SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Thriller

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Comedy Drama Thriller

না চাহিলে যারে পাওয়া যায় - ৪

না চাহিলে যারে পাওয়া যায় - ৪

10 mins
177



'দিমাক তেলে লেনে গয়া'

যাই হোক, আমি কাউকেই আর রাতের ঘটনা শোনাই নি সেদিন। ওদিকে তখন নবদম্পতীকে আশীর্বাদ করছিলেন সবাই - নববধূর পতিগৃহে যাত্রার পূর্বে, যথানিয়মে।

আমি কোন মতে একটু ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নিয়ে, তাদের দলে ভিড়ে গেলাম। কিন্তু কোথাও সেই চপলা হরিণীর দেখা পাইনা - গতরাতে তার রূপ ধরে নিশির ঐ ডাকে সাড়া দিয়ে, অমন নাজেহাল হবার পরেও, মনের দেখলাম এতটুকু শিক্ষা হয়নি!

প্রথম প্রথম প্রেমে পড়লে, ওরকম একটু আধটু নাকি হয়েই থাকে - কি যেন বলে, দিওয়ানাপন। যাই হোক, মন তখন প্রিয়ের দর্শন হেতু উতলা, আর তিনিও লজ্জাবতী হয়ে না জানি বেছে নিয়েছেন - কোন গৃহকোণের কোন নিরালা!

ব্যথিত হৃদয়ে তখন ভাবছি - আর বুঝি তার দেখা পেলাম না, আমার ঐ ফুলের ঘায়েই বুঝি, প্রেয়সী আমার মূর্ছা গেলো? মনটা উদাস হয়ে গেলো, এক পলকে সায়র থেকে আমি দেবদাসে পরিণত হলাম।

কিন্তু ঐ যে বললাম, বুদ্ধদেবদা আর বৌদির পবিত্র প্রেমের পরশে, আমার জীবনেও প্রেম এসেছিলো। তো সেই বৌদির বদান্যতাতেই, সেই সোনার হরিণের দেখা পেলাম - সে আরো উজ্জ্বল, আরো আকর্ষণীয় রূপে, অপরূপ সাজে।

মনে হলো, 'এত রূপ নিয়ে তুমি আমার সামনে এলে, মন বলে বুকে যেন ছুরি বসিয়ে দিলে!' আহা, মনে হলো বলি - কিয়া কাতিল আদা! যাই হোক, শুনলাম - বৌদির সঙ্গী হয়ে তাঁর ঐ বোন যাবে আমাদের সাথে বুদ্ধদেবদার বাড়ি!

মুহুর্তে, আমি দেবদাস থেকে ফের হরিদাস হয়ে উঠলাম। নবদম্পতীকে নিয়ে যাত্রা শুরুর জন্য, তখন কি তাগাদা শুরু করেছিলাম, ভাবলে নিজেরই এখন লজ্জা লাগে। যাই হোক, শুধু বুদ্ধদেবদা আমার এই মানসিক পরিবর্তন ও খুশীর কারণটা বোধ হয় বুঝলো।

তাই গাড়িতে চড়ার সময়, তাদের দুজনের পাশে আমায় জায়গা করে দিলো বসার। আর আমার ঠিক পিছনে, আমারই সীট ঘেঁষে বসলো তাঁর ঐ মিষ্টি শালিকা। আমি গাড়ির মিররে তার সেই পূর্ণশশী বদনের পানে চেয়ে রইলাম বহুক্ষণ। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লাম সারা রাতের ধকলের কারণে!

ঘুম ভাঙলো "তেরা দিমাক কিয়া তেল লেনে গয়া?" এই ভাষণে। কথাটা বলছিলো ধনঞ্জয়দা, ওর বাড়ি আসানসোল পার হয়ে। তাই তার কথাবার্তায় একটু আধটু হিন্দির আনাগোণা ছিলোই।

আমি চোখ কচলাতে কচলাতে বললাম - কেন, কি করলাম আবার?

ধনঞ্জয়দা - এক তো সারা রাত কাল কোথায় ঘুরে বেড়ালে, কি করলে কিছুই জানিনা। ঘুম যে হয়নি, তা তোমার নাক ডাকার বহর দেখেই বুঝেছি। কিন্তু ও বেচারীর কথাটাও ভাবো! ঐ পুঁচকি মেয়ের কাঁধে সারা রাস্তা মাথা রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুম দিলে, এবার তো ওকে রেহাই দাও!

আমি লজ্জায় জিভ কেটে মাথা তুলে দেখি, সেও লজ্জায় মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে। তার কাঁধ থেকে মাথা তুলে নিতেই সে নেমে দৌড় দিলো। আমরা বৌদিকে কোলে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ঢুকলাম।

দুপুরে খাবার টেবলে আবার মুখোমুখি হলাম আমার সেই ক্রাশের। এবার আর কোন ছাড়াছাড়ি নেই, গোগ্রাসে খাবার শেষ করে, হাত ধোয়ার জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে হাত ধুতে ওখানে আসতেই, তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলাম সোজা বাড়ির ছাদে!

বললাম - এটা কিরকম হলো?

সে - আমিও তো তাই বলছি, এটা কি হলো? আমাকে একা এখানে নিয়ে এলে কেন?

আমি - সে তো বলবই। তার আগে বলো তুমি কাল সারা রাত কোথায় ছিলে?

সে - কেন, ঘরে। তুমি হঠাৎ করে যা করে বসলে, আমি লজ্জায় আর ঘর থেকে বেরোতেই পারিনি। তোমার জন্য দিদির বিয়েটাও দেখতে পেলাম না। আবার কি করে বসবে কে জানে - মা জানতে পারলে না, আমায় চড়িয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিতো।

আমি - তার মানে কাল তুমি ঘরেই ছিলে। এর অর্থ আমায় নিশিতে ধরেছিলো।

সে - মানে? তোমায় আবার কখন নিশিতে ধরলো?

আমি তাকে আগের রাতের ঘটনা সব খুলে বললাম। সে শুনে ফিক ফিক করে হাসতে লাগলো দেখে বললাম - আমি প্রাণে মরতে বসেছিলাম শুনে, তুমি হাসছো?

সে - কে তোমাকে অত পাগলামি করতে বলেছিলো? কেন আগে কোন মেয়ে দেখোনি - এমন করছো যে!

আমি - দেখেছি, কিন্তু সত্যি বলছি, এমন রূপ, এত উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চঞ্চলা হরিণীর পাল্লায় কখনও পড়িনি, যার ঠোঁটের ঐ সুন্দর কমনীয় তিলটা দেখতে দেখতে, তার প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে উঠবো।

সে - বাবা, আমি অত কাব্য করা ভাষা বুঝি না। আর প্রেম করার বয়সও আমার হয়নি। ওসব আমার দ্বারা হবে না, বাদ দাও।

আমি - তাই বুঝি? তাহলে, এত লজ্জাই বা পাচ্ছো কেন, আর আমার সাথে এখানেই বা কি করছো এখন? আর সারা রাস্তা আমার মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে ঘুমাতেই বা দিলে কেন?

সে - জানিনা। আমার ওসব প্রেম টেম কিছু নেই। আমি এখানে তুমি নিয়ে এলে তাই এলাম - নিজে নিজে এসেছি নাকি? আমি চললাম, দিদি খুঁজবে। - বলেই দৌড়ে পালালো সে নিচেয়।

আমি পড়লাম আবার বিরহ যন্ত্রণায়। নিজের ওপরেই রাগ হলো - কি দরকার ছিলো ওকে রাগাতে যাওয়ার? বেশ কথা বলছিলো, এবার বুঝি সেটাও গেলো! কাল ওর মা এসে গেলে, আর মুখ দেখার সুযোগও পাবো না। ওকে যে কত কথা বলার ছিলো।

সেদিন আর একবারও তাকে একা পেলাম না কথা বলার জন্য। যদিও চোখাচুখি হলো অনেক বার, আর সে মিষ্টি করে এমন ভেংচি কাটছিলো প্রতিবারই যে, বুঝতে পারলাম - সে রাগ করে নি আমার কথায়। যাক ঐটুকু শান্তনা রইলো।

রাতে শুয়ে আছি, প্রবীরদা আর ধনঞ্জয়দা ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই, অথচ ক্লান্তি আছে যথেষ্ট! হঠাৎ মনে হলো, জানালা দিয়ে কেউ উঁকি দিয়ে চলে গেলো যেন! চোরের মন যেমন বোঁচকার দিকে, তখন আমার মনেও ঐ চপলাই শুধু ঘুরঘুর করছিলো।

ভাবলাম, সেই কি দেখা করতে এসেছে? এখন ভাবলে বড্ড বোকা বোকা লাগে, কিন্তু তখন আমার ঐ যে - 'দিমাক তেলে লেনে গয়া থা'। তাই, উঠে ঘর ছেড়ে বের হলাম। এদিক ওদিক চেয়ে কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না।

নিচে নেমে এসে দ্রুত এদিক ওদিক খুঁজলাম, কিন্তু কারোর দেখা পেলাম না। এমন সময় দেখি, কাকু মানে বুদ্ধদেবদার বাবা বাইরে বাথরুম করতে গিয়েছিলেন, ফিরছেন। জিজ্ঞাসা করলেন - কি হলো, কাউকে খুঁজছো?

বললাম - কেউ যেন ঘরে উঁকি দিয়ে চলে এলো।

কাকু - এখানে চোর ডাকাতের উপদ্রব নেই। তুমি হয়তো ঘুমের ঘোরে কি দেখতে কি দেখেছো। যাও ঘুমিয়ে পড়ো, অনেক রাত হলো। ভয় নেই, আমাদের অনেকেই নিচেয় আছি। ছাতেও আমার ভাই, ওর বন্ধু বান্ধবরা রয়েছে। দোতলায় মহিলারা আর তোমরা রয়েছো। যাও শুয়ে পড়ো।

আমি অগত্যা ফিরে এলাম ঘরে। জানালা দিয়ে বাইরে নিচের দিকে, তাকিয়ে দেখি - কেউ সত্যিই চলে যাচ্ছে! সম্ভবত তিনি মহিলা। পড়নের পোশাক দূর থেকে দেখে যা বুঝলাম - সালোয়ার কামিজ পড়া। কিন্তু দূর থেকে চাঁদের আলোয়, খুব স্পষ্ট তো দেখা গেলো না। তিনি মাঠের দিকে চলে গেলেন!

পরদিন আমি তক্কে তক্কে থাকলাম কখন আমার প্রাণ ভোমরাকে একবার একা পাই। কিন্তু কপাল মন্দ, সে সুযোগ আর এলোই না। তবে, দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়ার পর বৌদি ডাকলো গল্প করবে বলে। সেদিন বাসরে বাকিরা থাকলেও আমি তো ছিলাম না, তাই।

আমিও গিয়ে বসে পড়লাম তার কাছে। খাটে বুদ্ধদেবদা, বৌদি আর আমার ঐ হৃদয়হরণী পাশাপাশি পরপর শুয়ে। আমি তাদের মাথার কাছে চেয়ারে বসে। বৌদি - দুপুরে আজ একটা ঘুম দিতেই হবে - বলে দরজাটা আটকে দিলো।

তারপর, নানা কথাবার্তা মানে, দাদার সাথে তার কিভাবে পরিচয় ও প্রেমে পড়লো তারা, পড়াশুনা, চাকরি ও ভবিষ্যত প্লানিং ইত্যাদি সব কথা বলছিলো আমায়। সঙ্গে আমারও পড়াশুনা, চাকরি, প্রেমে না পড়ার ব্যথা সব শুনলো।

বুদ্ধদেবদা আর সেই চপলা হরিণী এর মধ্যেই ঘুমিয়ে গেছে, আর বৌদিও কথা বলতে বলতে, লম্বা লম্বা হাই তুলছে দেখে, বুঝলাম - এবার আমাকেও ঘর ছেড়ে বের হতে হবে, তারা ঘুমাবে।

এমন সময় কাকিমা এসে বৌদিকে ডাকলেন - বৌমা, তোমার কলেজের স্যার এসেছেন। তোমায় নিচে ডাকছেন, এসো তো মা একবার।

বৌদির কলেজেরই এক প্রফেসর, যাঁর কাছে পড়েওছিলো সে, তাঁর বাড়ি ছিলো এদিকেই। কিন্তু বয়স হয়েছে বলে, রাতে আসা অসুবিধাজনক হওয়ায়, তিনি এসেছিলেন ,দিনের বেলাতেই দেখা করে তাকে আশীর্বাদ করতে।

বৌদি উঠে, আমায় বসতে বলে, নিচে চলে গেলো। বুদ্ধদেবদা পিছন ফিরে শুয়েছিলো, আর সেই সুন্দরীর মুখটা ছিলো আমার ঠিক সামনেই। কি সুন্দর, অপূর্ব সেই কিশোরীর স্মিতা বদনের আকর্ষণ, আমার আবার বুদ্ধিনাশ হলো। আমি তার গালে নিজের ঠোঁটের একটা ছোঁয়া দেওয়া থেকে, নিজেকে কিছুতেই বিরত করতে পারলাম না!

আমার ঐ ছোঁয়ায় বোধ হয় তার নিদ্রাভঙ্গ হলো, অথবা সে ঘুমের ছল করছিলো - আমার আচরণে হতবাক হয়ে উঠে পড়লো। আবার সেই লজ্জায় গলে যাবার অবস্থা হলো তার, সঙ্গে তার মুখে ফুটে উঠলো সেই যে হাসি - অমন সুন্দর, পবিত্র, খুশী ও লজ্জামিশ্রিত এক অদ্ভুত অনুভূতির হাসি, আমি আজ পর্যন্ত তার তুলনা খুঁজে পাই নি।

তার হাতটা ধরে, তালুতে লিখে দিলাম আমার মোবাইল নাম্বারটা। বললাম - এখন তোমার নাহয় প্রেম করার বয়স হয়নি, কখনও তো হবে। এই আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো, এই মোবাইল নাম্বারটায় কল করো - যদি তোমার মনের কোথাও, আমার জন্য এতটুকু জায়গা দিতে ইচ্ছে করে তখন, তো।

আমি সত্যিই বহুদিন তারপর, তার অপেক্ষায় থেকেছি। সেও শুনেছি অপেক্ষা করেছিলো। তারপর একটা ভ্রম, দুজনেরই অপেক্ষাকে বৃথা করে দিয়ে, জীবন স্রোতে ছিটকে বহুদূরে পাঠিয়ে দিলো দুজনকে। আমি স্কুলের শিক্ষকতা ছাড়লাম, অন্য চাকুরী নিয়ে এই রাজ্যই ত্যাগ করে, চলে গেলাম বহুদূরে। সেও নতুন জীবনসঙ্গীর সাথে, পাড়ি দিয়েছে অন্যাভিমুখে - জানি না কোথায়। ও হ্যাঁ, আমার সেই মোবাইল নাম্বারটাও, সম্প্রতি ছেড়ে দিয়ে, নতুন কানেকশন নিয়েছি আমি।

যাক সে কথা, তখন প্রেমে মুগ্ধ আমাদের দুটি হৃদয়ের স্পন্দন, বেশ অনুভব করতে পারছিলাম দুজনেই। হঠাৎ কারোর পায়ের আওয়াজ শুনে ও বললো - কেউ আসছে। তারপর আবার ঘুমের ভান করলো, আমিও নিজের মোবাইলটা নিয়ে খুটখুট করা শুরু করলাম।

বৌদিই ফিরে এল তখন। আবার নিজের জায়গায় শুয়ে, বোনের দিকে ভালো করে চেয়ে চেয়ে দেখলো। আমি তখন যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানিনা, এমন ভাব করে বসে আছি।

বৌদি - শোন না, তোমাকে একটা কথা বলি? কিছু মনে করবে না, বলো?

আমি - না না। বলো।

বৌদি - আমার এই বোনটা কিন্তু এখনও খুব ছোট। শুধু দেখতেই বড় হয়েছে, আসলে এখনও বাচ্চাই একটা। ও যদি তোমার মত বর পায়, সত্যিই ভাগ্যবতী হবে। আমায় তোমার দাদা বলছিলো তোমার সম্পর্কে অনেক কথা। তোমার সাথে কথা বলে, আমারও তাই মনে হলো।

কিন্তু, ওকে আরও একটু বড় হতে দাও। নিজের বোধ বুদ্ধিটা আর একটু হোক ওর। আমি নিজেই ওর বিয়ের জন্য, কথা বলবো মাসির সাথে। কিন্তু, এখন না, ওকে এখন এসব নিয়ে কিছু বলো না, বা করো না। মাসিও জানতে পারলে খুব রাগ করবে, হয়তো ওকে মারধর বকাবকিও করবে।

আমি বুঝতে পারলাম, বৌদি আমাদের বিষয়ে ভালোই জেনে গেছে। তাই ঘুরিয়ে এইভাবে আমাদের থামাতে চাইছে। তাই লজ্জায় আমি মাথা হেঁট করে বললাম - হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছো। ও আমার থেকে কত ছোট। আমি ঐ একটু ঠাট্টা মজা করছিলাম আর কি। তুমি শোও, রাতে আবার ধকল যাবে, একটু ঘুমিয়ে নাও। এখনই তো আবার সাজাতে আসবে।

ওখান থেকে কোন মতে, উঠে পালিয়ে এসে বাঁচলাম তখন। বাইরে আসার পরেও ভিতরে কি চলছে, সেদিকে কান খাড়া করে রাখলাম। বৌদি দেখলাম ওর বোনের হাতে লেখা, আমার ফোন নাম্বারটা নেলপলিশ রীমুভার দিয়ে মুছে দিলো! বললো - তোর মা দেখলে কি জবাব দিবি ভেবেছিস তো? অত বেড়ো না।

তারপর, আর তার সাথে কথা বলার সুযোগ পেলাম না। রাতে, কনেযাত্রীর দলে তার মাও এলেন। বুঝলাম - আর কিছুই করার নেই আমার। সব জাড়িজুড়ি শেষ। কিন্তু তাঁদের বরণ করে নেবার সময়, সেও দেখি শাড়ি পড়ে, সেজে গুজে রেডী হয়ে, তাদের দলে যোগ দিলো।

সেই সুযোগে, আমি একটা গোলাপ নিয়ে তার একটা পাপড়িতে, আমার ফোন নাম্বারটা আবার লিখে, তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। ওমা, আমায় অবাক করে দিয়ে দেখি - তাকে প্রবীরদা আর ধনঞ্জয়দাও গোলাপ দিচ্ছে!

ধনঞ্জয়দা ফিসফিস করে বললো - ভাই, তোমার লাইন কাটছি না। ওর মা যেভাবে মেয়ের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে, তা'তে তোমাদের দুজনকেই, তার হাত থেকে বাঁচাচ্ছি।

কথাটা আমরা দুজনেই শুনতে পেলাম। সে মিষ্টি করে হেসে তিনটে গোলাপই হাতে নিয়ে, ওর দিদির কাছে, মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সেখানে যেতেই, মায়ের বেশ কিছু চোখা চোখা প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো বোধ হয় তাকে। তারপর করুণ চোখে আমার দিকে, সেই শেষ বারের মত চেয়ে, মাথাটা নিচু করে নিল - আর এক বারও চোখ তুলে চায়নি সে কারো দিকে!

যাই হোক, আমি যে আবার আশাহত, বিরহবেদনায় নিমজ্জিত হলাম সে তো বলাই বাহুল্য। নিমেষেই যেন, উৎসব মুখর ঐ বাড়িটা, আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠলো। আমি, কাউকে কিছু না বলে, ওপরের সেই ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।

ওদিকে সকলের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে, কনেযাত্রীর লোকজন ফিরে যাচ্ছে সেই রাতেই। বুদ্ধদেবদার ভাই, প্রবীরদা আর ধনঞ্জয়দা তাঁদের এগিয়ে দিতে যাচ্ছে - গ্রামের ভিতরে বাস ঢোকেনি। বাইরে, পাকা রাস্তার ওপর বাসস্টপেই দাঁড়িয়েছিলো গাড়িটা।

আমি তার ঐভাবে চলে যাওয়া দেখতে পারবো না বলে, উল্টোদিকের জানালার গ্রীলটা ধরে, মাথাটা তার ওপর ঠেকিয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ ঠাণ্ডা দুটো হাত এসে চেপে ধরলো আমার হাতদুটো! আমি আঁতকে উঠলাম - কি ভয়ানক ঠাণ্ডা ছোঁয়া।

তাকিয়ে দেখি - আমার সেই কাজল নয়না হরিণী এসে, হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আমার হাতদুটো ধরে। বললো - আমি পালিয়ে এসে, পিছন দিক দিয়ে এই জানালায় উঠেছি। তাড়াতাড়ি নেমে এসো - খুব দরকারী কথা আছে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেলো তো। বলে সে আবার নিচে নেমে গেলো।

আমিও দ্রুত নিচে নেমে তার পিছন পিছন দৌড়ালাম। সে দেখি হনহন করে আলপথে হাঁটছে। আমিও যতটা পারি দ্রুত হেঁটে তার কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু তার কাছে কিছুতেই পৌঁছাতে পারছি না।

এদিকে, তার পিছু পিছু হাঁটছি তো হাঁটছিই - আলপথের শর্টকাট যদি বাদও দিই, ওদের গ্রামের রাস্তা ধরে, অতি শ্লথগতিতে চললেও, বাসস্টপ পৌঁছাতে পনেরো মিনিটের বেশী লাগার কথা না। আর আমি হাঁটছি, বলা ভালো ছুটছি প্রায় এক ঘন্টা ধরে - কিন্তু বাসস্টপ আর আসে না!

ওদিকে কনেযাত্রীর সবাইকে বাসে তুলে দিয়ে, যতটা সম্ভব ভদ্রতা করে, বাসটাকে রওনা করিয়ে দিয়ে, তারপর ফেরার পথ ধরলো - ধনঞ্জয়দারা। রাত হয়ে গেছে বেশ, তাই আর গ্রামের রাস্তায় না গিয়ে সেই আলপথের শর্টকাট রুট টাই ভাগ্যিস নিয়েছিলো তারা।

খানিকটা আসার পর দেখে - আমি একা ঐ মাঠের মাঝখানে, তাদের তালপুকুরটার চারপাশে দ্রুত পায়ে চক্কর কাটছি। বুদ্ধদেবদার ভাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো। তাই তিনজনে একসাথে এগিয়ে এসে, আমায় ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো - আরে তুমি এখানে কি করছো, বাড়ি চলো?

এই বলে, আমার মুখে আলোর ছটা মারতেই, আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ি। ঘামে আমার পড়নের পোশাক পুরো ভিজে গিয়েছিলো। ওরাই আমায় ধরে ফেলে, চ্যাংদোলা করে বাড়ি নিয়ে আসে৷ আমাদের ঐ ঘরে নিয়ে এসে, ভালো করে চোখে মুখে জল দিয়ে, আমার জ্ঞান ফেরায়।

তারপর সবকথা বলি তাদের। বুদ্ধদেবদার ভাই সব শুনে বলে - নিশির ডাক। ওদের পাল্লায় পড়লে, সারা রাত দৌড় করিয়েই মারবে। তোমার কপাল ভালো যে, আমরা ঐ পথেই ফিরছিলাম। না হলে যে কি হতো, কে জানে?

সেই থেকে আর কখনও রাতে, পরিচিত অপরিচিত যে কেউ ডাকলে, আমি সঙ্গে যে থাকে, তাকে আগে ডেকে দেখাই, তারপর যা করণীয় করি। ওখানে খুব শিক্ষা হয়েছিলো আমার, মাগো!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy