মান অপমান
মান অপমান
আর না অনেকতো হোলো!!এত অপমান যে আমার প্রাপ্য নয় সে আমি জানি।কিন্তু কি করতে পারি আমি বলুন??আমি পরগাছা।
আমি কনক,চক্রবর্তী বাড়ির মেজ বউ।এ ছাড়া আর কোনো পরিচয় আমার নেই।এখন কেউ বলে কাকিমা,কেউ বৌদি,বৌমা।আমার স্বামী ,না তিনি আমার সাথে সেভাবে বাক্যালাপ করেন না,খুব দরকার না থাকলে। হ্যাঁ অনেক আগে বাবা আমায় কনক মা বলে ডাকতো।সে কবেকার কথা।বাবা মা আর আমি এই তিন জনের সংসার ছিল।বাবা যে কি ভালোবাসতেন।কিন্তু কপালে সুখ যে ছিল না।
আমার স্বামী মস্ত বড় এক কোম্পানিতে কাজ করে।ভীষণ ব্যস্ত উনি।ওনার জীবনে আমি এক ব্রাত্য অতিথি।উনি প্রায়শ সেটা আমায় বুঝিয়ে দেন।
আমি,আমার কথা বলছেন,ধুর মশাই আমাদের মত মেয়েদের উত্তর দিতে নেই।কিছুই জানেন না আপনারা। আমাদের শুধু কর্তব্য করে যেতে হয়।কিন্তু এই অবাধ্য মনটা মানে না জানেন।
ছোট্টবেলায় বাবার সাথে পুজোর ফুল পাড়তাম আর বাবা বলতেন কনা মা আমার ঠিক কনকচাঁপার মত দেখতে।বাবা ছিলেন স্কুলের মাস্টারমশাই।মা ছিল তার যেন ছায়া।কি ভালোবাসতেন মাকে। আমি ভাবতাম স্বামীরা এরম ভালোবাসেন তাঁদের স্ত্রীকে।অবশ্য আমি যে ভুল ছিলাম তা বুঝতে আমার বেশি সময় লাগেনি।দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় হঠাৎ স্কুলে খবর আসে বাবা খুব অসুস্থ।আর তারপরেই বাবা অকালে চলে গেলেন আমাদের শূন্য করে।কাকাদের দয়ায় কোনোরকমে চলছিল।এইসময়ে এই পরিবার থেকে সম্বন্ধ আসে।বিনাপণে আমার শ্বশুরমশাই আমায় এই বাড়িতে নিয়ে আসেন।কিন্তু এই গৃহে পদার্পণ করার পরেই বুঝে গেছিলাম আমার স্থান কোথায়।
দেবতুল্য মানুষ আমার শ্বশুরমশাই।ওনার দাক্ষিন্যে আমি অনেক সংগ্রাম করেছি।বিয়ের পরেই আমার বর অলোক জানিয়ে দেয় তিনি অন্য এক নারীকে ভালোবাসেন।তাই আমার প্রতি ওনার কোনো দায় নেই।অবশ্য সে জন্য আমাকে ভোগ করতে দ্বিধা বোধ করেন নি।ওনার মুখে শুনলাম আমার বাবা ও শ্বশুরমশাই খুব ভালো বন্ধু।তাই উনি বাধ্য করেছেন আমার স্বামীকে এই বিয়ে করতে।শাশুড়িমাতা আমায় সহ্য করতে পারেন না।কিছুই যে আমি আনিনি পরিবার থেকে।কোনো ঘুষ আমার মা যে এদের দিতে পারে নি আমাকে ভালবাসার জন্য। আমি হতদরিদ্র পরিবারের কন্যা,বংশমর্যাদা আমার নেই ।আমার মত মেয়ে এই পরিবারের যে অযোগ্য সে কথা প্রতিপদে বুঝিয়ে দিত সবাই।আমার ভাসুর ও বড় জা কিন্তু ডাক্তার,আর দেওর বিশাল উকিল।তিন সুপুত্রের অধিকারী।অথচ বাইরের একটি মেয়েকে উনি কাজের লোকের সম্মানটুকুও দিতেন না।বাপের বাড়ি যেতে দেয়নি।তাই মাকে দেখাও হয় না।
অবশ্য আমি উদয়াস্ত পরিশ্রম করতাম।কাজের রান্নার দিদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতাম।তার উপরে কিছু এটা ওটা রান্না।সেসব করেও শুনতে হত অনেক কথা।কখনো বড় জা বলত "সারাদিন তো বসে শুয়েই দিন কাটে তোমার ,জানোইতো তোমার দাদা মাছের ঝোল খায় না,ওর জন্য একটু চিকেনতো করতে পারতে।"চেষ্টা করতাম সবার
মন রেখে চলার।যদিও ভুল হয়েই যেত।আমার বর দেরী করে ফিরতেন তাই তার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকা,স্নানের সময় গরম জল,পছন্দের খাবার যতটা সেবা যত্ন করা যায় এই আর কি।দিনের পর দিন আমায় ভোগ করেছেন আমায়,ভাবতাম নিশ্চয় একটু হলেও ভালোবাসেন।কিন্তু ওনার অবজ্ঞার কমতি ছিল না। তাই বুঝে গেছিলাম আমি হাজার চেষ্টা করেও পাবো না ওনার মন আর বাড়ির লোকের মন ।
তবে আমার স্বামী কিন্তু সাগ্রহে আমার সেবা নিতেন আর ভুল হলে গাল মন্দ করতেন।বাড়ির অন্য মানুষরা আমায় অনুগ্রহ করতেন কখনো সখনো। মা এর কথা মনে পড়লে ফোনে কথা হত।আমার শ্বশুরমশাই খুব বিত্তশালী মানুষ ছিলেন।উনি দেখতে পেতেন আমার এই অপমান,তাই একদিন আমায় ডেকে পাঠালেন।আমি ভাবলাম হয়ত আবার কোনো অপরাধ করে ফেলেছি।চোরের মত যখন দাঁড়ালাম উনি জলদগম্ভীর স্বরে বললেন -"বৌমা তুমি যতই চেষ্টা কর কারো মন তুমি পাবে না।তার চেয়ে বরং নিজের কথা ভাব।তোমার বাবা ছিলেন আমার সুহৃদ।তোমায় আমি কলেজে ভর্তি করে দিচ্ছি।"
ওনার প্রচেষ্টায় শুরু করলাম পড়াশোনা।ঘরের অনেক কাজ করতাম।কিন্তু সমস্যা পিছু ছাড়ে কই।শাশুড়িমাতার কু-ইঙ্গিতে ঘরে টেকা দায়।তার উপর মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার।আপ্রাণ চেষ্টা করতাম পড়াশোনা করার।ঈশ্বর অবশেষে প্রসন্ন হলেন।ভালো ফল হোল।উনি আমায় বি-এড পড়ার সুযোগ করে দিলেন।এরপরেই এল এই দুর্যোগ।
এমন সময় কাউকে কিছু না জানিয়ে আমার এই ঈশ্বরতুল্য শ্বশুরমশাই চলে গেলেন দুপুরবেলায় ।এই শোকের মধ্যে শাশুড়িমা বললেন আমায় বের করে দিতে। রুখে দাঁড়াল শুধু ছোট দেওর।অথচ মানবিকতার খাতিরেও আমার তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত স্বামী কিছু বললেন না।আসলে ঘাড় থেকে আপদ বিদায়। দেওরের জন্য রাতটুকু থাকতে দিয়েছে। সব শেষ করে দেব বলেই ঠিক করেছি, তাই ভোর রাতে নীচে নামলাম।দেখলাম দেওর দাঁড়িয়ে আছে,উনি আমায় বাঁধা দিলেন।নিয়ে গেলেন এক আশ্রমে।ওনার চেষ্টায় একটা স্কুলে চাকরিও পেলাম।
একটা বাড়ি ভাড়া করেছি।মাকে এনেছি। স্কুলে পড়ানোর পাশে পাশে কটা টিউশন পড়াই।দিব্যি চলে যাচ্ছে। বছর খানেক বাদে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ দেখি এক জায়গায় লোকের জটলা।বুঝলাম গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।গিয়ে দেখি আমার স্বামী তার প্রেয়সীর সাথে প্রমোদ করতে গিয়েছিলেন।আচমকা উনি কন্ট্রোল হারান। ওনাকে নিয়ে হসপিটালে যাই,ওনার বাড়িতেও খবর দি।ওনার প্রেয়সী পালিয়েছিল আগেই।জ্ঞ্যান ফেরার পর উনি আমার দেখে বেশি অবাক হলেন।এই ঘটনার বেশ কয়েকদিন পরে ওনারা আমায় নিয়ে যেতে এসেছিলেন।এমনকি আমার স্বামীও।আমি ছাড়া নাকি সংসার অচল,আমি নাকি ঐ বাড়ির লক্ষ্মী।হাসি পাচ্ছিল খুব। না আমি ফিরে যাই নি।শ্বশুরমশাই বলতেন "যেদিন তুই কিছু নিজে করবি তোর একটা নিজস্ব পরিচয় তৈরী হবে এরাই তোকে মাথায় তুলে নেবে।"
তাই আর ফিরে যাই নি।আমি স্বাধীন ভাবে নিজের মত থাকব। অপমানের ভাগীদার হব না।আজ আমি জয়ী।