শিক্ষা
শিক্ষা


একটু বিরক্ত হয়েই দীপা তার ড্রাইভারকে বলল
--- "রামদীন কতবারতো বলেছি তোমাকে, গাড়িটা আসতে চালাও।"
দীপা একটি কলেজের অধ্যাপিকা। তিনি শুধু অধ্যাপনাই করেন না তার অন্য পরিচয় তিনি সমাজসেবিকা । আজ চলেছেন তিনি তার প্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধাশ্রমে,সেখানের হাল বুঝতে। কদিন ধরেই কানাঘুষো শুনছেন ওখানে বয়স্ক মানুষদের সাথে ভালো ব্যবহার হচ্ছে না। তাই কোনো কিছু না জানিয়ে তিনি নিজেই যাচ্ছেন সেখানে । বৃদ্ধাশ্রমে অনেক বয়স্ক মানুষের আবাস। তাদের খাওয়া দাওয়া সবে যত্ন প্রয়োজন। জনৈট ব্যক্তির চিঠিতে তিনি জানতে পেরেছেন খাবারের কোয়ালিটা বেশ খারাপ, ঘরদোর পরিষ্কার হয় না। অবশেষে পৌঁছলেন বৃদ্ধাশ্রমে।
পৌঁছাতে অনেকটাই সময় লেগে গেল। তাকে দেখে ঐ আশ্রমের ম্যানেজার ও বাকি কর্মীরা ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন।
মরমে মরে গেলেন দীপা দেবী, এ কি হাল তার সাধের আশ্রমের। শোনা গল্প তাহলে মিথ্যে নয়। কোনো ঘটনাই মিথ্যে বলা হয় নি। হলে কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, খাবারের জায়গা তেমন নোংরা, বেশ কিছুদিন তত্ত্বাবধান করা হয় নি। লজ্জায় ঘৃণায় অসহ্য লাগছিল। ম্যানেজার ও কিছু কর্মীকে তিনি বরখাস্ত করলেন। ফোন করলেন তার কিছু প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের, তারা আসতে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন যতদিন না আরো কিছু কর্মী নিযুক্ত হচ্ছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় দীপাদেবীর।
ঠিক এই সময় শুনলেন একজন আবাসিকের নাকি শরীর খুব খারাপ। তিনি গেলেন তার রুমে, কিন্তু রুমে গিয়ে চমকে গেলেন দীপাদেবী, এ কাকে দেখছেন তিনি? মনটা বড্ড দমে গেল তার।
বিন্দুমাত্র দেরী না করে দীপাদেবী ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যান। আশ্রমে দেওয়া ঘরের নম্বরে বার বার ফোন করতে থাকেন । ওদিকে ফোনটা রিঙ হয়ে গেলেও কেউ উত্তর দিচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি করে বেশ উদ্বিগ্ন হয়েই বাইরে বসে থাকেন। ওনার ঘরের সাথে যোগাযোগ করতেই পারেননি চেষ্টা করেও তাই তখন ঘরের কেউ উপস্থিত নেই।
গভীর রাত্রে চেতনা ফিরলে ঐ ভদ্রমহিলা দেখলেন এক অপরিচিতা প্রচণ্ড টেনশনে তার দিকে চেয়ে আছে । ক্লান্তিতে আবার চোখ বন্ধ করলেন। আধা ঘন্টার পর একটু ধাতস্থ হয়ে উনি বেডে উঠে বসলেন। উপস্থিত নার্সটিকে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন
--আমি এখানে কি করে এলাম?
নার্সটি দীপাদেবীকে দেখিয়ে বললেন
---- "উনি তো আপনাকে এনেছেন,"
দীপা আসতে আসতে তার সামনে গিয়ে বললেন
----"ম্যাডাম আমায় কি চিনতে পারছেন? "
বৃদ্ধা আতিপাতি করে তার মুখের মধ্যে কিছু খোঁজার চেষ্টা করল। বলল
---কিছুই মনে থাকে না রে মা।
মনে পড়ল না বৃদ্ধার। বয়স হয়েছে অনেক কিছুই মনে পড়েনা। দীপা কিছু বলার আগেই নার্সটি খুব অবাক হয়ে বলল
--- "আপনি দীপা ম্যামকে চেনেন না?? উনি সারদা
কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, তারপরে কত মানুষের পাশে দাঁড়ান, তার ঠিক নেই। ওনার একখানা বৃদ্ধাশ্রম আছে।
---'থামবেন আপনি'!
দীপার ধমকে চুপ করে যায় নার্স। নার্স বলল
কি নাম আপনার?
খুব ধীরে ধীরে বললেন
---মালা দে।
আসলে অঙ্কটা কিছুতেই মিলছে না মালাদেবীর । এক দীপাকে তিনি চিনতেন, ভীষণ আবছা একটা স্মৃতি। কিন্তু সে তো এতো সার্প ছিলনা। মালাদেবীর মনে পড়ে গেল অনেক আগের কথা।
------ মিস একটু অঙ্কটা বুঝিয়ে দেবেন? কিছুতে বুঝতে পারছি না! ভয়ে ভয়ে বলল ছাত্রীটি।তিনি কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কতবার একি জিনিস বোঝাব বলত? পড়াশোনায় তোমার একটু মন নেই। মাথায় কি আছে, ঘুঁটে? গোটা ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল। দুই চোখ জলে ভর্তি ছাত্রীটির ।দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে রেখেছে সে। প্রাণপণে সে চোখের জল আটকে রাখার চেষ্টা করছে। আসতে আসতে সরি বলে নিজের বেঞ্চে বসল । সেই ছাত্রী তাঁর অপছন্দের তালিকায় ছিল প্রথম। একেবারে মিডিওকার একটি মেয়ে, তাই ভীষণ বিরক্ত লাগত তার। সেই বছর তিনি ট্রান্সফার নিয়ে গেলেন ঘরের কাছে। কারণ তার একমাত্র সোনার টুকরো ছেলে। ছেলের দেখাশোনা আর পড়াশোনার জন্য তিনি এই স্কুল ছেড়ে দিলেন। সবার কাছে কত গর্ব করতেন ছেলেকে নিয়ে।
হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দীপাদেবী বলেন
--- দিদি আমার সাথে চলুন।
আসতে আসতে দীপা ওনাকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে ওঠায়। নির্লিপ্ত স্বরে মালাদেবী বলেন
--ওখানের গেট এখনতো বন্ধ হয়ে যায়।
--দিদি আপনি আমার বাড়ি যাচ্ছেন।
বৃদ্ধাশ্রমের বদলে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।
ওনার সেবার প্রয়োজন। না আর কোনো সংশয় নেই এই তার সেই অপছন্দের দীপা। খুব খারাপ লাগছে মালাদেবীর আর অস্বস্তিও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যই দীপাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি
---মা বাবা কেমন আছেন?
দীপা শুষ্ক হাসি হেসে বলে বাবা নেই আর মা শয্যাশায়ী। একটা অ্যাক্সিডেন্ট এ বাবা মারা যান আর মা বিছানাগত হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। আজ দীপার মনটাও বেশ হালকা। মনে পড়ে যাচ্ছে অন্য এক যুগের কথা। কখন যে স্মৃতির হাত ধরে এ জগৎ বিস্মৃত হয়েছেন তা নিজেও জানেন না।
ছোট্ট বালিকা চেষ্টা করত পড়াশোনা করতে।কিন্তু পেরে উঠত না। তার মা ও বাবা দুজনেই ছিলেন চাকুরিজীবী। ওরা বড্ড ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। মেয়েটির জন্য ওদের সময় নেই। গৃহশিক্ষিকা আছেন।কিন্তু তিনিও এত বকাবকি করেন ভয়ে বলতেই পারে না সে কি বুঝছে আর কি বুঝতে পারছেনা। সবাই বলে সে নাকি ওয়ার্থলেস। তার দিয়ে কিছু হবার নয়।দূর গাছের ডালের পাখি গুলোকে দেখে সে। ওদের মা কত আদর করে ওদের খাইয়ে দিচ্ছে। ও তো আয়ার কাছে মানুষ। মনে পড়ে না ছুটির দিনে মা খাইয়ে দিয়েছে কি না। কিন্তু যতদিন দাদু ছিল দাদুইতো পড়াত। যত্ন করত। কত ভালোবাসতো। দাদু বলত
---দিদিভাই একদিন অনেক বড় মানুষ হবে, সবাই বলবে ওই তো দীপা, ও খুব ভালো মেয়ে।
শুনতে শুনতে ছোট্ট মেয়েটির মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠত। সে বলত
---ও দাদু মানুষের মত মানুষ মানে কি? আমি অনেক টাকা রোজগার করব বাবার মত?
দাদু হেসে বলত
---না দিদিভাই টাকা না, মানুষের জন্য কিছু করা, তাদের পাশে থাকা আরো অনেক কিছু রে দিদিভাই, বড় হলে বুঝতে পারবি। যাও চুপটি করে শুয়ে পড়।
দাদু চলে যাবার পর কেউ তাকে আদর করে না গল্প শোনায় না। এদিকে রেজাল্ট ভালো হয় না। বাবা আর মা এর সম্মান নাকি তার জন্যই নষ্ট হয়। এদিকে তার দিদিতো কানপুরে আই আই টিতে পড়ে। মা ও বাবা তাকে নিয়ে কত গর্ব করেন।
গাড়ির সামনে চমক ভাঙে। মালাদেবীকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই ডাক দেয়
-- মানুদি ও মানুদি ...
---দিদি বলগো
---এই দিদিকে গেস্টরুমে নিয়ে যাও, দেখো ওনার যত্নের যেন ত্রুটি না হয়।
এই বলে ধীরে ধীরে উপরে যায়। গিটার অন করে গরম জলে গা ডুবিয়ে দেয় দীপা। সারাদিন যা ধকল গেছে। পুরোন স্মৃতিগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে মাঝে মাঝেই তার। গায়ে ওভারকোট গলিয়ে ডাইনিঙে এসে বসে।
কাজের এই দিদিও খুব দুর্ভাগা। বরের অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ঘর ছাড়ে। একদিন রাতের বেলা তার গাড়ির সামনে এসে পড়ে। দীপাই আশ্রয় দেয় তাকে।খেতে বসে মালা ম্যাম জিজ্ঞাস করেন
---তোমার দিদির কি খবর,ও তো ভীষণ ট্যালেন্টেড।
স্মিত হেসে বলে দীপা
---ভালো আছে। বিদেশের বাসিন্দা।
মুখ উল্টে কাজের দিদি বলে
---মা এর খোঁজ নেয় না গো, খুউউব বিজি তিনি। ফোন করে। সব তো এই দিদি করে।
দীপার ধমকে সে থামে। শুতে গিয়ে সব স্মৃতি ভিড় করে আসে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো যে তাকে খুব কষ্ট দেয়। মনে পড়ে যায় যখন তার গোটা ক্লাসে কেউ কথা বলত না তার সাথে। বাংলা মিস ছাড়া সবাই ছিল খুব বিরক্ত। কিন্তু ও যে মিসদের খুব ভালোবাসত। একদিন অঙ্ক না পারার জন্য মালামিস তাকে খুব বকেছে, অন্যমনে ভাবছিল কেন পারছেনা সে বুঝতে। ছুটির ঘন্টায় চমক ভাঙল তার। ঘরে আসতেই ডাইরিতে অভিযোগের পাহাড়। শুরু হল বকানি।পরদিন সকালে স্কুলে ভারাক্রান্ত মনে গেল। ক্লাস শুরু হতেই ক্লাসটিচার একটি মেয়েকে নিয়ে ঢুকলেন,বললেন
---মেয়েরা, আজ থেকে মিলি তোমাদের সাথেই পড়বে,ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে মিলি,তোমরা ওকে সাহায্য কোরো।
মিলি সোজা দীপার বেঞ্চে এসে বসে। কিছুদিন যেতেই দুজনের বন্ধুত্ব গভীর হয় । এই সময় মালা মিস স্কুল ছেড়ে চলে যান। মিলি খেয়াল করে দীপা কেমন ভয়ে ভয়ে থাকে। মিলি পড়াশোনায় খুব ভালো। সেই দীপাকে পড়া বোঝাতে শুরু করে। দীপাও নব উদ্যমে শুরু করে। আস্তে আস্তে দীপা উন্নতি করে। নতুন করে বাঁচতে শেখে দীপা।
কখন যে ঘুম এসে গেছিল বুঝতেও পারে নি।সকালে উঠে দেখে মালা দেবী চা খাচ্ছেন। চা খেতে খেতেই প্রশ্ন করেন মালা দেবী দীপাকে
--- কি নিয়ে পড়াশোনা করলে?
দীপা বলে
---পদার্থ বিজ্ঞান।
মালা দেবী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
দীপা বলল
---কি করে এত নিম্ন মেধার একটি মেয়ে এই বিষয়ে পড়াশোনা করেছে এটাই ভাবছেন তো ? আমি জানি ম্যাডাম আপনি আমায় অপছন্দ করতেন, পড়াশোনা খারাপ করতাম বলে। দাদু থাকাকালীন রেজাল্ট খারাপ হত না। দাদু মারা যেতেই বড্ড ধাক্কা পেয়েছিলাম। ঘরের টিচার কেয়ার নিত না। ফল তো আপনি জানেন। মিলিকে মনে আছে আপনার?
মালাদেবীর আবছা হলেও মনে পড়ল মেয়েটিকে। দীপা বললো
---মিলি আমায় পড়া বোঝাতো। আসতে আসতে দেখলাম বিষয়গুলো খুব সহজ। ভালো রেজাল্ট হলো।অবশ্য মিলি আমায় অনুপ্রেরিত করেছিল। তাই আজ আমি এখানে। ম্যাডাম আপনার ছেলের কি খবর ? ও তো খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিল।
মালা দেবীর মুখটা শুকিয়ে গেল।অনেক কষ্টে হাসিটা টেনে বললেন
---হ্যাঁ রে, মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার সে আজ। ওর পড়ার জন্য আমাদের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলাম। তোর কাকুও মারা গেলেন। কিন্তু ওর সুবিশাল অ্যাপার্টমেন্টে আমার ঠাঁই হয় নি রে মা। কি জানিস মা আমি ভালো শিক্ষিকা নই রে। তোদের মত কত মেয়েকে অবজ্ঞা করে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছি। আসল মানুষ হবার শিক্ষা যে আমিও পাই নি, দেখ না নিজের ছেলেকেই মানুষ করতে পারিনি আমি। তোর দাদুই ছিলেন প্রকৃত শিক্ষক। তাই তুই মানুষের মত মানুষ আজ।
মালাদেবীর দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ। আজ যে তিনি নিজের আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এতদিন ভাবতেন ছেলে মানুষ করতে গিয়ে কোথায় ভুল করেছিলেন, আজ তিনি বুঝে গেছেন কি ভুল করেছিলেন।