্বের দিকে দিনভর চেয়ে থাকতো......!
এতো গেলো সাজসজ্জার কথা, এখন হারেমের পরিকাঠামোগত দিকে যদি তাকানো যায়, সেক্ষেত্রেও কিন্তু তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো তথ্য উঠে আসে ইতিহাসের গহ্বর থেকে....
হারেম সংস্কৃতির প্রথম দিকে প্রাসাদের অভ্যন্তরেই নারীদের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা থাকতো... পরবর্তীতে নারীদের জন্য প্রাসাদ থেকে পৃথক করে আলাদা ভবন নির্মাণের রীতি চালু হয়... মুঘল আমলেই হারেম পূর্ণাঙ্গ রাজকীয় পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকাশ লাভ করে.... শাহী পরিবারের নারীদের আবাসস্থলগুলো ‘মহল’ নামে পরিচিত ছিলো.. এছাড়াও জেনানা, মহল-সারা, হারেম-সারা, হারেম-গাঁ, মহল-সারা, রানীবাস ইত্যাদি নামেও হেরেমকে আখ্যায়িত করা হতো........
'আইন-ই-আকবরী' ও 'আকবরনামা'র লেখক আবুল ফজল মুঘল হারেমকে অভিহিত করেছেন ‘শাবিস্তান-ই-খাস’ নামে.... রাজপ্রাসাদের এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিলো মহল এলাকা... বাগান আর ফোয়ারার দিকে মুখ করে থাকা অগুনতি কামরা জুড়ে ছিলো হাজার দুয়েক নারীর বাস আর তাদের প্রত্যেকের জন্যই ছিলো পৃথক পৃথক মহল... এছাড়া আরো তিনটি প্রাসাদে সম্রাটের উপপত্নীগণ বাস করতেন.. এগুলোকে বলা হতো, লেথেবার ( রবিবার), মঙ্গল (মঙ্গলবার) এবং জেনিসার (শনিবার) মহল.. এই নির্ধারিত দিনগুলোতে সম্রাট নির্দিষ্ট প্রাসাদে যেতেন... এছাড়া, সম্রাটের বিদেশী উপপত্নীদের জন্য 'বাঙালি মহল' নামেও একটি পৃথক মহল ছিলো........
একটি হারেম বা অন্তঃপুরে বহু কক্ষের ব্যবস্থা থাকতো... আলাদা রন্ধনশালা, আলাদা প্রহরী, আলাদা স্নানকক্ষ কোনো কিছুরই অভাব ছিলো না.... দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি কক্ষের মধ্যে থাকতো আরো একাধিক কক্ষ.. এক কক্ষের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করা যেতো একাধিক কক্ষের অভ্যন্তরে... হারেমের চারদিক বহু প্রহরী ও প্রাচীর বেষ্টিত থাকতো.. এতোসব কক্ষ ও আয়োজনের মূল দরজা কিন্তু থাকতো কেবলমাত্র একটিই....
পাশাপাশি, মুঘল হারেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত কঠোর.. বহিরাগতের পক্ষে মুঘল হারেমে প্রবেশ করা রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিলো.. সূর্যাস্তের সময় হারেমের দরজা বন্ধ করে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হতো... খোজা (eunuch) প্রহরীরাই হারেমের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকতো.. এসকল খোজাকে ‘নাজির’ নামে অভিহিত করা হতো... প্রত্যেক রাজকুমারীর একজন করে নাজির থাকতো যার ওপর তিনি গভীর আস্থা স্থাপন করতেন... হারেমের বেগমদের কারো কোনো সামগ্রীর প্রয়োজন হলে তারা হারেমের কোষাধ্যাক্ষের কাছে আবেদন করতো.. হারেমে ব্যবহারের জন্য আলাদা রকমের মুদ্রার প্রচলন ছিলো যা বাইরে পাওয়া যেতো না....
'হারেম' কথাটি শুনলেই যেন সাথে সাথে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে মহা আড়ম্বরপূর্ণ গদি, বিলাসবহুল শয্যা.. মখমলের বেশ কিমতি আচ্ছাদনের ওপর অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে উপবিষ্ট থাকা নৃত্যপটিয়সী নারী... পাশেই সুদৃশ্য পাত্রে বিভিন্ন অজানা রাজকীয় দেশী বিদেশী ফলের সমাহার, এবং এই সমস্ত কিছুর মাঝে মধ্যমণি হয়ে আয়েশ করে বসে আছেন সম্রাট, হাতে তার স্বর্ণপাত্রে সুরা ইত্যাদি ইত্যাদি...
কিন্তু তা সম্পূর্ণ সঠিক নয়... হারেম যে শুধুমাত্র রাজা বাদশাহদের চিত্তবিনোদনেরই স্থান ছিলো তা তো নয়, বরং তা ছিল সম্রাটের কাছের রমণীদের নিরাপদে রাখার একটি সুরক্ষিত স্থান.... হারেমের দারোগা ও তত্ত্বাবধায়করূপে নিয়োগ পেতেন সচ্চরিত্র মহিলাগণও.. হারেমের সর্বোচ্চ পদাধিকারী মহিলা কর্মচারীকে বলা হতো ‘মহলদার’... এরা সম্রাটের গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করতেন.. হারেমে অবস্থানকারী মহিলাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে তারা নিয়মিত সম্রাটকে অবহিত করতেন..
মহলদারের হস্তক্ষেপের কারণে প্রায়ই রাজকুমারদের সাথে তার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠতো... মহলদারের তীক্ষ্ম নজরদারী রাজকুমারগণ পছন্দ করতেন না....
আচ্ছা, সব জায়গাতেই তো রাজনীতি, আর হারেম এতোবড় একটা ব্যবস্থাপনা তার অভ্যন্তরে কি কোনও রাজনৈতিক গন্ধ ছিলো না? মুঘল হারেমের অভ্যন্তরে কি কোন রাজনীতি ছিল না? সত্যি বলতে কি ছিল বৈকি, একেকটি মহল ছিলো একেকটি জটিল রাজনৈতিক কেন্দ্র.. প্রত্যেক উজির-আমীর তাদের একটা দুটো মেয়েকে মহলে ঢুকিয়ে দিতে উদগ্রীব থাকতো এবং এর জন্য হারেমের মহলদারের সাথে মিলে নানান চক্রান্ত এমনকি দুরভিসন্ধির আশ্রয় নিতেও তারা পিছ পা হতো না... কারণ, একবার যদি কন্যা স্বয়ং সম্রাটের চোখে পড়ে যায় তাহলেই কেল্লা ফতে...!
অনেকসময় বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত সম্ভ্রান্ত বংশের অভিজাত স্ত্রীরাও হারেমের অভিজাত বা রাজবংশীয় স্ত্রীদের সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে তাদের দর্শন প্রার্থনা করতেন... এইভাবে সাম্রাজ্যের কোনো অভিজাতের স্ত্রী যদি হারেম দর্শনে অভিলাষী হতেন তাহলে তাকে প্রথমে হারেমের কর্মচারীদের অবহিত করতে হতো.. কর্মচারীগণ প্রাসাদ কর্মকর্তাদের কাছে এরূপ আকাঙক্ষার কথা জানাতো... এরপর যদি দর্শনপ্রার্থী হারেমে প্রবেশের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতেন তবেই তাকে প্রবেশাধিকার দেয়া হতো......
এছাড়াও হারেমকে সুরক্ষিত রাখতে অন্যান্য ব্যবস্থাও সম্রাটরা গ্রহন করেছিলেন... হারেমের ভেতরে বাইরে লাগানো হতো জীবন্তী, শ্বেতা মুস্কক ও বন্দক লতার গাছ... ওই লতাসমূহকে তুলে দেয়া হতো পেজাত এবং অশ্বথ গাছের ডালে.... কারণ এসব লতা ও গাছের জন্য নাকি বিষধর সাপ ভেতরে ঢুকতে পারতো না... আরো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পোষা হতো বিড়াল, ময়ূর, বেজি ও চিত্রল হরিণ.. কারণ এই সমস্ত প্রাণী সাপ দেখলে আক্রমণ করতো, এবং খেয়েও ফেলতো...
শুধু তাই নয়, হারেমের ভেতরে সাপের বিষ নির্ণয় করার জন্য পোষা হতো টিয়া, সারিকা ও ভৃঙ্গরাজ পাখি.. সাপের বিষের গন্ধ পেলেই এসব পাখি ছটফট শুরু করতো.. এছাড়াও, খাদ্যে বিষ নির্ণয়ের জন্য আরো পোষা হতো ক্রৌঞ্চ, জীবঙ্গ-জীবক, মত্ত কোকিল ও চকোর পাখি.. আশপাশে বিষ থাকলে নানারকম প্রতিক্রিয়া হতো এসব পাখিদের মধ্যে... যেমন, ক্রৌঞ্চ মূর্ছা যেতো, জীবাঙ্গ-জীবক অবসন্ন হয়ে পড়তো, মত্ত কোকিল মারা যেতো, আর রক্তবর্ণ ধারণ করতো চকোরের চোখ... বস্তুত, সেকালের শাসকরা বিষ প্রয়োগের ব্যাপারে সবসময়ই আতঙ্কিত থাকতেন..
আচ্ছা, হারেমের নারীরা রূপে স্বর্গের অপ্সরাদের সমতুল্য মনে হলেও তারা তো ছিলো সাধারণ মানুষই, আর তাই অসুস্থও হতো নিশ্চয়ই....
তবে কেমন ছিলো সে ব্যবস্থা, এই বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, হারেমের অন্যান্য বিষয়ের মতো এর চিকিৎসা ব্যবস্থাও ছিলো বেশ কঠোর নিয়মে আবদ্ধ এবং অনন্য.. হারেমের অভ্যন্তরে ‘বহিরাগত’ পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো বলে হারেম-রমণীদের শল্যচিকিৎসার ভারও ছিল নারীদেরই ওপর.. এদের বলা হতো, ‘জারাহ’.. তবে রোগীদের অবস্থা যখন জারাহদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেত, তখন বাধ্য হয়েই পুরুষ হাকিমদের ডেকে পাঠাতে হতো বেগমের খাস কামরায়.....
তাদেরকে হারেমে নিয়ে যাওয়ার ঝক্কিও কম ছিলো না... বেগমের জন্য নির্ধারিত 'খোজা'র কঠিন পাহারায় আপাদমস্তক কাশ্মীরি শালে মুড়ে অন্ধের মত তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হতো... কেউ তার চেহারা দেখতো না, তিনিও কাউকে দেখতে পেতেন না.. ভেতরে প্রবেশের পরেও শাহী নিয়ম অনুযায়ী, 'বাতচিত' করা যেত না সরাসরি বেগমের সাথে....!
বেগমের খাস দাসী বা বাদীর মুখে তার বিবরণ শুনে সেই মতো চিকিৎসা বা ওষুধের ব্যবস্থা করা হতো... হারেমের এক প্রান্তে, বিশেষ করে পেছন দিকে, থাকতো ধাত্রীবিদ্যা ও বিভিন্ন ব্যধিতে ব্যবহৃত ওষুধ ও পথ্যের ভাঁড়ার... সেইসময় মুসলিম ও হিন্দু শাসনামলে হারেমের নারীকুলের জন্য আলাদা চিকিৎসালয় স্থাপন করাটা গণ্য হতো অত্যাবশ্যক হিসেবে....
হারেমের নারীগণ রূপের পাশাপাশি গুণেরও কি পরিচায়ক ছিলেন না?.. সাম্রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে তাদের কি আদৌ অবদান ছিলো, থাকলে কিরকম, বা কতটা প্রসারিত ছিলো তাদের সে ভূমিকা.... ইতিহাসের সে পাতায় উঁকি দিলে দেখা যায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে বিশেষ বিশেষ কিছু নারীদের নাম যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন চূড়ান্ত সফল এবং আজও তারা তাদের ক্ষমতা, গুণ এবং বুদ্ধিমত্তার জোরে সমভাবে সমাদৃতা...
মুঘল রাজবংশীয় পুরুষেরা যেমন তাদের দোর্দন্ড প্রতাপে ভারতবর্ষকে শাসন করেছে,শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা যেভাবে শাসনের উত্তাপ ছড়িয়েছে, তেমনি মুঘল হারেমের নারীরাও কিন্তু পিছিয়ে ছিলেন না, তারাও ছিলেন দারুন অগ্রসর, কেউ কেউ নিজেদের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন বাদশাহ বা শাহজাদার বিকল্প নীতিনির্ধারকও....
হারেমের নারীরা প্রয়োজনীয় প্রাথমিক শিক্ষা গৃহের অভ্যন্তরেই পেতেন, অনেক মুঘল নারীই বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষত সাহিত্য, কাব্য ও শিল্পকলায় উচ্চতর শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়েছিলেন যার পরিচয় মুঘল সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্থাপত্য শিল্পে আজও ভাস্বর... তাছাড়া হারেমের নারীগণ মধ্য এশীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রায় সকলেই অশ্বারোহণ করতেন এবং এটি সেসময় খুবই স্বাভাবিক ছিলো... তারা পোলো খেলতেন, এমনকি স্বামীর সহগামীরূপে শিকারেও গমন করতেন...
মুঘল হেরেমের রমণীকুলের মধ্যে নানা কারণে বিখ্যাত যেসব নারী সুবিখ্যাত হয়ে আছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাবার-কন্যা গুলবদন বেগম, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, শাহজাহান-পত্নী সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহল, দারাশিকোর স্ত্রী নাদিরা বেগম, আওরঙ্গজেব কন্যা জেবুন্নেসা, শাহজাহান-কন্যা রওশন আরা, শাহজাহান দুহিতা জাহানারা এবং বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী জিনাত মহল....
আবার, পুত্র জাহাঙ্গীর যখন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তখন বিমাতা সেলিমা বেগমই মধ্যস্থতা করে শান্তি স্থাপন করেছিলেন.. পাশাপাশি, দারাশিকোর কন্যা শাহজাদা আযমের স্ত্রী এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্রবধূ দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন....
তবে প্রায় সকলেই নানা কারণে ও যোগ্যতায় আলোচিত-বিখ্যাত হলেও নূরজাহান, জাহানারা এবং জেবুন্নেসা ইতিহাস অন্য সকলের চেয়ে আলাদা, বিশেষ, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, এবং অবশ্যই উল্লেখযোগ্য.....
বিশেষত, নূরজাহান বা ‘জগতের আলো’....
নূরজাহান বা 'জগতের আলো' (প্রকৃত নাম, মেহেরুন্নিসা বেগম) নামে খ্যাত এই মুঘল রমণী কেবল ভারতবর্ষ বা মুঘল ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেরই এক বিস্ময়কর নারী ব্যক্তিত্ব... তাবৎ পুথিবীর ইতিহাসে তাঁর সমকক্ষ নারী খুব কমই দেখা গেছে.. মোগল প্রশাসন ও কীর্তিতে নূরজাহানের পারিবারিক অবদানও অনস্বীকার্য.. তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী মমতাজ মহল বিশ্ববিস্ময় তাজমহলে চিরশায়িতা, দৌহিত্রী বাদশাবেগম জাহানারা মোগল ইতিহাসে কল্যাণময়ীর উজ্জ্বল-প্রতীক... তাঁর অধস্থন বংশধর আওরঙ্গজেব-কন্যা জেবুন্নিসা ললিতকলায় অবদানের জন্য চিরনন্দিতা...
নূরজাহান ছিলেন রূপ এবং গুণের আকড়...তার কাব্য-প্রতিভা স্বরচিত ফারসি কবিতার বই 'দিওয়ানে মাকফি'তে লিপিবদ্ধ, যা তার উচ্চতর কবি পরিচয়কেও অন্যবিধ দক্ষতার পাশাপাশি সমভাবে তুলে ধরে...
স্বামী জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাঝে মাঝে স্বরচিত কবিতায় বাক্যালাপ করতেন, যাকে বলা হয় ‘নাজ’ ও ‘নাখরা’...
আবার এককভাবে স্বরচিত কাব্যপাঠ বা ‘মুশায়েরা’ তাঁর সময় থেকেই উপমহাদেশের সাহিতাঙ্গনে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে এবং তার প্রসারও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে... পরবর্তীকালে এই মুশায়েরা উত্তর ভারতের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যা এখন পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে... নূরজাহানের নিজস্ব-ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিলো...তিনি ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতা, সম্রাজ্ঞী হওয়ার পূর্বে তাঁর আপন হস্তাক্ষর মির্জা কামরানের 'দিওয়ান'-এর প্রথম পাতায় পাওয়া যায়....
নূরজাহান প্রকৃত পক্ষে কত ক্ষমতাবান এবং মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন, তার প্রমাণ তিনি জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও রেখে গেছেন... আওরঙ্গজেব তাঁর ক্ষমতাকে প্রাসাদভিত্তিক প্রতিরোধ ও আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য নূরজাহানকে নজর বন্দি করে রাখেন... মৃত্যুর পর দিল্লিতে অবস্থিত তাঁর মাজার পবিত্র স্থান হিসাবে আপামর জনসাধারণের সমাবেশের স্থানে পরিণত হলে সিপাহি বিদ্রোহের পর পরই ভীত ইংরেজ প্রশাসন মাজারকে দিল্লি থেকে সরিয়ে লাহোরে স্থানান্তরিত করে, যা এখনও সেখানে তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠিত শালিমার বাগে অবস্থিত রয়েছে.....
বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর ভাগ্যের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে নূরজাহানের ঐশ্বর্যময় জীবন.. প্রথম যৌবনে বধূবেশে নূরজাহানের বাঙলাতেই আগমন ও অবস্থান, এরপর সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি এই বাঙলাতেই বিবাহিত জীবন-যাপন করেছিলেন... বাঙলাপ্রীতির স্বাক্ষরও দেখা যায় নূরজাহানের জীবন-ইতিহাসে... নূরজাহান লাহোরের নলখা বাঙালি মহল ভবন স্থাপন করেন বাংলার কুটির আর মোগল স্থাপত্যের মেলবন্ধনে... নূরজাহানের পৃষ্ঠপোষকতাতেই পরবর্তীকালে ঢাকাই মসলিনের একটি নতুন ধারা এবং নকশার প্রবর্তন করা হয়, যাকে বলা হতো ‘আবে রাওয়াঁ’ বা ‘জলের ইন্দ্রজাল’....
কুশলী নূরজাহান নানা নতুন ধরনের এবং নতুন কায়দার পোশাকের উদ্ভাবক ছিলেন.... তাঁর সময় দস্তরখানের ব্যবহার, চোলি বা আধুনিক ব্লাউজের প্রচলন, পোশাকে বোতাম, বাদলা, কিঙ্গারি, ওড়না, অন্তর্বাস, নৈশবেশ, কুর্তা, শিলওয়ার, কামিজ এবং জরির লেসের উদ্ভব ও প্রচলন করেন তিনি, যা এককথায় তখনকার ভারতবর্ষে ছিলো অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব....
এছাড়া, সৌন্দর্য্যচর্চায় অপরূপ সুন্দরী নূরজাহানের সবচেয়ে খ্যাতনামা আবিষ্কার গোলাপের আতর, যার পোশাকী নাম ‘আতরে জাহাঙ্গীরী’.... তাঁর বিশিষ্ট স্নানঘরটিও রীতিমত একটি আগ্রহ এবং গবেষণার বিষয়... বিলাসবহুল স্নানগৃহের টাবে গোলাপ মিশ্রিত জলে তরলাকার ভাসমান পদার্থের মধ্যে গোলাপের নির্যাস ছড়িয়ে রাখা হতো.... নূরজাহানের স্নানের গোলাপ জলে আতর, চন্দন, রূপটান ও অন্যান্য বহু প্রসাধনী সামগ্রী মিশ্রিত থাকতো...
সুকন্যা নামক এক গবেষক নূরজাহান শিরোনামের এক জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন: “নূরজাহান নিজে সুরভিত হতেন গোলাপ নির্যাসের স্নানে, যার দৈনিক খরচ পড়ত তৎকালীন তিন হাজার টাকা..”....
নূরজাহান তখনও এই নামে খ্যাত হননি, তখনও তিনি মেহেরুন্নিসা, তার প্রথম স্বামী বাংলার রাঢ়-বর্ধমান অঞ্চলের জায়গিরদার শের আফগান আলি কুলি বেগের বিবাহিতা স্ত্রী... কিন্তু শের আফগান বেশিদিন সুখে জীবন অতিবাহিত করতে পারেননি, দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিবাদের জেরে তিনি নিহত হন অচিরেই...
কথিত আছে, প্রেয়সী নূরজাহানকে বিবাহ করার সুপ্ত অভিপ্রায়কে চরিতার্থ করার জন্যই নাকি সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণের পরেই নূরজাহানের স্বামীকে অছিলায় হত্যা করেন....
স্বামীকে হারিয়ে বিধবা নূরজাহান তেত্রিশ বছর বয়সে বিজয়ী দিল্লির সৈন্যদল কর্তৃক আটক হয়ে একমাত্র কন্যাকে(লাডলী বেগম)সঙ্গে নিয়ে আগ্রার দুর্গে চার বৎসর বন্দি এবং বৈধব্যের জীবন কাটান.... এখানে আসার পরেই সম্রাট জাহাঙ্গীর এক মিনাবাজারে নূরজাহানের রূপ-লাবণ্য দর্শনে পুনরায় মুগ্ধ হয়ে কেবল বিবাহ নয়, তাঁর প্রধান রাজমহিষীর মর্যাদা প্রদান করেন... সাঁইত্রিশ বছর বয়সী মেহেরুন্নিসা বেগম তখনও অপূর্ব রূপসী...
তিনি অতি অল্প দিনের মধ্যেই নিজের সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা ও কূটনৈতিক দক্ষতার জোরে সম্রাটের হৃদয়ে, জীবনে তথা দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক অনন্য স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন... তার রূপ এবং গুণে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে 'নূরজাহান' নামে আখ্যায়িত করেছিলেন.....
সম্রাট জাহাঙ্গীরের মদ্য ও আফিমের প্রতি তীব্র আসক্তি থাকায় নূরজাহানই গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় ভূমিকা পালন করেন, তাকেই সিংহাসনের পেছনের মূল শক্তি ধরা হয়.. তিনি শুধু ঐতিহাসিকভাবে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারিণীই ছিলেন না সেই সাথে ভারতীয় সংস্কৃতি, দাতব্য কাজ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও লৌহমানবীর ন্যায় ক্ষমতা পালনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন......
অবস্থা এতোটাই নূরজাহানের অনুকূলে চলে আসে যে, ইন্দ্রানী মুখার্জী মুঘল হারেম: কয়েকটি নিদের্শনামা গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে, “জাহাঙ্গীর নাকি বলতেন, আমি মদ ও মাংসের কথা জানি, সাম্রাজ্যের খবর রাখেন নূরজাহান..”.....
শুধু প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই নয়, নূরজাহান মোগল হেরেমে এসে পারিবারিক কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠা করেন... নূরজাহানের আগমনের পর জাহাঙ্গীরের বহুনারীবিশিষ্ট হেরেমে একস্বামী-একস্ত্রীর দাম্পত্যের সূচনা ঘটে... তিনিই প্রথম মোগল সম্রাজ্ঞী যিনি ঝরকায় সম্রাট যখন প্রজাদের দর্শন দিতেন, তখন সম্রাটকে পাশে থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দান করতেন.... তিনি প্রজাদের মনে রাজা-রাণীর যৌথতায় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক সৃষ্টি করেন... এছাড়াও তিনিই একমাত্র মুঘল সম্রাজ্ঞী, যাঁর নাম রৌপ্যমুদ্রায় অঙ্কিত আছে.. তার এতোটাই প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে প্রচলিত মুদ্রায় তার নামাঙ্কিত হয়েছিলো.....
রাজ্যশাসন ছাড়াও যুদ্ধ এবং শিকার যাত্রায় নূরজাহান সম্রাটের সহগামী হতেন... নূরজাহান শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন.... উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, তিনি নিজে বন্দুক চালিয়ে অনেক বাঘ শিকার করেছেন.. তিনি প্রায়ই সম্রাটের সাথে বাঘ শিকারে যেতেন, এমনকি শক্তিশালী বাঘ শিকারি হিসেবে তার খ্যাতিও ছিলো..তার বীরত্বের কবিতাও লিখেছেন অনেক কবি....
কথিত আছে, তিনি ৬ টি গুলি দিয়ে ৪ টি বাঘ শিকার করেছিলেন... তার এই অভেদ্য নিশানা দেখে মুগ্ধ সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে এক লক্ষ মুদ্রার সমমানের হীরার চূড় এবং এক হাজার আশরাফি(gold coins coin issued by Muslim dynasties in the Middle East, Central Asia and South Asia. It was worth two mohurs-মোহর) উপহার দেন.....
সম্রাজ্ঞীর উপযুক্ত শিকারের পোশাক ব্রিচেস ও হান্টিং কোট তৈরির জন্যও সম্রাট জাহাঙ্গীর ইংরেজ কোম্পানিকে নিদের্শ দেন....
এছাড়া,ইংরেজ দূত স্যার টমাস রোঁ লিখে গেছেন, মেহের আসলে দেশ শাসন করতো, জাহাঙ্গীর ছিলো নামকেওয়াস্তে সম্রাট...! জনৈক স্যার টমাস রোঁ প্রদত্ত ল্যান্ডো গাড়িটি জাহাঙ্গীর তাঁর বিবাহ বার্ষিকীতে সর্বপ্রথম নূরজাহানকে সঙ্গে নিয়েই ব্যবহার করেছিলেন... সেই বিবেচনায় উপমহাদেশে প্রথম আধুনিক মোটর গাড়ি ব্যবহারের কৃতিত্ব সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নূরজাহানেরই...
কাচ্চি বিরিয়ানির প্রবর্তনকারীও সম্রাজ্ঞী নূরজাহান... তিনি তাদের বিবাহ বার্ষিকীতে অভ্যাগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য প্রথম মৃগনাভি সুরভিত জাফরানি কাচ্চি বিরিয়ানি পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন.....
প্রতিভাধর নূরজাহানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত দু'টি স্থাপত্যকীর্তিই সমাধিসৌধকেন্দ্রিক... প্রথমটি আগ্রায় পিতা ইতিমুদ্দৌলার সমাধিসৌধ... অপূর্ব মোজাইকের কারুকাজ করা স্থাপত্যশিল্পটি সম্পূর্ণ মর্মর দিয়ে নির্মিত পিটাড়ৌরার চিত্রে শোভিত রত্নালঙ্কারের মতোই মনোমুগ্ধকর.. পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু এই সমাধিসৌধকে ‘স্থাপত্যের রত্ন’ বলে প্রশংসা করেছেন...আবার, পার্সি ব্রাউন এই সুনির্মাণটির সুখ্যাতি করে বলেছেন ‘নান্দনিক আদর্শের পরাকাষ্ঠা’...
নূরজাহান নির্মিত দ্বিতীয় স্থাপত্যকর্মটি হলো, লাহোরের শাদারায় অবস্থিত পতি-সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধ.. সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর চক্রান্তে অসফল হয়ে ভাগ্যবিড়ম্বিতা নূরজাহান আপন ভাগ্য মেনে নিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান... এমন কি মোগল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি-আগ্রাও ত্যাগ করেন তিনি... শান্তিময় নির্বিরোধী জীবন-যাপনের জন্য তিনি সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন আপন বিধবা কন্যাকে এবং বসবাসস্থল হিসাবে নির্ধারণ করেন স্বীয় স্বামীর স্মৃতিময় শহর লাহোরকে.... সম্রাট শাজাহান তার অন্যতম সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী নূরজাহানের নির্বিবাদী জীবন-যাপনে স্বস্তি বোধ করেন এবং তার জন্য বাৎসরিক দু লক্ষ টাকা ভাতা বরাদ্দ করেন.... তাঁর সময় অতিবাহিত হতে থাকে স্বামীর সমাধিসৌধ নির্মাণের কাজে, সাহিত্য কাব্য চর্চায় এবং দীন-দুখীদের মধ্যে দান-খয়রাত করে.....
শেষ বয়েসে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁকে বিপদজ্জনক মনে করে আগ্রা দুর্গে বন্দি করেন.. বাহাত্তর বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নূরজাহান... তার ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুর পর তাকে স্বামীর সমাধিস্থল লাহোর শহরে শেষ নিদ্রায় সমাহিত করা হয়... ভাগ্যের প্রবল উত্থান আর পতনে টালমাটাল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ক্ষমতা, যোগ্যতা, কুশলতা আর সৌন্দর্যপ্রিয়তায় উজ্জ্বল নিদর্শনের মতোই নিজের অতি সাধারণ সমাধিতে খোদিত করে রেখেছেন স্বরচিত বিখ্যাত কয়েকটি কথা: “বর মাযারে-ই মা গরীবান নই চিরাগি নাই গুলে/ নে পর-ই পরওয়ানা সুজদ নই সদা-ই বুলবুলে....”....
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ফারসী ভাষায় লিখে যাওয়া নূরজাহানের এই কথাকটির বাংলা অনুবাদ করেন: "গরীব গোরে দ্বীপ জেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে/ শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে..."........
..............................
সুদীর্ঘ মোগল ইতিহাসে নূরজাহানের পরেই বহুমাত্রিক যোগ্যতা আর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য স্থান পায় জাহানারার....
শাজাহান-মমতাজ দুহিতা, জাহাঙ্গীর-নূরজাহান দৌহিত্রী জাহানারা মোগল সংস্কৃতির সুকুমার গুণে উজ্জ্বল ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী.... তাঁর অবস্থান প্রথাগত নারীর শেষ প্রান্তে এবং আধুনিক নারীর প্রথমার্ধে.... ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগো, শাহজাদা দারাশিকো গ্রন্থে লিখেছেন: “পুণ্যশীলা জাহানারা বেগম মহিমাময়ী নারী, সম্রাট পরিবারের পারিজাত প্রসূন... তাঁকে কখনও কুদসিয়া বেগমও বলা হতো...”
প্রসঙ্গত, মোগল হেরেমে নারীদের পদ-মর্যাদা ও ক্ষমতাগত অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে... মোগল সম্রাটগণ শাহী মহলের কর্তৃত্ব দিয়ে ‘পাদশা বেগম’ (বাদশাহর ফারসি উচ্চারণ পাদশা) পদ-মর্যাদা দান ছাড়া কোন কোন মহিলাকে সীমিতভাবে ‘নির্দেশিকা ক্ষমতা’ দান করতেন...তাঁদের মধ্যে রাজমাতা, রাজমহিষী, রাজকন্যা ইত্যাদি পদবী ছিল..রাজমাতার নিদের্শিকাকে বলা হতো ‘হুকুমনামা’, অনুরূপ অধিকার রাজমহিষীও ভোগ করতেন.. রাজকন্যা বা বাদশাজাদীর নির্দেশিকাকে বলা হতো ‘নিশান’...এগুলো প্রশাসনিক নির্দেশিকার সমতুল্য.... এই ক্ষমতা বা অধিকার 'শরিয়ত' বিধানে নেই.. সম্পূর্ণ মোগল রাজশক্তির সৃষ্ট অধিকার বা ক্ষমতা মোগল নারীর বিশেষ উচ্চ মর্যাদার তথ্য জ্ঞাপন করে... এইভাবে নূরজাহানের কিছু হুকুমনামা এবং জাহানারার দশটি নিশানের সংবাদ পাওয়া যায়.....
বিখ্যাত মাতা মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর পিতা সম্রাট শাজাহান অন্য পুররমণীগণের বদলে জাহানারাকেই কেবল শ্রেষ্ঠ মর্যাদা ‘পাদশা বেগম’ প্রদান করেন, যা নূরজাহান বা মমতাজের মতো সম্রাজ্ঞীর বিশেষণ ছিল এবং জাহানারাই একমাত্র মোগল রমণী যিনি সম্রাজ্ঞী না-হয়েও কেবলমাত্র শাহজাদী থেকেও ‘পাদশা বেগম’ পদ লাভ করেছিলেন... সম্রাট শাজাহান কন্যাকে সর্বোচ্চ নারীর পদাধিকারী করার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজ প্রসাদের বাইরে আপন মহল তৈরি করে বসবাস করার অধিকারও দিয়েছিলেন এবং ব্যবস্থা করেছিলেন স্বাধীনভাবে পর্যাপ্ত আয়-উপার্জনেরও...
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালীন ধনী সম্রাট সুরুচিশীল শাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা রূপে-গুণে-শিক্ষায় অদ্বিতীয়া ছিলেন এই জাহানারা... তাঁর শিক্ষার জন্য সতিউন্নিসা নামের উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষয়েত্রী নিয়োগ করেন পিতা.. মাতার মৃত্যুর পর রাজমহিষীর প্রাপ্য ‘পাদশা বেগম’ মর্যাদা পেয়ে তিনি হলেন শাহী মহলের সর্বময়ী কর্ত্রী... আওরঙ্গজেব সম্রাট হবার পরও তাকে সেই উচ্চ পদ-মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করেননি.. ত্রিশ বৎসর ধরে তিনি দিল্লি-আগ্রার শাহী সীলমোহর সংরক্ষণের অধিকারিনী থাকেন, যদিও তিনি ভ্রাতার জিজিয়া কর আরোপের বিরোধী ছিলেন... সুরাটের বাণিজ্য শুল্ককরের জায়গির তাকে দেওয়া হয়, যার বার্ষিক আয় ছিল তৎকালীন ছ লক্ষ টাকা.. বিভিন্ন উৎস থেকে এক পর্যায়ে জাহানারার বার্ষিক আয় দাঁড়ায় সে আমলের সতের লক্ষ টাকা.. আপন কর্তৃত্বাধীনে শিল্প-কল-কারখানা পরিচালনা করতেন তিনি এবং তাঁর নিজের জাহাজ পর্যন্ত ছিলো... তাছাড়া তিনি পণ্য চালানের জন্য ওলন্দাজ ও ইংরেজ জাহাজ ভাড়া করতেন..এই সকল তথ্য জানিয়েছেন ইরফান হাবিব, মধ্যযুগের ভারত গ্রন্থে....
নূরজাহানের মতোই জাহানারারও নিজস্ব পাঠাগার ছিলো.. একইভাবে তিনিও প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন দান-খয়রাতে... বিশেষত দরিদ্র-পীড়িতদের আর বিবাহাদির প্রয়োজনে তিনি মুক্ত হস্তে দান করতেন... তিনিও সুন্দর সুন্দর ভবন নির্মাণ করেন.. তাঁর নির্মিত অপূর্ব সুন্দর দিল্লির সরাইখানার স্থাপত্যশৈলী ও সৌন্দর্য দেখে বিখ্যাত পর্যটক বার্নিয়ার প্যারিসেও অনুরূপ সুন্দর ভবনের প্রতিষ্ঠা কামনা করেন... পিতার বিশ্বখ্যাত তাজমহল নির্মাণের নেপথ্যে ছিলো জাহানারার প্রণোদনা... শাজাহান বলতেন, তিনি মমতাজের কল্যাণময়ী প্রতিরূপ কন্যা জাহানারার মধ্যে দেখতে পান....
নূরজাহানের মতোই জাহানারাও মোগল প্রশাসনের অন্যতম মন্ত্রণাদাত্রী এবং ছিলেন সম্রাটের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন পরামর্শদাত্রী.. ১৬৫৮ সালে শাজাহান পীড়িত হলে মোগল ক্ষমতা লাভ বিষয়ে ভ্রাতৃবিরোধ তুঙ্গে উঠে এবং সেই প্রায়-গৃহযুদ্ধাবস্থায় জাহানারার বিশেষ ভূমিকা উল্লেখ করার মতো বিষয়.... জাহানারা ভাগ্যাহত-উদারমতি দারাশিকোর পক্ষপাতী ছিলেন যদিও তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে রক্তপাতের ঘোরতর বিরোধী... সেকালের প্রথানুযায়ী, দারার সঙ্গে তার মাতা-পুত্রের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং দারাশিকোর বিবাহে যে ত্রিশ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়, তার সিংহ ভাগ অর্থাৎ চোদ্দ লক্ষ টাকা জাহানারা আপন তহবিল থেকে প্রদান করেন... দারার প্রতি আকর্ষণ তাঁর মতে দারার হৃদয়ের বিশালতা ও আত্মার মহত্ত্বের জন্য... আওরঙ্গজেব সম্পর্কে তিনি বলতেন, তার কাছে দুনিয়া নীতিবাক্যে আবর্তিত......
ক্ষমতার যুদ্ধে অবশেষে যদিও দারা পরাজিত, পলাতক, ধৃত, বন্দী ও পরিশেষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং পিতা শাজাহান আগ্রা দুর্গে বিজয়ী পুত্র ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দী হন, তথাপি জাহানারা পক্ষ-ত্যাগ করেননি.. দুর্লভ পিতৃস্নেহের ঐতিহাসিক ও মানবিক দৃষ্টান্ত রেখে জাহানারা স্বেচ্ছায় পিতার সঙ্গে কারাবাস গ্রহন করেন... তিনি সুদীর্ঘ নয় বৎসর পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বন্দী জীবন-যাপন করেন এবং পিতার কারা-যন্ত্রণা লাঘব করতে চেষ্টা করেন... এহেন বিষাদময় পরিস্থিতিতে পিতা শাজাহান কন্যা জাহানারার কোলে মাথা রেখে তাজমহলের দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, যে সকরুণ দৃশ্য কল্পনেত্রে এঁকেছেন শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত শাজাহানের মৃত্যু চিত্রকলায়.... পিতার প্রতি কন্যার এই দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্যবোধের নজীর বিশ্ব ইতিহাসে বিরল.... অনেকেই জাহানারাকে স্বীয় অবদানের জন্য শেক্সপিয়র বর্ণিত কিং লিয়ারের কন্যা কর্ডেলিয়ার সঙ্গে তুলনার করে থাকেন........
জাহানারা একাধারে ছিলেন সুকবি... স্বরচিত কাব্যশ্লোক তাঁর সমাধিতে খোদিত রয়েছে... দিল্লির বিখ্যাত সর্বজনশ্রদ্ধেয় সূফীসাধক নিযামুদ্দিন আউলিয়ার ভক্ত ছিলেন তিনি এবং তার মাযারে প্রচুর অর্থ অনুদান প্রদান করেন... এমন কি, জাহানারার অন্তিম ইচ্ছানুসারে, তিনি এই মহান আউলিয়ার সমাধি পাশে মুক্ত আকাশের নীচে চিরনিদ্রায় শায়িতা রয়েছেন, যে কবরের উপর কোন সৌধ নেই.. কেবল সমাধি ফলকে খোদিত রয়েছে বিখ্যাত স্বরচিত শ্লোক: “বেগায়র সবজা না পোশদ বসে মাযারে মারা/ কে কবর পোশে গরিবান গিয়াহ বসন্ত...”
দৃষ্টিপাত গ্রন্থে যাযাবর যার অনুবাদ করেছেন: “একমাত্র ঘাস ছাড়া আর যেন কিছু না থাকে আমার সমাধির ওপরে/ আমার মতো দীন অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন...”
কী অপূর্ব আত্মত্যাগ আর সংযমবোধ মিশে আছে জাহানারার জীবন ও মরনে! যিনি নেপথ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও সৌন্দর্যমন্ডিত সমাধিসৌধ তাজমহলের নির্মাণ-উৎসাহ প্রদানকারী এবং যিনি নিজেও স্বীয় সমাধিকে গৌরবময় স্থাপত্যে অভিষিক্ত করার মতো অঢেল সম্পদের অধিকারিনী ছিলেন, সেই তিনি নিজে সাদামাটা কবরের মাধ্যমে নিজের শেষ চিহ্নটুকুকে আবেগময় মাধুর্যে সিক্ত করেছেন.... তাঁর মনের গভীরে ছিলো ত্যাগের এক অনুপম অভিব্যক্তি, যা মৃত্যুতে প্রকাশিত হয়.....
জাহানারা সম্পর্কে সমকালীন বিখ্যাত সুফিসাধক মোল্লা শাহ বলেছেন: ইনি একজন অসাধারণ মহিলা... রহস্যবিদ্যা গভীরভাবে আয়ত্ত করেছেন.. ইনি আমার প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য... বস্তুতপক্ষে, জাহানারা ধর্মকে নিছক প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতায় নয়, দেখেছেন জীবনের বৃহত্তর নৈতিকতারূপে....
সুকবি জাহানারা ফারসি ভাষায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থও রচনা করেছেন.. অনেকগুলো নানা কারণে হারিয়ে গেলেও খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি এবং অন্য সুফি সাধকদের জীবনীসমূহ সংরক্ষিত রয়েছে.... জাহানারা বলেছেন, খাজা বাবার ভারতবর্ষে আগমন ঘটেছিলো ‘মাধুর্য’ ও ‘আলোক’ বিস্তারের উদ্দেশ্যে... জাহানারা খাজা বাবার একটি বিখ্যাত উক্তির অনুসারী ছিলেন, যেখানে খাজা সাহেব বলছেন: “উচ্চস্তরের আল্লাহর আরাধনা হলো জনগণের দুর্গতি দূর করা, অসহায়ের প্রয়োজন মেটানো ও ক্ষুধার্তদের আহার দেওয়া ...আরো হতে হবে মানবকে নদীর মতো উদার, সূর্যের মতো অনুরক্ত ও ধরিত্রীর মতো অতিথিপরায়ণ...” জাহানারা রচিত একটি আত্মজীবনী পাওয়া যায়, যা মোগল ঐতিহ্যের পরিচায়ক.. সেই আত্মজীবনী বেভারেজ ইংরেজিতে এবং মাখন লাল রায় চৌধুরী বাংলায় অনুবাদ করেছেন....
এক সঙ্গীতশিল্পী রাজপুত যুবকের সঙ্গে প্রেমাবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই গাঁথা উল্লেখ করে আত্মজীবনীতে জাহানারা কোনো উপন্যাসের আধুনিক বেদনাতুর কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের মতো ব্যক্তিসত্ত্বার হাহাকার ও যন্ত্রণাকে লিপিবদ্ধ করেছেন.. এছাড়াও, পূর্ব-পুরুষ বাবরের জীবনস্মৃতি থেকে কয়েকটি উক্তি তাঁর আপন আত্মজীবনীতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই মর্মে: “আমি আজ সম্রাট বাবরের কথাগুলো স্মরণ করছি.. আমার আপন আত্মার মতো বিশ্বস্ত কোন বন্ধু পাইনি.. আমার নিজ অন্তর ব্যতিত আমি কোন নির্ভরযোগ্য স্থান পাইনি...”....
জাহানারার অবস্থান ছিলো দিল্লির সাংস্কৃতিক জীবনধারার প্রাণকেন্দ্রে... তিনি সঙ্গীতশিল্পীকে এবং উচ্চমানের কাব্য রচনার জন্য কবিদের মুক্ত হস্তে উপহার দিতেন.. এমন কি, আপন কণ্ঠ হতে মণি-মুক্তার মালা খুলে শিল্পীকে উপঢৌকন দিয়ে মোগল আভিজাত্য ও ঐতিহ্য পালন করতেন... স্থাপত্য-নির্মাণেও জাহানারার অবদান অপরিসীম..... তাজমহলের নেপথ্য রূপকার তো ছিলেনই , দিল্লির বেশ কয়েকটি সুরম্য বাগানবাড়ি এবং বিখ্যাত সরাইখানা তাঁর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন... আগ্রার বিশ্বখ্যাত জামে মসজিদটিও তার তৈরি... বিশাল সম্পত্তি দান করে দিয়ে সেখানে একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি...
জাহানারার অনেক ছোট-বড় স্থাপত্য নিদর্শন সিপাহি বিদ্রোহের বিজয়ের পর দুর্বৃত্ত ইংরেজ সরকার মোগল শাসন ধ্বংসের মতো করেই ধ্বংস করে দেয়... মৃত্যুকালে তিনি প্রভূত অস্থাবর সম্পত্তি ছাড়াও তৎকালের হিসাবে নগদ তিন কোটি টাকা রেখে যান, যার অধিকাংশই হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে দান করে দেন... সম্রাট ঔরঙ্গজেব ইসলামি বিধান মতে জাহানারার পরিত্যাক্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ দান হিসেবে কার্যকর করে বাকী সম্পদ রাজকোষে বাজেয়াপ্ত করেন...
জাহানারার বিত্তশালীতার একটি তুলনামূলক উদাহরণও পাওয়া যায়... ১৮৩২ সালে একজন আমেরিকান শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তির বাজার মূল্য ছিলো দেড় মিলিয়ন ডলার, যার তখনকার বিনিময় হার ছিলো পঁচাত্তর লক্ষ টাকা... আর জাহানারা যে পরিমাণ সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন তার তৎকালীন মূল্য বিচার করলে দাঁড়ায় নগদ তিন কোটি টাকা! এ হলো মোগল বৈভব আর ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পদশালীতার নমুনা.....
জাহানারা তৎকালীন বিশ্বের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেন তাঁর সম্পদ, রূপ, গুণ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে... বিদেশি পর্যটকদের প্রায়-সকলেই তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন, যদিও মনে করা হয়, সে বিবরণ কখনও কখনও পক্ষপাতদুষ্ট ও কল্পনাপ্রসূত... তাভেনিয়ার বলেছেন, সম্রাট দুহিতা জাহানারা একটি স্বাধীন রাজ্য পরিচালনা করার মতো ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন....
এক্ষেত্রে, বিখ্যাত পর্যটক বার্নিয়ারের বিবরণ প্রণিধানযোগ্য... তিনি উল্লেখ করেন, শাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা বেগম সাহেবা অসাধারণ সুন্দরী ও গুণবতী ছিলেন... সম্রাট তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন... এই কন্যার উপর শাজাহানের অগাধ বিশ্বাস ছিলো এবং তিনিও পিতার সমস্ত দায়িত্ব বহন করতেন... শাজাহান যা আহার করতেন তা তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হতো, অন্যের তৈরি খাদ্য সম্রাট কখনও খেতেন না... এইজন্য মোগল দরবারে সম্রাটের এই কন্যার প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিলো অসাধারণ.... সম্রাটের সঙ্গে তিনি ছায়ার মতো থাকতেন, তাঁর আমোদ-প্রমোদ, হাসি-ঠাট্টায় যোগ দিতেন এবং কোন গুরুতর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কন্যার মতামতকে যথেষ্ট মূল্য দিতেন... বেগম সাহেবার ব্যক্তিগত ধনদৌলত ছিলো প্রচুর... কারণ তিনি সম্রাটের কাছ থেকে মোটা ভাতা ও উপহার তো পেতেনই, আমির-ওমরাহ, আমলা, আমত্যরাও যাতে তার 'নেক' নজরে থাকতে পারেন, সেই আশায় সর্বদাই নানা রকমের উপহার-উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে খৃুশী করার চেষ্টা করতেন... জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো যে সম্রাটের সমর্থন ও প্রীতি লাভে সক্ষম হয়েছিলেন, তার প্রধান কারণ এই ভগিনীর সহানুভূতি... দারা সবসময় এই ভগিনীর মন যুগিয়ে চলতেন....
জাহানারা ব্যক্তিগতভাবে ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণের অংশ এবং মোগল বংশের ভাগ্যের নিয়ামকও বটে.. কারণ জাহানারা একদা মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে অশেষ কষ্ট ভোগ করে যে ইংরেজ চিকিৎসকের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করেন, সে ইংরেজের বণিকের বুদ্ধিই কালক্রমে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের পথ রচনা করে....
এইবারে ঘটনাটির জেনে নেওয়া যাক, তা এইরকম:
জাহানারার স্নেহভাজন ছিল এক বাদী... অর্তকিতে একদিন আগুন লাগালো বাঁদীর বসনে, সে আগুন নেভাতে গিয়ে শ্যাহেজাদী জাহানারা নিজে দগ্ধ হলেন সাংঘাতিকরূপে... রাজ্যের নানা জায়গা থেকে এলো বড় বড় হাকিম , কবিরাজ.. চললো নানান চিকিৎসা.. কিন্তু ফল হলো না কিছুতেই... শেষে, সম্রাটনন্দিনীর জীবন সংশয় দেখা দিলো.. বিচলিত শাজাহান অবশেষে ডেকে পাঠালেন বাণিজ্য বহরের এক সাহেব চিকিৎসককে.. নাম তার গ্যাব্রিয়েল বাউটন.... সুরাটের ইংরেজ কুঠির ডাক্তার তিনি.. বাউটন বললেন, ঔষধ দিতে হলে রোগিনীকে চোখে দেখা চাই... শুনে তো সম্পূর্ন রাজ-দরবার স্তম্ভিত এবং হতবাক! বলে, কি বেয়াদপি! সম্রাট দুহিতার দিকে চোখ তুলে তাকানোর হিম্মৎ...! অনেকে রুখে গেলেন চিকিৎসকের দিকে... কিন্তু চিকিৎসক অনড়.. রোগি না দেখে ঔষধ দিতে তিনি পারবেন না, দিলেও আরোগ্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব হবে না.. রোগিকে ভালো মতো দেখে ঔষধ দিলে তিনি সুস্থতার আশ্বাস দিতে পারেন....
শেষ পর্যন্ত পিতৃস্নেহ জয়লাভ করলো সামাজিক প্রথাকে ছাপিয়ে গিয়ে... শাজাহান সম্মত হলেন বাউটনের প্রস্তাবে... এরপর অল্পকালের মধ্যে আরোগ্য লাভ করলেন জাহানারা.. তাঁর অনুরোধে সম্রাট চিকিৎসককে দিতে চাইলেন পুরস্কার: যা চাইবে, তা-ই পাবে... আভূমি কুর্নিশ করে বিচক্ষণ ডা. বাউটন বললেন, নিজের জন্য কিছু চাই না.. কোলকাতার ১৪০ মাইল দক্ষিণে বালাশোরে ইংরেজের কুঠি নির্মাণের জন্য প্রার্থনা করি, এক টুকরো ভূমিখণ্ড আর ইংরেজকে দান করুন এদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার... পিতৃস্নেহ আবারও কূট কৌশলের কাছে পরাজিত হলো.... শাজাহান বাউটনের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া তিনি বুঝতে পারলেন না......
জাহানারার অনুগ্রহে ইংরেজরা বাণিজ্য ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করলো ভারতবর্ষে এবং উপনিবেশের ভিত্তি স্থাপন করলো সকলের অলক্ষ্যে...আবার এই জাহানারার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে ইতিহাসও রচনা করেছে ইংরেজরা.. যাই হোক, জাহানারার আরোগ্য লাভের আনন্দে সম্রাট আটদিনব্যাপী নৃত্য-গীত, উৎসব ও ভোজের আয়োজন করেন... তারপর আরও অনেকদিন বেঁচে ছিলেন জাহানারা এবং পবিত্র রমজানের এক পুণ্য তিথিতে ঊনসত্তর বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন.........
..........................
নূরজাহান, জাহানারার সঙ্গে এক সারিতে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন আরেক হারেম রমনী, তিনি আওরঙ্গজেব-দুহিতা জেবুন্নেসা.......
তেজস্বিনী-চিরকুমারী এই মোগল রমণী ছিলেন বিখ্যাত কবি... জেব-উ-মুনশোয়া কাব্যরসিকদের নজর কেড়েছে প্রথম থেকেই... রাজনীতি ও চক্রান্ত থেকে বহু দূরে অবস্থান করে তিনি সুকুমার কলার আরাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছিলেন... তথাপি সাম্রাজ্যের ঝড় ঝাপটা তাকেও স্পর্শ করেছিলো... তিনি জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটিয়েছেন মোগল কারাগারে... মোগল সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি নীরব স্বাক্ষীর মতো অবলোকন করেন অবক্ষয় আর ধ্বংসের আসন্ন পদধ্বনি.....
এক দিকে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ সজ্জিত রয়েছে শত-সহস্র মোগল নির্মাণ ও স্থাপত্যের অলঙ্কারে, যার নেপথ্যের অন্যতম রূপকার ছিলেন যে সকল হারেমের নারীগন, তাঁদের সমাধিক্ষেত্র অতি সাধারণভাবে মিশে রয়েছে মাটির সঙ্গে... কেবল দুর্বাদল ছেয়ে আছে সেইসব নিরলঙ্কার সমাধিসমূহ জুড়ে... সেই পবিত্র স্মৃতিচিহ্নে প্রত্যহ নিশিতে নির্মল নীল আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ে সঞ্চিত হয় বিন্দু বিন্দু শিশির.. প্রভাতে স্পর্শ করে তরুণ অরুণের প্রথম আলো.. সন্ধ্যায় তাতে ছড়িয়ে পড়ে গোধূলির মায়াময় স্বর্ণাভা.. শতবর্ষ প্রাচীন মোগল রমণীকূলের সমাধি থেকে আজও উৎসারিত হয় কলা ও সুকুমার বৃত্তির অনিন্দ্য লালিত্য আর ভক্তিনত ত্যাগাকুল হৃদয়ের নম্র-লাজুক ভালোবাসা.....
না এই প্রথার এখানেই শেষ নয়, বাংলার স্বাধীন নবাবগণও মুঘল ঐতিহ্য অনুসারে হারেম প্রথা প্রবর্তন করেন.... ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীতে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরও হারেম ব্যবস্থা অপরিবর্তিত ছিলো.... ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মকর্তা ও ইংরেজ বণিকগণও নবাবদের মতো হারেম রীতি অনুসরণ করে তবে তাদের হারেমে আর্মেনীয়, পর্তুগিজ, বাঙালি, এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের সমাবেশ ঘটতো.....
আধুনিক সভ্যতা অতীতের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে, আর তাই ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সম্রাট বা বাদশাহদের কীর্তিকলাপ এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে.... সাম্রাজ্য নিঃশেষ হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে মণিমুক্তোয় জড়ানো হারেমের অপরূপ নারীরা... অথচ মুঘল হারেমের অন্তরালে কী লুক্কায়িত ছিলো সে নিয়ে আপামর জনসাধারণের আগ্রহ তৃষ্ণা আজও মেটেনি...........
সমাপ্ত
