Pronab Das

Fantasy

2  

Pronab Das

Fantasy

পাত্র চাই।

পাত্র চাই।

10 mins
1.1K


অনেকে বলেন জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে ভগবান আগের থেকেই নির্ধারণ করে রাখেন । অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি তা অনেকাংশে সত্যি । জন্ম ও মৃত্যু এখানে এই গল্পের বিষয় নয় । বিবাহের জন্য পাত্রী দেখাকে কেন্দ্র করে ভৌতিক সমস্যায় অর্থাৎ গোদা বাংলায় পাত্রী দেখতে গিয়ে ভুতের পাল্লায় পরা, এই হচ্ছে এই গল্পের বিষয়বস্তু। এমন উদ্ভট হাড় হীম করা ভৌতিক ঘটনা খুব কম শোনা যায়।


       প্রায় মাস ছয়েক হল চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছি। অনেকের কাছে এই অবসর অখন্ড অবসর হলেও আমার আছে তা ছিল একদম বিপরীত । বাড়ীর প্রায় সব রকম কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকি বলে কখন যে সকাল থেকে সন্ধ্যে হয়ে যায় বুঝতে পারিনা । এতে আখেরে এক প্রকার লাভই হয় আমার। সময়টা যেমন কেটে যায় সাথে শরীর ও মন থাকে বেজায় ফুরফুরে । প্রতিষ্ঠিত দুই ছেলে ও নাতি-পুঁতি নিয়ে আমার ভরা সংসার । ঠাকুমার কাছে চৈতন্য দেব ও মায়াপুরের গল্প শুনে দুই নাতি হঠাৎ বায়না ধরল মায়াপুর দেখতে যাবে। যেমন বায়না তেমনি কাজ। তাছাড়া আমারও অনেকদিন কাছে পিঠে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তাই এই সুযোগের সদ ব্যাবহার করতে পরদিনই নদিয়ার পূণ্য মায়াপুরে দিন তিনেকের জন্য তিনটি ভাল ঘর বুক করে ফেললাম।


     নির্ধারিত দিনে চিতপুর স্টেশন থেকে থেকে সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে হাজার দুয়ারী লোকালে সপরিবারে চেপে বসলাম। ট্রেন দমদম স্টেশনে পৌঁছলে যেটুকু ফাঁকা ছিল, সব সিট ভরে গেল। এমনকি মুখমুখি বসা সিটের রোয়ের মাঝেও যাত্রীরা দাঁড়াতে আরম্ভ করল। ট্রেন স্টেশন ছাড়তেই সামনের কোনের দিক থেকে বিপ্লবদা বলে কে একজন ডাক দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে কাত হয়ে দেখি কপালে চন্দনের টিকা লাগানো আপাদমস্তক গেরুয়া বসন পরা মধ্যবয়সী এক সন্ন্যাসী আমার দিকে মুচকি হেসে বিপ্লবদা বলে হাত নেড়ে ডাকছে। প্রথমটায় চিনতে না পারলেও ধীরে ধীরে আমার অফিসের জুনিয়র স্টাফ শান্তনুকে চিনতে পারলাম। একসময় ও আমার পাশের টেবিলে কাজ করেছে। বয়সে অনেক ছোট হলেও ওর সাথে একপ্রকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গেছিল। পরে ও অন্য চাকরী পেয়ে চলে গেলে ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু ওকে এত বছর পরে এই সন্ন্যাসীর বেশে দেখব তা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। সে আমার সামনে বসা এক ভদ্রলোকের সাথে তার বসার জায়গা অদলবদল করে বসল। প্রথমটায় আমার স্ত্রীও ওকে দেখে চিনতে পারেনি। যদিও বিপ্লব আমার বাড়িতে একবার এসেছিল। আমি স্ত্রীকে মেয়ে দেখতে গিয়ে ভুতের খপ্পরে পরার ঘটনাটির কথাটা বলতেই শান্তনুকে চিন্তে পারে। যাই হোক বেশকিছু আলোচনার পর জানতে পারলাম যে সে এখনও অবিবাহিত রয়েছে। চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। ব্যারাকপুর কোন একটি দরকারী কাজে এসেছে। 

অনেক কথার মাঝে আমি ওকে বললাম,..


" কিরে ভুতের তাড়া খেয়ে শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসী হয়ে গেলি ?" 


 সে চমকে উঠে সহস্যে জবাব দেয়,

" সেদিন আমরা বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম ... বিপ্লবদা।" 


      আমার স্ত্রী ওই ঘটনাটি জানে। ছেলেরা বা তার স্ত্রীরা একজন সন্ন্যাসীর সাথে আমাদের এই কথোপকথন কৌতূহলমুখে হা করে শুনছিল, ওদের মুখ দেখে বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম ওরা খুবই আগ্রহের সাথে অপেক্ষায় আছে ওই ঘটনা শোনার জন্য।


     দু একটা খুচরো কথাবার্তা আর মোবাইল নম্বর এক্সচেঞ্জ করতে করতেই ব্যারাকপুর স্টেশন চলে আসায় শান্তনু নেমে যায়। ও নেমে যেতেই ছেলে ও তাদের বউরা আমাকে ওই ভৌতিক ঘটনা শোনার জন্য বায়না শুরু করে। এদিকে আমার স্ত্রী প্লেটে লুচি আলুরদম ও মিস্টি সহযোগে সকালের জলখাবার পরিবেশন করতে করতে সেও আমাকে ওই ঘটনা আবার শোনানোর জন্য বলল। আমিও শুরু করলাম, সবাই সকালের জলখাবার খেতেখেত মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল।



      ঘটনাটি প্রায় সতেরো আঠার বছর পূর্বেকার। শান্তনু নামের ছেলেটি উত্তরবঙ্গ থেকে প্রোমোশনাল ট্রান্সফার হয়ে কোলকাতায় আমার সেকশনে সদ্য জয়েন করেছে। অফিসের বড়বাবু মিত্তির মশাই আমাকে ডেকে ওর কাজ বুঝিয়ে দিতে বলায় আমি ওকে ডেকে পাঠালাম। খুব স্বল্প সময়ে ওর সাথে কথা বলায় ওকে আমার খুব ভালো লেগে গেল। আমার ঠিক পাশের টেবিলেই ওর বসার জায়গা করে দিলাম। শিলিগুড়ির ছেলে শান্তনু বাবা মা নেই, মামার কাছে মানুষ। ঠিক এই কারণে আর ওর মিষ্টি স্বভাবের জন্য ও আর পাঁচটা স্টাফের থেকে নিকটে চলে এল খুব তাড়াতাড়ি। শান্তনুও বিপ্লবদা বলতে অজ্ঞান। তখন ওর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়স। অফিসের স্টাফ কোয়ার্টারে একা রান্না করে খায়। আমি ওকে অনেক বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করলাম। অফিসের কিছু কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা আগেভাগেই আমাকে বলে রেখেছিল। মাস তিনেক ধরে ওর সাথে পাত্রী দেখতে গেলাম, আমি তখন ওর এক প্রকার অভিভাবক। কিন্তু হয় বয়সে না হয় উচ্চতায় বা শারীরিক গঠনে ওর সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ মেয়ে পাওয়ায় যাচ্ছিল না । ওর এমনিতে তেমন কোন চাহিদা ছিল না। তবে ও নিজে যেহেতু প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি তাই একটু লম্বা মেয়েই ওর কাছে অগ্রগণ্য ছিল। গোটা পাঁচেক পাত্রী দেখার পর শান্তনু এক প্রকার আশাহত হয়ে পড়েছিল। ঠিক এমন সময় অফিসে আমার টেবিলে বিভিন্ন কাগজ পত্রের মধ্যে বছর দুয়েক পুরোনো এক সংবাদ পত্রের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটি পাত্রী চাই এর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। 


"বসিরহাট নিবাসী ২৮ / ৫' ৭" ফর্সা সুন্দরী পাত্রীর জন্য উঃ বঙ্গীয় পিতামাতা হীন প্রতিষ্ঠিত উপযুক্ত পাত্র কাম্য। 

যোগাযোগ: (একটি ল্যান্ডলাইন টেলিফোন নং) "


      অবাক হলাম 'পাত্র চাই' বিজ্ঞাপনটি পড়ে । মনে হল যেন শান্তনু কে উদ্দেশ্য করে বিজ্ঞাপন টি ছাপানো হয়েছে। দুবছর আগের সংবাদ পত্রের খবর, এতদিন কি বিয়ে না হয়ে বসে আছে ওই মেয়ের? মনে মনে ঠিক করলাম আগে টেলিফোন করে জানতে হবে, তারপর শান্তনুকে জনাব। দুপুরের দিকে অফিসের ফোন থেকে বিজ্ঞাপনে দেওয়া টেলিফোন নং-এ ফোন করলাম। অনেক্ষণ ধরে রিং হয়ে যাচ্ছে, কেউ ধরছে না। রিসিভার নামিয়ে ফোনটা কেটে আবার নম্বর ডায়াল করলাম। ফোনে বেজেই চলেছে কেউ তুলছে না। বিরক্ত হয়ে রিসিভার টা ক্রেডেলে রেখে দিতে যাব হঠাৎ ওপর প্রান্ত থেকে ঘসঘসে অস্পষ্ট চাপা গলায় বলে উঠলো,....


 হ্যালো, কাকে চাই?


     কেমন যেন অদ্ভুত শুনতে লাগছে কানে। কথায় যেন প্রাণ নেই। আমি সংবাদ পত্রে বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করে মেয়ের বিবাহ হয়ে গেছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। উনি শুধু এক কথায় " না " বললেন। আমি শান্তনুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে পাত্রী দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় উনি ঠিকানা জানিয়ে পরের শনিবার বিকেলের পর যেতে বললেন। আর এটাও বললেন যে আসার সময় কি কারণে আসছি সেটা ওই এলাকায় কেউ জিজ্ঞাসা করলে না বলতে কারণ সম্বন্ধ ঘেঁটে দেওয়ার মতো দুষ্টু লোকের অভাব নাকি সেখানে নেই। তাই পাত্রী একবার পছন্দ হয়ে গেল তারপর খোঁজ খবরের কাজ টি করা যেতে পারে বলে উনি জানালেন। ভদ্রলোক মনে হল খুব অসুস্থ, আর পাত্রীর বিবাহ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। 


     পরের শনিবার দুপুর নাগাদ শান্তনু কে নিয়ে শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোকাল ধরলাম। শ্রাবনমাস কে বলবে, ক-দিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। চড়া রোদ। উৎকট একটা ঘেমো অস্বস্তি সারাদিন ধরে লেগেই আছে। ট্রেন যখন বসিরহাট স্টেশনে পৌছল তখন পড়ন্ত বিকেল। স্টেশন চত্বরে ফুড়ফুড়ে হওয়ায় মাটির ভাড়ে চা খেতে খেতে খেয়াল করলাম উত্তরের আকাশে একফালি নিকষ কালো মেঘ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। টাকা মিটিয়ে পকেট থেকে ঠিকানাটি বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। ঠিকানা অনুযায়ী স্টেশন থেকে প্যাডেলভ্যানে মিনিট কুড়ির পথ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ওই দিকে কোন ভ্যান ওয়ালা যেতে রাজি হচ্ছে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে রাস্তা খারাপ বা ফেরার পথে যাত্রী পাওয়া যায় না এসব অজুহাত দিতে লাগল। অন্য কোন যানবাহন না পেয়ে এক বৃদ্ধ ভ্যান চালককে বেশি টাকায় একপ্রকার রাজি করলাম। শান্তনু আগে কখনো প্যাডেল ভ্যানে চাপেনি। সে খুব উৎসাহের সহিত সামনের বা দিকে চেপে বসল। এদিকে ঘন কালো মেঘটা আমাদের অলক্ষ্যে কখন যে মাথার ওপরের আকাশটাকে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে খেয়ালই করিনি। তারওপর বৃদ্ধ ভ্যান চালক যে গতিতে তার তিন চাকা ভ্যান চালাচ্ছেন তার থেকে আমরা হেঁটে গেলে হয়তো আরো আগে পৌঁছতে পারব বলে মনে হল। এবড়ো খেবড়ো ইটের রাস্তা ধরে আমরা দুলকি চালে এগিয়ে চলেছি। অবশেষে ভ্যান চালক ঠিকানা অনুযায়ী তিন রাস্তার মোড়ে বট গাছ লাগোয়া এক ভাঙ্গা মন্দিরের সামনে নামিয়ে দিল। এখান থেকেই ডানদিকে পুকুরের ধার ধরে একটু এগোলেই ওই ভদ্রলোকের বাড়ি। ভ্যান চালক টাকা নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল ,.…. 


      বাবু , এখানে কোথায় যাবেন? 


     হঠাৎ দীপক বাবুর সেই কাউকে কিছু না বলার কথা মনে পড়ে গেল। আমি চুপ করে থাকায় বৃদ্ধ ভ্যান চালক ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে যেতে বলে গেল,..… 


    "বাবু, এখানে বেশিক্ষন থাকবেন না, জায়গাটা ভাল না।"


      ওনার কথাতে আমি আমল দিলাম না। তবে জায়গাটা বড়ই নির্ঝুম। আশেপাশে বাড়ি ঘর তেমন নেই। মোড়ের মাথায় স্বল্প আলোতে ঠিকানাটি দেখে পুকুরপারের রাস্তা ধরলাম। শান্তনু কে দেখে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল যে ও এই গ্রাম্য পরিবেশটাকে দারুন এনজয় করছে। ঘড়িতে তখন সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম আধা ঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে পরব। ওই পথেই মিনিট তিনেক এগোতেই রাস্তা ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। বা দিকে একটা বাঁশঝাড় তার লাগোয়া সারিবদ্ধ চাঁই করা মাটির ডিপি দেখে বুঝলাম ওটা করবস্থান। মুখ ঘোরাতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। শান্তনু ও চমকে গেছিল। দেখি আমাদের সামনে প্রায় পাঁচ হাত দূরে একজন বয়ষ্ক লোক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,..…. 

  "কলকাতা থেকে এসেছি , দীপক রায়ের বাড়ি যাব।"


 ভদ্রলোক ফেসফেসে গলায় বলল ,..….

  আমিই দীপক রায়। এদিকে আসুন।

পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ি। বাড়িটিতে রং চড়েনি বহু বছর। সামনে বড় উঠোন। উঠোনে বড় ধানের গোলা। দীপক বাবু আমাদের ঘরের বারান্দা পেরিয়ে দোতলার একটি ঘরে বসালেন। উনি তেমন কথা বলছেন না আমি বা শান্তনু দু একটা প্রশ্ন করলে খুব সংক্ষেপে কখনো মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিচ্ছেন। বাড়িতে কম পাওয়ারের ডুম লাগানো, আলোর পরিমাণ খুব কম, কেমন যেন একটা অস্পষ্টটা চারিদিকময় ছিটিয়ে রয়েছে। পরিষ্কার সব কিছু দেখা যাচ্ছে না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হল করা যেন লুকিয়ে আমাদের দেখছে। গা টা কেমন ছম ছম করে উঠল।


     প্রায় মিনিট পাঁচেক বসে আছি এদিকে কারোর দেখা নেই। বড় ঘর। পুরোনো আমলের দামি আসবাবপত্র ছড়িয়ে ঘরময়। ঘরের একপাশে দামি কাঠের পেল্লাই পালঙ্ক ও আলমারি। আমরা নকশা কাটা কাঠের চেয়ারে বসে। সামনে মাঝারি মাপের পাথরের গোল টেবিল। ঘড়িতে তখন পৌনে ছ টা বাজে। সহসা ঘোমটা টানা এক মহিলা ঘরে প্রবেশ করল। হাতে একটা ট্রে । তাতে বড় বড় দুটো পাথরের গ্লাস আর সাদা দামি প্লেট বোঝাই মিষ্টি। পেছন পেছন দীপক বাবু ঢুকলেন। বাইরে তখন গুড় গুড় করে মেঘ ডাকছে। দীপকবাবু মহিলাকে ইশারা করল জানালা বন্ধ করে দিতে। মহিলা তৎপর হয়ে উঠলো, চটপট ঘরের জানালা বন্ধ করতে লাগল। হঠাৎ গগনভেদী এক বাজ পড়ার তীক্ষ্ণ শব্দ কানে এল, কাছাকাছি কোথাও আছড়ে পড়ছে। ভদ্রমহিলা সশব্দে ঘরের জানালাটি বন্ধ করে চলে গেলেন। হঠাৎ শান্তনুকে দেখি বড় বড় চোখ করে, ভুত দেখার মত ওই ভদ্র মহিলার দিকে চেয়ে আছে। বুঝলাম না ঠিক কি হয়েছে ওর। দীপকবাবুকে বললাম ছটা বাজে, আমাদের ফিরতে হবে। যদি পাত্রী কে নিয়ে এসে প্রাথমিক কথাবার্তা সারা যায় তাহলে খুব ভাল হয়। দীপকবাবু মুখে কোন কথা না বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এদিকে শান্তনুর আবার হল কি ? চোখ বড় বড় করে কাঠের মতো সোজা হয়ে আমার আর দীপকবাবুর দিকে কি যেন দেখছে। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর শরীর খারাপ লাগছে কি? দীপকবাবু ঘরের বাইরে যেতেই শান্তনু প্রায় লাফিয়ে আমার কাছে এসে কানে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,......


" বিপ্লবদা চল পালাই, এরা কেউ মানুষ নয়। জানালা বন্ধ করার সময় বাজের ঝলকানিতে ওই মহিলার কঙ্কালসার হাতের হাড় আর দীপকবাবুর মাথার চুল চামড়াহীন খুলি স্পট দেখেছি। "


      আমি শান্তনুর কথার কোন মাথা মুন্ডু বুঝলাম না। মৃদু ধমকে ওকে বললাম,....


      "শান্তনু এটা রসিকতা করার সময় বা জায়গা নয়।"


    হঠাৎ নুপুরের শব্দ কানে এল। সুশ্রী লম্বাটে গড়নের এক অল্পবয়সী মহিলাকে সাথে নিয়ে পূর্বের সেই মহিলা আর দীপকবাবু ঘরে এসে আমাদের সামনে বসলেন। আমি দীপকবাবুকে শান্তনুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তাদের সামনে রাখলাম। শান্তনুকে দেখছি আড়ষ্টভাবে সবকিছু লক্ষ্য করছে। মেয়েটিও মাথা নিচু করে বসে আছে। আমি তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। হঠাৎই বাইরের দরজায় কেউ এসে দাঁড়াল। সাথে সাথে অপর ভদ্র মহিলা এগিয়ে গিয়ে একটা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। মেয়েটি ট্রে থেকে চায়ের পেয়ালা আমাদের দিকে একে একে বাড়িয়ে দেওয়ার সময় আমি আবারও ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম। মেয়েটি মুখ তুলে নাম বলতে যাবে এমন সময় কড় কড় করে কান ফাটানো বাজ পড়ার শব্দে পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠল। আর এরই সাথে সাথে দোতলার ওই ঘরের ঘূলঘুলি থেকে তড়িৎ গতিতে এক টুকরো আলোর ঝলকানি মেয়েটির মুখের ওপর আছড়ে পড়তেই আমার হাতের চায়ের পেয়ালা সশব্দে নীচে পরে গেল। মেয়েটির মুখে যে অংশে ওই আলো পড়েছিল ঠিক সেই অংশে কোন চামড়া বা মাংস ছিলনা। এক মুহূর্তের জন্য মেয়েটির আসল রূপ দেখতে পেয়েছিলাম। মনে মনে ইস্ট নাম করতে করতে শান্তনুর ওই ভীত-আড়ষ্ট ভাবে বসে থাকার প্রকৃত কারণটা এবারে বুঝতে পারলাম। আমি শান্তনুর দিকে তাকিয়ে বোঝালাম যে আমরা ভয়ানক বিপদে পড়েছি। কিন্তু ভয় পেলে বা ভেঙে পড়ল বিপদ আরো বাড়তে পারে। ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা বাজে। আমি উঠে দাঁড়াতেই শান্তনুও উঠে দাঁড়াল। ঘরে উপস্থিত তিনজনই আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দীপকবাবুর উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বললাম,........


 "অনেক দেরি হয়ে গেছে, অনেকটা পথ। এবার আমাদের যেতে হবে।"


আমি ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। শান্তনু ও চটপট আমার পিছু নিল। এমন সময় চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটা চিল চিৎকারে আর্তনাদ করে বলে উঠল,....


      "না……না..….না….."


     ঘুরে দেখি ওই মেয়েটির জায়গায় একটা সাদা কঙ্কাল শাড়ী গহনা পরে দুহাত আমাদের দিকে প্রসারিত করে চিৎকার করছে। মাথা ঘুরতে লাগল দেখে। পা আর চলে না। শান্তনু কে চিৎকার করে বললাম..…...ভাগ……. শান্তনু ভাগ। প্রায় লাফাতে লাফাতে সিড়ি দিয়ে নামলাম।


     বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। উঠনে প্যচ-প্যচে কাদা। কোনোমতে দৌড়ে পালিয়ে আসার সময় উঠোনে থাকা ধানের গোলা হুড়মুড়িয়ে আমাদের ওপর পড়ল। শান্তনু তাতে চাপা পড়ে গেছে। পাগলের মতো খড় কুটো সরিয়ে কোন মতে ওকে টেনে বের করলাম। খুব বাঁচা বেচে গেছে ও। তেমন কোন চোট লাগেনি কারোর। ওর চশমাটা পেলাম না। হঠাৎ চোখ গেল ওই দোতলার ঘরের দিকে। তিন তিনটে কঙ্কালসার দেহ তখনও বারান্দাতে দাঁড়িয়ে। এরপর আর পেছনে তাকানোর সাহস হয়নি। ওই বৃষ্টির মধ্যে খালি পায়ে মোজা পরে আমরা কিভাবে যে বসিরহাট স্টেশনে পৌঁছলাম তা একমাত্র ঈশ্বর জানেন। 


     পরে পরিচিত একজনের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি জমিদারের বংশের বংশধর দীপক রায় ওই এলাকার একজন প্রভাবশালী বড়লোক ছিলেন। বড়লোক হলেও তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সাথে যুক্ত থাকতেন। তার একমাত্র আদরের কন্যা উমার ছোট থেকেই মানসিক সমস্যা ছিল, কিশোরী অবস্থায় বিয়ে করার জন্য বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি ভাঙচুর করতো। দীপকবাবু অনেক চেষ্টা করে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারেন নি। আবেগী উমা এমনি এক শ্রাবণী সন্ধ্যায় কীটনাশক খেয়ে দোতলার ঘরে আত্মহত্যা করে। দুঃখে কষ্টে পরদিন দীপক রায় ও তার স্ত্রী ওই ঘরেই একইভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মৃত্যুর পরেও তাদের অতৃপ্ত আত্মারা নাকি ওই বাড়িতে আজ আসে তাদের একমাত্র আদরের কন্যা উমাকে পাত্রস্থ করার উদ্দেশ্যে।



*******************************************************



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy