পিচাশ পর্ব এক
পিচাশ পর্ব এক
মুমূর্ষু মহিলার বিছানার ধারে ডাক্তারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে চাষী লোকটি। বৃদ্ধার মুখাবয়ব প্রশান্ত, সম্পূর্ণ সজ্ঞানতায় শুনছেন এদের কথোপকথন। মৃত্যুর জন্য তাঁর কোন অভিযোগ নেই, তিনি প্রস্তুত বয়স যে বিরানব্বুই! - জুলাইয়ের সূর্যালোকে খোলা জানালা ও দরজার মধ্য দিয়ে এসে পড়েছে চারপুরুষ ধরে ব্যবহৃত বাদামী মাটির বুকে সেই আলোর চাকচিক্য। তপ্ত বাতাসে ভাসে মাটির গন্ধ, ঘাসের ঘ্রাণ, দুপুরের রোদে পোড়া পাতার নির্যাস। ভেসে আসে গঙ্গা-ফড়িংদের ছেদহীন সি-সি রব। ডাক্তার চড়া গলায় বললেন, 'হোনোর, তুমি তোমার মাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে যেও না। যে কোন মুহূর্তে উনি মারা যেতে পারেন। চাষী মাথা নাড়ছে, কিন্তু আমার ফসলগুলি অনেকক্ষণ ধরে মাঠে পড়ে আছে। এই বেলা তুলে না আনলে অনেক ক্ষতি হবে। তুমি কি বলো মা?' মৃতপ্রায় বৃদ্ধার এখনো নর্মাল সুলভ বনলিপ্সা, চোখ ও মুখের অভিব্যক্তিতে যেন সম্মতি জানালেন হাঁ যাও। কিন্তু রেগে উঠলেন ডাক্তার, পা ঠুকে বললেন, 'বুঝলে হে, তোমার মন খুব কঠিন। আমি তোমাকে যেতে বলতে পারি না। মাঠের ফসল কাটা যদি তোমার এমন ভয়ঙ্কর জরুরী বোধ হয় যেতে পারো। কিন্তু খেয়াল রেখো, এক দিন। সেইদিন তোমারও ঘনাবে। সেদিন তোমার কাছে এসে আমি এভাবে দাঁড়াবো না কুকুরের মতন মারা যাবে। যতো সব জঞ্জাল!' রোগা লম্বা লোকটা ডাক্তারের হুমকিতে দ্বিধান্বিত একদিকে তার ভবিষ্যতের ভয়, অন্যদিকে বৈষয়িক আকর্ষণ। বললো, 'কতক্ষণ ধরে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলছেন?' “তা আমি কি করে জানবো, কড়া গলায় ধমকালেন ডাক্তার, সেটা বরং তোমার মা'র সঙ্গেই রফা করে নাও। ডাক্তার হিসাবে আমি তাঁর আরো কয়েক ঘন্টা পরমায়ু চাই। আমি একজন ডাক্তার বুঝলে?' লোকটা তার মনস্থির করে ফেললো, 'আমি যাচ্ছি, যেহেতু যেতে আমায় হবেই। আপনি রাগ করবেন না।' তিতিবিরক্ত ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নিলেন। গলায় তাঁর তীক্ষ্ণ হুঁশিয়ারি 'ঠিক আছে, যা ইচ্ছে করো। আমিও আর এই নোংরা পরিবেশে থাকতে পারছি না।' ডাক্তার রেগেমেগে দপদপিয়ে চলে গেলেন। হোনোর কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়ে আবার ফিরে আসে, মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, তুমি একটু একা থাকো। আমি চট করে র্যাপেট বুড়িকে ডেকে আনছি। র্যাপেট বুড়ি। এক বয়স্কা, ধোপানী। কাপড়কাচা ছাড়া তার আরো একটা ভূমিকা ছিল—ঐ গ্রামসহ নানা এলাকার বহু পরিবারের মৃত বা মৃতকল্পজনের পরিচর্যা সে করতো উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বদলে! তারও অন্তঃকরণে এই ক্ষয়িষ্ণু যুগের প্রতিচ্ছবি—যত রাজ্যের লোভ ও লালসা থিক থিক করছে। তার আলোচ্য বিষয় ছিল একমাত্র মৃত্যু, আজীবন সে কতরকমের মরণ দেখেছে, খুব উৎসাহের সঙ্গে সে সব ব্যাখ্যা করল। হোনোর তার বাড়িতে ঢুকে দেখতে পায়, ধোপানী জলে নীল গোলাচ্ছে। মেয়েদের রুমাল কাচবার জন্য। হোনোর আলাপ জমায়, 'আছো কেমন র্যাপেট বুড়ি?" বুড়ি মুখ তোলে, ‘গতানুগতিক। তোমার খবর কি?' "নিজে তো বহালতবিরাতে আছো। কিন্তু মার অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। ' "কি হয়েছে?” “শেষ বয়সের ব্যাধি আর কি। এখন যায় তখন যায় অবস্থা।' বুড়ি যেন মৃত্যুর গন্ধ পেয়েই নীল গোলা জল থেকে হাত তুলে নিলেন। তার পাকানো আঙ্গুলগুলি থেকে টপ টপ জল গড়াতে থাকে। গলার স্বরেও হঠাৎ সহানুভূতির প্রলেপ, 'সত্যি এ রকম অবস্থা তার? ডাক্তারে তো রায় দিয়েছেন, আজকের বিকেলটাও নাকি পার হবে না।” “তাহলে তো অবস্থা সত্যি সঙ্কটজনক" হোনোর কিন্তু আসল কথা পাড়তে দ্বিধা করে। কি ভাবে যে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করা যায়, এ সম্পর্কে অনেক রকম ভাবনা তার মগজে পাক খেতে থাকে। কিন্তু কোন কিছুই ঠিক না করতে পেরে আচমকাই বলে বসে, 'মা মারা না যাওয়া পর্যন্ত দেখাশুনা করতে কত নেবে তুমি? ... জানোইতো আমার অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল নয়। একজন চাকরকেও যা দেওয়া উচিত, তা দেবার সামর্থ্য আমার নেই। আমার দারিদ্র্যের জন্যই মার এই দূরাবস্থা। বিরানব্বুই বছর বয়সেও কী হাড়ভাঙ্গা খাটুনি না তাঁকে খাটতে হয়েছে, দশজন লোকের পরিশ্রম সে এই বয়সে একাই করেছে।' র্যাপেটের স্বরে গাম্ভীর্য, আমি লোক বুঝে দু'ধরনের মজুরি নিয়ে থাকি। ধনীদের কাছে দাবী করি দিনপ্রতি তিনশো টাকা ও রাত প্রতি পাঁচশো টাকা হিসাবে। আর সাধারণ লোকদের কাছে আমার রেট হল, দিনে দশো টাকা রাতে চারশো টাকা । তোমার বেলায় এই দ্বিতীয় রেটটাই প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু এই রেট চাষী লোকটার মনঃপুত হয় না। সে তার মাকে ভালোই জানে। জানে, তার মার জীবনীশক্তি কত মজবুত, সহজে মৃত্যুর মুখে যাবার পাত্রী তিনি নন। ডাক্তার যাই বলুন, সপ্তাহ খানেকের আগে চোখ বুঁজছেন না। হোনোর তাই দৃঢ়স্বরে বলে, 'না। আমি বরং চুক্তিবদ্ধ ভাবে তোমাকে এককালীন কিছু থোক টাকা দিতে পারি, যার পরিবর্তে গোটা কাজটা তুমি করবে। ঝুঁকি এখানে দু'জনেরই। ডাক্তারের রায়, যে কোন মুহূর্তে রোগিণী মারা যেতে পারে। যদি তাই হয়, তুমি জিতবে এবং আমি হারবো। আর মা যদি কাল, পরশু বা আরো কয়েকদিন টিকে যায়, জিত হবে আমার, হার হবে তোমার। বুড়ি সেবিকা অবাক চকচকে চোখে চাষীটার দিকে কয়েক পলক চেয়ে থাকে। মানুষের মৃত্যু নিয়ে সে কখনো এভাবে জুয়া খেলেনি। মনে তার সংশয়। আবার হঠাৎ কিছু পেয়ে যাবার লোভটাও জেগে থাকে। তখন তার মনে হলো, লোকটা তো তাকে ঠকাবার মতলবও করতে পারে। ‘তোমার মাকে না দেখা পর্যন্ত আমি কথা দিতে পারছি না।' “বেশ, তা হলে চলো, তাকে দেখবে।' ধোপানী হাত মুছে তার সঙ্গে রওনা দিল। সারাটা পথ দুজনের মধ্যে কোনো কথা নেই। ধোপানীর হাঁটার গতি অতি দ্রুত। গুটিকয়েক গরু প্রচণ্ড দাবদাহে ক্লান্ত, মাটিতে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। এদের পায়ের দপদপানিতে মাথা তারা এমন ভাবে তাকায় যেন তারা নতুন টাটকা ঘাসের জন্য আর্জি পেশ করছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে হোনোর করুণ স্বরে বললো, 'বোধহয় এর মধ্যে সবশেষ হয়ে গেছে।' তার অবচেতন মনের আশঙ্কাঘন প্রত্যাশা যেন ধ্বনিত হয় সেই ঘরে। কিন্তু তার মা তখনো মৃত্যুর ধারে কাছে পৌঁছাননি। পিঠ ঘুরিয়ে শুয়ে আছেন, অদ্ভুত শীর্ণ দুই হাত যেন কোন জন্তুর থাবার মতন দেখাচ্ছে। সেবিকা র্যাপেট পায়ে পায়ে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, বুঝবার চেষ্টা করে রোগিণীর অবস্থাটা। সে তাঁর নাড়ি টেপে, বুক পরীক্ষা করে, শুনবার চেষ্টা করে, রোগিণীর কথা বলবার ক্ষমতা এখনো কতখানি। তারপর দীর্ঘক্ষণ রোগিণীর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বাইরে চলে আসে। তার পিছন পিছন হোনোরও। হোনোরের প্রত্যয় দৃঢ়তর হয়, নিশ্চয় মা আজকের রাতটুকুও পার হবে না। সে জিজ্ঞেস করে, “কেমন বুঝলে?” সেবিকা ঠোঁট ওল্টায়, 'এখনো দু'দিনের পরমায়ু তো বটেই, তিন দিনও গড়িয়ে যেতে পারে। তুমি বাছা এককালীন দের হাজার টাকা দিলে বিবেচনা করতে পারি।” হোনোর রীতিমতন চেঁচিয়ে ওঠে, 'আরেব্বাস! দের হাজার! দের-হা-জার!' “তোমার কি মাথা খারাপ? আমি বলছি, আমার মা পাঁচ-ছয় ঘন্টার বেশী বাঁচবে না। বাঁচতে পারে না।' চলল দু'জনের মধ্যে দর কষাকষি। দু'জনই অনমনীয়। রফায় আসতে পারছে না। 'ঠিক আছে বাপু, ঠিক আছে, শেষ মুহূর্তে হোনোরই যেন হার মানে, দেরই দেবো, কপালে অর্থদন্ড রয়েছে। দেখাশোনা থেকে আরম্ভ করে ওর জামা- কাপড় কাচাকাচি সবই কিন্তু তোমায় করতে হবে।' করবো, করবো। তোমার পয়সা ঠিক উশুল হয়ে যাবে।' হোনোর তাড়াতাড়ি তার জমিতে ফিরে যায়। কাঠফাটা রোদ্দুরে ফসলগুলি বুনো হয়ে যাচ্ছে, পোকার উৎপাত, পাখিদের হানাদারি ...। সেবিকা গুটি গুটি রোগিণীর ঘরে। সঙ্গে তার সেলাই করার জিনিসপত্তরও রয়েছে। কারণ, যখনই সে কোন মৃতপ্রায়ের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে, তখন সে নিজের ও ঐ পরিবারের সকলের জন্যেই অতিরিক্ত কিছু কাজ করে থাকে বাড়তি অর্থের বদলে।
