মোর ভালোবাসার ধন
মোর ভালোবাসার ধন
কতকাল পরে দেখলাম,সেই একম কোথাও কোনো বদল নেই ,শুধু মাঝ দিয়ে নদীর স্রোতের মত বেয়ে গেছে সময়।কংসাবতী নদীর ধারে ছোট্ট শহর,অনেকদিন বাদে এলাম বাপের বাড়ি।আমি শিউলি।সেই কোন আট বছর আগে লাল বেনারসি পরিয়ে পাঠিয়ে দিল শ্বশুরবাড়ি। আজ আবার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমায় ফেরত পাঠিয়ে দিলে।দুইমাস হল আমার স্বামী মারা গেছেন। ছেলেই যখন নেই তখন আপদ বালাই কি আর ঘরে রাখতে আছে?তাই তারাও বিদায় দিলে। ঐ বাড়ির কাজের লোক দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলে। নিজের কিছুই নেই শুধু এই ঘর আর ঐ ঘর। বর্ষা শেষে শরৎ এসেছে, আমার জীবনে কোনো রং নেই কিন্তু এই ঘন নীল আকাশে শরতের মেঘের আনাগোনা দেখে মনটা আজ উদাস হয়ে গেল। দূরে ক্ষেতের মধ্যি দিয়ে একটা মেয়ে আসছে। নিজের পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে বড়।আমি ওগুলোকে সযত্নে মনের মণিকোঠায় রেখে দিয়েছি।ওগুলো আমার বড্ড আপন । মনের ক্ষততে প্রলেপ দেয়।
ঘরে ঢুকতেই মা আছাড়ি বিছাড়ি দিয়ে কাঁদল, আর বললো
---তোর একি সর্বনাশ হলো রে মা,তোকে এই বেশে দেখতে যে আমার প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে রে মা!
বড় বৌদিদিও সজল চোখে আমায় নিতে এলে সেই মা বলে উঠলেন ,
---ও বড় বৌমা তুমি পোয়াতি মানুষ,তুমি এখন এসোনি ওর সামনে, এতবড় মেয়েছেলে বলি বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে গা?
আমি বিধবা তাই এখানেও আমি অপয়া ,এটা বুঝতে সময় লাগে নি আমার । আমার জন্মের পরেই নাকি বাবার ব্যবসা ফুলে ওঠে।তিনি নাকি বলতেন এই মেয়ে আমার সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে,তাহলে আজ আমি কি করে অপয়া হলুম বুঝলুম নে। ছোটো বোন কাকলি আমায় ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের দাস দাসী থেকে শুরু করে সবাই কেমন ফিসফাস করছে,আমি কিছুতেই বুঝছিনে কেন। সন্ধ্যাবেলায় বাবা সবাইকে বললেন,
---শিউলিকে ওর দেওর ভাসুর তাড়িয়ে দিয়েছে।
দুই দাদা বললেন
---কিন্তু তা বলে শিউলি নিজের অধিকার ছাড়বে কেন??শিউলির উচিত ঐ শ্বশুরবাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থাকা।এখানে লোকে পাঁচ কথা বলবে।
বাবা গম্ভীর মুখে বললেন
---আর যেতে হবে না ওকে। এত অপমানের পরেও হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ছোটোবৌদি বললে ---ভালোই,গেলো দাদাদের টাকায়।
এই বাড়িতে দুটি খেতে আমি আসিনি, এসেছি নিজের সম্মানটুকু বাঁচাতে, কিন্তু কাকে বলবো, সেকথা । বিয়ে হবার পর স্থির করেছিলাম এই ভিটেতে পা রাখব না।আমার মত মেয়েদের কোনো পন যে করতে নেই সেই সময় এটাও বুঝিনি।
আমার শ্বশুরবাড়ি বিশাল বড়লোক, অবশ্যি মনের দিকে খুব কতটা বড় সে আর বুঝতে বাকি নেই। আমার স্বামীরা চার ভাই,তিন বোন। বিয়ের পর আমার স্বামী আমায় এক দিনের তরেও সুখ দেয় নি। জানিনা কার দোষ বিয়ের বছর দুই পরেও আমার কোলে কোনো সন্তান এল না। আমার স্বামীও আমায় মাঝে মাঝে বলতেন , তার জীবন নাকি আমার জন্য শেষ হয়ে গেছে। খুব অবাক লাগতো। আমি তো চাইনি আসতে ওনার জীবনে। বিয়ের বছর দুই মুখে নানা কথা শোনালেও গায়ে হাত দেন নি। এরপরে একদিন আমায় অনেক কিছুই বলছিলেন, আমি বরাবরের মতই নিরুত্তর ছিলাম, হঠাৎ আমার চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে বলেন আমি কেন কিছু বলছিনা। আচ্ছা মুখে মুখে কথা না বলাটাও কি দোষের?
আমার জীবনের থেকে সব রং তো সেদিন চলে গেছিল যেদিন পলাশকে মেরে ধরে আমার জীবনকে রিক্ত করে দিয়েছিল আমারি পরিবার।
এই শহরের খুব সাধারণ ঘরের ছেলে পলাশ।আমার থেকে বছর দুয়েকের বড়।এক ইস্কুলে আমরা পড়েছি।পলাশের মা আমার মা এর সই,তখন থেকেই আমাদের ভাব।
এখানেই মাঠে ঘাটে ছুটে বড় হয়েছি আমি। আমার কলকল করে কথা শুনে সবাই বলত
---এ মেয়ে কি করে শউর ঘর করবে গো।
কানে এখনো ভাসে
---পলাশদা ও পলাশদা,কোথায় লুকোলে তুমি?
যখন কেঁদে ফেলতুম এই ভেবে যে পলাশদা হারিয়ে গেছে, ঠিক তখনই পলাশদা আমার সামনে এসে বলত
----ধ
ুর পাগলি তোকে ছেড়ে কোথায় যাব আমি?
সেই ছোট্ট বেলার বন্ধুত্বে কখন যে বসন্তের হাওয়া লেগেছে আমি জানতেই পারিনি।দুজনেই যে দুজনকে ছাড়া ভাবতেই পারতাম না। এই শহরে আমার বাবা দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ব্যক্তি। কখন যে আমার বাবা আর দাদা বুঝে গেল আমার আগেই যে আমি পলাশকে ভালোবাসি জানতে পারিনি।পলাশের বাবাকে ওরা হুমকি দিয়েছিল।আমি তখন সদ্য দশম শ্রেণী পাশ করেছি। আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলল আমার অনুমতি ছাড়াই।আমার শ্বশুরমশাই এর কি একটা ব্যবসার ব্যাপারে যেন বাবার সাথে দরকার ছিল। তাই আমি ছিলাম বলির বখরা। বাবা আমায় বলেছিল যদি এই বিয়ে না করি পলাশদাকে মেরে দেবে। আমি পলাশদাদের ঘরে গিয়ে ওকে বলি
---তুমি চলে যাও এখান থেকে।
শোনেনি পাগলটা আমার কথা। বাবার লোকেরা ওকে খুব মেরেছিল। আমার বিয়েও হয়ে গেল। আর পলাশদাকে দেখিনি। শুনেছিলাম পলাশদা চলে গেছিল এই শহর থেকে।
আমার জীবনের সব কিছু শেষ হয়ে গেছিল ঐ এক রাতেই। তারপরে শ্বশুরবাড়ির ব্যবহারে আরো চুপ হয়ে গেলাম। সেটাও আখ্যা পেল 'দেমাকি' শব্দে। আসলে শ্বশুরবাড়িতেও ছিল না আমার অস্তিত্ব,আর বাপের বাড়িতেও ছিল না। কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেছিল। শ্বশুরমশাই এর এক শত্রু আমার স্বামীকে খুন করে ,দোষ হয় আমার। আমি নাকি অপয়া ডাইনি তাই স্বামী মারা গেছে। এসব কিছুই ছুঁয়েও ছুঁয়ে যায় না আমায়। ভাসুরের কুনজর থেকে বাঁচতেই চলে আসি বাপের বাড়ি।
শরতের সময় পুজোর গন্ধে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা। আমার স্বামী মৃত হলেও আজ অত্যাচারের কষ্ট নেই। সারা শরীরে পোড়া দাগ আর কালশিটেগুলো হালকা হয়ে গেছে, সেগুলো এখনো রয়েছে, অবশ্য মনের দগদগে ঘায়ে মলম কে লাগায় ? আমার গায়ে আজ সাদা থান কিন্তু মনটা ঐ মেঘগুলোর সাথেই ভেসে চলেছে। আজ যে মহালয়া।মা এর আগমনির সুর বেজে চলেছে,
---বাজল তোমার আলোর বেণু।
আসতে আসতে পায়ে পায়ে ছাদে উঠলাম। একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝলক আমার গোটা শরীরে বুলিয়ে দিল। আজ মনে যেন অনেক শান্তি। সব তো শেষ, তাই আজ নতুন করে হারানোর কিছুই নেই।
আজ বহুদিন বাদে নদীর ধারে গেলাম।হঠাৎ এক চেনা স্পর্শে আমার পুরো শরীরে শিহরন খেলে গেল।মনের ভ্রম কি না জানি না,কিন্তু ভ্রম হলেই ভালো।মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পলাশদা।বোধ হয় স্বপ্ন।কিন্তু না স্বপ্ন নয়। পলাশদা আমায় বলল কেমন আছ শিউলি??নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল
---কেমন দেখছ তুমি?
ও বলল
--- বড্ড স্নিগ্ধ,পবিত্র। কিন্তু এই সাদা যে তোমায় মানায় না শিউলি।
কতদিন বাদে আমার শরীর মন শিহরিত হয়ে উঠল। পলাশদা এখন নাকি মস্ত চাকরি করে, সবাই বলে।
কতদিন বাদে আজ আবার মন যাচ্ছে নিজেকে আয়নায় দেখতে। শূন্য সিঁথি, নিরলংকার দেহ তবুও মনে শিহরণ লাগছে।কতদিন বাদে আজ দুই চোখ বেয়ে নেমেছে জলের ধারা।
পূজোর চারটে দিন পেরিয়ে গেল। দেখা হয়েছে পলাশের সাথে।আজ বিজয়া দশমী।পলাশদা এসেছে আমার বাবার কাছে। হঠাৎ বাবা আর দাদাদের চিৎকার কানে আসে আমার। গিয়ে দেখি ওরা বলছে
--- আমাদের ঘরের সম্মান নষ্ট করছিস।
আজ সবার সামনে পলাশ আমায় বলল
---- শিউলি তোমায় বিয়ে করব বলে তোমার বাবার অনুমতি নিতে এসেছিলাম। উনি দেন নি অনুমতি, তুমিও কি রাজি হবে না??
নিজের অজান্তেই ওর হাতখানা ধরলাম। পলাশদা আমায় টেনে নিয়ে গেল মন্ডপে। আমার বাবা আর দাদারাও এল আমার পেছনে পেছনে। সবাই মাকে দশমীর বরণ করছিল।পলাশদা মা এর সামনেই আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিল সিঁদুরে।ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই স্তম্ভিত চোখে আমায় দেখছে।আর পলাশদা বলছে
---কি সুন্দর লাগছে তোকে শিউলি।
নিরাভরন দেহ,সাদা থান আর সিঁদুরে রাঙানো সিঁথি আমার। আজ সত্যি বলতে মন যাচ্ছে
---"....তোমায় নতুন রূপে পাব বলে হারায় ক্ষনে ক্ষন
ও মোর ভালোবাসার ধন।"