মেট্রো, একটি আত্মহত্যা এবং ওর
মেট্রো, একটি আত্মহত্যা এবং ওর


মেট্রোর টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে মেয়েটা খুচরো টাকার ছোট পার্সটা বার করে। কত টাকার টিকিট কাটবে ভাবতে ভাবতেই পেছনের অসহিষ্ণু ছেলেটি বলে ওঠে -''ম্যাম একটু এগিয়ে... তাড়াতাড়ি....''
মেয়েটা দেখে লাইন এগিয়ে গেছে। দ্রুত পায়ে কাচের জানালার দিকে এগিয়ে যায় মেয়েটি। অফিস টাইম, সবার তাড়া রয়েছে। অবশ্য লাইন ছোট, কারণ নিত্য যাত্রীদের স্মার্ট কার্ড রয়েছে। মেয়েটা একটা কয়েন তুলে নেয়। একটা দশ টাকাই যথেষ্ট। শুধু সুরঙ্গে নামার জন্য এর চেয়ে বেশি খরচ করবে কেন ? অবশ্য বাকি টাকা পয়সার আর মূল্য নেই ওর কাছে।
সামনের মহিলা টিকিট নিয়ে সরে যেতেই মেয়েটি দশ টাকার কয়েনটা বাড়িয়ে দেয়। বয়স্ক টিকিট বিক্রেতা ওর কয়েনটি নিয়ে একটা কালো চাকতি এগিয়ে দেয়। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তুলে নেয় মেয়েটি। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যায় গেটের দিকে। ঠিক তক্ষুনি ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে টপকে গেটে টিকিট ছুঁইয়ে চলমান সিঁড়িটার দিকে এগিয়ে যায় ওর ঠিক পিছনের সাদা শার্ট পরা ছেলেটা। মেয়েটা বিরক্ত হয়ে দেখে চলমান সিঁড়িতেও কয়েকটা ধাপ টপকে দ্রুত নিচে নামছে সাদা শার্ট।
কত তাড়া থাকে একেক জনের জীবনে!! কিন্তু ওর নিস্তরঙ্গ জীবনে কোনও তাড়া নেই আজ। মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই পৃথিবীর উপর সব মোহ মায়া কেটে গেছে ওর।
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নেমে ও দেখে দু দিকের লাইনই ফাঁকা। ঠিক কোনদিকে যাবে ও ভাবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে সিঁড়ির নিচে এসে। বোর্ডে লেখা রয়েছে দমদমের দিকের ট্রেন ঢুকবে চার মিনিট পর, সাউথেরটা পাঁচ মিনিট পরে। দু দিকেই বিক্ষিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রচুর লোক, সবাই ব্যস্ত।
মেয়েটা দু দিকেই তাকায় তারপর অলস পায়ে সাউথের দিকে এগিয়ে যায়।
আর পাঁচ মিনিট এই পৃথিবীর বুকে শ্বাস নেবে ও। তারপর.... ছুটে আসা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে শেষ ঝাঁপ। সব শেষ। মান, অপমান, অভিমান, চাওয়া, পাওয়া জীবন যন্ত্রণার অবসান।
হলুদ দাগটার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় ও। এবার ট্রেন দেখতে পেলেই একটা ছোট্ট লাফ ..... কিন্তু ছয় মিনিট পার হতে যায় কোনও দিকেই ট্রেন নেই!! ভিড় বাড়ছে। অফিস টাইম, সোমবার।লাফাবের দরকার নেই, একটু বেকায়দায় যে কেউ উলতে পড়তে পারে লাইনে এতো ভিড়। না: এ সময়টা বাছা ঠিক হয়নি। কিন্তু ট্রেন তো এত লেট করে না কখনো!!
অসহিষ্ণু জনতার গুঞ্জন বাড়ছে, একটা অস্পষ্ট ঘোষণা ভেসে আসে। পরের স্টেশন শোভাবাজারে একজন আত্মহত্যা করেছে জাস্ট আগের ট্রেনে। তাই আপাতত সিগন্যাল নেই। গুঞ্জন ততক্ষণে কোলাহলে পরিণত হয়েছে। কিছু লোক ওয়েট করছে, কিছু লোক বেরিয়েও যাচ্ছে একরাশ বিরক্তি নিয়ে।
রাগে মেয়েটার মুখ দিয়ে একটা বিরক্তি সূচক শব্দ বেরিয়ে আসে।
-'' আমার আজ প্রথম অফিস, জানেন। দশটায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। এখানেই এত দেরি হচ্ছে। প্রাইভেট চাকরি... প্রথম জয়েনিং। '' কখন যে ও সাদা শার্টের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নিজেই বোঝেনি। ছেলেটার দিকে এক ঝলক তাকায় ও। সাদামাটা চেহারা, পরিধেয় ও সাধারণ।
-''চাকরিটা খুব কষ্ট করে পেয়েছি। খুব দরকার ছিল। ওরা বলেছিল টাইমিংটাই আসল। ওটা একদিনও মিস করতে না। আর দেখুন প্রথম দিন .... কি অবস্থা!!”
মেয়েটা ভাবে এখানেও প্রতিযোগিতা। একটুর জন্য অন্য কেউ ওকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। না হলে এতক্ষণে ওর ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে থাকত ঐ রেলওয়ে ট্র্যাকে। আগের ট্রেনটা পেলেই ও শেষ করে ফেলতে পারত নিজের জীবন। তখন এই লোকগুলো ওকে নিয়ে আলোচনা করত এভাবেই। অন্তত কিছু লোকের কাছে গুরুত্ব পেতো ও।
-''ভাই, তাড়া থাকলে ওলা বা উবের ধরো। এখন এসব মিটতে এক ঘণ্টার উপর লাগবে। '' এক ভদ্রলোক চলমান সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বললেন সাদা শার্ট কে।
ছেলেটা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা বোকা বোকা হাসি হাসল। বলল-''এই অফিস টাইমে আত্মহত্যা করার কোনও মানে হয় ? সবার হয়রানি! ''
-''প্রতিটা মৃত্যুর পেছনে কারণ লুকিয়ে থাকে। '' দার্শনিকদের মত উত্তর দেয় মেয়েটা।
-''নিজে তো মরল, আমার চাকরিটা বোধহয় গেল। কত লোকের আজ লেট হবে বলুন তো ?''
-'' একটা মেয়ে মরে গেলো.... আপনি চাকরি চাকরি করছেন? উপরে উঠে ট্যাক্সি বা বাসে চলে যান। '' বিরক্তি ঝরে পড়ে মেয়েটির গলায়।
-''এখন বাস ধরলেও সময়ে পৌঁছনোর চান্স নেই। ট্রেনটা যদি চালু হয় একটু হলেও আশা আছে। ''
আরও কিছু লোক মেট্রো রেল আর আত্মহত্যাকারীকে গালাগাল দিতে দিতে উপরে উঠে যায়। এবার বোঝা যাচ্ছে ঘোষণাটি, বলা হচ্ছে বিশেষ কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রো পরিসেবা বন্ধ।
ছেলেটা ঘড়ি দেখে। একটা ফোন করতে চেষ্টা করে। বোধহয় নেটওয়ার্ক নেই !! এবার পকেট থেকে পার্স বার করে, মেয়েটা দেখতে পায়, একটা নোংরা একশো আর দুটো মলিন দশ টাকা।
পার্সটা আবার পকেটে রেখে ছেলেটা চারদিকে তাকায়। আপন মনে বলে -''এই শ্যামবাজার থেকে টালিগঞ্জ বাসে যেতে এখন পাক্কা দেড়ঘন্টা। কাজটা আর পাবো না। '' কেমন অসহায় গলা।
আস্তে আস্তে ফাঁকা হচ্ছে স্টেশন। দুটো বসার জায়গা ফাঁকা দেখে ছেলেটা এগিয়ে যায়, মেয়েটার দিকে তাকায় একবার।
এখনো দু দিকেই রেড সিগন্যাল। মেয়েটা ভাবে আত্মহত্যা তো একদিকে হয়েছে !! অন্য লাইনটা যদি চালু থাকত.... এতক্ষণে এর পরের স্টেশনেও সবাই এ ভাবেই কি বিরক্ত হত?
এখন ও কি করবে? মরতে এসেও এতো জ্বালা কে জানত!! হতাশ হয়ে সাদা শার্টের পাশেই বসে পড়ে।
-''হাইওয়েতে যদি কেউ রান ওভার হয় সরকার তার পরিবারকে কুড়ি লক্ষ টাকা দেয় বুঝলেন। ইনসিওরেন্স । সরকারের পক্ষ থেকে। তা এরা মরার জন্য ওখানেই যেতে পারে। খরচ নেই, পরিবারটাও বেঁচে যাবে। '' কোনের পাকা চুল ওয়ালা বৃদ্ধ বললেন।
-''যা:, মরলে সরকার টাকা দেবে কেন ?'' ছেলেটা একটা নিষ্পাপ সরল প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
-''আমি ইনসিওরেন্সেই আছি ভাই। হাইওয়েতে মরলে কত দালাল আসে বাড়িতে জানো? বলবে একটা কমিশন নিয়ে বাকি টাকা পাইয়ে দেবে। কত দেখলাম।কিন্তু প্রচার নেই। '' বৃদ্ধ বললেন।
-'' মেট্রো যদি এটা প্রচার করে এখানে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে কিন্তু। '' ছেলেটা বলে।
-''কিন্তু প্রচার করা চলবে না। সেটা তো আত্মহত্যার প্ররোচনা হয়ে গেলো। '' বৃদ্ধ উঠে পড়েন। অলরেডি খুব লেট।
মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়, দু দিকের লাল আলোগুলো যেন ওকে বাঁধা দিচ্ছে, কে যেন ফিসফিস করে কানের কাছে বলছে এখনো সময় হয় নি। আরও একবার ভেবে দেখতে। না:, আজ দিনটাই খারাপ।
-''পরশু মালার বিয়ে, আজ চাকরিটা হলে ওকে ফোন করতাম একবার। একটা চাকরিতে যে ঢুকেছি বলতাম শুধু। ছোট বোনটা মাধ্যমিক দেবে এবার। একটা অঙ্কের টিচার দিতাম। মায়ের ডাক্তার, বাবার চশমা, পিসির ওষুধ কত কি.. . একটা আত্মহত্যা সব শেষ করে দিল। '' দু হাতে মাথাটা চেপে ধরে ছেলেটা।
মেয়েটা তাকায় ওর দিকে। কি স্বার্থপর ছেলে !! শুধু নিজের পরিবার নিয়ে ভাবছে। আচ্ছা যে আত্মহত্যা করল সেও কি ওর মতই বীতশ্রদ্ধ জীবনের প্রতি !! কয়েক সেকেন্ড দেরি করলে এই মুহূর্তে ঐ লাশের জায়গায় ওর এই শরীরটা পড়ে থাকত !!
আর ঘোষণাটি হচ্ছে না। অফিস টাইমে শ্যাম বাজারের মত ব্যস্ত মেট্রো স্টেশন এখন খাঁ খাঁ করছে। সবাই প্রায় বেরিয়ে গেছে। মেয়েটা ভাবে এর চেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গাড়ির নিচে ঝাঁপ দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে বেঁচেও যেতে পারে। হয়তো হাত পা ভেঙ্গে পড়ে রইল!!
একটি বৃদ্ধ লোক ঝুঁকে হাঁটছে। বিড়বিড় করে বলছে -''লোকে কেন যে এখানেই মরতে আসে!! আবার উপরে উঠতে হবে। এই গরমে ভিড় বাসে কি করে যাবো আজ ?''
এক মাঝ বয়সী মহিলা একটা ঢাউস ব্যাগ কাঁধে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে বলে -''গড়িয়া যাবো। কি বাস পাবো বাইরে ?''
মেয়েটা মাথা নেড়ে জানায় যে সে জানে না। ওদিকে ছেলেটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে, উশখুশ করছে। আপন মনেই বলে -''আর কোনও আশাই নেই। মালাকে আর বলা হল না যে আমি .....''
-''মালা কে ?'' এবার একটু কৌতূহল জেগে ওঠে মেয়েটার মনে।
-''ছোটবেলার বন্ধু, ভালো বন্ধু... চাকরিটা আগে পেলে হয়তো আরও কিছু হত। কিন্তু..... ভালো থাকুক ও। ভালো ঘরে যাচ্ছে। ''
মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আবার ঘোষণা হচ্ছে , বলছে কিছুক্ষণের ভেতর চালু হবে মেট্রো। কিন্তু শুনশান প্লাটফর্মে হাতে গোনা কয়েকজন।
মেয়েটা উঠে দাঁড়ায় । এই ফাঁকা প্লাটফর্মে কিছুতেই ঝাঁপ দেওয়া যাবে না।
ছেলেটা বলে -'' যে চলে গেল সে জানে না কতজনকে বিপদে ফেলে গেলো। চাকরিটা না পেলে একটা সংসার ভেসে যাবে। ''
-'' আবার চাকরি পাবেন। এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন ?'' এবার মেয়েটার গলায় হালকা সহানুভূতির ছোঁওয়া।
-''পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করে এই প্রথম চাকরি। আমার না আছে পরিচিতি, না ভালো রেজাল্ট। টাকাও নেই। কে দেবে চাকরি!! টিউশন ও জোটে না আজকাল। প্রাইভেট ফার্মগুলোও মেয়েদের আগে নেয়। '' ছেলেটার গলায় হতাশা।
মেয়েটা ভাবে অর্ক কে হারিয়ে ডিপ্রেশনে যেতে যেতে সে ভেবেছিল মরেই যাবে। কিন্তু সে মরলে অর্কর কিছুই হবে না। ব্যাঙ্গালোরের এসি অফিসে বসে সে এখন অন্য কোনও মেয়ের চিন্তায় মগ্ন হয়ত। তার জন্য যে একটা মেয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে মরতে এসেছে সে হয়তো কখনো জানবে না। কিন্তু বাবা মা বন্ধুরা ভীষণ দুঃখ পাবে। এটা কি করতে যাচ্ছিল সে!! একটু আগে ছেলেটাকে স্বার্থপর মনে হয়েছিল। এখন মনে হয় সে নিজেই স্বার্থপর। শুধু নিজের কথা ভেবে ভেবেই আজ এখানে এসে পৌঁছে ছিল। এই ছেলেটা তো পরিবারের কথা ভাবছে। নিজের ভালোবাসার ভালো চাইছে। সুরক্ষা দিতে চাইছে অনেককে। চাকরিটা না পেলে....
আবার একটা ঘোষণা হচ্ছে। পাঁচ মিনিটে ট্রেন আসবে বলছে। দু একজন করে আবার সুরঙ্গে নামছে। মুহূর্তের মধ্যে ব্যস্ত মানুষের স্রোত এসে পৌঁছে যাচ্ছে প্লাটফর্মে। আত্মহত্যার কথা সবাই ভুলে যাচ্ছে, এই ব্যস্ত জীবনে দু মিনিটের বেশি এসব ঘটনা মনে রাখে না কেউ। যে যার মত নিজের কাজে চলেছে। একটা প্রাণ কি কারণে মুছে গেলো এই পৃথিবীর বুক থেকে তা ভাবে না কেউ। সাদা শার্ট ও উঠে দাঁড়িয়েছে, ট্রেন ঢুকছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে -''দেখি একবার গিয়ে, এক ঘণ্টা লেট !! যদি কিছু হয় !!"
-''অল দা বেষ্ট। আপনার চাকরিটা হবে। আমি বলছি। না হলে নতুন কিছু হবে । যা হয় ভালোর জন্যই হয়। '' মিষ্টি হেসে ট্রেনে উঠে যায় মেয়েটা। না:, আর এসব ভাববে না। বাঁচতে হবে নিজের জন্য। আত্মহত্যা করে কিছুই বদলাতে পারবে না। মানুষ মনেও রাখবে না। বড় জোর পেপারের ভেতরের পাতার এক কোনও পাঁচ লাইনের একটা খবর বার হবে, নামটাও থাকবে না তাতে। মানুষ হয়রান হবে, কিন্তু কেউ ওর জন্য ভাববে না। তারচেয়ে একবার অন্যভাবে বেঁচেই দেখা যাক