পিচাশ পর্ব দুই
পিচাশ পর্ব দুই
হঠাৎ সে রোগিণীকে জিজ্ঞেস করে, "মাদাম, আশা করি পুরোহিতকে আপনার কাছে আনা হয়েছিল।' মাদাম বনতেপস মাথা নাড়লেন। ধর্মপ্রাণা র্যাপেট সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ওঠেঃ 'হায় ভগবান! এমনও হয়। আমিই তবে যাই পাদরী ডাকতে। বলতে বলতে সে একরকম ছুটতে থাকে বাজারের মধ্য দিয়ে। তার হাবভাব ও ঝড়ের গতি দেখে বাজারের লোকেরা ভাবে, নির্ঘাৎ কোথাও আগুন টাগুন লাগেছে বা দুর্ঘটনা ঘটেছে। পারলৌকিক তাগিদে পাদরীও দেরি না করে রওনা দিলেন। তাঁর পিছন পিছন গির্জার এক বালক-গায়ক ঘন্টা বাজাতে বাজাতে চলেছে, যেন সে গ্রামবাসীদের কাছে ঈশ্বরের আগমন-বার্তা ঘোষণা করছে। অনেক দূরে যে সমস্ত লোকেরা কাজ করছিল, ঐ ঘন্টাধ্বনি শুনে মাথার টুপি খুলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখে, পাদরীর সাদা দাড়ি ধীরে ধীরে একটি খামার বাড়ির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। যে সব মেয়েরা ফসলের আঁটিগুলি জড়ো করছিল তারা সোজা হয়ে দাঁড়া ও ক্রুশ আঁকে। একদল কালো মুরগী ভয় পেয়ে তাদের পরিচিত গর্তে লুকিয়ে পড়ে। লাল ঘাগরা পরা গির্জার বালক- গায়ক চলেছে ছুটে ছুটে, আর পুরোহিতও একদিকে ঘাড় কাং করে টুপি দুলিয়ে কাদো কাদো গলায় মগ্ন পড়ছেন ও ছুটছেন। সবশেষে প্রার্থনার ভঙ্গীতে হাঁপাতে হাঁপাতে চলেছে র্যাপেট বুড়ি। হোনোর ব্যবধানে থেকে সবই খেয়াল করেছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে, ফাদার চলেছেন কোথায় ?” জবাব আসে 'তোমার মার অন্তিমকাল। তাই প্রার্থনা হবে। আহা, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।' হোনোর বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। বরং আপন মনে মন্তব্য করে, 'ব্যাপারটা তবে বেশ জমেছে। সে আবার মাঠের কাজে মন দেয়। ... পাদরী নিজের দায়িত্ব সারলেন। মাদার বনতেস্পসের বিবর্ণ ঠোঁট বিড়বিড় করে নড়তে থাকে। অস্ফুট উচ্চারণে তিনি তাঁর স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন।
পাদরী নিজের কর্তব্যকর্মে তৃপ্ত হয়ে গির্জায় ফিরে গেলেন। ঘরে তখন শুধু দুই বুড়ি—একে অপরের দিকে দৃষ্টিবদ্ধ। র্যাপেটের ঘোলাটে চোখেও চুনা জ্বলছে—বুড়িটার পরমায়ু আর কতক্ষণ? কতক্ষণ ?........ দিন ফুরিয়ে রাত ঘনায়। সূর্য ওঠে অস্ত যায়। মিষ্টি বাতাস বইছে ঝিরিঝিরি করে। জানলার পর্দা; যা দিনের বেলায় ছিল সাদা, এখন দেখাচ্ছে হলুদ-হলুদ। সব জিনিসই সময়ে তার রঙ বদলায়। বাতাসের আনাগোনায় ঐ পর্দা যেন এই রোগিণীর প্রাণবায়ুরই মতন মুক্তিসন্ধানী। তিনি শুয়ে আছেন মৃত্যুর প্রতিক্ষায়, দুই চোখের পাতা খোলা, যেন পরম নির্বিকারে প্রতীক্ষা করছেন অনিবার্য অথচ, মন্থর মৃত্যুর জন্য। তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর, গলার ভেতর থেকে ঠেলে আসছে শিসের মতন আওয়াজ। মনে তো হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবেন এবং এই পৃথিবী এমন একজন মহিলাকে হারাবে যাঁর বিরুদ্ধে বলবার বিশেষ কিছু নেই। একজন সাধারণ, অতি সাধারণ মহিলা নীরবে অন্তর্হিত হয়ে যাবে। রাত যখন জমাট, হোনোর ফিরে এলো। বিছানার ওপর ঝুঁকে প্রথমেই দেখে নিলো, তার মা তখনো বেঁচে আছেন। প্রথাসিদ্ধ অভ্যাসে জিজ্ঞেসও করলো, ‘কেমন বোধ করছো?' তারপর সে বুড়ি র্যাপেটকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবার সময় স্মরণ করিয়ে দেয়, 'কাল আসবে – ঠিক সকাল পাঁচটায়।' র্যাপেটের চোখের - তীব্র চাহনি আড়ালে জ্বলে ওঠে। পরের দিনে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে র্যাপেট বুড়ি ঠিক এসে হাজির হয়। হোনোর তখন নিজের হাতে তৈরি সুপ্ খাচ্ছিল। একটু পরেই আবার তাকে মাঠে ছুটতে হবে তো।
রাপেট ঔৎসুক্য প্রকাশ করে, “কি গো, তোমার মা কি এখনো বেঁচে আছেন?” হোনোর মুচকি হাসে, 'অবস্থা একটু ভালোর দিকেই মনে হচ্ছে।' বলেই সে রওনা দিলো ফসলভরা মাঠের দিকে। বুড়ি র্যাপেটের বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে। তার কপালে রেখাগুলি উপর্যুপরি কয়েকবার কেঁপে ওঠে। কেমন এক অস্বস্তিকর ভাবনায় তার বুকের ভেতরটা জমাট বেঁধে আসে। এ যাবৎ তার ভেতর যে স্বচ্ছন্দ কর্মতৎপরতা ছিল, তার লেশমাত্র দেখা গেল না। সে ছুটে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে রোগিণীর মুখের ওপর। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের মধ্যে চোখ মেলে তাকান মূমুর্ষু মহিলা। সেবিকার মনে হলো, এই মৃত্যু নেহাতই অনিশ্চিত। দু'দিন বাঁচতে পারে, চারদিনও বেঁচে থাকতে পারে ... এমনকি, আটদিনের পরমায়ুও থাকা আশ্চে নয়। ... চাপ চাপ ভয় এসে গ্রাস করতে থাকে র্যাপেটকে। ক্রমশ ক্রমশ তার মুখাবয়বে চাপা ঠি। দারুণ ক্ষোভে সে কেঁপে কেঁপে ওঠে- হোনোর তাকে ঠকিয়েছে, ঠকিয়েছে। সহজে মরবার পাত্রী এ নয়। তবু সে কাজ করে, যেন যোদ্ধাবেশে প্রতীক্ষা করে মৃত্যুর সেই মহেন্দ্রক্ষণের।
তার দুই চোখে আত্যন্তিক গাম্ভীর্য স্থির হয়ে আছে, মাদাম বনতেস্পসের অসংখ্য রেখাময় কোঁচকানো মুখের ওপর। সকালে দূরবর্তী মাঠ থেকে প্রাতঃরাশ সারতে আসে হোনোর। তাকে বেশ খুশী খুশী দেখাচ্ছে। সংদ্যালয় এক মজাদার অনুভূতি নিয়েই সে মাঠে যায় পরিশ্রম করে—তার ফসলগুলিকে সে যথেষ্ট ভালো অবস্থাতেই তুলতে পারছে। হোনোরের এই স্ব-মাদকতায় বুড়ি র্যাপেট জ্বলতে থাকে। পলে পলে দণ্ডে দণ্ডে সময় বয়ে যায়। আর তার আর্থিক ক্ষতি নিশ্চিত হয়ে উঠছে। বাজিতে হারতে চলেছে সে। সে চাইছে ভীষণভাবে চাইছে, এখনই ঐ বুড়িটার কাঠি কাঠি ঘাড়টা ধরে এক ঝাঁকানিতে খেল খতম করে দিতে; এক ঝাঁকানিতেই অক্কা পেয়ে যাবে, সময় বাঁচবে, যন্ত্রণার লাঘব হবে, সেও বাজি জিতবে, ফলতঃ তার আর্থিক লোকসান হবে না।
যতসব ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা র্যাপেটের মাথায় জটলা পাকাতে থাকে। বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “এই যে, শয়তানের দেখা এখনো পেয়েছেন।' মাদার বনতেস্পস ক্ষীণস্বরে উত্তর দেন, “না।” সেবিকা তখন এমন এক ভয়াল গল্প বলতে আরম্ভ করে, যা মূমুর্ষু মহিলার স্নায়ুর ওপর দারুণ চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সে ব্যাখ্যা করে মৃতুর প্রাক-মুহুর্তে মানুষ কি ভাবে শয়তানের দেখা পায়। শয়তানের এক হাতে থাকে ঝাঁটা, অন্যহাতে জলের পাত্র। এক বিচিত্র শব্দ তুলে এগিয়ে আসে। ... আপনি যদি তাকে কখনো দেখতে পান, তবে জানবেন ঐখানেই আপনার ইতি, মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আপনার হৃদযন্ত্র অচল হয়ে যাবেই। র্যাপেট বুড়ি শয়তান-দর্শনের গল্প বলতে গিয়ে অনেক মৃত মানুষের উপমাও টেনে আনে, ... লয়সেল, এউলেই রেঁতার, সেফিজা, গগনান, সারফাইন গ্রসপিড ইত্যাদি প্রত্যেকেই মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে পিশাচকে দেখতে পেয়েছিল। জোসেফাইন, বুড়ি র্যাপেটের গল্প শুনতে শুনতে বনতেস্পসের অসুস্থতা বেড়ে যায়।
রোমাঞ্চিত তিনি বিছানা কুঁচকে দুই হাতে তার ভর দিয়ে উঠে দেখতে চাইলেন, এই ঘরের প্রত্যন্তে কোথাও পিশাচের আবির্ভাব ঘটেছে কিনা। মওকা বুঝে র্যাপেট চকিতে ঘর ছেড়ে চলে যায়। আলমারি খুলে একখানা চাদর বের করে। এবং তা দিয়ে নিজের সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখে। তারপর ঐ চাদরের নিচে জল ফোটাবার একটা পাত্রকে এনে এমনভাবে মাথা ও মুখ চেপে রাখে যে মনে হয়, বুঝি তার তিনটে শিং গজিয়েছে। তারপর ডানহাতে ঝাঁটা ধরে বাঁ হাতের জলের জাগটাকে সপাটে এমন ঝাপটা মারে যে উৎকট শব্দ তুলে জাগটা আছড়ে পড়ে মাটিতে। সেই শব্দে ঘরের মেঝে অব্দি কেঁপে ওঠে। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের ওপর পা দিয়ে রোগিণীর ঘরের ঝুলন্ত পর্দাটাকে টেনে নামায় র্যাপেট। মাথা ও মুখ আটকানো পাত্রে এক ধরনের বিচিত্র আওয়াজ করতে করতে সে এগিয়ে আসে রোগিণীর দিকে, ঠিক যেমন পুতুল খেলায় শয়তানের মূর্তি নাচতে নাচতে এগিয়ে চলে।
অভাবনীয় আতঙ্কে মূমূর্ষু মহিলা বুঝি উন্মাদিনী। তাঁর ঠেলে বেরিয়ে আসা দুই চোখে ৰুনো দৃষ্টি। অমানুষিক দিশেহারা উত্তেজনায় তিনি উঠে বসেন ও পিশাচের হাত থেকে রেহাই পাবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন। সেই ব্যর্থ প্রয়াসে তাঁর কাঁধ ও বুক বিছানার বাইরে ঝুলতে থাকে। তারপরই একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়েন। এবং সেটাই তাঁর অন্তিম নিঃশ্বাস। বুড়ি র্যাপেট আবার সব জিনিসপত্রাদি যথাস্থানে ঠিক ঠাক করে রাখে। ঝাঁটাটা রাখে আলমারির এক কোণে, চাদরটা আলমারির ভেতরে, সেদ্ধ করবার প্যানটা স্টোভের ওপর, জলের জাগটা শেলফের ওপর এবং চেয়ারটা দেওয়ালের বিপরীত দিকে। এরপর পেশাদারী নিপুণতায় সে বিস্ফারিত চোখের দুই পাতা বুজিয়ে দেয়, পবিত্র পার থেকে জল ঢেলে একটা ডিশ এনে রাখে বিছানার ওপর। সবশেষে প্রথাসিদ্ধ কায়দায় মৃতার আত্মার জন্য হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসে যায় সে। রাতে ঘরে ঢুকেই হোনোর র্যাপেটকে ঐ প্রার্থনারত অবস্থায় দেখতে পায়। দেখে তার মনে প্রথমেই যে ভাবনা আসে তা হলো – ইস্, বুড়িটা আমায় পাঁচশো টাকা ঠকালে! ও এখানে আছে মাত্র তিনদিন ও এক রাত, যার পারিশ্রমিক হওয়া উচিত এক হাজার টাকা, দের-হাজারও নয়।
Part 1:-
https://storymirror.com/read/story/bengali/lnus4qth/picaash-prb-ek/detail