সাইকো পর্ব দুই
সাইকো পর্ব দুই
অনিবার্যভাবে তাঁকে পা রাখতে হয়েছিল শার্লের একলা থাকার কোয়ার্টারে। রোম শহরের প্রান্তে ভারি সুন্দর ছিমছিম সাজানো ওই ডুপ্লেক্স কোয়ার্টারটি। বেশ মনে পড়ে রবার্তোর কত বছর হয়ে গেছে, এখনও মনে হয় এই বুঝি গতকালের ঘটনা। আকাশ জুড়ে একরাশ মেঘের আনাগোনা । বাতাসে কেমন একটা বাদলা গন্ধ। যেকোনো সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আসতে পারে। ভারি মনোরম পরিবেশ। এমন বৃষ্টি হব হব মধ্যদিনেই তো প্রথম প্রেমিকার চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা বলতে হয়। হাতে হাত রেখে হাঁটতে হয় অনেকটা পথ। বেচারী রবার্তো সেই আসন্ন-বৃষ্টির মাঝ দুপুরে তিনি কিনা এক শরীর সর্বনাশিনীর খপ্পরে পড়লেন। সেই যে অন্ধ বিবরে ঢুকলেন আর বেরিয়ে আসতে পারলেন না। ছটফট করলেন, আর্তনাদ করলেন, সমস্ত শরীর থেকে রক্ত ঝরল, কিন্তু কোনো নারী এসে তাঁকে সেভাবে বোঝবার চেষ্টা করল না কোনোদিন। শার্লে হাসছিলেন, রাত পোশাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা তাঁর উদ্ধত দুটি স্তন তখন আমন্ত্রণী ইশারায় রবার্তোকে আয় আয় করে ডাকছে। শার্লে গুনগুনিয়ে গান গাইছিলেন। সেই গানের মধ্যে একটা আশ্চর্য মাদকতার সুর মিশেছিল। রবার্তোর কেবলই মনে হচ্ছিল এর আগে কোনো নারী এইভাবে তাঁকে আকর্ষণ করেনি। সত্যি কথা বলতে কী, দূর থেকে অনেক মেয়ের দিকে তিনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকেছেন। অবশ্য এই ভালো লাগার সূত্রপাত হয়েছে মাত্র কয়েকমাস আগে। তার আগে পৃথিবীটা আরও বেশি রঙিন ছিল। মন ছিল খুশিয়াল। তখন লিঙ্গ বিভাজন বিষয়টি রবার্তো বুঝতে পারেননি। না পারার-ই কথা। শার্লের গালে তখন টোল পড়েছে, চোখে তখন ঘোর লেগেছে। একপা একপা করে রবার্তোর আরও কাছে এগিয়ে এলেন তিনি।
রবার্তো তখন বিমূঢ় এবং বিমুগ্ধ। শার্লের শরীর থেকে উঠে আসা ঘাম-মেশানো পারফিউমের গন্ধ তাঁর তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজিয়ে দিয়েছে বন্য অর্কেস্ট্রা। রবার্তোর কেবলই মনে হচ্ছে, আর নয়, শরীরের কোথায় যেন মৃদু শিহরণ শুরু হয়ে গেছে। ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে উন্মাদনার রাত নেমে আসবে। শার্লের ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি। কী খোকা, একটু কগন্যাগ টেস্ট করবে নাকি? এমন আমন্ত্রণকে কি উপেক্ষা করা যায়? আর তখনই, কী আশ্চর্য, বাইরে সোঁ সোঁ ঝড়ের আওয়াজ আকাশ-বাতাস ভেদ করা বৃষ্টির ইশারা। দুষ্টু বাতাস খোলা পর্দা পথে ঢুকে পড়েছিল এই ডুপ্লেক্সের ফ্ল্যাটের ভেতর। অতি দ্রুত সেখানে গিয়ে কাচের জানলা টেনে দিলেন শার্লে। চোখের পলক ফেলার আগে নিজেকে একেবারে নগ্নিকা করে দিলেন তিনি। আর রবার্তোর মনে হল, পৃথিবী বোধহয় স্বর্গের এক উপমা হয়ে উঠেছে। তারপর? সময়-প্রহরী বলল, তিন ঘন্টা ছ’মিনিট। রবার্তো জানেন, অনন্তকাল।
আর শার্লের কাছে এটা ক্ষণকালীন বিহ্বলতা ছাড়া আর কিছু নয়। শেষ অথবা শুরু আমরা জানি না। তারপর মাঝে মধ্যে গোপনে এবং প্রকাশ্যে রবার্তোকে দেখা গেল ওই ডুপ্লেক্সের ফ্ল্যাটের আশেপাশে মুখ চুন করে ঘোরাঘোরি করতে। শার্লে এক পাকা খেলোয়াড়। জীবনে এক বালকের সাথে দু'বার সঙ্গম করেন না তিনি। কী অবাক! যে ছেলেটির সাথে রবার্তোর চিরকালের বৈরীতা, সেই ডিওভাল্লো তখন ফুড়ুৎ করে ঢুকে পড়েছে শার্লের একাকিনী থাকার ঘরে। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে সেদিন মাথায় খুন চেপে গিয়েছিল বেচারী রবার্তোর। পরের দিন খেলার মাঠে এক সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই বন্ধুতে সে কী ভীষণ মারামারি। কী অবাক! দূরে, তখন বোধ হয়, শার্লের ঠোটের কোণে ফুটে উঠেছে স্বৈরিণীর মৃদু হাসি। রবার্তো অথবা ডিওভাল্লো, দু'জনেই তো হেরো খেলোয়াড়। কারণ এখন শার্লের একাকিনী থাকার ফ্ল্যাটে অন্য এক নওজোয়ানের আবির্ভাব ঘটে গেছে। এভাবেই তো প্রতি মধ্যদিনে তিনি সঙ্গী পাল্টান।
একের পর এক কত বালকের জীবনে নেমে আসে অমাবস্যার চাপ চাপ অন্ধকার। জেনে শুনে তারা পা দেয় ওই প্রেমের ফাঁদে। মনটা বিষিয়ে গিয়েছিল রবার্তোর। স্বমেহনের পালা শেষ হতে না হতে এসে গেল বয়ঃসন্ধির নিষিদ্ধ প্রহর। পড়শী মেয়ের চোখে তখন তিনি প্রত্যক্ষ করছেন মহাসূর্যের আলোকশিখা। কাজের মেয়েটির উথলে ওঠা বুক দেখে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে রাতের অন্ধকার। ছটফটানি বাড়ছে ক্রমশ। অদ্ভুত একটা আবেগ এসে ভাঙছে তটভূমি। ভাগ্যিস, পড়াশোনাটা মোটামুটি করেছেন তিনি। না হলে হয়তো গার্জেনদের কাছে কানমলা খেতে হত। বয়স পৌঁছে গেল কুড়ির কোঠায়। এবার একটু থিতু হতে হবে। বাবার বিশাল ব্যবসায় হাত না দিলে চলবে কেমন করে? এটা বোধ হয় ভালোই হল। তখন তিনি ওই বুটিকে নিয়মিত বসছেন। দেশ বিদেশের কত সুন্দরী তরুণী ক্রেতা হিসাবে সেখানে আসে। তাদের সাথে ভিন্নতর গল্পোগাছায় দিন কেটে যায়।
অথচ চোখ বন্ধ করলে, কী অবাক, ভেসে ওঠে শার্লের ঢলঢল মুখখানি, ভীষণ রাগের পাশাপাশি তীব্র ভালোবাসা হাত ধরাধরি করে সমান্তরাল পথে হাঁটতে থাকে। রবার্তো জানেন এই জীবনে ঘৃণা এবং ভালোবাসার মধ্যে মেরুকরণ কখনও সম্ভব হবে না। অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লেন রবার্তো। প্রেম, নাকি – এই জটিল প্রশ্ন করে আমাকে উত্যক্ত করবেন না। কোনটা যে সঠিক মনের টান, এবং কোনটা শরীরের খেলা, আমরা তা বুঝব কেমন করে? সেই মেয়েটি দুর্ভাগ্যবতী, অথবা সৌভাগ্যবতী, কে জানে। মেরিনিয়া, সদ্য স্নাতক মিউজোলজি, অর্থাৎ জাদুঘর বিজ্ঞান। হঠাৎ বেড়াতে বেড়াতে একদিন বান্ধবীদের সাথে হাজির হয়েছিলেন ওই বুটিক শপে।
তারপর চার চোখের মিলন ঘটে গিয়েছিল কি? না, সেদিন কিন্তু মধ্য দিনে বৃষ্টির বিন্দুমাত্র ইশারা ছিল না। লোকে বলে, ইতালিতে সর্বত্র চিরবসন্ত বিরাজমান। অথচ সেদিন সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। উচ্ছৃঙ্খল যুবকের মতো সূর্য ছুঁড়ে দিচ্ছে তার রাগ এবং ঘৃণা। আর সেই মেয়েটিকে দেখে হঠাৎ রবার্তোর মনে হয়েছিল, এই পৃথিবীতে বুঝি বসন্ত এসে গেছে। অকারণে এবং অসময়ে। রবার্তোর চেহারার মধ্যে একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। না, একে আমরা শুধুমাত্র যৌনতা শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে পারি না। এই পৃথিবীতে এমন কিছু নারী এবং পুরুষের আবির্ভাব ঘটে, যাদের চারপাশে এক অলৌকিক পরিমণ্ডল রচিত হয়। মনে হয়, তারা বুঝি স্বপ্ন লোকের বাসিন্দা, যেখানে গেলে অবগাহন করতে ইচ্ছে হয়।
সেখানে বসলে আচমন করতে ইচ্ছা জাগে। তাই বোধহয় রবার্তোর টানে অথবা তাঁর কথা বলার ভঙ্গিতে বেচারী মেরিনিয়া আবার হাজির হল ওই বুটিক শপে। পরপর সাতদিন ঠিক বিকেল পাঁচটা বেজে পনেরো মিনিটে। সাতদিনের চোখাচোখি এবং কথা বলার মাধ্যমে রচিত হল যে শৃঙ্খল, তা অবশেষে চার্চের ল্যাটিন মন্ত্রণালয়ে শেষ হল। সাদা গাউন পরিহিতা মেরিনিয়াকে দেখে রবার্তো তখন একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। পৃথিবীতে এত শ্বেত শুভ্রতা এখনও বেঁচে আছে, অকলঙ্ক অলঙ্কার, রবার্তো তা ভাবতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন, সব মোহিনী কন্যাই বুঝি শার্লে। একাধিক পুরুষ সঙ্গীর সাথে নিত্যমৈথুন করা যার স্বভাব। কিন্তু এই মেয়েটি এর নিষ্পাপ মুখে বোধহয় বসুন্ধরার ছায়া থরথর করে কাঁপে।

