Imran Hassan

Abstract Fantasy Others

4.7  

Imran Hassan

Abstract Fantasy Others

আমার বন্ধু রহিম

আমার বন্ধু রহিম

6 mins
461


 আমরা গাঁয়ের ছেলেরা সবাই মিলে সদাসর্বদা সুখেই ছিলাম। আমাদের জন্য না ছিল কোন বিদ্যালয়, না কিছু শেখার ব্যবস্থা। আমরা ছিলাম যেন মুক্ত বিহঙ্গ, সারাটা দিন খেলে বেড়াতাম। আহা, কি খেলাটাই না খেলতাম! আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল কি অটুট এবং সবাই সবাইকে কি ভালটাই না বাসতাম। ক্ষিদে পেলে আমরা বাড়িতে ছুটতাম এক টুকরো রুটির জন্য, বয়ামে রাখা খানিকটা পনীরের জন্য, খেয়ে নিয়ে পরক্ষণেই আবার হাওয়া। কখনো কখনো বিকেলের দিকে আমরা জড়ো হতাম গালগল্পের জন্য। একটি ছেলের নাম ছিল রহিম। কত গল্প আর রূপকথাই না জানত সে, সে- সবের যেন শেষ ছিল না। গ্রীষ্মের জ্যোৎস্নাভরা রাতগুলিতে আমরা গোল হয়ে বসতাম আমাদের আঙিনায় জড়ো করা তক্তাগুলির উপর এবং মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম রহিমের মুখের দিকে। সে আমাদের বলত গুলি-পেরির গল্প, আলো এবং অন্ধকারের রাজ্য এবং নন্দন কাননের পাখির গল্প। বল বল রহিম, আমাদের আরেকটা গল্প বল। অন্ধ রাজার গল্পটা বল, সেই যে তোতাপাখির কাহিনী আর সেই যে টেকো আর দাড়ি-গোঁফ না-থাকা লোকটার গল্পটা বল।'                  

                                       এক

একদিন আমাদের গাঁয়ে এক পাঠশালা হল। আমার বাবা-মা আমাকে পাঠশালায় ভর্তি করলেন, আরো বিশ-ত্রিশজনও তাই করলেন। মাইনে ছিল বছরে এক হাজার । যে-সব ছেলের বাপ-মা তা দিতে অপারগ, তারা পাঠশালায় বাদ পড়ল। আমার বেশির ভাগ বন্ধুরই পাঠশালায় যাতায়াত ঘটল না, তাদের মধ্যে রহিমও ছিল। জীবনে এই প্রথম আমরা বিচ্ছিন্ন হলাম। ঐ পাঠশালা আর শিক্ষক আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর কাজটি শুরু করলেন। এই প্রথম আমাদের বোঝানো হল যে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্পন্ন ঘরের ছেলে, কেউ কেউ গরীব। আমার কানে রহিমের সেই আর্ত কান্না এখনো ভাসে, ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে সে কাঁদছে আর চেঁচাচ্ছে। 'আমিও পাঠশালায় যাব গো ।' এবং ওর বাবার গলাও আমি যেন এখনো শুনতে পাই, সেই চেঁচানি : 'হা ঈশ্বর, তুই কি বুঝবি নে! আমার যে কানাকড়িটিও নেই! আমার যদি এক হাজার থাকবে তা দিয়ে আমি দানাপানি কিনতাম রে, তবে তো তোরা না খেয়ে মরতিস না রে। আমার যে কানাকড়িটিও নেই! রহিম আর আমার অন্য যে সব বন্ধুর কপালে পাঠশালায় ভর্তি হওয়া ঘটে নি তারা ঘুরে ঘুরে আসত আর দল পাকিয়ে দাঁড়াত আমাদের দরজার ওপাশে, উঁকি মেরে দেখত আমাদের। কিন্তু পণ্ডিতমশাই ওদের ভেতরে ঢুকতে দিতেন না। তিনি ওদের তাড়িয়ে দিতেন। ছুটির সময়েও তিনি ওদের সঙ্গে আমাদের খেলতে দিতেন না। তিনি বলতেন, পাঠশালার ছেলেদের সঙ্গে বাইরের ছেলেপিলের খেলাধুলার প্রশ্নই ওঠে না। আমার বন্ধুরা চলে যেত, পাঠশালা থেকে একটু দূরে গিয়ে কোথাও বসে থাকত, যতক্ষণ না আমাদের ছুটি হয় ততক্ষণ অপেক্ষা করত। তারপর সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। পাঠশালায় প্রথম বছরে ক্রমে ক্রমে আমার নতুন নতুন বন্ধু হল। বছর না ঘুরতেই রহিম আর আমার অন্য যে সব বন্ধুর কপালে পাঠশালায় ভর্তি হওয়া ঘটেনি তারা আমার জন্য বাইরে আর অপেক্ষা করত না।          

                                     দুই

গাঁয়ের পাঠশালায় আমি পড়েছিলাম দু বছর। তারপর আমার বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন কাছের একটা শহরে। সেখানকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করালেন আমাকে। আমার কাছে এ ছিল এক নতুন জগৎ। যত বাড়ি সবার লাল ছাদ। সেখানে মানুষেরা কি সুন্দর সব পোশাক-পরিচ্ছদ পরত। সব পরিষ্কার, ঝকঝকে। স্কুলটিও ছিল মস্ত বড় এবং সুন্দর। পাঠশালার মতো একজন মাত্র পণ্ডিতমশাই এখানে নন, এখানে শিক্ষক আছেন বেশ কয়েকজন, তাদের মধ্যে আবার একজন মহিলা। আমার কাছে তো এক পুলকিত বিস্ময়। নতুন পরিবেশ এবং স্কুলের সঙ্গে সামঞ্জসা রক্ষা করে আমার পোশাক-পরিচ্ছদেও পরিবর্তন ঘটল। এখন আমি শহুরে বিদ্যালয়ের সুন্দর পরিচ্ছন্ন ইউনিফর্মে সজ্জিত। এমনি রূপান্তরিত হয়ে ছুটির সময় আমি ফিরে গেলাম আমার গ্রামে। রহিম আর আমার পুরনো বন্ধুরা যখন শুনল আমি বাড়ি ফিরেছি, সকাল সকাল সবাই ছুটে এল। এদিকে সেদিকে জড়ো হয়ে উকিঝুকি মারতে লাগল। আমি বেরিয়ে এলাম ওদের সঙ্গে কথা বলতে। বলতে পারি না আমরা কি বলাবলি করেছিলাম। কিন্তু বেশ মনে আছে আমাদের সেই পুরনো বন্ধুত্ব তখন আর ছিল না। ওরা যেটা প্রথমেই লক্ষ্য করল, তা আমার ইউনিফর্ম। আমার খাটো কায়দানশীন জামাটার দিকে তাকিয়ে। রহিম চোখ মটকাল, বলল, 'তোকে দেখতে লাগছে যেন ওরা লেজ থেকে তোর পালক টেনে বের করেছে।' সবাই হেসে উঠল। খুব চটলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। রহিম তখন আমার জ্যাকেটের কাপড়ে হাত বুলিয়ে পরখ করল, দেখাদেখি বাকিরাও তাই করল। কি মোলায়েম কাপড়' বলতে বলতে তারা অবাক। তখনই প্রথম ওদের পরনের জামা- টামার দিকে নজর পড়ল, লক্ষ্য করলাম কি নোংরা আর ছেঁড়া-ফাটা ওদের জামা- কাপড়। বাস্তবিকই গোটা গ্রামটাকেই আমার মনে হল হা-ভাতে আর নোংরা। 

                                   তিন

দু বছর বাদে আমার বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন এক মহানগরীতে এবং আরো বড়ো এক স্কুলে আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন। সেখান থেকে যখন ফিরলাম, আমার পুরনো সঙ্গী-সাথীরা সবাই তখন বয়স্ক, এল তারা, সম্ভাষণ করল আমাকে — যেমন করে করল অন্যান্য চাষাভূষারা—এবং তাদেরই মতো দাঁড়িয়ে রইল একপাশে, সসম্ভ্রমে। আমাদের কথাবার্তার মধ্যে যখন একজন একবারই আমাকে জিজ্ঞেস করল গায়ের পাঠাশালার সেই মেলামেশার দিনগুলোর কথা আমার কিছু মনে আছে কিনা, তখনই রহিম মুখ খুলল। “তোমার মনে পড়ে রাত্তিরবেলা তোমাদের উঠোনে তক্তার ওপর কেমন গোল হয়ে বসতাম সবাই আর প্রাণের কথা বলতাম?' জিজ্ঞেস করল। ‘তা কখনো ভুলতে পারি। সে তো আমার এক অক্ষয় স্মৃতি।” মনে হল শুনে রহিম খুশি হল, তবু সে দূরে সরে রইল, অচেনার মতো। যাই হোক, মহানগরীতে যখন আমার ফেরবার সময় হল, আমার বাবা রহিমের বাবার কাছ থেকে আমার জন্য একটা ঘোড়া ভাড়া করলেন। ঠিক হল, আমি চড়ব ঘোড়ায় আর সেই ঘোড়ার সঙ্গে যাবে রহিম। যখন যাত্রা করলাম, আমি রইলাম ঘোড়ার পিঠে, রহিম চলল পায়ে হেঁটে, ছিন্ন বসনে জীর্ণ পাদুকায়। বাস্তবিকই আমার খারাপ লাগল। ঐভাবে আমি খানিকটা গিয়ে আমি বরং হেঁটেই যাই' বলে নেমে পড়লাম। আমরা এগোতে লাগলাম, কখনো একসঙ্গে পায়ে হেঁটে, কখনো বা পালা করে ঘোড়ায় চেপে। রহিম খুশি হল কিন্তু আমি বেশ বুঝলাম, আমার ভদ্রতার মনোভাবটি সে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে নি। বরং আমি যে হেঁটে যাচ্ছি এতে রহিম আমাকে বোকা ভাবল। আমি ক্ষুণ্ণ হলাম, কিন্তু এর চেয়ে আরো খারাপ ব্যাপার হতে তখনো বাকি।কিছু খেয়ে নেবার জন্য রাস্তায় এক জায়গায় থামলাম। একটা তরমুজ কাটবার জনা পকেটের ছুরিটা আমি রহিম হাতে দিলাম। তারপর ফের যখন যাত্রার উদ্যোগ করছি তখন দেখি সেটি উধাও। রহিম দিব্যি কেটে বলল, ওটা সে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং আমি নাকি সেটা পকেটে রেখেছি। আমি জানতাম ও তা মোটেই দেয় নি তবু পকেটগুলি একবার হাতড়ে দেখলাম। যাক, রওনা হওয়া গেল। এটা পরিষ্কার ছুরিটা সে গায়েব করেছে। পরে অবশ্য অন্য লোকে তার কাছে সেটা দেখেওছে। রাস্তায় যেতে যেতে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল। নিশ্চয়ই হারানো ছুরিটার জন্য নয়। তার চেয়ে আরো বড় একটা ক্ষতির জন্য। আমার বন্ধু সে সম্পর্কে মোটেই উদ্বিগ্ন নয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর পর রহিম যখন ফিরবে আমি ওকে ঘোড়ার জন্য ভাড়া দিলাম। এছাড়া জ্যাকেট বানাবার জন্য কিছু ছিট কাপড় কিনে দিলাম। কিন্তু ও বলে বসল, 'বকশিস দেবে না?' আমি দারুণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। দিলাম বকশিস। তবে এরপর থেকে যখনই আমার মনে পড়েছে সেই ছেলেবেলার দিনগুলির কথা, চাঁদনী রাতে তক্তার ওপর গোল হয়ে বসে রহিমের মুখে গল্প শোনার কথা— তখনই আমার মনটা ভরে গিয়েছে ব্যথায়, করুণায়। 

                                    চার

“রহিম গরীব....রহিম কিছু জানে না, কিছু শেখে নি...গ্রাম্যজীবনের নিরাশ্বাস দারিদ্র্যে নেসো গুঁড়িয়ে গেছে...যদি ও শিক্ষার সুযোগ পেত, যদি প্রতিপালিত হত সুস্থ জীবনের নিয়মে, তবে তো সে আমি যা হয়েছি তার চেয়ে অনেক বড় হতে পারত।' আজ যখন আমি রহিমের কথা ভাবি এসব মনে হয়। মনে মনে নিজেকে বলি, চেষ্টা করি তার দোষ স্খালন করতে। আমার চোখে তাকে বড় করে তুলতে, ছেলেবেলায় যেমন ভালবাসতাম তেমনি করে ওকে আবার ভালবাসতে চাই। আমি চাই রহিম আমার চোখে থাক তেমনি হয়ে যেমনটি ছিল সেই শান্ত তারাভরা জ্যোৎস্নাধোয়া রাতগুলিতে। কিন্তু এখন দেখছি তা অসম্ভব। আমি তা পারি না। সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে আসে আরেকটি ছবি। লজ্জাকর এবং কষ্টকর একটি ঘটনার ছবি। শিক্ষাজীবন শেষ হলে বিশ্বভুবনে নিজের জন্য একটি স্থান প্রস্তুত হল আমার। ফের একবার এলাম গ্রামে, আমার জন্মভূমিতে। সেদিন গ্রামের মাঠটি ছিল লোকে লোকারণ্য। প্রচুর কোলাহল। মাঠের মাঝখানে একটা খুঁটির সঙ্গে বাঁধা রহিম। লজ্জায় ঝুলে পড়েছে তার মাথা। শুনলাম ওর সাজা হচ্ছে, চুরি করেছে বলে। আমি ওর পক্ষ নিয়ে কথা বললাম। ও ছাড়া পেল। কিন্তু এখনো আমার মনে গেঁথে আছে—কাঠফাটা রোদে— রহিম খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। মাথাটা পড়েছে ঝুলে। আর মানুষজনের উল্লাস। চুরি এবং চোরকে চাবুক মারার ঘটনা আমাদের গ্রামের স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমি এই ঘটনাটিকে ভুলতে পারি না। ভুলতে পারি না তক্তার উপর চাঁদনী রাতে ছোট্ট রহিম বসে আছে, আমাদের গল্প বলছে। রহিম — নিষ্পাপ, মিষ্টি। রহিম, আমার ছেলেবেলার বন্ধুটি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract