খাদ্য
খাদ্য
অফিস থেকে বেরিয়ে মিওআমোরেতে ঢুকেই চিজ স্যান্ডুইচের অর্ডার দিল ঋভু। খিদেতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। মনের মধ্যের চিন্তাটাও কুরে কুরে খাচ্ছে, দুটো মিনিট শান্তি পাচ্ছেনা। এই প্রজেক্টটা ওকে পেতেই হবে, আর প্রজেক্টটা হাতে পেলেই, তার কেরিয়ার তরতর করে এগিয়ে যাবে। কিন্তু বিভাস যেভাবে পেছনে পড়ে আছে তাতে এই প্রজেক্টটা পাওয়াই খুব শক্ত। একটা মাছি অনেকক্ষণ ধরে গুনগুন করেই চলেছে, দুমিনিট যে শান্তিতে চিন্তা ভাবনা করবে, সেই উপায়টুকুও নেই। মিও আমোরের স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে বেশ নীল আকাশটা দেখা যায়। কতদিন যে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় নি সে, তা নিজেও জানেনা, কিচ্ছু ভালো লাগে না আজকাল।
আলতো একটা ধাক্কা অনুভব করলো ঋভু পিঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখে জুনিয়র পিয়ালী আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল বলে একটা ছেলে বললো
---কী রে পিয়ালী, বস তোকে নাকি আজ ডেকেছে, ওর মেয়ের জন্মদিনে।
পিয়ালী ওর স্ট্রেট চুলটা হাত বুলিয়ে বললো
---স্যার আমাকে খুব ভালোবাসে। বেশী কাউকে বলে নি, ঐ আমাকেই আর ওনার প্রিয় কিছু সিনিয়রদের ডেকেছেন, যা শুনলাম।
পিয়ালীর মেকাপ দেওয়া মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও কতটা খুশি। 'আমার ভিনদেশী তারা' গানটার একটা লাইন বারবার বেজে থেমে যাচ্ছে, ভীষণ বিরক্ত লাগছে ঋভুর। পিয়ালী আড়চোখে তাকিয়ে ছিল ঋভুর দিকে। এরম ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে যেকোন মেয়ের মন জয় করতে পারে, পিয়ালীও প্রথম দিন থেকেই তাই মন দিয়ে বসে আছে। কিন্তু ঋভুতো নিজের জগতেই মগ্ন। সেই মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট, আদর্শ অ্যান্ড ব্লা ব্লা ব্লা। এতোক্ষন সে দাঁড়িয়ে আছে অথচ সৌজন্য মূলক হ্যালো হাই ঋভু তাকে বলেনি। অধৈর্য্য হয়ে পিয়ালী বললো
---ঋভুদা ইওর ফোন ইজ রিংগিং।
সম্বিত ফিরে পেয়ে ঋভু বললো
--হ্যাঁ, আমার ফোনটা বাজছে, ওহহ
একটু চুপ থেকে বললো
--বুঝতে পারিনি আসলে।
পিয়ালী ঋভুর থতমত খাওয়া মুখের দিখে তাকিয়ে বলে
---ফোনটা ধরো ঋভুদা, একনাগাড়ে বেজেই চলেছে।
---ধরছি।
ফোনটা নিয়ে ঋভু 'হ্যালো' বলতেই, ওইপাশ থেকে গম্ভীর গলায় একজন বললেন
---কতক্ষণ ধরে ল্যাবে তোমাকে খুঁজছি ঋভু, তুমি কি বাইরে?
--হ্যাঁ স্যার , একটু খেতে এসেছিলাম।
--ইটস ওকে, তোমার ইনভিটেশনের কার্ডটা তোমার ডেস্কে রেখে গেলাম , বিকেলে অবশ্য আসবে, মৌ খুব খুশি হবে।
--ওকে স্যার।
বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় খেলে গেলো ঋভুর, ঠোঁটের কোণায় বিজয়ের হাসি। এই প্রজেক্ট পেতে আর তাকে কোন অসুবিধায় পড়তে হবে না। পিয়ালী ঋভুকে বিড়বিড় করতে দেখে নীচু স্বরে বলে
---পাগল একটা..
মিও আমোরের ছেলেটা বললো
--স্যার আপনার স্যান্ডুইচটা দিই তাহলে ।
ঋভু স্যান্ডুইচটা নিয়ে বাইরে এসে তাড়াতাড়ি আবার রিঙ ব্যাক করে বললো
---স্যার একটা আব্দার আছে, আজকের বার্থডে কেক কিন্তু আমি আনবো প্লিজ স্যার। আমি মৌ এর টেস্ট জানি, স্যার প্লিজ।
ফোনের ওইপাশ থেকে একটু হেসে বললেন
---অ্যাজ ইউ উইশ।
সেবার স্যার ও মৌ এর সাথে সাউথসিটিতে যখন দেখা হয়েছিল মৌ বায়না ধরেছিল কেক খাবে। সে মৌকে সাউথসিটির স্পেনসারে যখন নিয়ে যায়, স্ট্রবেরি কেকটার দিকে মৌ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। ভাগ্যিস দেখা হয়েছিলো সেদিন। আজ কাজে লেগে যাবে।
স্যান্ডুইচের কামড় দিতে দিতে ফুটপাথ দিয়ে আনমনে চলার সময় হঠাৎ ঋভু ধাক্কা খেলো একটা ছোট বাচ্চার সাথে। একটু বিরক্ত নিয়ে তাকাতেই দেখে শতচ্ছিন্ন নোংরা জামা পড়া বছর ছয়ের শিশু, চোখদুটো খুব উজ্জ্বল। হাতে অ্যালুমিনিয়ামের ত্যাবড়ানো থালায় থাকা মুড়িগুলো ছিটিয়ে পড়ে গেছে ফুটপাথে। নোংরা ধুলোমাখা বাচ্চাটা অবাক চোখে ঋভুর দিকে তাকিয়ে একটা একটা করে মুড়ি কুড়িয়ে তুলছে থালায়। ওর দিকে জুল জুল চোখে চেয়ে আছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো, অস্বস্তি হচ্ছে বড়ো। একটা তীক্ষ্ণ গলা কানে এলো
---হি হি তোর জন্মদিন নাকি? দেখ মাটিতে মুড়িগুলো পড়ে গেছে। আমাদের ওসব জন্মদিন টিন হয় না রে।
ঘাড় ঘোরাতেই ঋভু দেখে আরেকটা একটু বড়ো বাচ্চা ঐ ছেলেটিকে কথাগুলো বলছে। ছোট্ট ছেলেটি নীরব, বড়ো বড়ো চোখদুটো টলটলে জলে ভরা, কান্নায় ঠোঁট টা বেঁকে গেছে। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো ঋভুর।
সে তাড়াতাড়ি ল্যাবে ফিরে টেস্টের রেজাল্টগুলো মেলাতে চাইলেও সেগুলো মিলছেনা, বারবার ঐ করুণ উজ্জ্বল চোখদুটো মনে পড়ছে, মনটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে । কাজ অসমাপ্ত রেখেই সে বেরিয়ে পড়লো, ফুটপাথে এধার ওধার তাকিয়েও ঐ বাচ্চাটাকে দেখতে পেলো না । স্যার এর বাড়ি এই পাড়াতেই। ঋভু দেরী না করে ফরটি ফাইভ বি বাসটা দেখতে পেয়েই উঠে পড়ে সাউথসিটিতে গিয়ে ঐ স্ট্রবেরি কেক আর বেশ দামী একটা পুতুল কিনে প্যাক করিয়েই উবের বুক করে বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে আবারো বেরিয়ে পড়লো।
পার্টিতে পৌঁছে বার্থডে কেকটা দিতেই স্যার আর মৌ এর মুখটা আনন্দে ভরে গেছে। গিফ্টটাও দিল। 'ওল্ড ম্যাক ডোনাল্ড হ্যাভ এ ফার্ম' একনাগাড়ে বেজেই চলেছে আর্টির এই রুমের মধ্যে, জমকালো পার্টিতে জমকালো পোশাকের আড়ালে যেন সবাই অভিনয় করছে। একটুও ভালো লাগছে না ঋভুর, দমবন্ধ হয়ে আসছে। কেক কাটার পরে বাচ্চারা একদিকে আনন্দ করছে, অন্যদিকে বড়রা দামী শ্যাম্পেন, ওয়াইনের গ্লাস হাতে ব্যস্ত পলিটিকেল আলোচনায় । পিয়ালীও আধুনিক অফ সোল্ডার পোশাকে সেজে স্যারের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ঋভুর দিকে তাকালেও ঋভু অনুভব করেছে, ও যেন ব্রাত্য, পিয়ালী মেতেছে বিনিময় প্রথায়। ঋভু একবার পিয়ালীকে হাত ধরে টানলেও, বেশ বিরক্তির সুরেই সে বলে
---ইউ নো ঋভুদা, ইউ আর আনবিলিভেবেল! হোয়াই আর ইউ সো পসেসিভ? আমি তোমায় পছন্দ করি, না না বলা ভালো যে ভালোবাসি, বাট তুমি তো বুঝেও অবুঝের মতো থাকো। আর এই প্রজেক্টটা আমারো চাই যেকোন মূল্যে। তারপর ব্যস শুধু তুমি আর আমি। এসব ফালতু বস্তাপঁচা সেন্টিমেন্টের আমার কাছে দাম নেই।
মনটা খুব তিতকুটে লাগছে ঋভুর। ঘেন্না হচ্ছে নিজেকেও।
আবারো চোখের সামনে ভেসে আসছে ঐ শিশুর চোখদুটো, ওর মুড়ি কুড়িয়ে নেবার ভঙ্গিমা।
পায়ে পায়ে পিছিয়ে আসতে আসতে ঋভু পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে আসে, দমবদ্ধ হয়ে আসছিলো তার। আনমনে ফুটপাত দিয়ে ফেরার পথে দেখে সেই দুই তিনটে বাচ্চা জটলা করে হাসছে খেলছে বকবক করছে। সামনে ভাঙা থালায় দুটো শুকনো রুটি, নিয়ে তারা কাড়াকাড়ি করছে। সেখানে কোথাও কোনো অভিনয় নেই, কৃত্রিমতা নেই, চাওয়া নেই, পাওয়া নেই। এধার ওধার তাকাতেই ঋভু দেখলো দূরে একটা ফাস্টফুডের দোকান। খুব খিদে পেয়েছে তার। তিনটে বিরিয়ানীর অর্ডার দিলো ঋভু আর একটা এগরোল। পকেটে সাকুল্যে সাতশো টাকা পড়ে আছে। তিনটে বিরিয়ানী বাচ্চাগুলোকে দিতেই, ওদের চোখগুলো কেমন চকচকে হয়ে গেল , একগাল হেসে বললো
---বাবু আমাদের জন্য?
ঋভু রোলটায় আয়েশ করে কামড় দিয়ে বললো
---হুঁ তোদের জন্য।
কোথায় যেন একটু হলেও মনটা ভালো লাগছে ঋভুর। দূরে আকাশের দিকে তাকাতেই তার মুখে ফুটে উঠলো এক মায়াবী হাসি।