লকডাউন(১৪)
লকডাউন(১৪)
কল্যাণপুরের নুলিয়া নদীর ব্রিজ ক্রশ করে মেলাবুড়ি মন্দিরকে পাশে রেখে সোজা গিয়ে বাদিকে টার্ণ নিয়ে আরো খানিকটা সোজা গিয়ে ডানদিক যেতে হবে। বেশ খানিক গেলে গোবিন্দপুর গ্রাম। অতিতে যখন আসানসোলের বাড়িতে স্কুল –কলেজের দিন গুলো কেটেছে তখন সেই গোবিন্দপুর গ্রাম থেকে আমদের বাড়িতে গৃহ সহায়িকার কাজে আসত পুনি। মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত । পুনির মায়ের নাম খেলু বাউরি- আমরা মাসি বলতাম। সেই মাসি যে সব বাড়িতে কাজ করত সেই খান থেকে সাহায্য নিয়ে পুনির বিয়ে দিয়ে দিল। আমরা যখন সিক্সে পড়ি তখন সে এক কন্যার মা হয়ে গেছে। পরে বোধহয় আরো দুই কন্যা হয়েছিল। মাসির মুখে শুনেছিলাম সে ভালো নেই । কন্যা হওয়ার অপরধে তাকে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত হতে হয়েছে। এসেছিল এক দুবার আমাদের বাড়ি। জীবন যন্ত্রনায় মুখের হাসি অনেকটা শুকিয়ে গেছিল। খেলু মাসির চার মেয়ে আর দুই ছেলে। হঠাৎ একদিন শুনলাম বড়মেয়ে হ্যারিকেনের আলোয় পুড়ে মারা যায়। বড় মেয়ের তিন মেয়ে ও এক ছেলে ও বড় জামাইকে নিজের সংসারে আশ্রয় দেয়। জামই সেরকম কিছুই করতো না। সেও কিছুদিনের মধ্যে মারা যায়। সেই সময় থেকে জ্যোৎস্নার সঙ্গে আমদের পরিচয়।
মা জোৎস্নাকে মায়ের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল আর বাড়ির টুকটাক কাজ করত । অত্যন্ত প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন ছিল। স্কুলে সহপাঠীরা তার থেকে বয়সে ছোট বলে স্কুলে যেতে অনিহা ছিল। মাকে বলত- ‘ মামি আমি তোমার কাছে বাড়িতেই পড়ব’। এই ভাবেই দিন চলছিল। সময় কাটতে থাকে। বোন কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়। বাবা বোনের সুবিধার জন্য ভিআর এস নিয়ে কলকাতায় চলে যান। জ্যোৎস্না সেই সময় বেশ কিছুদিন কলকাতায় ছিল। প্রথম যেদিন জেরক্স মেশিন দেখে হেসে কুটি পাটি, আমায় ফোন করে বলে , তার জীবনের দেখার কিছুই আর বাকি রইলনা। একটা কাগজ মেশিনে ভিতর চালান করলে ঠিক সেরকম একটা কাগজ বেড়িয়ে আসছে কী অবাক কান্ড ! আবার মাটির তলা
দিয়ে পাতাল ট্রেন।কেউ দরজা খোলেও না আর কেউ দরজা বন্ধ করেনা কিন্তু নিজের থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। ভুতুরে কাণ্ড। আমি জানতে চেয়েছিলাম –কেমন লেগেছে ?সে জানায়, প্রচণ্ড ভয় লেগেছে। সে বলে , আজব শহর কলকাতা সবাই ছুটছে। সেই জ্যোৎস্না আমার মেয়ে হবার সময় আমার শ্বশুরবাড়িতে অনেক দিন ছিল। মেয়েতো জোন্নাদিদি বলতে অজ্ঞান ছিল। আমার মায়ের ইচ্ছে ছিল কলকাতার কাছাকাছি জোৎস্নার বিয়ে হোক।এত দিনে শহুরে আদব কায়দায় সে রপ্ত কিন্তু তার দিদারা গ্রামের দিকেই পাত্র ঠিক করে। ভালো ছেলে, কারখানায় কাজ করে। শাড়ি থেকে বাসন, চাদর থেকে যতটুকু সম্ভব গয়না সব গুছিয়ে দেওয়া হয়। আসতে আসতে আসানসোলের বাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। সেদিন জোৎস্না ও জ্যোৎস্নার দিদার সেকি কান্না। ততদিনে জ্যোৎস্না দুই ছেলের মা। আমরা ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। ওদের কোনও ফোন ছিল না।
ডিসেম্বরের শীতের এক সন্ধ্যায় বাবার একটা পুরনো ফোন আছে । সেখানে আননোন নাম্বার থেকে বারবার ফোন আসে। ফোনটা খারাপ। খুব আসতে কথা শোনা যায়। সেদিন বাবার কাছে গিয়ে শুনলাম পুরনো ফোনে বারবার একটা ফোন আসছে । কে যে চেষ্টা করছে ? আমি ফোন করি –কাকে চান ? বারবার এই নাম্বারে ফোন করছেন?একটি মহিলা কন্ঠস্বর- মাপ করবেন, ভুল করে অন্য নাম্বারে চলে গেছে বোধ হয়। আমি চিৎকার করে উঠি- জ্যোৎস্না না? সে আনন্দে বলে মিনি মাসি । আমার একটা ফোন হয়েছে। প্রায় চেষ্টা করি মামার পুরনো নাম্বারে ফোনটা বেজেই যায় আমি বলি ফোনটা খারাপ। আমি তোকে আমার ফোন থেকে ফোন করছি। ওর এক অদ্ভুত ডাক বাবা –মা হচ্ছে মামা –মামি আর আমি ও বোন মিনিমাসিও ছোটন মাসি, আমার বর –মেসো আর আমার শাশুড়ীমা হচ্ছেন কাকিমা । আসলে পুনি আমাদের সম বয়সি ছিল বলেই আমদের মাসি বলত। তারপর থেকে মাঝে মাঝে আমরাও ফোন করতাম ও করতো। লগডাউনের দিনে ওর কথা বড্ড মনে পড়ছে । কেমন আছে কে জানে? আজ অনেক রাত হয়ে গেল। কাল দেখি ওকে একবার ফোন করবো।