STORYMIRROR

Payel Guha

Horror Crime Thriller

4  

Payel Guha

Horror Crime Thriller

ফল।।

ফল।।

12 mins
311

~১~


তাতানকে খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। কোথায় গেল ছেলেটা? পাগলের মতো ওর মা গোটা পাড়া খুঁজে বেরালো, কিন্তু পায়নি। একটা গোটা রাত ছেলেটা বাড়ির বাইরে, তার উপর কাল রাতে যা দুর্যোগ গেল তারপর ছেলেটা কি আর... না তাতানের মা আর ভাবতে পারছে না।সুবোধের বাবা আলিপুরদুয়ার থানার পুলিশ অফিসার, উনি এসে জিজ্ঞেস করলেন সুবোধকে, “ তোরা তো কাল একসাথে খেলছিলিস, একসাথে ফিরিসনি?” সুবোধ আর শাশ্বত একবার চোখাচোখি করল, তারপর সুবোধ বলল, “ বাবা, মেঘ করে এসেছে দেখার পরও আমরা খেলছিলাম, ভাবলাম একটু পর বাড়ি আসব। এমন সময় হঠাৎ কবরখানার ওদিকটায় মানে মাঠের কাছাকাছি একটা বাজ পরে তুমুল আওয়াজ করে‌। আমরা তো বেজায় ভয় পেয়ে যাই, তারপর ছুটে বাড়ি চলে আসি।”— আর তাতান? — আমরা তো একসাথেই দৌড় দিয়েছিলাম, ও যে আসেনি তা কিভাবে জানবো।সুবোধের বাবা চিন্তিত মুখে মাথা নাড়েন। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি হলেও আর পাওয়া যায়নি তাতানকে। তাতানের মা সারাদিন ছেলের জন্য বসে থাকেন, খুঁজে বেড়ান, কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে যেতে লাগলেন। কয়েকজন বললেন, “নির্ঘাত ছেলেটা কালজানিতে পরে ডুবে গেছে” কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব তার কোনো যুক্তি দিতে পারেননি, বাড়ি ফেরার পথে নদী পরে না তবে? তারপর সময়ের হাত ধরে সবাই ভুলে গেল, কিন্তু ভুলতে পারলো না তাতানের মা‌।


এই ঘটনার এক-দেড় মাসের মাথায় সুবোধরা শিলিগুড়ি চলে যায়। সুবোধের বাবা ট্রান্সফার হলে ওকেও ওর বাবার সাথে চলে যেতে হয়। তারও পর কেটে গিয়েছে আরো অনেক বছর, সেদিনের দশ বছরের সুবোধের এখন ২৫ বছর বয়স। সুবোধ এখন কলকাতা থাকে, বাবা মারা যাবার পর ওর মা সবে দেড়মাস হলো ওর কাছে এসে থাকছে। আজ ওর বান্ধবী শ্রুতির কাছে মা-কে রেখে ও ফিরছে ছোটবেলার শহরে।সুবোধ ছোটবেলায় যেখানে থাকত, সেই জায়গাটার নাম চেঁচাখাতা। আলিপুরদুয়ার শহর থেকে অনেকটা ভিতর দিকের জায়গা। ওখানে ওদের জমি-জায়গাটা এখনও আছে। ওর বাবা থাকতে ওর বাবা আসতো, বাড়িটা, জমি-জায়গা গুলো দেখে যেতো। আসলে চেঁচাখাতায় ওর দাদুর বানানো বাড়ি ওটা, ওর বাবা পুলিশের চাকরি করতো বলে বদলি হতে হতো, তবু ওর বাবা নিজের পৈত্রিক সম্পত্তিকে আগলে রাখতো‌। তাই এতোদিন ওকে এসব কিছু দেখতে হতো না, ওর বাবা-ই মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেতো। কিন্তু ওর বাবার অবর্তমানে কিভাবে কি করবে তা জানে না। কিভাবে মেনটেইনেন্স হয় তাও ওর অজানা। তাই সবটা দেখতে এসেছে সেই ছোটবেলার জায়গায়।


গিয়ে উঠেছে ওর সেই ছোটবেলার বন্ধু শাশ্বতর বাড়ি। শাশ্বত এক-দুবার শিলিগুড়িতে এসেছিল, ওটুকুই দেখা, তবে যোগাযোগ মুছে যায়নি। এতোদিন পর আবার ছেলেবেলার জায়গায় ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে মিলে বেজায় খুশি দু'জনেই। — তবে ফাইনালি তুই এলি। আমি তো ভাবলাম তোর পদধুলি আর পরবে না। — চুপ কর তো! আচ্ছা আসার সময় দেখলাম এ জায়গাটা কত চেঞ্জ হয়ে গেছে রে!  — হবে না? আসতে আসতে দেখ না, এখানেও ফ্ল্যাট হওয়া শুরু হবে‌। তো বলছি তুই সে শুভারম্ভটা কর না! — না ভাই, প্লিজ এই সাজেশন দিস না। যতই বল এতো দিন পর আলিপুরে এসে মন ভালো হয়ে গেল। এখানে ওই ফ্ল্যাটের জঙ্গলের কি দরকার বল? — বটে! তো বসে কি করবি? চল উঁচু মাঠের থেকে ঘুরে আসবি নাকি? — চ! দুপুর বেলা বসে থাকাতো পাপ তাই না? সেই ছোটবেলার মতো দুপুরে উঁচুর মাঠে যাওয়া যাক।


ওদের এলাকার বড় মাঠ হল ওই উঁচু মাঠ। উঁচু মাঠ বলে কারন মাঠ পার করলেই কবরস্থান, আর তারপর শশ্মান, তারপর চর নেমে কালজানি। ওই উঁচুর মাঠটাই ওখানকার বাচ্চাদের খেলার জায়গা। ওরাও ওখানেই খেলাতে যেত। এতোগুলো বছর পর সেই মাঠে দাঁড়িয়ে সুবোধ আর শাশ্বত ছোটবেলার কথা গুলোই রোমন্থন করছিল। হাসাহাসি, ইয়ার্কি চলছে। গল্প করতে করতে কবরখানায় চলে গেছিল ওরা, হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থমকে গেল। ওর থমকে যাওয়া মুখ দেখে শাশ্বত বলে ওঠে, “তাতানের মা এখন এই গাছ তলাতেই বসে থাকে। রাতে আমাদের ক্লাব থেকে একজন এসে ওনাকে নিয়ে যায়, আবার সকাল হলেই উনি নিজে এখানে চলে আসেন।”— আর তাতানের বাবা?— কবেই মারা গেছেন— আচ্ছা শাশ্বত, এখানেই তো...কথাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, শাশ্বত বলে ওঠে, “ হ্যাঁ, এখানেই... আমাদের জীবনে ওই একটাই ভুল, ওই একটাই পাপ থেকে গেল রে...”সুবোধ মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। শাশ্বত বলে, “ছাড়, কি আর করবো। তখন তো আমরা ছোট ছিলাম, জেনে বুঝে তো করিনি।” সুবোধ বলতে যাচ্ছিল, “ সত্যিই কি জেনে বুঝে...” অসম্পূর্ণ থেকে যায় কথাটা। যে গাছের নিচে তাতানের মা বসে আছে, সেই গাছে চোখ আটকায় সুবোধের।— একি! এ আবার কেমন গাছ?


~২~


এখানে গাছটার বর্ননা দেওয়া দরকার। গাছটা একটা মরা গাছ, কিন্তু ওই গাছটায় ফলে আছে লাল টকটকে চেরির মতো ফল। “এ আবার হয় নাকি?”, সুবোধ ভাবলো মনে মনে।কিন্তু শাশ্বত অবাক হলো না, বরং শিহরিত হল‌। তড়িখড়ি করে বলল, “ দেখ আজকেও আবার মেঘ করে কালো হয়ে এসেছে। সন্ধ্যেও হয়ে এসেছে, অন্ধকার হয়ে গেল, বাড়ি যাওয়াটা দরকার ভাই। ওসব ফল-টল ছাড়।“কিন্তু!...", সুবোধকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে রীতিমতো টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে আসলো শাশ্বত।


ব্যাপারটা রহস্যজনক লাগে সুবোধের কাছে। ফলের ব্যাপারটা মোটেও মাথা থেকে বেরোয় না সুবোধের। বাড়ি এসে জিজ্ঞেস করে শাশ্বতকে, “ওমন করে টেনে আনলি কেন আমায়?”— আরে দেখেছিস, বাইরের কি অবস্থা? অন্ধকার হয়ে এসেছিল তাই...— বাচ্চা ভোলানো কথা বলিস না। কি লুকোচ্ছিস?— শোন! মরা গাছে কখনো ফল হয়? ওই গাছটা ভূতূরে। ওই গাছের ফল যে দেখে তার বিপদ নিশ্চিত। ওই ফল দেখার পর মানুষ আকৃষ্ট হয়, কারন ঘটনাটা তো বিরল। সেই আকর্ষণে যে যে গাছটার কাছে গেছে তাদের পরে কবরে পাওয়া যায়।— কী!— হ্যাঁ, ইনফ্যাক্ট আমাদের এখানের রঘুদাও দেখতে পেয়ে গেছিল। তারপর ঠিক কী হয় কেউ জানে না। ওনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে, খুঁজতে খুঁজতে ওখানে গেলে, মাটির উপরে একটা মানুষের হাত দেখতে পাই, মাটি খোঁড়া হয় তারপর, দেখি রঘুদার প্রাণহীন শরীর। এখন কিভাবে জলজ্যান্ত মানুষটাকে কবর দিল, তা কেউ জানে না।— এই কাহিনীর সাথে ফলটার কী সম্পর্ক? উনি যে ফলটার জন্য ওখানে গেছিল তার কি প্রমান?— ওনার স্ত্রী বলেছে রে। উনি ফলটা দেখে ওনার স্ত্রীকে বাড়িতে এসে বলেছিলেন, কিন্তু ওনার স্ত্রী বিশ্বাস করেনি বলে, রঘুদা ফল এনে দেখাবে বলেছিলো।হেসে ফেলে সুবোধ। এসব কি বোকা বোকা কথা! এই একটা ঘটনা থেকে এরা এমন গুজব রটাচ্ছে! নির্ঘাত এই ঘটনার পিছনে অন্য কোনো কারন আছে, লোকটার কোনো শক্রুও থাকতে পারে। শক্রুর কথাটা বলতেই শাশ্বত ফোঁস করে ওঠে। — ওমন র্নিবিবাদী লোকটার শক্রু? বাজে কথা বলিস না।সুবোধ আমল দিলো না শাশ্বতর কথায়। কোনো একটা ব্যাপার আছে ওই গাছটায়, বেশ ইন্টারেস্টিং! দেখতে হবে কাল আরেকবার... তবে সুবোধ এসব আর শাশ্বতকে বলল না। ও বুঝতে পেরেছে, যেহেতু ঘটনাটা বিরল তাই এমন কথা রটেছে।শাশ্বত-র সাথে ওই করবখানার গাছ নিয়ে কথা বাড়ায়নি সুবোধ। শাশ্বত মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়ে, আড্ডা দিয়ে ঘুমোতে যায়। 


তখন হয়তো মাঝরাত। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় সুবোধের। প্রথমে ঘুম ভাঙার কারনটা বুঝতে না পারলেও পরে খেয়াল পরে ওর খাটের মাথার দিকের জানালাটা খুলে গিয়েছে। আর বাইরে ঝড় উঠেছে, ওই ঠান্ডা হাওয়ায় ঘরের টেম্পারেচারটাও অনেকটা নেমে গিয়েছে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে‌। আর খেয়াল করে একটা মিষ্টি গন্ধে ভরে আছে ঘরটা। কি মনে হতে, জানলার কাছে এসে দাঁড়ায় সুবোধ। ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছে ওর মুখে, আর সাথে গন্ধটাও আছে। মনে মনে একবার ভাবলো কিসের গন্ধ? কোনো ফুল? কিন্তু শাশ্বতর বাগানে এমন সুগন্ধী ফুলের গাছ তো দেখলো না। তবে? আবার নিজেই নিজেকে বোঝালো, ঝড়ের হাওয়ার সাথে বয়ে আসছে, আসপাশের বাড়ি থেকে। বুকভরে নিঃশ্বাস নিল সুবোধ‌। হয়তো কয়েক সেকেন্ড পার হয়েছে কি হয়নি, মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছে সুবোধের। সুবোধ ভাবছে শুতে চলে যাবে, জানলাটা বন্ধ করার মুহূর্তে চোখ পরল শাশ্বতদের গেটের সামনের কে জেনো দাঁড়িয়ে। না ভয় পায়নি সুবোধ, কৌতুহলী হয়ে ওঠে। ভালো করে বোঝার জন্য তাকিয়ে থাকে, রাস্তা অন্ধকার ঝড়ের জন্য কারেন্ট অফ, বুঝতে পারছিল না, এমন সময় একবার বিদ্যুৎ চমকালে দেখতে পায় তাকে‌।তাতানের মা? এই ঝড়ের রাতে ওখানে কি করছে? আর সুবোধ স্পষ্ট দেখলো ওর মা জানালার দিকে তাকিয়ে, কিন্তু কেন? কেন-র উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল না সুবোধ, মানসিক ভাবে ভারসাম্য হারানো মানুষের সব কাজের কারন থাকবে এমন তো নাও হতে পারে। তবে এমন ঝড়ের রাতে উনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে? সুবোধ ভাবলো ওনাকে ভিতরে নিয়ে আসবেন। জানলা থেকে সরে দরজার দিকে এগোলো সুবোধ। শাশ্বতকে ডাকবে ভেবেও ডাকলো না। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বাইরে তখন তান্ডব চালাচ্ছে ঝড়, মাঝেমাঝে বজ্রপাত, বিদ্যুৎ চমকানো চলছে। ও তার মধ্যে দৌড়ে সদর দরজা আর বাড়ির গেটের মধ্যেকার ব্যবধান পেরিয়ে গেট খুলে, “কাকিমা এখানে কি করছো?”কিন্তু ও বেড়োতেই হঠাৎ এগোতে লাগলো তাতানের মা। একটু থতমত খেয়ে যায় সুবোধ। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকে, “কাকিমা! শোনো! কোথায় যাচ্ছ?”কিন্তু তাতানের মা থামলো না, এগিয়ে চলল। এই ঝড়ের মধ্যেও তাতানের মা দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সুবোধের এই ধুলো-ঝড় এর মধ্যে এগোতে যথেষ্ট নাজেহাল হতে হচ্ছে। যখন ওরা উঁচু মাঠে পৌঁছালো ততক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে‌। উঁচু মাঠে তাতানের মা-কে আসতে দেখে সুবোধ বুঝতে পারে কেন এসেছেন। উনি কি মাঝে মধ্যেই আসেন? তবে যে শাশ্বত বলল ক্লাবের লোক ওনাকে নিয়ে যায়? নিশ্চয়ই উনি যে রাতেও এখানে আসেন তা হয়তো কেউ জানে না। সুবোধ এসব ভাবতে গিয়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গেছিল, তবে ও জানতো তাতানের মা সেই গাছটার ওখানে থাকবে। সেখানে গিয়ে দেখলো, ঠিক তাই। তাতানের মা গাছের ওখানে, মাটির উপর নিজের আঁচল বিছিয়েছেন, আর বলে যাচ্ছেন, “ভয় পাস না বাবু আমি এসেছি। এই তো তোর মাথায় আঁচল দিয়েছি... আর ভিজবি না তুই‌। ভয় পাস না বাবু, এই তো আমি এসেছি, তোর মা এসেছে”থমকে গেল সুবোধ। বুকটা মুষড়ে উঠল ওর। মনে পরে গেল, সেই ছোটবেলার বিকেলের কথা...


~৩~

তাতান-সুবোধ-শাশ্বত তিনজন ছোটবেলার থেকেই একে অপরের বন্ধু। এই তিনমুর্তি সবসময় একসাথে থাকে। আর সারাক্ষন দুষ্টুমি করে বেড়ায়‌। বিশেষ করে তাতানের দুষ্টুমি বুদ্ধি সবচেয়ে বেশি। আর যত রাজ্যের বিপজ্জনক কাজ কর্ম করে খেলতে ও মজা পায়, ভয়-ডর জিনিসটার ছিটেফোঁটাও ওর মধ্যে নাই। ওর মতে ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়‌‌। সেদিনও তাতানের মাথায় চাপে, ওরা কবরস্থানে লুকোচুরি খেলবে। বাকি দু'জন একটু ভীতু হলেও তাতানের উপর কোনো কথা বলতে পারেনি। শেষ দুপুরে তিনজন কবরস্থানে যায়।মেঘলা হয়ে কালো হয়ে এসেছিল সেদিন। কিন্তু তাতানের মতে অমন ওয়েদার নাকি কবরস্থানে খেলার জন্য আদর্শ। ওখানে টুক-টাক লুকোচুরি খেলতে শুরু করে। প্রতিবার সুবোধ আর শাশ্বত হেরে যাচ্ছিল। স্বাভাবিক, ওরা দু'জন দিব্যি বুঝতে পারে তাতানের এই জায়গাটা চেনা, আর ও জেতার জন্যই এখানে আজ খেলতে এসেছে। আগের দিন হেরে গেছিল কিনা! সেদিন সুবোধরা খুব খচিয়েছিল, তাই আজ... তাতানের ফন্দি বুঝতে পেরে তাতানকে শায়েস্তা কিভাবে করা যায় তার সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে ওরা।এবারের চোর সুবোধ। শাশ্বতকে ধরে ফেলেছে কিন্তু তাতান? না দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। সুবোধ খুঁজতে থাকে।শাশ্বত খেয়াল করে অন্ধকার করে এসেছে, কালবৈশাখী উঠবে বলে। সন্ধ্যের আগেই যেন আজ সন্ধ্যে নামতে বসেছে।— ভাই ওয়েদার দেখেছিস? বাড়ি চল...— তাতানকে না হারিয়ে আজ যাব না— আরে আকাশ দেখ...শাশ্বত আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে সুবোধের দিকে তাকাতে, দেখে সুবোধ একটা নির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে।— কী দেখছিস?সুবোধের মুখে চোরা হাসি। শাশ্বত-র কাঁধ ধরে, আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছিস কিছু?“তাতান!”, শাশ্বতর গলায় বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। কবরস্থানে বেশ কদিন আগে খোঁড়াখুড়ি চলেছিল হয়তো। এক ভাঙা কবরের মধ্যে ঢুকে তাতান! কবরটির সিমেন্টের বাঁধানোটা আধখানা ভাঙা, তার মধ্যে গিয়ে ঢুকেছে। হুট করে দেখলে চোখেই পরবে না, পরেও নি ওদের। এখান দিয়ে একটু আগেও ওরা গেছিল, দেখতে পায়নি। কবরে কেউ লুকোবে তার কথা কারোর মাথায় আসার কথাও না। শাশ্বত-র অবাক ভাবটা কাটার আগেই দেখতে পায়, সুবোধ এগিয়ে গিয়েছে কবরটার কাছে। আর তারপর যা করল, তাতে হতবাক হয়ে যায় শাশ্বত‌। সিমেন্টের ভাঙা অংশটা বাকি অংশটার উপর ছিল ওটা ঠেলে ফাঁকটা বন্ধ করে দেয় সুবোধ। ভিতর থেকে তখন তাতান রে..রে করে ওঠে‌। একটু ফাঁক ছিল সেখান দিয়ে হাত বের করে নাড়াতে থাকে, আর ভিতর থেকে তাতানের গলা শোনা যাচ্ছে, “আরে কি করলি! সরা বেরোবো....”সুবোধ হো হো করে হাসছে।— কি? অতি চালাকের গলায় দড়ি পরলো তো? না থাক তুই ওভাবে... বেশি চালাকি না! বলতে বলতে হাসতে থাকে।শাশ্বতর মনটায় একটা ভয় কাজ করতে থাকে‌। শাশ্বত জানে যে এটা মজা কিন্তু একটা ভয় দানা বাঁধতে থাকে মনে। যেন ওর মন বলতে চাইছে কিছু একটা খারাপ হবে আজ। এমন সময় একটা বাজ পরে কাছে পিঠেই।স্বভাবতই ভয় পেয়ে যায় ওরা। চোখের নিমেষে সুবোধ দৌঁড়তে শুরু করে। শাশ্বত-ও সেই মুহূর্তের জন্য ভুলে যায় তাতানের কথা,ও ছুটতে শুরু করে। ওরা যখন কবরখানা থেকে বেড়িয়ে উঁচু মাঠে পৌঁছালো, বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। একবার চিৎকারে করে শাশ্বত সুবোধের উদ্দেশ্যে বলল, “ভাই! তাতান তো রয়ে গেল গর্তে..."না সুবোধ শুনতে পায়নি। ওরা যে যার বাড়ি চলে এসেছিল। সেদিন গোটা সন্ধ্যে থেকে রাত তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হয়। আর তাতান...


~৪~

না সুবোধরা কাউকে কিছু বলেনি, ভয়ে। আর কারোর তাতানকে কবরে খোঁজার কথা মাথাতেও আসেনি, আসলে হয়তো...যদিও ততক্ষনে কি আর তাতানকে পেত!


বৃষ্টির জোরটা আরো বেড়েছে। সেই মিষ্টি গন্ধটা এখন পাচ্ছে সুবোধ। গন্ধটার উপস্থিতিই যেন ওকে অতীত থেকে বর্তমানে এনে দাঁড় করালো। গন্ধটা যেন ওর চেতনা, জীবনীশক্তি সব শুষে নিচ্ছে। কেমন একটা ঘোর লেগে যাচ্ছে ওর...এখানে এতো জোড়ালো কেন গন্ধটা? তবে কি ওই গাছটা থেকে আসছে? ওই ফলের গন্ধ? মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিসের আমোঘ টানে যেন এগিয়ে গেল গাছটার দিকে, তাতানের মাকে পাশ কাটিয়ে। এতক্ষন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চোখ সয়ে গেছে ওর। বিদ্যুতের আলোতে দেখতে পেল নীচের এক ডালে একটা ফল ঝুলছে। এগিয়ে গেল, ডালটার কাছে গিয়ে দেখল ডালটা খুব একটা নীচু না, পায়ের পাতাটা উঁচু করে ধরতে চাইল ফলটা। ও যে কেন এতো আকর্ষিত হচ্ছে, এতো বৃষ্টি মাথায় করেও কেন বাড়ি না গিয়ে ফলটা ওর কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে ও নিজেও বুঝতে পারছে না। যেন মনে হচ্ছে ও এখন আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। ও ওমন আচ্ছন্ন অবস্থাতেও এবার একটা ছোট্ট লাফ দিল ফলটা ধরবে বলে আর ঠিক সেই সময় একটা বাজ পড়লো কাছে পিঠেই। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে পরে গেল। ও জানতো না সেখানে একটা গর্ত ছিল, গর্তে পরে যায়।তবে না.. এটা তো কোনো গর্ত নয়, একটা কবর!!..ও উঠতে যাবে তখনই একটা সিমেন্টের স্লেপ ঢেকে দিল মুখটা। শুধু একটা মাত্র ফাঁক রয়ে গেল। সুবোধের আচ্ছন্ন ভাব কেটে গিয়েছে, তার বদলে ওর বুকে চেপে বসেছে ভয়, মৃত্যু ভয়। ওই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে হাত বাড়িয়ে কোনো রকমে চিৎকার করার চেষ্টা করল কিন্তু ও জানে কে শুনতে পাবে ওর গলা? এতো বৃষ্টির মধ্যে? আর তাছাড়া এখানে তো আর কেউ নেই, শুধু...তবে? কে ঢেকে দিল? তাতানের মা? না না, ওর মায়ের গায়ে এতো জোর হবে না যে... তবে?একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেল, ঘিসঘিসে কন্ঠস্বর, “কি? অতি চালাকের গলায় দড়ি পরলো তো? না থাক তুই ওভাবে... বেশি চালাকি না!” বলতে বলতে হাসতে থাকে।বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। কে বলল কথাটা? ও ছাড়াও কি আরো কেউ ছিল? এটা তো ও তাতানকে বলেছিল না সেদিন? তবে কি এটা তাতানের গলা? কিন্তু তা কি করে সম্ভব? তাহলে কি শাশ্বত? এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালো ও? 

বৃষ্টির জল গলগল করে ঢুকতে লাগল গর্তে ওই ফাঁক দিয়ে... খুব ক্ষীন একটা মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পাচ্ছে সুবোধ, “মুক্তি মুক্তি! আমার বাবুর আজ মুক্তি!” 


~৫~

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সুবোধকে পাশে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো শাশ্বত‌। পরে সারা বাড়িতেও যখন দেখল সুবোধ নেই, তখন ধরে নিয়েছিল হয়তো ওর মর্ণিং ওয়াকে যাবার স্বভাব আছে, তার উপর মায়ের কাছে শুনল সদর দরজাটা নাকি ভেজানো ছিল।কিন্তু যখন বেলা বাড়লেও সুবোধের দেখা নেই, চিন্তা বাড়লো শাশ্বতর‌। সুবোধ কি কারোর বাড়িতে গেল? তবে একবার জানাবে না? একটু বিরক্ত হয়েই বেরিয়ে পড়ল সুবোধের খোঁজে। কোথায় ভেবেছিল আজ দু'জন সকালে মাছ ধরতে কালজানির পারে যাবে!


রাস্তার মোড়ে জটলা দেখে এগিয়ে যায় শাশ্বত।— কি হয়েছে রতন?— আরে বলো না দাদা সকালে ক্লাবে এসে দেখি কাকিমা নেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না কোথায় থাকবেন, ওনাকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে আসবো ভেবে ওই কবরখানায় গিয়ে দেখি, কাকিমা ভিজে একাকার, মনে হয় কাল রাতে ওখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু কাল যা ঝড় বৃষ্টি হল, তারমধ্যে কি না উনি ওখানে গেছেন ভাবো! দেখি হাসছেন আর বলছেন, “ মুক্তি মুক্তি! আমার বাবুর আজ মুক্তি!”— কী!— হ্যাঁ, আরো শোনো, হঠাৎ চোখ পরে কাকিমার থেকে পাঁচ পা আগে মাটিটা কেমন উঁচু উঁচু , আর আমি স্পষ্ট দেখলাম সেখান থেকে বেরিয়ে আছে একটা হাত! কেউ খুন করে পুঁতে দিয়ে গেল নাকি গো?শাশ্বতর বুকটা ঢিপ করে ওঠে। কোন অজানা আশঙ্কায় ও আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে সবাইকে নিয়ে সেখানে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে রতনের বর্ণনা মতো তাতানের মা প্রলাপ বকছে। তার থেকে পাঁচ পা আগের জায়গাটার দিকে এগিয়ে যায় শাশ্বত। বুক ঢিপঢিপ করছে, মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে বলে যেন ওর মনের আশঙ্কাটা সত্যি না হয়। কিন্তু কাছে গিয়েই বুঝতে পারে ওর আশঙ্কাটাই সত্যি। যে হাতটা বেরিয়ে আছে তার অনামিকার আংটি ও ঘড়ি দেখেই চিনতে পারে যে ওটা, সুবোধ!ওর নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্ফুটে “সুবোধ”, বলে আর্তনাদ করে ওঠে।বুক মুষড়ে ওঠে ওর। আশপাশে সকলের ওর মুখে সুবোধের নাম শুনে হইচই ফেলে দেয়। এর মধ্যে একজন মাটিগুলো হাত দিয়েই সরাতে শুরু করে। মাটি সরতেই দেখে সিমেন্টের স্লেপ! ভাঙা কবর?  চোখ জলে ভরে ওঠে‌ শাশ্বতর‌। হঠাৎ তাতানের মায়ের হাসিটা কানে যেতে বিদ্যুৎ খেলে যায় ওর মাথায়।তাতানের মা বলছে, “ মুক্তি মুক্তি! আমার বাবুর আজ মুক্তি!” 


তার মানে কী! সেই ছোটবেলার ঘটনাটা মনে পরে যায়।তার মানে কি এটা ...আর কিছু ভাবতে পারে না শাশ্বত... পায়ের জোর কমে আসে ওর... তারপর কিছু মনে নেই।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror