মুখাগ্নি
মুখাগ্নি
একটা স্টেশনে মনে হয় ট্রেন দাঁড়ালো। দূরে হকারদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সাইড আপার বাথে টান টান হয়ে শুয়ে পড়েছিল । শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেছিল চোখের দোরগোড়ায়। এতক্ষণ ঘুমোনোর পর শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় উধাও হয়ে গেছে। আপারবাথ থেকে নীচে নেমে জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই বুকের ভিতর শিরশির করে উঠলো। নাম না দেখেও চোখ বন্ধ করে সে বলে দিতে পারে এই শহরের নাম। এই শহরের আকাশ বাতাস তার চেনা। এই শহরও চেনে তাকে বড্ড আপন করে। তার প্রিয় শহর আসানসোল। যেখানে কেটেছে মিলির শৈশব, কৈশোর, যৌবন। আজ মিলি কলকাতাবাসী। বাবা -মাও বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় আছেন। আসতে আসতে সে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ফ্ল্যাসব্যাকে মিলি দেখছে একটা ছোট্ট মেয়ে বাবার স্কুটারের পিছনে নুলিয়া নদীকে পিছনে ফেলে ব্রিজ পেরিয়ে কল্যাণপুর হাউসিং । সেখানেই ছিল এক সময় মিলির বাড়ি। মা,বাবা,দিদা, বোন ও মিলিকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। একদিন রাস্তা অবরোধ হয়েছিল । সেদিন মিলির স্কুল থেকে আসতে বড্ড দেরি হয়ে গেছিল। মেলাবুড়ির মন্দিরের সামনে আসতেই দেখেছিল মা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। পাড়ার মোড়ে চিন্তিত মুখে দিদা তার জন্য অপেক্ষারত। মিলিকে দেখে দিদার ফোকলা দাঁতে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। দিনগুলো ভালোই কাটছিল । মিলি স্কুল পেরিয়ে কলেজে ওঠে। একদিন দিদা অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন হাসপাতালে বাবা রাতে থাকতেন। মিলি, তার বোন ও মা পালা করে দিনের বেলায় থাকতো। মিলি যখন কেবিনে বসে থাকতো তখন সে নাকে এক বিষাদের গন্ধ পেতো। সামনের বেডে দিদা শুয়ে মৃতুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আর সে চুপচাপ বসে আছে। দিদার জীবনো বড্ড কষ্টের । দিদার চার মেয়েও দুই ছেলে। বড় ছেলে মানে মিলির বড় মামা এক ট্রেন দুর্ঘটনায় মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মারা যান। সেই শোকে দাদাভাই মানে মায়ের বাবা মারা যান। ছোটমামা বিয়ের পর দিদাকে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। মা বাবা দিদাকে আসানসোলে নিয়ে আসেন। নিজের বাড়ি থেকে চলে আসার দুঃখ দিদার মনে সারা জীবনি ছিল। মারা যাওয়ার ঠিক আগের দিন দিদা মিলিও তার বোনকে বলেছিলেন – ‘দুষ্টু গরুর থেকে ফাঁকা গোয়াল অনেক ভালো । দেখিস আমার মৃতুর পর যেন আমার ছেলে মুখাগ্নি না করে । যে আমায় ছেলের মত সেবা করলো সেই ছোট জামাই যেন আমার মুখাগ্নি করে । পরজন্ম যদি থাকে তাহলে তাকে যেন ছেলে হিসাবে পাই।’ ঠিক তার পরের দিন দিদা মারা যান। মিলির মামা ঠিক খবর পেয়ে শ্মশানে উপস্থিত হয়। আত্মীয়স্বজন বলতে থাকেন, ছেলে যেমনি হোক মুখাগ্নি তারি অধিকার। মিলি ও তার বোন রুখে দাঁড়ায়। দিদার শেষ ইচ্ছা তাঁরা কিছুতেই অমান্য করতে দেবে না। পাড়া প্রতিবেশীরা মিলি ও তার বোনের পাশে দাঁড়ায়। তাঁরা বলেন, যে ছেলে মাকে কোনদিন দেখলো না তার কিসের অধিকার। অবশেষে ঠিক হয় প্রথমে মিলির বাবা মুখাগ্নি করবেন তারপর মিলির মামা। শেষ পর্যন্ত তাই হয়। ঝাকুনিতে মিলির সম্বিৎ ফিরে পায়। সে দেখে ট্রেন চলছে আর তার চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে।