মোবাইলের মায়াজালে
মোবাইলের মায়াজালে
---- তাতাই ডকুমেন্টসগুলো ঠিক করে নিয়েছিস তো?
---- হ্যাঁ মা।
---- সাবধানে সাইকেল চালাবি। রেনকোটটা ভালো করে পড়ে নে।
--- হুঁ গো, সব করছি। ডোন্ট ওয়ারি।
রেনকোটটা গায়ে গলাতে গলাতে একবার বাইরের দিকে উঁকি দিল তাতাই। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ব্যাগটা একবার চেক করল সে, হুমম মোবাইলটা ঠিকঠাক প্যাক করা আছে। হাজার বৃষ্টি এলেও কাবু করতে পারবে না। আজকে এমনিতে কোনো ডকুমেন্টস দেখতে চাওয়ার কথা নয় যদিও তবুও চাইলে ফোনেই দেখিয়ে দিতে পারবে সে। স্ক্যান করা ফাইলগুলো রাখা আছে সব। বাইরে বেরিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল তাতাই। আজ বি.এড কলেজের প্রথম দিন। ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা। এতো কম্পিটিশনের বাজারেও VTT কলেজে সে সুযোগ পেয়ে যাবে ভাবেনি। তাতাইয়ের বরাবরের স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার, আর VTT তে সুযোগ পেয়ে মনে হচ্ছে যেন আরও একধাপ এগিয়ে গেল স্বপ্নপূরণের পথে। কিন্তু জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরুর দিনে এরকম বৃষ্টি নামলে ভালো লাগে নাকি!
রেনকোটে জবুথুবু তাতাই যখন সাইকেলটা নিয়ে কলেজে ঢুকলো তখনও বৃষ্টি কমার নাম নেই। কলেজের সামনের বারান্দার অনেকে দাঁড়িয়ে আছে, সব অপরিচিত মুখ। সাইকেলটা স্ট্যান্ডে রেখে সেদিকে এগিয়ে এলো তাতাই। অফিস সামনেই, জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই অফিসে যিনি কাজ করছিলেন তিনি কৃত্রিম হাসি টেনে বললেন, "আজ ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হবে শুধু, আর কিছু না। কাল থেকে ক্লাস।"
"আজ ফ্রেশার্স!" ইশ! ফ্রেশার্সের দিন এমন ম্যাড়ম্যাড়ে করে কেউ সাজে! আগে থেকে যদি জানা যেত তাহলে একটু হলেও সাজগোজ করত তাতাই। অবশ্য যা বৃষ্টি!
যথাসময়ে শুরু হল ফ্রেশার্স। তাতাইয়ের খেয়াল পড়ল যাহ মাকে তো খবরটা দেওয়া হয়নি! ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করল তাতাই। দেখল স্ক্রিনের ওপর কয়েক ফোঁটা জল। অবাক হল তাতাই, এত প্যাক করার পর তো জল ঢোকার কথা নয়। যাইহোক, জলটা রুমালে মুছে ফোনটা করল সে। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। তখনই পাশের জন ওর সাথে আলাপ জমাবার চেষ্টা করতেই তাতাই সেদিকে মন দিল। সেই মেয়েটার সাথে সে যখন গল্প গুজবে ব্যস্ত তখনই আচমকা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল, তাতাই তাকিয়ে দেখল মা ফোন করছে। তাতাই সবুজ আলোয় আঙ্গুল ছোঁয়াল, আঙ্গুলটা পিছলে গেল। ফোনটা ধরা হল না। বার কয়েক চেষ্টা করল তাতাই, পরিণতি একই। উফফ ফোনটা হ্যাং করেছে! এমনটা তো হয়না সচরাচর। একটু অপেক্ষা করার পর আবার চেষ্টা করল তাতাই। উঁহু কোনো লাভ হচ্ছে না। ফোনটা সুইচ অফ করে ব্যাগে রেখে দিল সে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে পুরো দমে। এটার ছবি তুলে ফেসবুক এর হোয়াটসএপে স্ট্যাটাস দিতেই হবে, এমন গ্র্যান্ড ওয়েলকমের ছবি না দিলে চলে নাকি! নিন্দুকরা দেখবে আর জ্বলবে। অতএব ফোনটা বের করে সুইচ অন করল তাতাই। কিন্তু একি, এতো টাচ করলেও কাজ হচ্ছে না!তাতাই ছবি তুলবে কি করে! কি হবে এখন! ফোনটারই বা কি হল! ব্যাপারটা ঠিক সুবিধের ঠেকছে না। ফোনটা পেছন দিকে ঘোরাতেই তাতাই দেখতে পেল কভারের মধ্যে জলের পুরু স্তর। আঁতকে উঠল তাতাই। রুমাল দিয়ে জলটা মুছে ব্যাগে ভরে রাখল সে। ফোনের ভেতরে জল ঢুকে গেছে নাকি কে জানে! পাশের মেয়েটাকে নিজের ফোন নম্বর দিয়ে তাতাই বলল হোয়াটসএপে সব ছবিগুলো মনে করে পাঠিয়ে দিতে।নিজেও খাতায় মেয়েটার ফোন নম্বর নিয়ে রাখল, যদি মেয়েটা ভুলে যায় মনে করাতে হবে ওকে।
হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরল তাতাই। নাহ, ফোন বাবাজির সারার কোনো লক্ষণ নেই। তড়িঘড়ি সে মায়ের ফোনটা নিয়ে ইউটিউব চালালো--- "HOW TO REPAIR YOUR PHONE AFTER GETTING WET"
সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল অজস্র ভিডিওর লিংক। তাতাই বেছে বেছে সবচেয়ে কম সময়ের ভিডিও যেটা সেটাই চালালো। ওখানে দেখাচ্ছে চালের কৌটোর মধ্যে ফোনটা রেখে দিতে হবে। আরেকটা ভিডিও দেখা যাক। একটা মেয়ে সেখানে বলছে, "একদিন আমার ফোনটা বৃষ্টির জলে একদম ভিজে গিয়েছিল।"
হ্যাঁ হ্যাঁ তাতাইয়েরও তো তাই হয়েছে, তাতাই চোখ বড় বড় করে দেখল মেয়েটা বলছে, "তারপর আমি একটা খুব সাধারণ কাজ করলাম। আমার ফোনের পার্টসগুলো আলাদা করে চালের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলাম। মাত্র চব্বিশ ঘন্টায় সেরে গেল আমার ফোন।"
সবাই তাহলে চালের ব্যাগে ঢোকাতে বলছে। আরেকটা ভিডিওতে বলছে অনেকগুলো সিলিকন প্যাকেট দিয়ে কোনো একটা এয়ার টাইট জায়গায় রেখে দিতে হবে। তাতাই একটা লম্বা টিফিন কৌটো নিয়ে তাতে চাল ভরল খানিকটা। তারপর ড্রয়ার থেকে সিলিকন ব্যাগগুলো বের করে সেই কৌটোর মধ্যে ফেলে দিল। যদিও তাতাইয়ের ফোনটা ঢালাই ফোন, ব্যাটারি বের করা যায়না কিন্তু একটা ভিডিওতে তো ওরকম ফোনও সরিয়ে দেখাল। নিশ্চয় কাজ হবে এতে। তাতাইয়ের পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।
---- বাবা ফোনটা সারাতে নিয়ে যাবে?
---- কেন ইউটিউব দেখে কিসব যে এক্সপেরিমেন্ট করছিলি?
---- বাবা সারেনি। ফোনটা তো আর সুইচ অনই হচ্ছে না। ওরা চব্বিশ ঘন্টা বলেছিল আমি কিন্তু আটচল্লিশ ঘন্টা রেখেছিলাম তাও…
---- এখন কি করে যাবো! বাইরে এতো বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হচ্ছে।
---- কিন্তু ফোন ছাড়া আমি দুদিন কাটিয়েছি, আর সম্ভব নয়। আমার ফোনটা চাইই।
---- সেদিনই বলেছিলাম দোকানে চল, কিন্তু নাহ ইউটিউব টোটকা চাই তোর।
---- অন্য সময় তো কাজ করে।
---- কিন্তু এবার করল না।
---- হুঁ। বাবা ফোনটা না হলে আমি খুব প্রবলেমে পড়ে যাবো। আমাকে একটা বড়গল্প জমা দিতে হবে ১৫ তারিখের মধ্যে। এডভান্স করে দিয়েছে ওরা।
---- তো লিখে ফেল, সমস্যা কি!
>---- আরে বাবা আমার ফোনে লেখা হয়ে গিয়েছিল অনেকটা, নতুন করে আবার লেখা সম্ভব না।
---- ব্যাকআপ রাখিসনি কোথাও?
---- ফোনেই তো রাখা আছে ব্যাকআপও।
---- অদ্ভুত! এটা কেমন ব্যাকআপ রাখা হল?
---- আসলে আমি ফাইল ডিলিট হওয়ার ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু ফোনটা খারাপ হয়ে যাবে ভাবিনি।
---- উচিত ছিল ভাবা। আসলে তোদের জেনারেশন না এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে করতে এমন জায়গায় গেছে যে প্রযুক্তি ছাড়াও যে মানুষ বাঁচতে পারে সেটাই ভাবতে ভুলে গেছিস। আগেও লোকে কিন্তু লেখালেখি করত। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র এরা কিন্তু কেউ মোবাইলে লিখতেন না। তাও এঁদের সম্মান আজ বিশ্বজুড়ে।
---- ওহ প্লিজ বাবা… এখন না কেউ ওই খাতা কলম নিয়ে লেখে না। এখন তো লেখা লিখেও মেলে পাঠাতে হয়, সেই তো টাইপ করতেই হবে একসময়। তাই বেশি খাটবো কেন!
দোকানে বলেছে ফোনটা সারাতে বেশ কয়েকদিন লাগবে। তাতাইয়ের বান্ধবী পূজার পরিচিত দোকান, তাই একটু কমসম দেখে করে দেবে বলেছে। ল্যাপটপটা খুলে মনমরা হয়ে বসে আছে তাতাই। গুগল ড্রাইভে রাখা সব পুরোনো গল্প। ইশ যদি কোনো ম্যাজিক হয়ে নতুন গল্পটাও এখানে চলে আসতো তাহলে কি ভালোই না হত! আসলে আগে তাতাই google docx. এ লিখতে। কিন্তু ওর এক বন্ধু এক দারুণ app এর সন্ধান দিয়েছে কয়েকদিন আগে। তাতে সুন্দর ভয়েস টাইপিং হয়। তাই সেটাই ব্যবহার করে গল্পখানি লিখেছিল তাতাই। বুকটা ধড়ফড় করছে, ফোনটা আসার পর গল্পটা সময়ে শেষ করতে পারবে তো! কিংবা ফোনটা যদি রিসেট করতে হয় তাহলে তো… উফফ আর যেন ভাবতে পারছে না তাতাই, মাথাটা ঘোরাচ্ছে। ওই ম্যাগাজিন কতৃপক্ষ এমনিতেই সময় বাড়িয়েছিলেন, আর বাড়াবেন না নিশ্চয়। এবার তাহলে এডভানসের টাকাটা ফেরৎ দিতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপের ওপর মাথা রাখল তাতাই। কি রোরিং জীবন--- পড়াশুনার চাপ নেই এখন, অন্য কোনো কাজ নেই তবুও তাতাই এনজয় করতে পারছেনা সময়টাকে। ফোন ছাড়া সময় কাটানো যায় নাকি!
---- দিদি এই দিদি…
---- কি?
---- লুডো খেলবি?
---- ধ্যাত জ্বালাস না তো।
---- খেল নারে। প্লিজ। তুই তো শুয়ে আছিস।
---- তোর কোনো কাজ নেই?
---- বৃষ্টিতে খেলতে যেতে পারিনি। কি বোর লাগছে।
---- আচ্ছা চল।
আপাতত কিছু তো করার নেই তাতাইয়ের, তাই পিচাইয়ের সাথে একটু লুডোই খেলা যাক। লুডো খেলতে খেলতে আপন মনে হাসল তাতাই। পিচাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
--- কি হয়েছে রে?
---- মনে পড়ে গেল কিছু।
---- কি?
---- ছোটবেলায় তুই কেমন তোর গুটি কেটে দিলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে দিতিস!
---- আর তুই পুঁটকে উল্টে দিয়ে ছয় ফেলার চেষ্টা করতিস… হুঁ
পুরোনো কথা মনে পড়তেই হো হো করে হেসে উঠল দুই ভাইবোন। তখনই দুটো জায়গায় পাঁপড় ভাজা আর মুড়ি নিয়ে ঢুকলেন মা। ওদের কাছে থালা দুটো রেখে বেরোতে যেতেই পিচাই বলে উঠল,
---- মা খেলো না আমাদের সাথে।
---- আমার অনেক কাজ পড়ে আছে যে।
---- উঁহু প্লিজ এক দান।
---- আচ্ছা।
আঁচলে হাত মুছে খাটে গুছিয়ে বসলেন মা। তাতাই অবাক হয়ে বলল,
---- তুমি খেলবে!
মা হেসে বললেন,
---- তোর সাথে খেলতাম না বুঝি! তোরই তো আজকাল সময় হয়না।
---- ঠিক বলেছো মা, দিদি একদম পচে গেছে। আর খেলে না আমার সাথে। ছোটবেলায় কত মজা করতাম বলতো? আর এখন দিদি সবসময় শুধু ফোন আর ফোন। আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়না অবধি।
---- তুই আর ভাঁট বকিস না ভাই।
---- ভাঁট আর কি বকছে! ও তো ঠিকই বলছে, তোকে আজকাল সবসময় দেখি পড়া হল তো ফোন নিয়ে বসে আছিস। জিজ্ঞেস করলে বলিস গল্প লিখছি। গল্প লেখ সেটা ভালো কথা কিন্তু গল্প লিখতে গিয়ে যে বাড়ির লোকের সাথে গল্প করাটাই ভুলে গেলি। ঠাকুমা তোকে কত মিস করে জানিস? দিনে একবার অন্তঃত তার কাছে গিয়ে বসতে পারিস রোজ।
এই বলে নিজের লালগুটিটা চাললেন মা। মায়ের কথাগুলো কোথাও ভেতরে গিয়ে যেন আঘাত করল তাতাইয়ের। মায়ের কাছ থেকে ছক্কা নিয়ে চালতে যেতেই অন্যমনস্কতার কারণে ছক্কাটা ছিটকে পড়ল দূরে। সেটা তুলতে যেতেই তাতাইয়ের চোখে পড়ল পিচাইয়ের খাটে রাখা একটা নতুন বই… "অর্জুন সমগ্র - ৬"। সমরেশ মজুমদারের অর্জুন তাতাইয়ের কিশোরীবেলার হিরো, অর্জুনের খুব বড় ভক্ত সে। প্রথম পাঁচটা খন্ড তার সংগ্রহে আছে ৬নং পার্টটা নতুন। পিচাই কবে কিনল কে জানে! কতদিন হয়ে গেল তাতাই গল্পের বই পড়েনি। এখন লেখার প্রয়োজনেই যা পড়ার পড়ে ফোনে, বইয়ের পিডিএফ হোক কি গুগলের তথ্য, এছাড়া তো আর কিছু পড়া হয়না। গল্প লেখা বা সেই সংক্রান্ত কাজ ছাড়া বাকি যেটুকু অবসর সময় থাকে সেটাও তো ফোনে এটা সেটা করতেই কেটে যায়। তাতাই আগে কত বই পড়তে ভালোবাসতো, সেই অভ্যেসটা কবে ছাড়া হয়ে গেল! তাতাইয়ের প্রিয় গন্ধ ছিল নতুন বইয়ের গন্ধ, সেটা কবে হারিয়ে গেল ওর জীবন থেকে! এখন ফাঁকা সময়ে মোবাইলে গেম খেলে তাতাই। এই ক'দিনও তো গেম খেলতে না পেরে ওর মন মেজজ বিগড়ে আছে; অথচ আগে তো ও এর পিচাই লুডো, ক্যারাম, পাজল এইসব কত কি খেলত! এইসব কিছু কবে হারিয়ে গেল ওর জীবন থেকে আর কিভাবেই বা হারাল!
লুডোর ছক্কাটা হাতে তুলল তাতাই। ওটার একটা পিঠে ছ'টা বিন্দু, আরেক পিঠে মাত্র একটা। তাতাই উপলব্ধি করল প্রযুক্তির ভীড়ে টেক স্যাভি হতে গিয়ে ও ওই পুঁটটার মত একলা রয়ে গেছে এক পিঠে, আর ওর প্রিয় মানুষগুলো ওর থেকে চলে গেছে দূরে, বহুদূরে...