Indrani Samaddar

Abstract

3.5  

Indrani Samaddar

Abstract

জবাব (শারদ সংখ্যা)

জবাব (শারদ সংখ্যা)

4 mins
191


ঠিক কবে থেকে খেলু বাবুদের বাড়িতে বাসন মাজছে, কাপড় কাঁচছে , ঘরমুছে  সংসার চালচ্ছে - সাল, তারিখ আজ আর মনে পরেনা। দেখতে দেখতে একমাস হয়ে গেল। খেলু কাজে যায়না। কাজে যায়না মানে যে ইচ্ছাকৃত যাচ্ছেনা এমন নয়। আবার কাজের সব বাড়ি যে তাকে জবাব দিয়ে দিয়েছে সেরকমও নয়। মাথার সব চুল পেকে গেছে, লোকের বাড়ি কাজ করতে করতে। বাবুদের বাড়ি কাজ করে ছেলে- মেয়েগুলোকে বড় করল। ছেলে - মেয়ের বিয়ে দিল। তাদের ঘর আলো করে নাতি-নাতনি এলো।  কিন্তু আজ অব্ধি সে এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতি আগে দেখেনি । কাজে একদিন না যেতে পারলে বৌদিদের কপালে বিরক্তির ভাজ দেখেছে। এখন কিনা সেই কাজের বাড়ি থেকে তাকে কাজে যেতে বারণ করছে। সব মানুষ ভয়ে ঘরবন্দি। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছেনা। দাদা-বৌদিরা অফিসে যাচ্ছেনা। সব সময় নাক মুখ ঢাকা। যেদিন খেলু প্রথম শোনে কাজে যেতে হবেনা সেই দিন সারা রাত চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারেনা। 


 খেলুর বড়মেয়ে রীনা বেশ কয়েক বছর আগে মারা যায়। বড় মেয়ের মৃত্যুর পর তিন নাতনী , ছোট নাতি ও জামাইয়ের দায়িত্ব খেলুর উপর এসে পরে রিনা সন্ধ্যেবেলায় রাতের রান্না সেরে শুয়েছিল । হ্যারিকেন পাশেই মিটমিট করে জ্বলছিল। বাচ্চাগুলোর হুটোপুটির শব্দ শুনতে শুনতে কখন যে রীনার দুচোখে ঘুম এসে যায়! কী করে যেন হ্যারিকেন পরে গিয়ে ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। বাচ্ছাগুলোর চিৎকারে আসে - পাশের বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে আসে। খবর পেয়ে খেলু ছুটে যায়। খেলু ও বড় জামাই রীনাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। কিছুদিন পর রীনা খানিক সুস্থ হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বাড়িতে আনার কিছুদিনের মধ্যে রীনা মারা যায়। রীনা মারা যাবার পর বড়জামাই কেমন যেন হয়ে যায়! সারাদিন মদ খেয়ে বাড়িতেই চুর হয়ে থাকত। বাচ্চাগুলো কী খাবে? কাজে যেতে হবে – সেই সব চিন্তা যেন উধাও হয়ে যায়। খেলু জামাই সমেত বাচ্চাগুলোকে তার কাছেই এনে রাখে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে জামাই মারা যায়। তিন নাতনি ও এক নাতীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পরে খেলুর উপর। খেলু কাজ বাড়িয়ে দেয়। বড় ছেলের বউয়ের কাছে বাচ্ছাগুলোকে সক্কাল সক্কাল রেখে বারো বাড়ি কাজ সেরে যখন গ্রামের পথে পা বাড়াতো তখন সুর্য্যিমামা সবে বাড়ি ফিরে এক কাপ চা নিয়ে বসেছে। অপরদিকে সবে চাঁদমামা কাজে মন দিয়েছে। বাড়ি ফিরে খেলু রাতের খাবার বসাতো। ছেলে ও ছেলের বউয়ের রাতের রান্না সেই করত। আসলে খেলু চায় বাচ্চাগুলো মামা-মামিকে মায়ার বাধনে বাঁধুক। তার বয়স হয়েছে। আজ আছে কাল নেই। তার অবর্তমানে বাচ্চাগুলো যেন পথে না বসে। যদিও খেলুর ছেলে ও ছেলের বউ ভালো মনের মানুষ। দিনের বেলায় বৌমা রান্ন-বান্না ও বাড়ির সব কাজ করতো। এই ভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল। তিন নাতনী ক্লাস ফোর অব্ধি পড়াশুনো করে। তারপর তারা কাজে লেগে যায়। খেলু এখন বেশী বাড়ি কাজ করতে পারেনা। বয়স হয়েছে। নাতিও এক দোকানে কাজে লেগেছে। শেষের কয়েক বছর খেলুর ভালোই কাটছিল। ভাবছিল এবার বড় নাতনীর বিয়ে দেবে কিন্তু এর মধ্যেই কী একটা মুখপোড়া রোগ এলো যে ভয়ে সবাই চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে যায়। চেনা মানুষকে রাস্তায় দেখলে মানুষ মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। এমনকি ঘরের লোক মারা গেলে তাকে শেষবারের মত চোখের দেখাও নাকি দেখা যায় না। এতো বয়স হল কিন্তু খেলু তার গোটা জীবনে এতো সব্বোনাশী রোগ দেখেনি।


কেউ কাজে যায়না। ছেলে থেকে নাতি । খেলু থেকে এমনকি নাতনী গুলো বাড়িতে বসে আছে। একমাত্র বড়ছেলের মেয়ে জবা এক বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা থাকে। সে কাজের বাড়িতেই আছে। বৌমা  ফোন করেছিল , জবা জানিয়েছে সে ভালো আছে। এইভাবে সবাই বসে থাকলে এতো বড় সংসার যে কী করে চলবে? সেই চিন্তায় খেলু অস্থির হয়ে যায়। দেখতে দেখতে কয়েক মাস কেটে যায়। খেলু কাজের বাড়িগুলো থেকে মাইনে পায় । শুধু একটা বাড়ি জানায় আপাতত তাদের ঠিকে লোকের প্রয়োজন নেই। খেলু শুধু নয়, নাতনীদের কিছু বাড়ি আপাতত ঠিকে লোক লাগবে না জানিয়েছে। ছেলে ও নাতির কাজ নেই। কোনো রকমে সংসার চলে। এরই মধ্যে একদিন জবা বাড়ি ফিরে আসে । আসার পর থেকেই গলা ব্যথা, জ্বর। কিছু লোক মাথা থেকে পা অব্দি ঢাকা এক অদ্ভুতুড়ে পোশাক পরে একদিন বাড়িতে উপস্থিত হয়। জবাকে কীসব পরীক্ষা করে। কয়েকদিনের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্সে করে সেই অদ্ভুত পোষাক পরে লোকজন এসে জবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তার নাকি করোনা হয়েছে। বাড়ির বাকিদের পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী বাকিরা সুস্থ। যে হাসপাতালে জবাকে ভর্তি করা হয় সেখানের একটা ফোন নাম্বরে ফোন করলে ফোন বেজেই চলে। প্রায় দুই দিন পর অপরপ্রান্তে  কেউ ফোন তুলে জানায় রুগীর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তারপর সপ্তাহ কেটে যায় কিন্তু জবার কোনো খবর পাওয়া যায়না। খেলুর বৌমা বিছানা নেয়। খেলু ছেলেকে বলে 'ফোনে যখন খবর পাওয়া যাচ্ছেনা। আমরা চল হাসপাতালে গিয়ে খবর নিই ' খেলুর ছেলে বলে-' অত বড়ো হাসপাতালে জবাকে কোথায় খুঁজে পাব!'  খেলু জানায়, ' এতোদিন হয়ে গেলো যখন কোনো খবর পাওয়া গেল না  তখন যেতে হবেই। আমিও যাব তোর সঙ্গে। ক্লাস টেন অব্দি পড়েছিস। তোর বাপ মরে গেল। পড়াশুনোর ইতি হল। কাল সক্কাল সক্কাল আমি ও তুই বেরিয়ে পড়বো। ঠিক খুঁজে বাড়ি নিয়ে আসবো আমাদের জবাকে' । মাও ছেলে দুজনের চোখে জল।


পরের দিন সকাল সকাল মাও ছেলে হাসপাতালের উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পরে। রাস্তার দুপাশে কাশ ফুল দেখে খেয়াল হয় মা দূর্গা আসছেন। খেলু হাতজোর করে ভগবানের উদ্দেশ্যে বলে ' ঘরের মেয়েকে যেন ঘরে ফিরে নিয়ে যেতে পারি ঠাকুর।' হাসপাতালে অনেক খুঁজে কোথাও জবার হদিশ পাওয়া গেলো না। হঠাৎ ছেলে ছুটতে ছুটতে একটা ট্রলির দিকে ছুটে যায়। ট্রলির উপর বাক্স। একটা বাক্স দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। খেলু ছুটে যায়। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। ছেলে কান্না মেশানো গলায় জানায় জাবা আর নেই। খেলু ভাবে এই খবর শোনার আগে তাঁর মরে যাওয়া ভালো ছিল। বাড়িতে যে মা তাঁর সন্তানের অপেক্ষায় আছে তাকে সে কি বলবে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract