চিনির জালা
চিনির জালা
হাতে ছোট্ট একটা পুঁটলি নিয়ে এক যুবক কলকাতা শহরের নিউ মার্কেট বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে, ব্যাপারীরা সেখানে বিক্রি করছে নুন লাগানো শসা, নকলী রান্নার মাখন, চোরাই কাপড়-চোপড় এবং পুরনো আসবাবপত্র। ধীর এলোমেলো পা ফেলে সে হাঁটছে আর অনবরত তাকাচ্ছে চারপাশে অচেনা জায়গায় কোন ঠিকানা খুঁজে বেড়ানোর মতো। সব কিছু মিলিয়ে তার মুখের এমনি একটা চেহারা যা কেবল কবিদের মুখেই দেখা যায়—সমালোচকদের কাছে তাড়া খেয়ে অর্ধ-অসন্তুষ্ট, অর্ধ-অপমানিত। সে যদি মাথায় পুরনো ইংলিশ ক্যাপের বদলে ছড়ানো আকারের ফরাসী টুপি পরত, লোকে তবে ভাবত এক গ্রাম্যশিক্ষক শহরে এসেছে নিজের জন্য একটা টুপি কিনতে বা কোন খেলা দেখতে; বা যদি সে বেঢপ লম্বা এবং বেজায় কোঁচকানো দলামোচড়া রঙচটা কোটটা গায়ে না দিয়ে রাসায়নিক বস্তুতে ধোলাই করা আটসাঁট একটা জ্যাকেট পরত তাহলে লোকে ভাবতে পারত এ হচ্ছে এক ছোট দোকানদার, এসেছে এক প্রাদেশিক শহর থেকে। কিন্তু আসলে সে এর কোনটাই নয়, এবং আপনি যদি প্রকৃত ব্যাপারটা জানতে চান তো বলি, সে হল এক কয়েদী, সবে মাত্র ছাড়া পেয়েছে। আহা, তার সামনে যখন জেলখানার লৌহফটকটা খুলে গেল মনটা নেচে উঠেছিল কি যে আনন্দ। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। আকাশ থেকে তখন চমৎকার ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। সেই মুহূর্তে, অবশ্যই, সব কিছু নিয়েই সে বড্ড বেশি ভাবাভাবি করছিল, জেল থেকে ছাড়া পেলে সকলেই যা করে। তার কাছে চমৎকার লাগছিল মানুষজন, খোলা জানালাওয়ালা বাড়িগুলো, চলমান গাড়ি-ঘোড়া, আকাশ থেকে পড়তে থাকা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। কিন্তু এ সব কিছু ছাপিয়ে, তার মনের মধ্যে আরো কিছু হচ্ছিল, কোন অজানা ভূগর্ভ কি বাড়ি কি রেস্তরাঁ থেকে খাদ্যের সুগন্ধ তার নাকে এসে লাগছিল, ফলে তার প্রবল একটা স্পৃহা জাগছিল গরম গরম কোন খাদ্য— খাবার। তাই প্রথম যে রেস্তরাঁটি তার চোখে পড়ল তাতেই সে ঢুকে পড়ল। এবং পেট পুরে খেয়ে নেবার পর সে তার পরিস্থিতি বিষয়ে ভাবতে শুরু করল, পরিতৃপ্ত হবার পর স্বভাবতই সবাই যা করে। রাতটি কোথায় কাটানো যায় তাই সে ভাবতে শুরু করল। শহরে তার কোন আত্মীয় নেই, যাবার মতো কোন বন্ধুবান্ধবও নেই, সর্বসাকুল্যে নগদে তার কাছে ছিল একটি পাঁচশত টাকার নোট যা থেকে খাওয়া বাবদ তিনশো টাকা বেরিয়ে গেছে। দূরের চেনাজানাদের কথা সে ভাবছিল, লরির স্বগ্রামবাসীদের কথা যাদের সকলেরই শহরে কোন-না-কোন ব্যবসা ছিল। দরজি ওহানেসের বাড়িতে যাবার কথা ভাবল সে। যদ্দিন না কোন কাজ জোটে তন্দিন কিছু সাহায্য যদি তার কাছে পাওয়া যায় কিন্তু তক্ষুণি তার মনে পড়ল একবছর আগে সে দর্জির একটা আবদার মেটায় নি—গাঁ থেকে আসবার সময় সে তার জন্য শিম-বরবটি আনে নি। তারপর সে নিকল মুচির কাছে যাবার কথা চিন্তা করল, কিন্তু সে-ও তো হবার নয়, কারণ একবার তর্কাতর্কির সময় সে মুচিটাকে বুরজোয়া বলে গাল দিয়েছিল এবং তাইতে মুচি বেজায় চটে গিয়েছিল। পরে সে আর সব গ্রামবাসীর কথা মনে করার কথা ভাবল – সারকিস ব্যাপারী, দোকান-কর্মচারী বাগরাত এবং সাইমন কামার। কিন্তু আবার তার মনে ভেসে এল বিশ্রী সব ঘটনা, এবং শেষমেশ সে মনস্থির করে ফেলল সরাসরি সে যাবে দোকানী আবেলের কাছে যে তার পরলোকগত বাবাকে খুব ভাল চিনত এবং তার বাবাই যাকে গাঁ থেকে শহরে নিয়ে এসে মানুষ করে দিয়েছিল। তার মনে হল আবেলই হচ্ছে সবচেয়ে আশাপ্রদ ঠাই। এবং এখন সে চলেছে কলকাতা নিউমার্কেট বাজারের হৈ-হট্টগোলের মধ্য দিয়ে আবেল দোকানীর কাছে সাহায্যের প্রত্যাশা নিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে সে আবেলের কথা ভাবতে লাগল। তার দোকানের কথা—যেখানে সে ছিল তিন বছর আগে। তার সাইনবোর্ডের কথা—যাতে আঁকা ছিল নৈবিদ্যের মতা একটা চিনির ঢিপি, একটি নাশপাতি এবং একটা সাজি-ভরা আপেল। এসব মনে পড়াতে আবেল তাকে দূর ছাই করবে ভাবনাই এল না। “কিছুতেই সে আমাকে না বলতে পারবে না" আপন মনে নিজেকে বোঝাতে লাগল, ‘কারণ আমার বাবাই তো ওকে মানুষ করেছে। আমার বাবা যদি না দেখত ওকে, তবে তো ওকে রাখালি করতে হত পানাই পায়ে দিয়ে আর যদি দেখি সাহায্য করবার কোন গরজ ওর নেই, আমি তাহলে ওকে বলব আমাকে কিছু টাকা দাও, রাহা খরচ, পরে তোমাকে শোধ করে দেব...' মাথার মধ্যে এই সব চিন্তার ঘুরপাক খেতে খেতে সে পৌঁছে গেল আবেলের দোকানে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেতরে উকি মারল। দোকানের ভেতরে এ্যাপরন-আটা একটা ছোকরা মাত্র দেখা গেল, তড়িঘড়ি কিছু চিবোতে ব্যস্ত। ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে যুবকটি প্রথমে কিছুটা ইতস্ততঃ করল, কিন্তু শেষে যখন নিজের পরিস্থিতিটা আরো পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিল যে রাত কাটানোর মতো কোন ঠাঁই তার নেই, কিনে খাবার মতো পয়সা নেই পকেটে, তখন সাহসে ভর করে ভেতরেই ঢুকে গেল। তাকে দেখে ছোকরাটি চটপট চুইংগামটা মুখ থেকে বের করে পকেটে চালান করল। 'কি চাই আপনার?'—বলল তেজী গলায়। সে এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করল। 'আমি দেখা করব'—বিড়বিড় করে বলল সে, আবেল মশায়ের সঙ্গে, তোমার মনিব। উনি আছেন এখানে? বাড়ি আছেন? 'তিনি ডিনার খাচ্ছেন...তাঁকে ডাকতে বলছেন?" আবার দোটানায় পড়ল। বড় অসময়ে এসে পড়েছে সে। একটু পরে এলে ভাল কিন্তু ঠিকই তো আছে, ছেলেটা তার মনিবকে আনুক না ডেকে যদি তাতে তার হত... ডিনারে ব্যাঘাত না ঘটে। ছোকরাটি চুপচাপ দোকানের ভিতরে সটকে গেল এবং সে দোকানের পাটার দিকে এগোল। যতক্ষণ না আবেল উদয় হন ততক্ষণ সে নিরীক্ষণ করতে শুরু করল ঢাকনাওয়ালা সব একরকম দেখতে মোটা মোটা চিনির জালার সারি—যা সচরাচর ব্যবহারে লাগে কেবল গ্রাম্য পুরোহিতদের এবং শহরের নিম্নশ্রেণীর যাজকদের। সে ঢাকনাগুলো খুলতে লাগল একটার পর একটা, নির্বিকারভাবে দেখতে লাগল সেগুলো আর ভাবতে থাকল, আবেল হয়তো তাকে চিনতেই পারবে না; তাদের শেষ দেখা- সাক্ষাতের পর তিনটি বছর কেটে গেছে..কিন্তু যদি সে চিনতে পারেই, সে হয়তো খুশিই হবে, কারণ তার পিতৃদেবকে ধন্যবাদ যে আবেল এমন একখানা দোকান বানাতে পেরেছে, এবং নিঃসন্দেহে সে তাকে বিমুখ করবে না, সে তাকে সাহায্য করবেই..... “কিন্তু যদি ও জানতে পারে যে আমি চুরির দায়ে জেল খেটেছি তবে হয়তো সাহায্য করবে না'—আপন মনে সে বলতে লাগল, 'ও কিছুতেই বিশ্বাস করবে না যে আমি নির্দোষ এবং সেইজন্যেই আমি খালাস পেয়েছি... খালাস পাওয়া লোকেরা নির্দোষ হতে পারে তা লোকেরা মানতেই চায় না...'। একবার ইচ্ছে হল দোকান ছেড়ে চলে যায়, যাতে করে নিজের গ্রামের লোকরা তার সম্পর্কে কিছু না জানতে পারে। কিন্তু পরে মনে হল, লোকেরা যদি তার আড়ালে তার সম্পর্কে যা-তা সব বলতে শুরু করে দেয়। ফলে তাকে থেকে যেতে হল। ঠিক সেই মুহূর্তে পার্টিশন করা দেয়ালের পেছন থেকে দ্রুত পা ফেলার শব্দ শোনা গেল। হাত এখন চিনির জালায়, ঐ অবস্থায়ই সে স্থির দাঁড়িয়ে রইল যাতে কেউ তাকে সন্দেহ না করে। এলেন সেখানে মাঝারি আকৃতির একটি লোক, হাত দুটো একটু ফাক করা (বোঝাই যায় এঁটো হাত), লরির সত্যিকার একটি মানুষ, মুখে দাক্ষিণ্য এবং চোয়াড়ে ভাব, ছোট করে ছাঁটা পাকগুলো মাথা এবং মুখখানা শজারুর কাঁটাগুলোর সাদৃশ্য আনে না এমন নয়; বললেন তিনি যুবকটির মুখের দিকে তাকিয়ে, 'কি চাই আপনার ?" 'আমি—সে বলতে শুরু করল ঢাকনাটা এপাশ-ওপাশ করতে করতে, আমি চাইছিলাম...'
খেতে খেতে উঠে আসা লোকটির সামনে সে একটু অপ্রস্তুত বোধ করছিল, কারণ কেমন অধৈর্য চোখে তাকাচ্ছে সে। 'আমি চাইছিলাম কি...' বলতে বলতে এবার সে চিনির জলাটাই ঘোরাতে লাগল। দোকানী অসহিষ্ণুভাবে নড়ে উঠলেন এবং যুবকটিকে কেবলই চিনির জালাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, 'ও আচ্ছা, একটা চিনির জালা কিনবেন বুঝি? ওর দাম তিনশো টাকা । “এ আমাকে চিনতে পারছে না'—সে ভাবল এবং আত্মপরিচয় দেবার কথাও ভাবল। 'বুঝলেন কিনা, আমি হলাম খেচান খুড়োর ছেলে'—বলতে বলতে তার চোখ- মুখ লাল এবং তক্ষুণি সে ভাবল এ কি বোকার মতো একটা কথা সে বলল, এটা না বললেই হত। 'খেচান খুড়োর!'—বিস্ময়ে দোকানী বলে উঠলেন, আমাদের খেচান খুড়োর ?? 'হ্যাঁ'—সে খুশি, মনে হচ্ছে শুরুটা ভালই করেছে। এখন আবেল হয়তো তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে..... ‘আচ্ছা, আপনি যদি খেচান খুড়োর ছেলেই হন তাহলে দামটা কিছু কমানো যেতে পারে'—বললেন দোকানী। দুশো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিন, নিয়ে যান। জিনিসটা খাসা মাল পরে পস্তাতে হবে না।” সে চুপ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবছিল, সে যা বলতে শুরু করেছে সেটা কেমন করে চালিয়ে যাবে। তবু চাইছিল আবেল তাকে কিছু শুধোক। কিন্তু লোকটি কোন আওয়াজই দিচ্ছে না এবং শরীর থেকে হাত দুটো ফাঁক করে রেখে অধীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। "ও, এটা আপনার চলবে না বুঝি... ? 'আমি, বুঝলেন কিনা..?' সে ফের শুরু করল এবং বলতে চাইল এইমাত্র সে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে এবং একটু অভাবে পড়ে গিয়েছে, কিন্তু ফের চুপ মেরে গেল। তাকে এসব বলে কি হবে, তাতে কি লাভ...? সত্যি বলছি পেত্যয় করুন, ওর কমে আর হয় না-দোকানী জোর দিয়ে বললেন, ‘সুদ্দু আপনার জনো একটু কম নিচ্ছি। এগুলো আমরা হামেশা তিনশো বিশ টাকায় বিক্রি করি, আর দেখুন আপনাকে দিচ্ছি দুশো টাকায়। জিনিস সম্পর্কে দেখতে হবে না। এ হল ওদেসার মাল, সেরা আর টেকসই কত। যদি ভেঙ্গে না ফেলেন, বিশটি বছর তো হেসে খেলে। সে দুলছেদ্বিধায়।
'বুঝলেন কিনা, আমি জেল থেকে মাত্তর বেরিয়ে এলাম তো, তাইতে... সে চেষ্টা করল বলে যেতে, কিন্তু দোকানীর দিকে ফের তাকিয়ে, একবার ছোকরাটার দিকে তাকিয়ে সে মধ্যপথে থেমে গেল, চুপচাপ হয়ে গেল। আবেল আবার অসহিষ্ণু একটা ভঙ্গি করলেন, এমন একটা ভঙ্গি যা শুধু খেতে খেতে উঠে আসা বা কোথাও যেতে তাড়া থাকা লোককে মানায়। 'এ প্রায় কেনা দামে নিচ্ছি,ব্যাস্ততা দেখিয়ে তিনি বললেন, 'এটার কেনা দাম হল গিয়ে..... নিজের গায়ের লোকের কণ্ঠস্বরে স্পষ্টই বুঝতে পারছিল সে তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে; সে হয়তো ঐ বাচ্চা ছেলেটারও বিরক্তির কারণ হচ্ছে কারণ বড় বড় চোখ করে উগ্র দৃষ্টিতে ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আছে একঠায়, অতএব চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। *এটা কি আপনার চলবে না?' দোকানী জিজ্ঞেস করলেন। যুবকটি সাহসে বুক বাধল। 'না। দাম বড্ড বেশি। 'কত দিতে পারেন?' ইচ্ছে করেই খুব কমিয়ে একটা দাম সে বলে ফেলল। দুশো টাকা। তাতে লোকসান পড়ে যাবে অনেক।' ওর চেয়ে বেশি আমি দিতে পারব না'—বলল অনিচ্ছাভরে এবং তাড়াতাড়ি করে দরজার দিকে পা বাড়াল। 'দশ দিন।' 'পারব না—স্থির গলায় যুবক আবার বলল এবং নিজের কণ্ঠস্বরে এবং নিজের উত্তরে সে নিজেই খুশি হল। দরজা খুলে সে চৌকাঠে পা দিল। 'ঠিক আছে, চলে আসুন চলে আসুন, নিয়ে নিন। পেছন থেকে হাঁকলেন দোকানী। চলে আসুন... আপনি যখন আমাদের খেচান খুড়োর ছেলে তখন আর কোন কথা নেই, থাকতেই পারে না...." কথাটি না বলে সে ফিরল, দিয়ে দিল দুশ টাকা —তার সঞ্চিত যা ছিল তার সবটাই—এবং চিনির জালাটা নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। কয়েক মিনিট বাদে, আবার সে হাঁটতে লাগল নিউ মার্কেট বাজারের মধ্য দিয়ে, হাতে তার একটা নতুন চিনির জালা, সেই সঙ্গে সেই পুঁটলিটা।