Hothat Abegi
Hothat Abegi
মাংসটা কষাতে কষাতে চোখটা হঠাৎ ঝাপসা হ'য়ে এল অজুস্বিতার....
পাশের ঘরে বাবান আর তুতান পড়ছে.... আরেক ঘরে তাদের ঠাকুরদা ঠাকুরমা.... চোখ ও মন টিভির পর্দায়, সান্ধ্যকালীন সিরিয়ালে.... বাচ্চাদুটোর বাবা সবে ফিরেছে অফিস থেকে, ক্লান্তি মাখা দু'চোখে.....
অজুস্বিতা রাঁধছে...আজ মেনুতে পোলাও, ভাপা ইলিশ,কষা মাংস...ইতিমধ্যেই বেশ সুবাস ছড়িয়েছে.... অজুস্বিতা বড্ড ভালো রাঁধে....
কিন্তু হঠাৎ করেই যেন ছন্দপতন হয়... কোথা থেকে একরাশ আবেগ এসে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে টেনে নিয়ে চলে যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে..... এখন এই মুহুর্তে ওর মন অন্য কোথাও পড়ে আছে....
হয়তো এই মুহুর্তে ওকে দেখলে কেউ ভাববে , গৃহবধূর চিরাচরিত অভিযোগগুলো ভেসে উঠছে ওর মনে... ঝাপসা করে দিচ্ছে দুচোখ...
নাহ্ ,অভিযোগ তার নেই... তবে অপরাধবোধ আছে...
ঘর অফিস দুদিক সামলেও বই আর গুগল দেখে অনেক রান্না শিখেছে সে বিয়ের পর... শ্বশুর, শাশুড়ী, বর, এখন বাচ্চারা সবার প্রিয় অজুস্বিতার রান্না... তবু যখনই সে ভালোমন্দ রাঁধে তার মনে পড়ে দুজন মানুষের কথা.... বিয়ে করে যাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছে সে ..... তাদের কখনো বিশেষ কিছুই রেঁধে খাওয়ায়নি....সেরকম কিছুই তো করেনি তাদের জন্য....
মা অন্যদিকে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লে"ধুর্!!"/"বিরক্তিকর!", বলে ভাত নামিয়েছে কোনদিন তো মায়ের চোখে হাসি....কোনো কোনো দিন মেয়ের দায়সাড়া ভাবে কোনোমতে করে দেওয়া বিকেলের চাটুকুই যেন বাবার কাছে তৃপ্তির.... খুব দরকার ছাড়া রান্নাঘরের ধারেকাছে ঘেষতো না ও.... রোদে পুড়ে যখন বাবা ওরই জন্য কলেজের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে,মা পুজো দিতে দিতে বলেছিলো, "মোম, একটু নুন চিনির জল করে দিবি তোর বাবাকে..? আমি এখন পুজো দিচ্ছি,তুই একটু করে দে না মা..".... অজুস্বিতার মনে পড়ে, ও ওর ঘর থেকেই বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিলো, "উফ্ মা...! আমি এখন পারছিনা...তুমি ফ্রি হলে করে দিও..".... ও চিরকাল মা বাবার আদুরে মেয়ে মোম হয়েই থেকেছে, মোমের পুতুলের মতোই....
কিন্তু এখন কোনো কোনো দিন দুপুরে অফিস থেকে শ্রতায়ুধ ac গাড়ি করে বাড়ি ফিরলেই অজুস্বিতা ব্যস্ত হয়ে ওঠে.... কোনোদিন ঠান্ডা স্কোয়াশ, কোনোদিন মন ভালো করা ম্যাঙ্গোশেক ইত্যাদি নিজের হাতে তৈরি করে ওর সামনে নিয়ে গিয়ে তুলে ধরে, শুধুই কি কর্তব্যের খাতিরে... না, অজুস্বিতা জানে সবটাই ও করে আবেগ ভরে....
বিয়ে হলো.... একমাত্র সন্তান যখন দূরে অন্য এক সংসারে মানিয়ে নিচ্ছে, রাঁধতে শিখছে,দিনের পর দিন এটা ওটা করে সবার মন জয় করার চেষ্টা করছে..... তখন সেই বয়স্ক মানুষদুটো বয়সের ভারে না পেরে দুটো চালে ডালে ফুটিয়েই খেয়ে নিচ্ছে....বেশ অনেকদিন মা ফোনে ওকে বলেছে," বয়স হচ্ছে তো মোম তাই সেদ্ধ খাই..আমাদের নিয়ে ভাবিস না, আমরা তো এই দুজন মাত্র.. তুইও নেই,দুজনের জন্য অতো শতো করতে আর ইচ্ছে করে না..আমাদের এতেই বেশ চলে যায়,ভালোই আছি... তুই ওদের কথা ভাব, ওরা সবাই কিন্তু এখন তোর ওপরেই নির্ভরশীল মোম..ওদের যত্ন করিস, খেয়াল রাখিস...কেমন?...."...এই তো কথায় কথায় সেদিন মা বললো বাবার নাকি পাঁঠার মাংসে আর কোনো টান নেই, অথচ যে কিনা রবিবার হলেই পাঁঠার মাংস এনে নিজেই ম্যরিনেট করে ফ্রিজে রেখে পরে মাকে ধীরে সুস্থে রসিয়ে বলতো," বুঝলে, মাটনটা ম্যরিনেট করাই আছে, তুমি শুধু তোমার ওই স্পেশাল রেসিপিটা জমিয়ে রাধো, ব্যস..... "....
বুকটা মুচড়ে ওঠে অজুস্বিতার... পাঠার মাংস কষে, চোখ ঝাপসা হয়.... ফিরে যেতে ইচ্ছে করে মেয়েবেলায়... বুড়োবুড়িকে প্রাণভরে রেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে হয়...খুব করে যত্ন করতে ইচ্ছে হয়....
বড্ড ফাঁকি দিয়েছে সে... বড্ড বেশী অবহেলা তারাই পেয়েছে যারা দিয়েছে সবচেয়ে বেশী... শান্ত সন্ধ্যায় রান্নাঘরে মেয়ের মনে বাবা, মা সন্তানসম হয়ে ওঠে......
******সমাপ্ত******
