পিছুটান
পিছুটান


এই প্রথম বার ট্রেনে চেপেছে প্রতিমা ।ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দ, আর জানালা দিয়ে ছুটে যাওয়া ঘরবাড়ি গাছপালা দেখে তার মনে খুব আনন্দ হচ্ছে । ফেলে আসা মাঠ, কাশবন,নদীর চর সব কিছু তাকে টানছে। সব বার টানে , কিন্তু তার মত হতভাগীর পক্ষে কি আর আসা সম্ভব?
"কিছুটা নেওয়া হল নি ।ভাইটার লেগে একটা জামা হলেও বেশ হত। কিন্তু!!"
পাশের বাবুর ডাকে ,
"কি রে প্রতিমা কিছু খাবি ?"
না আজ সত্যি তার খিদে নেই। তাদের সেই ছোট্ট গেরামটা কি সুন্দর । এই বাবু না থাকলে সে আসতেই পারত না। দয়ার শরীর এই বাবুর। অথচ কালকের দিনটাই একদম অন্য ছিল।
"কি রে কত লাগবে?"
বলেই ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরালেন।
"বাবু আজ রেতে হবে নে।"
বলে প্রতিমা ঘুরে দাঁড়াল। ভদ্রলোক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
"তোদেরো পূজো !"
গোটা কলকাতা শহর সেজেছে, আলোর সাজে। এত আলো, যে চোখ ধাঁধিয়ে যায় । কিন্তু ওদের মন্ডপে ওঠা বারণ। তবে ঠাকুর দেখতে আর কে বাঁধা দিচ্ছে ।লালি ,রেশম, মহুয়া, সবাই দল বেঁধে যায়। কত রকমের পূজো । প্রতিমা কিছুতেই বোঝেনা , সে ভাবে "এ কেমন দুগগা মা, কেন এখন আর মহিষাসুরকে বধ করছে না।"
কত মহিষাসুর যে তাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করে দিন রাত। তাদেরকে কেউ কেন বধ করে না? তবে তাও মনটা হালকা লাগে, এই পূজো দেখতে, একদিনের জন্য হলেও এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি প্রতিমাদের। তাদের মাসি ফাতিমা এইটুকু ছাড়পত্র দেয়।
এই চতুর্থীর দিন ফাতিমা ,প্রতিমাকে ডেকে বলে
" কি রে তোর নাকি কাজের মন নাই,কাল বাবুকে না করে দিয়েছিস শুনলাম।"
প্রতিমা, আজ ফাতিমার পা দুটো জড়িয়ে বলল,
"এ মাসি পূজোর পর আমি তুকে পুসিয়ে দেব। দিনে রাতে কাস্টমারদের মন জোগাব।"
ফাতিমাও জানে পূজো আসলেই মেয়েগুলোর মন খারাপ হয়। কিন্তু ব্যবসা করতে গেলে তো এসব ভাবলে চলবে না। ফাতিমা বলে
"বাবুগুলোকে খুশি করাই তোদের পূজো "।
আজ রাতে প্রতিমার ঘরে আসে এক কোট প্যান্ট পরা বাবু। ঘরে ঢুকে দরজা দিতেই শাড়ির আঁচলটা বুক থেকে নামিয়ে প্রতিমা বলে
"তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফোটো"।
সেই বাবু তার দিকে না তাকিয়ে সিগারেট ধরিয়ে খেতে থাকে। বছর কুড়ি বয়স প্রতিমার। প্রতিমা অধৈর্য হয়ে পড়ে বলে
"তা মরতে সিগারেট খেতে কি এখানে এয়েচেন নাকি,ন্যাকাষষ্ঠি।"
বাবুটা বলে
"আমার নাম ব্রত।এখানে আগে কমলির কাছে আসতাম।তোর মত বয়সের ছিল। ভেবেছিলাম কমলিকে এইখান থেকে নিয়ে যাব। মেয়েটাকে মারন রোগে ধরল।তোকে দেখে ওর কথা মনে পড়ল ,তাই।" বাঁকা হাসি হেসে প্রতিমা বলে
"কি হবে ভেবে? সমাজ মেনে নেবে নে। ঘেন্না করে।আর রাতের বেলায় তারাই আসে শরীর খুঁজতে ।জানেন বাবু আমি গেরামে মানুষ, বড় অভাব ছিল । এইরম এক দুগগা পূজার রাতেই ফিরছিলেম ভাই এর সাথে,হঠাত্ তিন চারটে লোক আমার নাকে কি এক গন্ধ শোকায়,আর আমার তারপর কিচ্ছুটি মনে ছিল না। যখন চোখ খুলি দেখি একটা অন্ধকার ঘরে আমি বন্দী। বড় সাধ যায় ঐ গেরামটাতে যেতে। বড় সাধ যায় । আবার ভাইটার হাত ধরে ঘুরতে মন যায় ।আলপথ ধরে কত ছুটতম।সারি সারি ধানক্ষেত। পেট ভরে ভাত জুটতো নি,কিন্তু মনে কি আনন্দ । "
বাবুটি বলে
"যাবি তোর গ্রামে, আমি নিয়ে যাব।কি নাম তোর গ্রামের?"
প্রতিমা বলে
" কেনে নিয়ে যাবি? কি লাভ তোর?আমার গ্রাম জামতোড়া। লালমাটির পথ।সোঁদা গন্ধ ,মন ছুঁয়ে যায় "।
ব্রত ফতিমাকে মোটা টাকা দেয় চার দিনের জন্য প্রতিমাকে রাখার জন্য ।
ব্রত নিজের জীবনে অনেক কিছুই হারিয়েছে । তার মনে হল এই মেয়েটির মুখে একটু হাসি আর আনন্দ দিলে হয়ত কিছু ভালোকাজ করা হবে। স্টেশনে নেমে একটা ভ্যানগাড়ি ভাড়া করে আসে গ্রামের কাছেই এক হোটেলে। উদাস চোখে প্রতিমা তাকিয়ে থাকে আকাশে। পরদিন সকালে ঐ বাবুকে ছাড়াই আসতে আসতে মাঠের পথ দিয়ে প্রতিমা চলে তার গ্রামের দিকে । সেই আলপথ, হরি কাকার দালান বাড়ি, ধানের ক্ষেত এক আছে।শুধু তার জীবনটাই কেমন পালটে গেল। এত আলো চারিদিকে কিন্তু কই তার জীবনে কোনো আলো নেই। শুধু অন্ধকার । ঐ দিকে দুগগা মন্ডপে সন্ধিপূজোর কাঁসর ঘন্টা বাজছে, ঠাকুর মশাই মন্তর পাঠ করছেন। তার জীবনের অসুর কি করে বধ হবে দুগগা মা? মন্ডপ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঐ তো তার ভাইটা পূজো দেখছে। তার বাপ মাওতো আছে। সে কি যাবে??না না তাকে দেখলে বাপের মুখ পুড়বে। সে যাবে নে। আসতে আসতে পিছু হটতে লাগল প্রতিমা । আলপথ ধরে ফেরার সময় একটা ধাক্কা লাগে পেছন থেকে । প্রতিমা বেসামাল হয়ে পড়ে, এমন সময় সে শোনে
"দিদি"?
মুখ তুলে দেখে তার ভাই ।
"বাবুয়া তুই"।
বলে প্রতিমা থমকে যায়, ভাই তাকে জড়িয়ে বলে
" দিদি তোকে কারা নিয়ে গেছল রে,মাকে জিজ্ঞেস করলে খালি বকে। তুই কোথায় থাকিস রে,? বাবা বলে দিদি মরে গেছে আমাদের লেগে।আমি যখন বড় হব তখন তোকে আমার কাছে নিয়ে চলে আসব।"
মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে প্রতিমা বলে
"তুই বড় হয়ে আমায় নিতে আসিস রে ভাই।"
সে জানে তার বাপ মা তাকে অশুচি ভাবে,কি দোষ তার। সে জানে তার ভাই কোনোদিন আসবে না তাকে নিতে, বাপ মা এর মত ও তাকে ঘেন্না করবে। তবু একবুক আশা নিয়ে সে বাঁচবে। হয়ত একদিন তার ভাই তাকে নিতে আসবে।একদিন সে সবার মত দুগগা পূজোতে অঞ্জলি দেবে।আর বলবে
" মা মাগো সকলের মঙ্গল কর মা।"