নতুন পরিচয়
নতুন পরিচয়
(১)
“অবশেষে হাতে পেয়ে গেলে তোমার বহু কাঙ্খিত জিনিসটা।”
“রাগ করেছিস আমার ওপর?”
“নাহ… রাগ করতে যাব কেন?”
“তোর মনের উষ্মা মুখের ভাষায় স্পষ্ট।”
“মানে?”
“মানে আবার কি? কতটা রাগ জমে আছে বলে তোর বাবার ডেথ সার্টিফিকেটটাকে বলতে পারলি আমার বহু কাঙ্খিত জিনিস।”
“না মা… আমায় ভুল বুঝছো তুমি, আঘাত করতে চাইনি তোমায়।”
“ঠিক আছে। জানি তোর মনে ক্ষোভ জমে আছে কিন্তু আমার আর কি করণীয় বল?”
“মা..”
“হুম?”
“বলছি বাবা যদি ফিরে আসে?”
“তোর মনে হয় ওঁর ফেরার কোনো আশা আছে?”
“যদি আসে? মা, আমরা তো বাবা আর নেই সেরকম কোনো প্রমাণই পাইনি তাই না?”
“মানুষটা সাত বছরের ওপর নিখোঁজ… এটা যথেষ্ট প্রমাণ নয় কি? উনি যদি বেঁচেই থাকতেন বাড়ি কি ফিরতেন না এতদিনেও? তাছাড়া কম খোঁজা খুঁজিও তো করা হয়নি।”
“সবই জানি মা কিন্তু তাও…”
“তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুই এখনও ছেলে মানুষ তাই এসব কথা বলছিস। আমিও একটা সময় অবধি আশা করতাম ফিরবেন মানুষটা। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি। এ সমাজ বড় নিষ্ঠুর বাবা!সবাই খুবলে খেতে আসে। এই সমাজে টিকে থাকতে হলে মনকে শক্ত করতে হবে আমাদের।”
“জানি।”
“ওঁর ডেথ সার্টিফিকেটটা খুব দরকার ছিল। এবার ওঁর সব টাকা পয়সা তুলতে পারবো। যে কোম্পানির কাজে উত্তরাখন্ড গিয়ে মানুষটা ঐরকম একটা ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়ে গেলেন, সেই কোম্পানিই দেখলি তো কোনো সাহায্যই করলো না। তুইও আজ তিন বছর পাশ করে বসে আছিস, চাকরির আশায় আর কতদিন থাকবি?”
“তো আমি কি করবো?”
“আমি ভাবছিলাম তোর বাবার টাকা পয়সাগুলো পেলে একটা ব্যবসা শুরু করতে পারবি। সামান্য আঁকার স্কুল চালিয়ে কি কষ্টে যে এই সাত আট বছর সংসারটা টানছি, তোর পড়া চালিয়েছি সে আমি জানি কি ঈশ্বর জানেন; কিন্তু আর টানতে পারছিনা, শরীরটা বড্ড খারাপ লাগে আজকাল।”
“হুম মা। টাকা পেলে ব্যবসা শুরু করতে পারি। কালই ব্যাংক এ যাবো কথা বলতে।”
“হ্যাঁ সেই ভালো। তবে তার আগে…”
“তার আগে কি?”
“তোর বাবার কাজ তো হয়নি, তাই ভাবছিলাম ওঁর শ্রাদ্ধের জন্য একটা পুজো করবো। আত্মা বলে কিছু আছে কিনা আমি জানিনা তবে যদি থেকে থাকে তাহলে সৎকার হয়নি বলে ওনার আত্মা নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছেন; আমি তাই ভাবছি শ্রাদ্ধের আয়োজন করবো।”
“বেশ। তবে তাই হোক।”
"তোর বাবা নেই তো কি হয়েছে, ওঁর স্মৃতিগুলো তো আছে আমাদের সঙ্গে। সেই নিয়েই মা ছেলেতে মিলে কাটিয়ে দেব বাকি জীবনটা।"
(২)
“আরে আরে ভাই! দাঁড়ান দাঁড়ান... আপনি এভাবে ছুটছেন কেন? কি হয়েছে আমায় বলুন…”
“আ… আমার ভীষণ পাগল পাগল লাগছে, কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা আমি…”
“আহা ভাই! আপনি দাঁড়ান, দাঁড়ান বলছি।হ্যাঁ, এই তো লক্ষ্মী ছেলে। এবার আসুন, এখানে বসুন দিয়ে বলুন আপনার কি সমস্যা।”
উদভ্রান্তের মতো ছুটতে থাকা লোকটা এবার থমকে দাঁড়িয়ে গেল তারপর জুলজুল করে দেখতে লাগলো ওপর ব্যক্তিকে। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি এবার নিজেই এগিয়ে এসে প্রথম জনকে ধরে বসালো মাঠের নরম কচি ঘাসে, নিজেও বসলো।
“এবার বলুন সমস্যাটা কি?”
“আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা…”
“আপনার কি কিছু মনে পড়ছে? কোনো স্মৃতি...”
“আবছা আবছা… একটা উঁচু মতন বিছানায় শুয়ে আছি… পাশে মুখোশ ঢাকা কয়েক জন… হাতে কেমন সব জিনিস....ধারালো…”
“হুম… হসপিটালে ছিলেন?”
“হসপিটাল? কই না তো… ঠিক মনে পড়ছে না।”
“আচ্ছা। ঠিক আছে, একটু শান্ত হয়ে বসুন তারপর মনে করার চেষ্টা করুন।”
কিছু সময় পর…
“মনে পড়ছে মনে পড়ছে…”
“বাহ্… বলুন এবার।”
“আমি একটা কারখানায় কাজ করতাম… বন্ধ হয়ে গেল… রোজগার হারালাম….”
“চুপ করে গেলেন কেন? তারপর কি হলো বলুন?”
“হ্যাঁ… তারপর হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিলাম তখনই দেখা হলো ওর সাথে…”
“কার সাথে?”
“নামটা মনে পড়ছে না যে..”
“আচ্ছা নাম বাদ দিন, বলুন তার সাথে দেখা হওয়ার পর কি হলো?”
“সে বললো একটা কাজ আছে… আমাকে নিয়ে এলো একদিন সন্ধ্যে বেলা… খুব বৃষ্টি পড়ছিল তখন, আকাশ জুড়ে কালো মেঘ…. দাঁড়ান দাঁড়ান, একদিন বলছি কেন! কালই তো নিয়ে এলো আর তারপরই…”
“কি তারপর?”
“উফফ… যন্ত্রনা… জোর করে শুইয়ে দিলো… চিৎকার করে উঠলাম… বৃষ্টির শব্দ… কিচ্ছু শোনা গেল না… মুখোশ পরা লোক… হাতে ছুরি কাঁচি… আমার আর মনে পড়ছে না যে…”
“আন্দাজ করতে পারছি কিছুটা… তবে ভালো করে বুঝতে হলে চিগুদাই ভরসা।”
“চিগুদা?”
“হুম… চিত্রগুপ্ত।”
“লোকে এমন নাম কেন যে রাখে! কেমন যেন মৃত্যুর গন্ধ… ”
“হাঃ হাঃ হাঃ …”
“হাসছেন কেন আপনি?”
“ভাই তোমার নাম কি?”
“আমার নাম প্রকাশ কুমার দাস।”
“আচ্ছা পিকু ভাই এখুনি আমি একটা কথা বলবো তোমায়, বিশ্বাস করবে কি?”
“কি কথা দাদা?”
“যদি বলি তুমি আর বেঁচে নেই?”
“ইয়ার্কি করছেন আমার সাথে? এই তো দিব্যি বসে কথা বলছি আপনার সাথে, এত সুন্দর বাগান, নরম কচি ঘাস আর আপনি বলছেন আমি বেঁচে নেই?”
“হ্যাঁ ভাই ঠিকই বলেছ তবে… ব্যাপারটা হলো গিয়ে সত্যিই তুমি আর বেঁচে নেই। এই যে তুমি আমার সাথে কথা বলছ কারণ আমিও যে তোমারই মতো, আর বেঁচে নেই আমিও। আর এই জায়গাটা হলো… আচ্ছা পার্গেটরি বলে কিছুর কথা শুনেছ?”
“কি? তরী?মানে নৌকা?”
“আহা তরী না, টোরি, পার্গেটরি। এটা হলো স্বর্গ আর নরকের মাঝামাঝি এক জায়গা। কৰি সাহিত্যিকদের লেখায় খুব পাবে এর কথা, পড়নি কখনো?”
“আমার ওসব পড়াশুনো ভালো লাগেনা।”
“এ-হে! সে কি কথা! যাইহোক তা পড়লে জানতে পারতে জায়গাটার কথা। যদিও এখানটা ঠিক সাহিত্যে বর্ণিত পার্গেটরি নয় তবুও আমি তোমাদের মতো যারা আসে তাদের বোঝাতে এই নামটাই বলে দিই। তা ভাই এটা হলো এমন একটা জায়গা যেখানে মৃত্যুর পর থেকে সৎকারের আগে অবধি মানুষ এসে থাকে। এরপর সৎকার হয়ে গেলে এখান থেকে বোধহয় স্বর্গ বা নরকে কোথাও একটা যায়, আমিও ঠিক জানিনা কোথায় যায়… আমার এখনও সৎকার হয়নি কিনা। হেঁ হেঁ!”
“প্লিজ দাদা এসময় এসব ইয়ার্কি করবেন না আমার ভালো লাগছে না।”
“আহা রাগ করেনা ভাই… এই বাগানটা পৃথিবীর মতোই লাগছে তাই না? আসলে সবই মায়া বুঝলে? মৃত্যুর পর পৃথিবী ছেড়ে ডাইরেক্ট এখানে সবাই আসে বলে এই জায়গাটা পৃথিবীর ছায়ায় তৈরি করা হয়েছে।”
“আপনি কি লেখক? গাঁজাখুরি গল্প লেখেন?”
“হুমম… বুঝলাম… এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তাহলে আর কি সবাইকে এসময় যেটা বলি তোমাকেও তাই বলি; বলছি যে উঠে দাঁড়াও, দিয়ে খানিকটা হাঁটাহাঁটি করো আর ওই সময় পায়ের দিকটা খেয়াল করবে।”
“না হাঁটবো না… আপনি কে মশাই যে আপনার কথা শুনবো আমি?”
“হক কথা বলছো ভাই… এতক্ষণ হয়ে গেল নিজের পরিচয়টাই দিতে ভুলে গেছি। যাই হোক, এই অভাগা অধমের নাম হলো চন্দন বক্সী।”
(৩)
“চিগুদা এই যে এর ব্যাপার স্যাপার একটু দেখতে হবে।”
“আবার কাকে নিয়ে পড়লে ভাই?”
“হেঁ হেঁ… এই যে দাদা এর, বয়সটা কি বা আর … মনে হচ্ছে কিডনি পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে বেঘোরে প্রাণটা দিয়েছে।”
“বুঝলাম। নাম কি?”
“প্রকাশ কুমার দাস।”
“দেখি … দেখি… হুম পেয়েছি। বাহ্! চন্দন দারুণ।”
“কেন দাদা আমি আবার কি করলাম?”
“একদম ঠিক বলেছ, তবে শুধু কিডনি নয় আরো অনেক কলকব্জা বের করে ছেড়েছে।”
“ইসসস… কি বা বয়েস! আমি ভাবছিলাম যে… উফফ আমারই হয়েছে যত জ্বালা। যাই বেচারাকে সান্ত্বনা দিই। যখনই উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো মাটিতে পা পড়ছে না, ভেসে আছে তখনই বুঝলো যে সেই জগতে আর নেই, আর তখন থেকে বউ এর কথা ভেবে হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করেছিল আবার চোখ থেকে জল বেরোচ্ছেনা দেখে আরো জোরে কাঁদতে লেগেছে।”
“চন্দন…”
“হ্যাঁ দাদা?”
“কেন করো এসব? তোমাকে কতবার সাবধান করেছিনা যে এদের মায়ায় জড়িও না, ওরা এখান থেকে বেরিয়ে গেলে সব ভুলে যায় কিন্তু তুমি শুধু শুধু কষ্ট পাও প্রত্যেকবার।”
“কি আছে দাদা ক্ষনিকের কষ্ট তো, একজন যায় আবার নতুন কেউ আসে। এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই তো আর এসব কোনো স্মৃতি থাকবেনা আমার… কোনো অনুভূতিও থাকবে না আর।”
“হুম… কিন্তু… আমার মনে হয় কি জানো মৃত্যুর পর মানুষকে এই জায়গায় আনাটাই ঠিক নয়। এতো পুরো মায়ার সাম্রাজ্য, লোকে বিশ্বাসই করতে পারেনা যে সে মারা গেছে। আমার মনে হয় এই জায়গাটা এমন হওয়া উচিৎ ছিল যেখানে মায়া কাটানো হয়, উল্টে এ কিনা..”
“বটে, কিন্তু চিগুদা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যখন এটা বানিয়েছেন তখন নিশ্চয় কোনো প্রয়োজন আছে এর। উনি কি অকারণে কিছু করতে পারেন?”
“হুম... তুমি তো দেখছি দিন কে দিন বেশ অন্যরকম করে ভাবতে শিখছো।”
“হেঁ হেঁ! সব আপনারই দয়া চিগুদা। এবার তবে যাই আমি?”
“আচ্ছা যাও। সামলাও তোমার নতুন ভাইকে।”
“হেঁ হেঁ… ওহ! হ্যাঁ, বলছি যে সুপুদা আর সোনাদা ঠিক ঠাক পৌঁছে গেছে?”
“একদম। দুজনে এখন খাটে শুয়ে খেলা করছে।”
“বাহ্ বাহ্… সত্যি ওঁদের সাথে কাটানো সময়টা দারুন ছিল। ওঁদের মতো আপন আজ অবধি কাউকে মনে হয়নি আমার।”
“হ্যাঁ জানি। আর তোমার সোনাদা আসার পর যা করেছিলে তার সাথে! উফফ! এখনো ভাবলে পেটটা গুলগুল করে হাসি পায়।”
“সবই সুপুদার আইডিয়া ছিল। নিজের মৃত্যুর মিষ্টি করে বদলা নেওয়ার ভারটা দিয়ে গিয়েছিলেন আমার ওপর। উনি বলেছিলেন সোনাদা আসা অবধি যদি আমি এখানে থাকি তো… হেঁ.. হেঁ.. আমি তো তোমার কাছে আগেই শুনেছিলাম যে সোনাদা শিগগির এখানে আসছেন কিন্তু সুপুদাকে সে কথা জানাইনি, হয়তো দুঃখ পেতেন।”
“ দুঃখ নিশ্চয় পেতেন। যতই দাদার মজা করার ছলে ওঁর প্রাণ যাক তাও দাদা তো। মৃত্যুকে কেউ ভালোবাসেনা হে, নিজের মৃত্যুর থেকেও বোধহয় মানুষ বেশি ভয় পায় কোনো আপনজনের মৃত্যুকে… মায়া …জীবনের মায়া… মারাত্মক জিনিস। তা ভালোই করেছিলে না জানিয়ে।”
“হেঁ… হেঁ… সোনাদা কিন্তু প্রথম দিকে বেজায় ক্ষেপে থাকতেন আমার ওপর।”
“হবেই তো! একেই এখানে প্রথম এসে সবার এক পাগল পাগল অবস্থা হয় তার ওপর তুমি তোমার সাঙ্গপাঙ্গ দের নিয়ে যদি তাঁকে ওই এপ্রিল ফুল না কি যেন করতে তাঁকে বোঝাও যে তিনি পাগলাগারদে এসেছেন, রাগ তো করবেনই।”
“হেঁ… হেঁ… ছেলেপুলে গুলোকে পাগলের অভিনয়ের রিহার্সাল করাতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল নাকি!”
“তারপর সুনির্মলকে সত্যি কথাটা বলার পরও কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি, ভাবছিল পাগলের প্রলাপ সব। তোমার ঐ ‘একটু হেঁটে দেখুন’ পদ্ধতিও তো ফেল মেরেছিলো, উনি ধরে নেন ওটা পাগল অবস্থার দৃষ্টি বিভ্রম।”
“তা যা বলেছ চিগুদা। ওঁকে সত্যিটা বিশ্বাস করাতে আরও কালঘাম ছুটে গেছিলো আমার।আচ্ছা এখন তবে আসি চিগুদা। নতুন ছেলেটা অপেক্ষা করছে।”
“হুম...এসো।”
“কাদের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন চিত্রগুপ্ত বাবুকে?”
“আমার দুই মরণতুতো দাদার কথা।”
“কি দাদা!”
“মরণতুতো, মানে মৃত্যুর পর এখানে দাদা পাতিয়েছিলাম তাদের, এই যেমন তোমাকে ভাই পাতালাম।”
“আচ্ছা। তা ওঁরা এখন কোথায়?”
“ওরা এই তিনদিন হলো নতুন জন্ম নিয়েছেন। আগের জন্মে সোনাদা মানে সুনির্মলদা ছিলেন সুপুদা মানে সুপ্রকাশদার মেজদাদা। কিন্তু এবারে দুজনে যমজ হয়ে জন্মেছেন তবে সুপুদা পাঁচ মিনিট আগে বেড়িয়েছেন। হেঁ হেঁ … এই জন্মে সুপুদা মনে হচ্ছে দাদা হয়ে বেশ দাদাগিরি করবেন সোনাদার ওপর।”
“ওরা কি করে মারা গিয়েছিলেন?”
“সে এক লম্বা গল্প, পরে বলবো তোমায়।”
“আচ্ছা।”
“হুম।”
“দাদা একটা কথা জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে; এই চিত্রগুপ্ত বাবু কি যমরাজের এসিসট্যান্ট চিত্রগুপ্ত?”
“হাঃ হাঃ হাঃ… সবাই এসে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে।
না ভাই! চিগুদা সেই যমরাজের চিত্রগুপ্ত নন, চিগুদা এই পারগেটরির দেখভালের দায়িত্বে আছেন। যমরাজ বলে আদৌ কেউ নেই। বুঝলে?”
“আচ্ছা উনি কি মানুষ? মানে উনি কি আমাদের মতোই মৃত্যুর পর...?”
“এহে! এটা তো একটা ভালো প্রশ্ন করেছ তো ভাই। এই প্রশ্নটা আমার মাথায় আসেনি কোনোদিন। দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে চিগুদাকে।”
(৪)
“কাল আমি এখান থেকে চলে যাবো চন্দন দা আর আজ কিনা আপনার কোনো পাত্তাই নেই?”
“আহা রাগ কোরো না ভাই… চিগুদার সাথে একটু মিটিং করছিলাম।”
“মিটিং? কি নিয়ে?”
“বলছি সব। এসো বসো। ভাই সত্যি বলতে তোমার মৃত্যুর কারণটা জানার পর থেকে বড্ড ছটফট করছিলাম। শুধু তুমি একা নও, আজ এখানে কতদিন আছি সেই সময়ের হিসেব তো পাইনা তবে আন্দাজ হয় পৃথিবীর হিসেবে হবে অনেক বছর। তো এতদিনে অনেক মানুষকে দেখলাম যাদের অন্যায় ভাবে মৃত্যু হয়েছে অন্যের হাতে মানে সোজা ভাষায় যাকে বলে খুন।”
“হ্যাঁ দাদা, ভীষণ রাগ হয় জানেন… মনে হয় যদি ওই লোকগুলোকে কোনো শাস্তি দিতে পারতাম নিজের হাতে তাহলে হয়তো জ্বালা জুড়াতো। বেঁচে থাকাকালীন কত শুনতাম মরে গেলে নাকি ভুত হয়ে দুষ্ট মানুষের ঘাড় মটকানো যায়!”
“ঘাড় মটকানো না ছাই! একবার মরে গেলে হাজার চেষ্টা করলেও নতুন জন্ম নেওয়ার আগে পৃথিবীতে আর যাওয়াই যায়না। জানো ভাই বড্ড ইচ্ছে হয় একবার যদি দেখতে পেতাম আমার স্ত্রী আর ছেলেটা কেমন আছে! ছেলেটা বড্ড ন্যাওটা ছিলো আমার, কি করছে এখন কে জানে! পড়াশুনো টাও শেষ করাতে পারলাম না তার আগেই…”
“দুঃখ করবেন না দাদা।”
“দুঃখ করা বহুদিন হলো ছেড়ে দিয়েছি। শুধু জানতে ইচ্ছে করে ওরা কেমন আছে! কি করে দিন কাটছে? ছেলেটা চাকরি বাকরি পেলো কিনা কে জানে! কোম্পানি ওদেরকে কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়েছে কিনা তাও জানিনা।”
“দাদা আমার কি মনে হয় জানেন উত্তরাখন্ড এর সেই বন্যায় ভেসে যাওয়া বহু বেওয়ারিশ লাশকে সরকারি উদ্যোগে দাহ করা হয়েছিল, তো আমার মনে হয় আপনাকেও সেই সময়ই… আর সেই কারণেই বৌদি আর ভাইপো নিশ্চয় আপনার সন্ধান পায়নি তাই শ্রাদ্ধ শান্তিও করতে পারেনি, আর আপনি আটকে রয়েছেন এখানে।”
“হুম… তাই হবে হয়তো।”
“ওহো দাদা! আপনি চিগুদার সাথে মিটিং এর কথা কি বলছিলেন যেন?”
“এই দেখেছ! আমার এই সমস্যা... এ জন্য তোমার বৌদিও খুব রাগ করতো… এক কথা বলতে বলতে সেটা ভুলে অন্য কথা বলতে লেগে যাই।”
“হিঃ হিঃ!”
“হ্যাঁ তা যা বলছিলাম ভাই, তোমার মতো আরো যারা অন্যায়ের স্বীকার তাদেরও ইচ্ছে করে খুনিকে নিজের হাতে কিছু শাস্তি দিতে। কিন্তু এখানে সেরকম কোনো ব্যবস্থাই নেই। চিগুদার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দুষ্ট লোকগুলো শাস্তি পায় মরার পর এখান থেকে নরক বা ওই জাতীয় কোনো একটা জায়গায় গিয়ে আর যাদের ওপর তারা অন্যায় করেছে সেই মানুষগুলো তো মনে হয় জানতেও পারেনা যে তাদের অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে। তাই চিগুদার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম যে যদি উপরওয়ালাদের সাথে কথা বলে এই নিয়ে কিছু একটা করতে পারেন মানে যদি এমন কোনো ব্যবস্থা চালু করা যায় যে এখানে থাকাকালীন তোমার মত অন্যায় ভাবে মৃত ব্যক্তি নিজেই কোনো ভাবে তোমাদের অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে…বা অন্তত জানতে পারে যে তার অপরাধীর কি শাস্তি হচ্ছে তাহলে খুব ভালো হয় তাই না?”
“একদম ঠিক কথা বলেছেন দাদা… তা চিগুদা আশ্বাস দিলেন কিছু?”
“দুঃখের কথা কি আর বলি ভাই… ধমকে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন, বললেন যত আজগুবি চিন্তা নাকি এসব! কিন্তু আমার মনে হয় এই জায়গাটার একটু রিমডেলিং দরকার।”
“আচ্ছা আপনি তো অনেক দিন আছেন এখানে, আপনি পারেন না ওপর মহলে যোগাযোগ করতে?”
“অনেক দিন থাকলে কি হবে ভাই, কোনো ক্ষমতা আছে আমার! আমি তো তোমাদেরই মতো একজন। তাও যদি সুযোগ পাই কিছু একটা নিশ্চয় করব।”
“সত্যি বলছেন দাদা?”
“একদম।”
(৫)
“ আরে আরে চিগু দা ব্যাপারটা কি? এতো আনন্দ কিসের?”
“ভাই যা বলবো সেটা শুনলে তুমিও আনন্দে নেচে উঠবে।”
“আচ্ছা তাই নাকি?”
“হ্যাঁ ভাই হ্যাঁ।”
“কি সেটা?”
“আজকে কি হবে জানো?”
“জানি তো, প্রকাশ আজ এখান থেকে চলে যাবে।”
“হ্যাঁ কিন্তু প্রকাশের সাথে আরো কেউ আজ যাবে এখান থেকে।”
“সে আর নতুন কি,আরো যাদের যাদের আজ সৎকারের দিন তারা যাবে, রোজই তো যায়। এতে নতুন কি আছে!”
“হাঃ হাঃ! নতুন আছে বৈকি।”
“কি নতুন?”
“ভায়া তুমি কি জানো তোমার শ্রাদ্ধ চলছে এখন?”
“কি বললেন?”
“হ্যাঁ ভাই ঠিকই বলছি। তোমার শ্রাদ্ধ চলছে, এবার শেষমেশ তুমি মুক্তি পাবে এই মায়া জগৎ থেকে।”
“আ… আপনি সত্যি বলছেন? আমি মুক্তি পাবো!”
“একদম সত্যি বলছি ভাই। অবশেষে তোমার স্ত্রী আর ছেলে আজ তোমার কাজ করছে।”
“উফফ… কি বলব ভেবেই পাচ্ছি না… চিগু দা…ও ভাই প্রকাশ শুনছিস আজ আমিও এখান থেকে যাবো তোর সঙ্গে… অবশেষে… উফফ কি আনন্দ…”
চিত্রগুপ্ত আজ একলা দাঁড়িয়ে, বহুদিন হলো একলা দাঁড়ানোর অভ্যেস ছাড়া হয়ে গেছে… সেই যবে থেকে চ্ন্দন এসেছে সেই তবে থেকে রোজ মৃত আত্মাদের এই স্তর থেকে অন্য স্তরে পাঠানোর সময় চিত্রগুপ্তের সাথে থাকে চন্দন। ও ঠিক জুটিয়ে নিতো কোনো ভাই, দাদা, ভাগ্না, বোন, মাসিমা আরো কত কি! যেসব আত্মারা বুঝতেই পারতোনা তাদের মৃত্যু হয়েছে, এখানে এসে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতো তাদের উদ্ধারকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো চন্দন বক্সী। সবার সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতো যে কটা দিন তারা এখানে থাকতো… আর বিনিময়ে কি পেতো! শুধু কষ্ট… মায়া শুধু কষ্ট বাড়ায় আর কিচ্ছু না। তবে এবার সেই দিন শেষ। আজ অবশেষে চন্দনও মুক্তি পাবে। আচ্ছা চিত্রগুপ্ত নিজে কি জড়ায়নি মায়ার বাঁধনে? এখানে কারুর চোখ থেকে জল পড়ে না তাই হয়তো চিত্রগুপ্তের ভেতরের উথাল পাথাল বাইরের কেউ টের পায়না। কিন্তু সে নিজে বেশ উপলব্ধি করে চন্দন বক্সী লোকটা কেমন আষ্টে পৃষ্টে তাকে জড়িয়েছে মায়ার বাঁধনে।
কালো গহ্বরটা উন্মুক্ত হয়ে গেছে, এবার এক এক করে সবাই ঢুকবে। সবার শেষে দাঁড়িয়ে চন্দন আর প্রকাশ। চন্দন বক্সী শেষ বারের মতো বিদায় জানায় চিত্রগুপ্তকে। প্রকাশ ঢুকে যায় গহ্বরে। চন্দনও পা রাখতে যায় আর তখনই….
“এ আমি কোথায়? এটা কোন জায়গা! হেল্প হেল্প… প্লিজ হেল্প...।”
চন্দনের পা টা থমকে যায়… চিত্রগুপ্ত বলে, “যাও চন্দন, দেরি কোরো না তাড়াতাড়ি যাও নয়তো গহ্বর বন্ধ হয়ে যাবে...।”
ভেতর থেকে প্রকাশ চিৎকার করে, “শিগগির এসো চন্দনদা।”
চন্দন বক্সী পা টা সরিয়ে নেয়… চিত্রগুপ্ত আঁতকে ওঠে,
“এ কি করছ চন্দন যাও, নয়তো আর কখনো এখান থেকে বেরোতে পারবে না।”
চন্দন বক্সী বোধহয় শুনতে পায়না কথাগুলো, দৌড় লাগায় সে। পৌঁছে যায় নবাগতা মেয়েটার কাছে,
“বোন শান্ত হও, শান্ত হও বলছি… আমি তোমায় সাহায্য করবো। বলো কি হয়েছে?”
“সত্যি বলছেন দাদা আপনি সাহায্য করবেন আমায়?”
“হ্যাঁ বোন। এসো এখানটায় বসো।”
গহ্বরটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। চিত্রগুপ্ত আবার সেই দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভঙ্গিতে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে, এই ভয়টাই সে পাচ্ছিলো।
হঠাৎই একটা উজ্জ্বল সাদা আলোতে ভরে যায় চারিদিক, কোথা থেকে যেন একটা গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
“চন্দন বক্সী … তুমি সত্যিই অসাধারণ। নিজের জন্য না ভেবে এতদিন ধরে অন্যকে সাহায্য করে গেছ এমনকি আজও তাই করলে। নিজের মুক্তির তোয়াক্কা না করেই তুমি ছুটে এলে অন্যকে সাহায্য করতে। আমরা তোমাকে চিত্রগুপ্তের সাথে এখানকার দায়িত্ব দিতে চাই। তুমি যদি সে দায়িত্ব গ্রহণ করো তাহলে কিন্তু পৃথিবীর হিসেব অনুযায়ী আগামী হাজার বছর আর মুক্তি পাবেনা আর যদি দায়িত্ব না নিতে চাও তবে আমরা তোমার জন্য আবার গহ্বর উন্মুক্ত করে দেব, তুমি পরের স্তরে যেতে পারবে। এবার বলো কি চাও তুমি?”
চিন্তায় পড়ে যায় চন্দন বক্সী, ভাবতে থাকে কি করা যায়! তবে ওই কয়েক মুহুর্তই চিন্তা! তারপরই তার সেই বিখ্যাত ভুবন ভোলানো হাসি নিয়ে বলে,
“আমি থাকবো এখানে। ওদের দরকার আমাকে, আমি থাকবো।”
“তোমার কাছে এমনই জবাব প্রত্যাশা করেছিলাম। আজ থেকে তবে তোমার নতুন নাম হলো মিত্রগুপ্ত।”
“মিত্রগুপ্ত… বাহ্ বেশ নাম তো।”
সাদা আলোটা মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, আর সেই নতুন আসা মেয়েটারও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। চন্দন বক্সী থুড়ি সদ্য প্রমোশন প্রাপ্ত মিত্রগুপ্ত ছুটে আসে চিত্রগুপ্তের কাছে, “চিগু দা এবার থেকে তুমি আমায় মিতু ভাই বলে ডেকো কেমন?”
“আচ্ছা তাই ডাকবো।”
“হেঁ হেঁ! তুমি সকালে আমায় সাহায্য করলে না তো এখন দেখো আমিও পেয়েছি ক্ষমতা ওপরমহলে যোগাযোগ করার। এবার আমি নিজেই পারবো আমার দাবি জানিয়ে ওখানে আপিল করতে। তুমি দেখো আমি ঠিক এই জায়গাটার রিমডেলিং করেই ছাড়বো।”
“হুম।”
“বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার! হুঁ হুঁ! যখন সিস্টেমটা চালু হবে তখন দেখবে তোমার মিতু ভাই কি করতে পারে!আচ্ছা এখন আমি আসি হ্যাঁ? নতুন কেউ এলো নাকি দেখি।”
চন্দন বক্সী মানে মিত্রগুপ্ত চলে যায়… তার চলে যাওয়া পথ পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চিত্রগুপ্ত… সত্যি এই মায়া জিনিসটা ভীষণ মারাত্মক…একবার যাকে ধরে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে….এবার হাজার বছর ব্যাটা থাকবে এইখানেই… আচ্ছা চিত্রগুপ্তের নিজের কত বছর হলো যেন! পাঁচশো ছাড়িয়ে যাবে কি!
(সমাপ্ত)