Imran Hassan

Romance Others

4.6  

Imran Hassan

Romance Others

অদ্ভুত ভালোবাসা

অদ্ভুত ভালোবাসা

10 mins
317


আজ সকালটা বড় সুন্দর, চারিদিকে ঝলমলে রোদ । নীল আকাশে সাদা হৃষ্ট পুষ্ট মেঘ ,দেখে মনে হয় যেন শীতকালে  ভুল করে শরৎ  এসে পড়েছে। সদ্য পারা মুরগির ডিম হাতে নিলে যেমন মনটা একটা নির্মম অবাক আনন্দে ভরে যায় এই আকাশের দিকে চাইলেও ঠিক তেমনি হয়। 

                     আনন্দের অবশ্যই একটা কারণ আছে আজ বহুদিন পর একটু অবসর পেলাম। অনেকদিন থেকে বাড়ি যাওয়া নেই । স্নাতক শেষ করে কলকাতায় আসি সেই আসায় শেষ আর বাড়ি যাওয়া হলো না । এতদিন পর আজ বাড়ি যেতে চলেছি।

             অনেকদিন থেকে বাড়ি যায়নি তার  কারণও আছে বটে। এখানে এসে ইউপিএসসি ক্র্যাক করার পর আইএএস র র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনার পদে নিযুক্ত হই তারপর এত ক্রাইম বেড়েছে কলকাতায় যে নিজের জন্য একটা ছুটি জোটাতে পায়নি। একটা বড় মিশনে গিয়েছিলাম আর কি। তাছাড়া আমার নিজেরও ফেরার ইচ্ছা ছিল না । এর কারণ হলো ভালোবাসা।আমার প্রেমিকা আমার বাড়ির শহরে থাকে যার সাথে আমার কথা বলা মূলত অসম্ভব (এর কারণ অবশ্য যথাস্থানে বলব )তাই যাওয়ার ইচ্ছা নেই । 

             অদ্ভুত তাই না সবাই ভালোবাসার টানে বাড়ি ফিরে কিন্তু আমি ভালোবাসার জন্য বাড়ি ফিরতে চাই না । তোমরা হয়তো বলতে পারো তাহলে আজ কেন যাব বাড়িতে ? যেতে তো হবেই আমার ছোট কাকার মেয়ের বিয়ে তাই তো আরো আনন্দ।কিন্তু একই প্রশ্ন বারবার আসে বাড়ি যাবো কি ? আসলে গল্পটা একটু অন্যরকম আর পাঁচটা প্রেমিক প্রেমিকার মতো নয় , আমি ওই কথা মনে আনতে চাই না কিন্তু বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে আবার মনে পড়লো সেই অদ্ভুত প্রেমের কাহিনী । 

             আমাদের শহরটি খুব বড় ছিল না। ওরকম আয়তনের অন্তত পনেরোটি শহর লাগবে কলকাতার মতো একটি মহানগরী বানাতে। আমাদের একটি যৌথ খামারও ছিল। চেয়ারম্যানের নাম ছিল অ্যাডাম, বা অবিকল যদি বলতে হয়, rusty-old অ্যাডাম। সবাই বলে অ্যাডামের ড্রাইভার তাঁর এই নামটি দিয়েছিল। অ্যাডাম হাঁটা পছন্দ করতেন না। নিজের নয়! খামারের গাড়িটি তাঁর কাছে ছিল যেন পায়ের বুটজোড়া; মাঠে এবং জেলা কমিটিতে যেতেন ঐ মোটরগাড়ি চেপে; পথে যেতে যেতে কারো সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি গাড়িটি থামাতেন, জানলা গলিয়ে মাথাটি বাড়িয়ে দিতেন, এক কথায়, আমরা যেমন যতক্ষণ না ঘুমুতে যাই ততক্ষণ জুতো পরে থাকি, উনিও তেমনি খামারের গাড়িটি ব্যবহার করতেন তাঁর বাড়ির একেবারে দোরগোড়া পর্যন্ত। সাধ্যে কুলোলে গাড়িটি হাঁকিয়ে তিনি সোজা বিছানার ওপরই যেন এনে ফেলতেন, এক কথায়, অ্যাডাম গাড়িটার মরচের মতোই গাড়িটার সঙ্গে লেপটে থাকতেন। খাড়া লম্বা হয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় আমি তাঁকে কক্ষণো দেখি নি ।

             তোমরা নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবে—প্রেম আর অ্যাডামের মধ্যে সম্পর্কটা কি? হুট করে কোন কিছু ভেবো না যেন। জীবন কিন্তু এই শিক্ষাই দিয়েছে—মরচে কখনো- সখনো সোনাও আনে। rusty-old অ্যাডামমের একটি মেয়ে ছিল, নাম আরেভ, আরেভিক—যার মানে হল সূর্যকিরণ। তার ছিল সৎমা। নাম ছিল মাদাম রোজা। আমি ডাকতাম মাদাম ব্যারিয়ার বলে। আর বেচারী আরেভিক ছিল মরচে এবং বারিয়ারের মধ্যিখানে আটকা। ঊষার আগেই সে ঘুম থেকে উঠত, আর মাঝরাতের আগে ঘুমোতে যেতে পারত না। ফরমাস খাটতে খাটতেই তার দিন যেত এবং রান্না করা ছাড়া আর সবরকম গেরস্থলির কাজেই সে আটকে থাকত। 

             

         “জলদি! কোন্ চুলায় গেছিস? পেঁয়াজগুলো দে!' 

          "আরে তুই যে একটা মরা বেড়ালের চেয়েও জঘন্য। একটু পা চালিয়ে হাঁটতে পারিস্ না?' "বিছানা-টিছানাগুলো রোদে দিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি করবি কিন্তু। এই হল গিয়ে মাদাম ব্যারিয়ারের ব্যাপার-স্যাপার। rusty-old তার সঙ্গে অনুপান দিতেন; 

         আরেভ, আমার বুটজুতো পালিশ করে দে।

         আরেভ, আমার কোটটাতে ধুলো জমেছে।”

         'আরেভ, চাদ্দিক তো দেখছি ধুলোয় ধুলোময়।

          ওঁরা আরেভিককে ভালবাসতেন না। আ! আরেভিক... যখন বুঝলাম, আমার কাছে সে সূর্যের চেয়েও বেশি, তখন সে পড়ে ক্লাশ নাইনে আর আমি ক্লাশ টেন-এ। হলের দুপাশে আমাদের ক্লাশঘর মুখোমুখি। রাস্তার দুপাশে আমাদের বাড়ি দুটি ছিল মুখোমুখি। এক কথায়, আমরা ছিলাম যেন সূর্য আর পৃথিবী : সব সময়ই বিপরীতে, সব সময়ই দূরে দূরে। কিন্তু সূর্য আর পৃথিবীর মিলন যে হতে পারে না সেটা তো তখন বুঝিনি ।  

          আরেভিক ছিল তন্বঙ্গী, রূপসী, ওর চোখ দুটি ছিল বড় বড়, কালো, ভীত। দারুণ সুন্দর হয়ে উঠল সে , আর তাই তা চোখের প্রান্তরেখায় ফুটে উঠল অরুণাভা। মাদাম ব্যারিয়ার ওকে দুচক্ষে দেখতে পারতেন না। আরেভকে মারধোর করার কোন সুযোগই তিনি হাতছাড়া করেন না। বিধান দেবার ব্যাপারে অ্যাডাম ছিলেন অভ্রান্ত, আর তাই আরেভিকের বিশাল কালো কালো চোখ দুটি সব সময়ই থাকত অশ্রু-টলোমলো। 

            আমি ওর অপেক্ষায় থাকতাম ওদের সদর দরজার বাইরে। 'কত বড়টি হয়ে উঠেছ তুমি, আরেভিক। কি সুন্দর হয়েছে দেখতে।'

           ও আমার দিকে তাকাত অবাক হয়ে। পরিষ্কার বুঝতাম আমার কথা ও বিশ্বাস করত না। 'ওরা আমাকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাশা করে, তুমি বোঝ না, আরমেন ? তুমি আবার ফোড়ন কাটছ?' 

           'আমি কিন্তু সত্যি বলছি আরেভিক। সত্যি তুমি সুন্দর।” 

           মনে হত রেগে গেছে, লজ্জায় লাল হয়ে উঠত তার মুখ, কিন্তু চোখ দুটি হাসত। 'আচ্ছা? আর কিছু?" কথা ঘোরানোর চেষ্টা করত।

 "আজ বিকেলে বাগানে এসো। অপেক্ষায় থাকব।” ক্ষণকাল দ্বিধা করত সে আর তারপর ত্বরিত চরণে বাড়িতে ঢুকে যেত। বিকেলে এসেছিল বাগানে। আর বিকেলটা হয়ে উঠেছিল আলোয় ঝলমল। 'এই!' ও বলেছিল সলজ্জে। 

         অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমরা ছিলাম চুপচাপ। আমার ঠোঁট থেকে অস্ফুটে উচ্চারিত হয়েছিল অনুরাগের এমন সব কথা যা আমি তার আগে কখনো বলি নি, কিন্তু সেই অস্ফুট উচ্চারণ পরে ঘটেছিল নীরবে, একাকী আমার মনের মধ্যে। আমাকে ও দেখছিল নিবিড়ভাবে মাথাটি নামিয়ে চুপচাপ।

         “কি খুশি যে হয়েছি তুমি আসায় – বলেছিলাম আমি। 'তুমি কি সুন্দর। কি সুন্দর...' 

         ‘ঐ জন্যেই আমি এসেছি। এমন কথা আমাকে আগে আর কেউ বলে নি।' বলেই চুপ করে গিয়েছিল এমনভাবে, যেন যা বলে ফেলেছে তাতে, আফসোসের আর শেষ নেই। কয়েক মুহূর্ত পরে বলল, 'তুমি তো ঠাট্টা কর নি, আরমেন, তাই না?' 

      "দিব্যি কেটে বলছি আরেভিক, তুমি ঠিক সূর্যের মতো!”

     হাঁটতে হাঁটতে আমরা ফিরে এলাম শহরে। অনিচ্ছায় নিলাম বিদায়। ও প্রেমে না ছিল কথা, না চুম্বন। সে এক বিরাট দুকূলপ্লাবী ভালবাসা যাতে শপথ নেই, আশা নেই, অঙ্গীকার নেই। আমরা হাঁটছিলাম নীরবে, মনে মনে উভয় উভয়কে চুমু খাচ্ছিলাম, জড়িয়ে ধরছিলাম। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একই রাস্তায় বাড়ি ফেরা। অতক্ষণ বাইরে থাকার জন্য মাদাম ব্যারিয়ার আরেভিককে পরে দু- দুবার পিটিয়েছেন। 

                      ইত্যবসরে, মাঠে মাঠে বসন্ত এসে গেল। তা আমাদের ডাকছিল। একদিন স্কুল ছুটির শেষে আরেভিক আর আমি কাশফুল তুলতে গেলাম। ঈশ্বর, সে কি বসন্ত। পাহাড়-পর্বত, নদী প্রান্তর উপত্যকা সবকিছু সবুজে সবুজে সমাচ্ছন্ন হয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের সামনে। সীমাসংখ্যাহীন ফুল চতুর্দিকে বিসারিত। সেই প্রথম আরেভিককে অত খুশি মনে হাসতে শুনলাম। প্রজাপতিগুলির পিছন পিছন ও হুটোপুটি করতে লাগল, তারপর গিয়ে ঝাপাল খাঁড়ির মধ্যে আর আমার গায়ে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিল জাবুজুবু করে।

       আমি খেপে গেছি, তাই না?' সে বলেছিল। 

      এখন তাকে সত্যিই লাগছে যেন সূর্য। ফুলের তোড়া বানাবার জন্য ও যখন ঘাসের উপর বসে পড়ল, আমি তখন নুয়ে ওর মরাল গ্রীবায় চুমু খেলাম। ওর ত্বক ছিল মখমলের মতো উষ্ণ আর নরম। আমার ঠোট দুটো ফুল আর রৌদ্রের স্বাদ পেল। ও বাধা দিল না, কিন্তু আমি যখন ওর মুখের দিকে তাকালাম, ওর অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে ভয়। কাঁদতে শুরু করল।

            "কেন অমন করলে?' দু হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। যা করেছি তাতে অন্যায় কিছু ছিল? ওকে চুমু খাওয়ার মধ্যে অন্যায়টা কিসের? ওর চোখদুটি লাল হয়ে উঠল, যেন আবার বকাঝকা খেয়েছে। কিন্তু আমি তো শুধু চুমুই খেয়েছি। বাড়ি ফিরবার জন্য রওনা হলাম। হঠাৎ এক ধুলোর কুণ্ডলী আমাদের সামনে উত্থিত হল। আরেভিক মড়ার মতো স্থাণু হয়ে গেল। 'সেরেছে! এ যে বাবা।' ওর বাবা ইতিমধ্যেই গাড়ির দরজা খুলে ধরেছেন। ধূলিধূসরিত একটি রাক্ষস আমাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। তখনই দেখালাম অ্যাডামের দুটি পা, চারটে চাকা নয়। কোনদিন ভাবতে পারি নি উনি অত বিশাল আর ওঁর কাঁধটা অত চওড়া। 

        এখানে কি করছিস, আরেভিক?' 

      প্রথমে ও ফুলের তোড়াটা পেছনে লুকানোর চেষ্টা করল। পরে নীরবে তা বাবার দিকে বাড়িয়ে ধরল, কিন্তু অ্যাডাম তা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। 

      "এই ভিখিরিটার সঙ্গে কি করিছস এখানে, বদ মেয়ে?? – চিৎকার করে ওঠেন। বুড়ো ফুলগুলিকে তো ছিঁড়ে কুটে খেয়ে নিয়েছে, শীগগিরি তা এখন আমাদেরও গিলে ফেলবে, অ্যাডাম এবার আমার দিকে মুখ ঘোরালেন। 'ভেবেচিন্তে চল হে, ছোকরা। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে বড্ড।' এই বলে আরেভিককে চুলের ঝুঁটি ধরে গাড়িটার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। সগর্জনে গাড়িটি চলে গেল। পেছনে ধুলোর কুণ্ডলী। ইস, কি ময়লা জমেছে গাড়িটাতে, খুব ভাল করে ওটা ধোয়ানো দরকার। 

       আমাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠল। এমন কি স্কুলেও আরেভিক আমার কাছে আসতে ভয় পেত। স্নাতক হবার পর আমি কলকাতায় আসি আরো পড়াশুনার জন্য। কিছুদিন পর শুনলাম আরেভিকের বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর rusty-old অ্যাডামের চাকরি চলে গেছে। সবাই বলছে ওঁর এখন আছে দুই হাত দুই পা এবং উনি ওঁর পা হাঁটবার কাজে ব্যবহার করছেন। আমার কথা এখানেই শেষ,আরেভিকের ইতিহাসও এখানেই শেষ । আজ এত কাল পরে সেই মাঠের পাশে এসে আবার মনে পড়ে গেল বাল্যের সেই অপূর্ব অপরাহ্ণের কথা, মনে পড়ে গেল তার কথা । আমার মনের কোথাও জেগে রইল অ্যারভিকের স্মৃতি, তার গ্রীবা সূর্যালোক আর ফুলের যে আশ্বাস দিয়েছিল তার জন্য মনটা এতদিন পরে আবার যেন কেমন করে উঠলো।

💓❣️🥺


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance