Indrani Samaddar

Horror

2.6  

Indrani Samaddar

Horror

মৃত্যুপুরিতে জীবিত মানুষ...

মৃত্যুপুরিতে জীবিত মানুষ...

5 mins
435



সুজয় কয়েকমাস আগে পর্যন্ত প্রাইভেট ফার্মে কাজ করত। লকডাউনের পর থেকে চাকরি গেছে। কতদিন ঘরে বসে থাকা যায়। সুজয় নতুন কাজ জোগার করে। কাজটা খানিক বাধ্য হয়েই নিতে হয়। মনে মনে ভাবে অন্য কাজ পেলেই এই কাজ সে ছেড়ে দেবে। । সে লোকের বাড়ি বাইকে করে খাবার পৌঁছে দেয়। দেখতে দেখতে কয়েক মাস কেটে গেছে। 


আজ সারাদিন বৃষ্টি পড়ছে। কখনো একটু বেশী আবার কখনো কম। করোনার আতঙ্কে এমনিতেই রাস্তায় লোকজন কম থাকে। আজ বৃষ্টির জন্য রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। জিপিএস অন আছে। ডেলিভারি লোকেশান এসেই গেছে। এখন রাত প্রায় নটা। জিপিএস যে বাড়ির দিকে দিক নির্দেশ করছে সেটা অনেকটা ভুতুড়ে বাড়ির মত দেখতে। গ্রিলের দরজা খুলে ভিতরে যেতে সুজয় দেখে ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার সয়ে গেলে দেখে জানলার ভিতর থেকে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। তবে বাল্বের আলো নাকি মোমবাতির আলো বোঝা যাচ্ছে না। সে আজ অব্ধি বড়ো বড় আবাসনে খাবার দিয়েছে। শুধু আবাসন কেন বিভিন্ন পুরনো পাড়ায় খাবার দিয়েছে। যেতে-আসতে  লোকজনের উপস্থিতি দেখেছে। কিন্তু এরকম হরর স্টোরি র মত প্লটে খাবার দিতে আসা এই প্রথম। হঠাৎ করে সুজয়ের পায়ের আঙ্গুল গুলো ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে। অন্ধকারে পায়ের উপর দিয়ে কিছু যেন ছুটে চলে গেল কিন্তু কী শীতল স্পর্শ। মনের ভেতরটা কেন জানি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। গ্রিলের ভিতর আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে আসে পাশে অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ চলছে। একবার ভাবে হাতে খাবার নিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু এই খাবার দেওয়ার সঙ্গে তার ও তার স্ত্রীর জীবন ধারণ করার সম্পর্ক ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে তাই ইচ্ছে থাকলেও খাবার নিয়ে ফিরে আসতে পারল না।


  সামনে এক ফালি বাগান। বাগান না বলে আগাছার স্তূপ বলা উচিত। বাগানে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। একটা বিশাল গাছ বাড়িটাকে ছাতার মত করে ঢেকে রেখেছে। মনে হচ্ছে হরার স্টোরির প্লটে সুজয় বিরিয়ানির প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে। কিন্তু কে খাবে এই গা ছমছমে পরিবেশে বিরিয়ানি। হয়ত বাড়িতে কোন বাচ্চা আছে। সেই খেতে চেয়েছে। মা-বাবা হয়ত তাদের অনেক কষ্টের জমানো টাকা খরচা করে বিরিয়ানি খাওয়াবে কিংবা বাড়িতে বিশেষ অতিথি এসেছে বা কারোর জন্মদিন। তার বেশ ভয় ভয় করছে কিন্তু কেন যে ভয় করছে। তবে একরকম থমথমে ভুতুড়ে পরিবেশ এর আগে কখনো দেখেনি । হিজিবিজি চিন্তা করতে করতে দেখে একতলায় গ্যারেজের পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। গ্যারেজে ধুলোয় ঢাকা একটা সাইকেল ও স্কুটার দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দেখে দুটো চোখ জ্বলছে। ভয়ে হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। পরক্ষণেই কাঁপুনি যখন খানিক কমে তখন দেখে সেই চোখ এক নিরীহ বিড়ালের। এই অলৌকিক পরিবেশে গা ছমছম করা অনুভূতিতে হয়ত অকারনেই ভয় লাগছে। এখন খাবারের প্যাকেট সৌরেন শিকদারকে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে হয়ত শরীর খারাপ লাগছে নাকি ভয় পেয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে দেখে একজন চাদর গায়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। এতক্ষণ পর একজন মানুষ দেখে সে মনে বল পায়। জানতে চায় সৌরেন শিকদার কী এখানে থাকেন। হাড়হিম করা একটা গলা শুনে শরীরের ভিতর থেকে সুজয় কাঁপুনি অনুভব করে। তার সামনে একটা ভৌতিক মুখের অবয়ব। চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢাকা। শুধু দুটো চোখ দেখতে পাচ্ছে। কি শীতল চাউনি। হাড় হিম করা গলায় লোকটা বলে ওঠে –‘ কী দরকার?’ সুজয় কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে-‘খাবারের প্যাকেট দেবার ছিল?’ লোকটি সেই ভয়ঙ্গর হাড় হিম গলায় বলে ওঠে – ‘খাবারের প্যাকেট আমায় দিন।’ লোকটা হাত বাড়াতেই ভয়ে সুজয় খাবারের প্যাকেট ফেলে দে ছুট। এক ছুটে গ্রিলের দরজা থেকে সবে পা বের করবে। ঠিক সেই সময় একটা হাতের স্পর্শ। হাত তবে মানুষের নয়। এক কঙ্কালের হাত। দেখেই সুজয়ের চোখে অন্ধকার নেমে আসে।


চোখ বন্ধ করেও নাকে বিরিয়ানির গন্ধ পাচ্ছে। মাথাটা ভার। চোখের পাতা খুলতে পাচ্ছেনা। অনেক কষ্টে চোখ খুলে দেখে সে একটা চৌকিতে শুয়ে আছে। খাবারের গন্ধের সঙ্গে একটা বিটকেল গন্ধ মিশে একটা উটকো গন্ধ নাকে আসছে। সেই ঘরেই কয়েকজন ভৌতিক মুখের সাক্ষাৎ পান। চেয়ার নিয়ে বসে আছে কয়েকজন ভুত । খাবারের প্যাকেট থেকে এক একজন একেকবার খাবার তুলে খাচ্ছে। এদের মধ্যে একজন ভয়ংকর দেখতে ভুত বলেই চলেছে-‘ সমগ্র ভুত জাতির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন ।‘ হঠাৎ এক ভুত লক্ষ্য করে সুজয়ের জ্ঞাণ ফিরেছে। সে বলে ওঠে –‘ আসুন কর্তা। বসে কিছু খেয়ে নিন। আপনার আনা খাবার এখনো বেঁচে আছে। মানে আমারা বাঁচিয়ে রেখেছি । আমরা ভুতেরা জোটবদ্ধ ভাবে বেঁচে থাকি। মানুষের মত ভীড়ে একটা ছোট যন্ত্র নিয়ে খুটখুট করতে করতে বাঁচি না’ পাশের থেকে আরেক ভুত বলে ওঠে-‘ এই কয়েক মাস আগে আমিও মোবাইল নিয়ে খুট খুট করতাম কিন্তু এখন নিজের ভুল বুঝেছি। তখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। এতো ব্যস্ত যে গাড়ি চালাতে চালাতে ফোনে কথা বলছিলাম। উলটো দিক থেকে একটা গাড়ি এসে পিষে দিয়ে চলে যায়। প্রথম প্রথম ভারি দুঃখ হোতো এখন আর হয়না। তবে যদি দেখি কেউ ফোন কানে দিয়ে রাস্তায় যাচ্ছে তবে তখনি মনে হয় ঘাড় মটকে দিই। তা আপনি কী কত্তা কানে ফোন গুজে রাস্তা চলচল করেন। তাহলে আজ নয় কাল গাড়ির তলায় যাবেন । তার চেয়ে এক্ষুনি ঘাড় মটকে দিই।’ কথা শুনে সুজয় ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় ।  


মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ কানে যাচ্ছে। সুজয় চোখ খুলতে এখনো ভয় পাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে অচেনা লোকজন তাকে ঘিরে রেখেছে। সে এক জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে আছে। সারা গায়ে অসম্ভব ব্যথা। দুজন লোক সুজয়কে ধরে তোলে। বাইক চালানোর মত শক্তি ছিলনা। একজন অটোয় করে বাড়ি পৌঁছে দেয়। পাড়ার এক বন্ধু বাইক বাড়ি অব্ধি নিয়ে আসে। প্রথম কিছুদিন সুজয় সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করলেই সেই রাতের দেখা ভুতগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। রাত হলেই মনে হয় জানলার সামনে ভীতিজনক মুখের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। মোবাইলের দিকে চোখ গেলেই মনে হয় একটা কঙ্গাল হাত গলা টিপতে এগিয়ে আসছে। সারাদিন ভয়। সারাদিন আতঙ্ক পিছন ছাড়ছে না। সুজয়ের স্ত্রী মৈত্রেয়ি বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। ডাক্তার ঘুমের ঔষুধ দিয়েছে। রাতে ঘুমের ঔষুধ ছাড়া ঘুম আসে না। দেখতে দেখতে কয়েক মাস কেটে গেছে। পুরনো চাকরি ছেড়ে সুজয় ও মৈত্রেয়ী হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করে। সুজয় ও তার স্ত্রী দুজনেই খুব ভালো রান্না করে। খাবার ডেলিভারির জন্য একটা ছেলে রেখেছে। বাকি কাজ স্বামী – স্ত্রী মিলেই করে। একদিন সকাল থেকে সুজয়ের নাকে একটা বোটকা গন্ধ এসে ধাক্কা মারে। অথচ একি বাড়িতে মৈত্রেয়ী কোনো গন্ধ পাচ্ছেনা । এখন রোজ মৈত্রেয়ী দেখে রান্না করা খাবার উধাও হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে সুজয়ের সঙ্গে নিত্যদিন মৈত্রেয়ীর কথাকাটাকাটি চলছে। সুজয় ভাবে মোত্রেয়ীকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ওদের জীবনে অশরীরীরা হানা দিয়েছে। তাদের সঙ্গে একি বাড়িতে বাস করছে। প্রথম প্রথম দুই একজন ভুত ছিল । এখন বাড়ির মধ্যে গিজগিজ করছে ভুত। তারা রান্না করা খাবার খেয়ে নিচ্ছে। শুধু যে খায় তা নয়। হয়ত কিছু বাজার থেকে লাগবে নিমেষের মধ্যে সেটা নিয়ে আসছে। একদিন এক ভুত বলে ‘ কর্তা আপনার গিন্নীকে ভাবছি আমরা দর্শন দিয়েই দিই। তাহলে রোজের অশান্তি থেকে আপনি নিস্কৃতি পাবেন। সেদিন আপনার ডেলিভারি বয় রাস্তায় যেতে যেতে মোবাইল দেখছিল দিয়েছি ঘাড় মটকে। এখন সে আমাদের সঙ্গে আছে।’ মৈত্রেয়ী রান্না করছিল । হঠাৎ মনে হল কে যেন ঘরে আছে। চোখ মেলে পাশে থাকাতেই চক্ষু চড়ক গাছ দেখে কতগুলো ভুত তারই রান্না করা খাবার খাচ্ছে। ভয়ে মৈত্রেয়ী অজ্ঞান হয়ে যায় কিন্তু জ্ঞান ফেরেনা। এখন বাড়িতে  মৈত্রেয়ীকে নিয়ে অশরীরির সংখ্যা আরেকজন বাড়ল। সুজয় এখন ভুতের ভিড়ে একা মানুষ। ভুতেরা রান্না করে আর সে খাবার পৌঁছাতে যায়। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror