নীল নভঘনে
নীল নভঘনে
"শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে"এই গানটাই ঘুরে ফিরে বাজাতো তখন। আর চোখেও বাণ নামতো সহজেই। সবটাই লক্ষ্য করেছিলেন ভাস্বর আর ভাস্বতীর বাবা মা। তাই তো সেবারে জন্মদিনে ওকে উপহার দিয়েছিলেন এই হারমণিয়ামটা।
প্রাণপন চিৎকার করে গলা সাধতো ওস্তাদজীর কথা মতো।কত আর বয়েস হবে তখন, বছর সতের আঠারো। তারার ঘরে গেলেই গলায় কষ্ট হতো। কিন্তু কিছুতেই হাল ছাড়নেওয়ালী নয় ভাস্বতী।
কাজে কাজেই মা হবার তাই হলো। ভোকাল কলরবের সমস্যার শুরু। এতদিন কালো আর স্নিগ্ধতা বিহীন চেহারার জন্যে লোকে বিরক্ত বোধ করতো আর এবার তার সাথে যোগ হলো চেরা বাঁশের মত ভয়েস।
খুব চেষ্টা করেছিলো সেই গানটা তুলতে, "এই মণিহার আমায় নাহি সাজে। পারেনি। তার আগেই ডাক্তারবাবুর নির্দেশে রেওয়াজ ছাড়তে হয়েছিলো।
"নীল নভঘনে আষাঢ় গগনে তিলঠাঁই আর নাহিরে"
আবৃত্তি করারও জো নেই আর। অথচ এই আবৃত্তিকে ও কতই না ভালো বাসতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কোটস তুলে তুলে নিজের লেখা চিঠিতে বসাতো। তাতেই তো অচিন্ত্যর ওকে দেখতে এতো ইচ্ছে হয়েছিল।
একদিন অচিন্ত্য এলোও। কিন্তু চক্রবর্তী মশাইয়ের এত খাতির যত্ন পেয়েও , ভাগীরথীর তীরের খাগড়ার
এই মনোরম বাড়িটা দেখেও হবু শ্বশুর বাড়ি বলে ভাবতে পারলোনা কিছুতেই। ও বাড়ির সকলের বাইরের চেহারাটাই দেখলো । মনটা বুঝতে পারলোনা।
ভাস্বর অবশ্য ওর পাওয়ার খাটাতে চেয়েছিলো। পার্টির লোকজন লাগিয়ে বিয়েটা রে অচিন্ত্যর সাথে দিতে পারতো, তা জানে ভাস্বতী। কিন্তু ও তাতে রাজি হয়নি। সারাজীবন এর মত অপমান সহ্য করা আরো অনেক বেশি কঠিন হতো। তার চেয়ে হাসিমুখে বিদায় দেওয়াই সোজা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাসিটা বজায় রাখতে পারেনি। চোখেভরে উঠেছিলো টলটলে জলে। তবে রাজপুত্রের মতো মানুষটাকে অভিশাপ দিতে পারেনি কোনোদিন।
এরপর ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ভাস্বতী কলকাতায় নার্সিং পড়তে গেছে। একজন অতি সাধারন চেহারার মানুষকে বিয়েও করেছে।
সংসারের কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যে ফেসবুকের রিলস গুলো দেখে সময় পেলে। আনমনে দেখতে দেখতে একটা ভিডিওতে চোখ আটকে যায়। ঈন্দ্রানী হালদার। ভাস্বতীর সমবয়সীই হবে হয়তো। কিন্তু ওঁনার সেই আগেকার সুন্দর চেহারা কোথায়!
এখনও যে চেনা যায় মানুষটাকে সেই যথেষ্ট। হঠাৎ করেই স্টেজ কাঁপিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে গেয়ে ওঠেন,
"ধনধান্যে পুস্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা"
হে ধরনী ...........আমার আর কি দুঃখ.......
নয় বছরের মেয়ে ভাস্বতীর হারমণিয়াম বাজিয়ে স্বরগম প্র্যাকটিস করছে মিষ্টি রিনরিনে গলায়,
সারে সারেগা, রেগা রেগামা, গামা গামাপা, মাপা মাপাধা, পাধা পাধানি.............
মা মেঘ করেছে, বৃষ্টি আজ নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু ভাস্বতী আর কাঁদবেনা।
