সাইকো
সাইকো
সবেমাত্র ভোর হয়েছে। শরৎ আকাশে ভাসছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘমালা। এখানে এলে মনে হয় আমরা বোধহয় সত্যি সত্যি স্বর্গে পৌঁছে গেছি। এই পৃথিবীতে দুঃখের চিহ্নমাত্র নেই। নেই হতাশার আর্তনাদ। নেই অবক্ষয়ের হাহাকার। আমরা কোথায় এলাম?
পাঠক-পাঠিকারা, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুন, চারপাশে সমুদ্রের নীল জলরাশি। মৃদুমন্দ তরঙ্গের খেলা। ঈশান কোণে লেখা নেই ঝড়ের পূর্বাভাস। আর এই সাগর মধ্যে এক একটি দ্বীপের অবস্থান। সারা পৃথিবীর বিত্তবান মানুষেরা যেখানে স্থাপন করেছেন তাঁদের সাধের আরামের আবাস। এখানে রোজ সন্ধ্যাসমাগমে নৃত্যপটিয়সী সঙ্গীতানিপুণা বিনোদিনী কন্যাদের আবির্ভাব ঘটে। তাদের পায়ের ছন্দে কেঁপে ওঠে পৃথিবী। তাদের চোখের তারায় ঘূর্ণন জাগে। তারা ভূ-ভঙ্গিতে সর্বনাশা ডাক দেয়।
বলে, "হে পুরুষ এসো, আমাকে আদর করো। আমার দেহের সর্বাঙ্গে আঁকা হোক তোমার দুষ্টু জিভের কারুকায্য। আমি যে জন্ম-জন্মান্তর ধরে শুধু তোমারই অপেক্ষাতে বসে আছি।" প্রেমিক পুরুষ, লোলুপ পুরুষ, লোভী পুরুষ, বিত্তবান পুরুষ এসে মৌমাছির মতো ভিড় জমায় সেই মৌচাকে। গুনগুন শব্দ শোনা যায় সারারাত। শরীরে শরীরে মেলামেশা, ভাব ভালোবাসার অবুঝ খেলা, ডলার অথবা ইয়েনে মিটিয়ে দেওয়া হয় পারিশ্রমিক। তারপর? সকাল আসে, সঙ্গমতৃপ্ত শরীরগুলো তখন ঘুমের আশ্লেষে আহ্লাদিত। অথচ রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠা রবার্তোর বহুদিনের অভ্যাস। বছর পঞ্চাশ বয়স। এখনও শরীরের কোথাও সামান্যতম শৈথিল্য জাগেনি। এর কারণ কী? তিনি সুচতুর, তিনি জানেন যৌবনকে মুঠোবন্দী করতে হলে কতগুলি কঠিন কঠোর অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়। না-হলে মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হবে। চোখের কোনে জমবে ঘুমহারা রাতের কালিমা। তখন হয়তো টাকার থলির লোভে মেয়েরা ছুটে আসবে, কিন্তু আগের মতো আর প্রেম নিবেদন করবে না। মৈথুন-ক্লান্ত মুহূর্তে তাদের মনের কোণে কোথাও জেগে উঠবে একটুকরো অবসাদ।
আর সেটা কেমন করে সহ্য করবেন রবার্তো ইতালিয়ান, রসিকজন বলে থাকেন, ঈশ্বর বুঝি ইতালিয়দের নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন। চোখ বন্ধ করলেও আপনি এমন একজন ইতালিয়র সন্ধান পাবেন না, যাকে দেখতে সুন্দর নয়। অসুন্দর শব্দটার প্রবেশ নিষেধ এই মিলান অথবা রোম শহরে। আর এখানে? ভূমধ্যসাগরের এই ছোটো বড়ো দ্বীপে তো শুধুই সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। অবশ্য এখানে যে শুধু ইতালিয়ান কোটিপতিরা আসেন তা নয়; বিশ্বের সব দেশ থেকে সুখী রাণতৃপ্ত মানুষের পায়ের ধ্বনি শোনা যায় এইসব দ্বীপমালায়। এক একটি দ্বীপ কিনে নিয়েছেন এক একজন ধনকুবের। সযত্নে রচনা করেছেন বসন্ত বিতান। ভ্রমরের গুঞ্জন আর পাখির কলরব শুনবেন বলে।
জন্মসূত্রে রবার্তো বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তাঁর বাবা লুই ছিলেন ইতালির এক বড়ো মাপের জমিদার। সারা বিশ্বের শিল্পরসিক মানুষ কারণে অকারণে ইতালিতে আসে। যাবার সময় স্মারক হিসাবে বেশি দাম দিয়ে নানা শিল্পসামগ্রী কিনে নিয়ে যান, বাড়ি ফিরে ঘর সাজাবে বলে। আর এই ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন ওই লুই নামের ভদ্রলোক, দু-হাত ভরে রোজগার করেছেন। জীবনটাকে উড়িয়ে দিয়েছেন আতসবাজির মত করে। যা কিছু সঞ্চয় ছিল, সবই পেয়েছেন এই রবার্তো। কারণ তাঁর ভাইবোন বলে কেউ নেই। এই পৃথিবীতে তিনি একক রাজা। তাই বোধহয় জন্মমুহূর্ত থেকে এমনভাবে মানুষ হয়েছেন। বিলাসিতা শব্দটার সাথে তার চিরকালের সখ্য। এক অর্থে সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছেন তিনি। পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিল না কোনোদিনই আবার সেই অর্থে বেলেল্লাপনাতেও জড়িয়ে পড়েননি। শান্ত আভিজাত্য কিশোরবেলা থেকেই রবার্তোর চারপাশে বিরাজ করত। তিনি যে মস্ত বড়ো ঘরের সন্তান, এই কথাটা সবসময় মনেরাখার চেষ্টা করতেন। চারপাশে টেনে দিতেন গণ্ডী। সহজে কারো সাথে মিশতেন না। মুখচোরা অথবা গোমড়া বলে কুখ্যাতি ছিল তাঁর। যখন এই বাঁধন ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেন, তখন বুঝি তাঁর মুখে কথার তুবড়ি ছুটত। কৌতুকরসে প্লাবন ডাকতেন চারপাশে। অন্তরঙ্গ বন্ধুরা রবার্তোর এই গোপন পরিচয়ের খবর জানেন। আর জানেন বলেই বোধহয় তারা কেউ এই মানুষটিকে অবহেলা অথবা ঘৃণা করতে পারেন না।
প্রেমে পড়েছেন বেশ কয়েকবার। সেই স্কুল জীবনে — দশ বছরের বড়ো এক শিক্ষিকা। তাঁকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করেছিলেন। তখন সবে জাগছে শরীর। কোশ হতে কোশান্তরে পৌঁছে যাচ্ছে সর্বনাশা সঙ্কেত। পৃথিবীর সব কিছুকে বড়ো নতুন করে দেখতে ভালো লাগছে রবার্তোর। এই সূর্য কি গতকাল এতটা উজ্জ্বল ছিল? এই চাঁদ কি এত সুন্দর জোছনাধারায় স্নান করাত মাঝসন্ধ্যার পৃথিবীকে? এই পাখির গান কি এত সুমধুর ছিল? সব কেমন পালটে যাচ্ছে। এর কারণ কী? অনেক ভাবতে ভাবতে একরাতে হলুদ স্বপ্নে বিভোর হয়ে রবার্তো আবিষ্কার করলেন ওই শিক্ষিকা শার্লের সান্নিধ্যই তাঁর মনোজগতে ছোটোছোটো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছে। মহিলা সান্নিধ্য যে এত কাম্য এবং রমণীয় হতে পারে, বেচারী রবার্তো এর আগে সে খবর পাননি। পাবেন কী করে? তখন তো সবেমাত্র তাঁর বয়স এগারো পার হয়ে বারোতে থমকে থেমে দাঁড়িয়েছে। তখন থেকেই চূড়ান্ত প্রেমের অভিনয় করতে শুরু করলেন রবার্তো। অবশ্য এর জন্য আমরা তাঁকে হয়তো দোষারোপ করব না। মেয়েরা চিরকালই মোহিনী মায়ায় ছেলেদের আকর্ষণ করে। তারপর তাকে অন্ধ বিবরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। রবার্তোর ক্ষেত্রে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। এবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। অথচ, সব জেনে শুনেও পতঙ্গ ছুটে যায় আগুনের দিকে। স্বল্পস্থায়ী জীবনে ঘনিয়ে আসে শেষের সেদিন। রবার্তোর জীবন-নাটকে এমন এক একটি ট্র্যাজিক ছবি আমাদের অবাক করে দেয় বৈকি। সব জেনেও তিনি বিষপান করলেন। ড্রআর শার্লে তখন তাঁর থেকে দশ বছরের ছোটো এই সদ্য বালককে নিয়ে খেলছেন অবুঝ খেলা। সদ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। স্কুলে আঁকার দিদিমণি। আঁকার ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সময় ও সুযোগ পেলে এভাবেই তিনি অল্পবয়সী বালকদের প্রলভিত করেন। হঠাৎ কখন সাদা ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে দু'চোখের আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দেন তার কাছে। বেচারী রবার্তো, বৃষ্টি হব- হব এমন এক দিনে তিনি শার্লেকে দেখে একেবারে ভীত হয়ে গেলেন, আর এর ফলে তাঁর জীবন-নাটকে একের পর এক রুদ্ধশ্বাস ও অবিশ্বাস্য ঘটনা কেন ঘটতে থাকল.... মহাকাল বোধহয় এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে।
Part 2 link:-https://storymirror.com/read/story/bengali/gf9vzstq/saaiko-prb-dui/detail।
Part 3 link:-https://storymirror.com/read/story/bengali/y06rs85r/saaiko-prb-tin/detail
Part 4 link:-https://storymirror.com/read/story/bengali/jjj4uhm2/saaiko-prb-caar/detail