মাঝরাতের হাতছানি
মাঝরাতের হাতছানি
অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময় । মাঠে আমন ধান কাটা চলছে। সারাদিনে যত ধান কাটা হয়ে ; আঁটি বেঁধে সব মাঠেই রেখে দেওয়া হয় দু'তিন দিনের জন্য। তারপর যখন সেগুলো শুকিয়ে যায় গোরুর গাড়ি বোঝাই করে এনে খামারে তোলা হয় ।
কিন্তু ওই তিনদিন অর্থাৎ কাটা ধান খামারে আসার আগে পর্য্যন্ত সময়টুকু পাহারা দিতে হয় ; বিশেষ করে রাতের বেলায় । নইলে মাঠ থেকে ধান চুরি হয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা থেকে যায় ।
সেই পাহারার কাজ করত সুখদেব বাউরী । রাউৎরায়েরা গ্রামের বিত্তশালী মহাজন । ভাদ্রমাসে দাদন দিতেন মজুরদের । সেই সময়টা তাদের কাছে আকাল । গাঁটে পয়সাকড়ি থাকত না । সেই দাদনের টাকায় সংসার চলত। পরিবর্তে ধানকাটার সময় মজুরদের একপ্রকার বিনে পয়সায় কাজ করিয়ে নিতেন ।
দুর্ভাগ্যবশত সেই পরিবারে জন্ম নিয়েছিল রমাপতি । তাগড়া জোয়ান ছেলে বাড়িতে বসে বসে বখাটে হচ্ছে শুধু। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে । স্কুল যাবার নামে পুকুর পাড়ে গিয়ে বড়শিতে মাছ ধরে আর পুকুরঘাটে স্নান করতে আসা মেয়ে বৌদের জলকেলি দেখে ।
একদিন সুখদেব ওরফে সুখার জ্বর হয়েছিল । যথারীতি রাউৎরায় কত্তাকে জানিয়ে এসেছিল সুখার বউ । রাউৎরায় আর লোক পাননি । অথচ মাঠ পাহারা না দেওয়ার ঝুঁকিও নিতে পারছেন না ।
ঠিক করে ফেললেন রমা যাবে রাত পাহারায় । তখনকার দিনে আশেপাশে কোন গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি । টর্চ আর হ্যারিকেনের আলোই ছিল ভরসা ।
বাবু বললেন - বাপ রমা ! সারাদিন তো ইড্ডিং বিড্ডিং করে বেড়াস ; আজ রাতে মাঠে পাহারা দিতে যেতে হবে। পারবি ?
রমা বলে - পারব না কি বলছ বাবা ! নিশ্চয় পারব ।
- ভয় খাবি না তো ?
- ধূররর্ ! ভয়! কিসের ভয় ? চোর ডাকাত ভুত প্রেত ? আমাকে শুধু পাঁচ সেলের টর্চটা আর তোমার ওই বেতের লাঠিঠা পেলেই সাহস এমনি গজিয়ে যাবে ।
রাউৎরায় বললেন - লাঠিটা দিতে পারি । কিন্তু টর্চটা আমি ছাড়তে পারব না ।
- তবে কি চোখ দুটো জ্বেলে পাহারা দেব ?
- তা' কেন ? তেলভর্তি হ্যারিকেনটা শিবিরের মুখে টাঙিয়ে দিবি। ওতেই সবাই বুঝে যাবে ওখানে সুখা আছে ।
গ্রামে সন্ধ্যে সাতটা হলেই অন্ধকারে নিঝুম হয়ে যায় । পথে তো দূর ; ঘরের ভেতরেও লোকজন দরজা বন্ধ করে সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়ে ।
রমাপতিদের বাড়িতে অবশ্য খেতে খেতেই আটটা বেজে যায় ।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে এক বাণ্ডিল বিড়ি, একটা ম্যাচিস আর লাঠি হ্যারিকেন নিয়ে রমা চলল ধান পাহারায় ।
রাত এগারোটা পর্য্যন্ত জেগেই ছিল । বিড়ি টানতে টানতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে জানে না ।
বিড়ির আগুন নিভে যাওয়ায় কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি ঠিকই কিন্তু রাত তখন ক'টা হবে জানে না ; রমা শুনতে পেল রুমঝুম রুমঝুম নাচের শব্দ ।
গায়ে চিমটি কেটে দেখে নিল স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি।
কান দুটো কুত্তার মত খাড়া করে দিক চেনার চেষ্টা করল।
ঠিকই শুনছে সে । শিবিরের ঠিক পিছন দিক থেকে নূপুরের আওয়াজ আসছে ।
হ্যারিকেন যেমন ঝোলানো ছিল, রইল । শিবিরের পিছনদিকের ধানের আঁটিগুলো আস্তে আস্তে সরিয়ে নিজেকে বাইরে বের করে নিতেই দেখল একটি বেশ ফর্সা সুন্দরী মেয়ে কোমর দুলিয়ে হাত পা নেড়ে নাচছে।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখটা দেখার জন্য আর একটু এগিয়ে গেল । এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে কাছাকাছি একটা দীঘির পাড়ে চলে এল ।
ওই দীঘিটা ছিল মড়া পোড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট। সেটা সে খেয়াল করেনি । কোন চিতাও জ্বলছিল না ।
হঠাৎ দেখল গোটা দশেক চিতায় মড়াগুলো পুড়ছে । আর সেই আলোর ছন্দে ছন্দে মেয়েটা নাচছে।
কিন্তু অবাক কথা ; মেয়ের মুখটা কিন্তু কিছুতেই দেখা যাচ্ছে না ।
রমার প্রচণ্ড সাহস । গাঁয়ে চোর ডাকাত পড়লে সবার আগে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে । এখানেও তার কোনরকম ব্যতিক্রম হল না।
সোজা ঘোমটা ধরে টান দিতেই দেখতে পেল একটা দাঁত বের করা কঙ্কালমূর্তি । ধরবার চেষ্টা করল । কিন্তু কিছুতেই তাকে ধযা যায় না । গায়ে হাত দিলেও
কোন অনুভব হয় না যে শরীর মানে কায়া; ছায়া নয় ।
কিন্তু এ তো কেবলই ছায়া , ধোঁয়া ধোঁয়া।
সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল । ছায়ামূর্তি বিকট হাসি হেসে উঠল । এবার সে রমাকে জাপটে ধরল । রমাপতির মনে হল বহুদিন থেকে খেতে না পাওয়া কোন হায়েনা তার শরীর থেকে মাংসগুলো টুকরো টুকরো কেটে ছিঁড়ে নিচ্ছে । শরীরময় রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা দুনিয়ার জ্বালা যন্ত্রণাগুলো তাকে গিলে ফেলছে ।
রমা প্রাণপণে ওই ছায়ামূর্তির বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাইছে । কিন্তু পারছে না ।
একটা সময় জোরে চিৎকার করে উঠল । কিন্তু তার মনে হল যেন ওর চিৎকার কেউ শুনতে পাচ্ছে না। সেইজন্য গলা ফাটিয়ে আরও জোরে , আরও জোরে চেঁচাতে লাগল।
রমার মনে পড়ে গেল সে তো মাঠে ধান পাহারায় এসেছে। এমন পাহারা তো অন্যরাও দিচ্ছে। সে যে এত চিৎকার করছে কেউ শুনতে পাচ্ছে না কেন ?
আশেপাশে নজর লাগিয়ে দেখে নিল । আলো তো জ্বলছে কিন্তু সেগুলো তো সব চিতার আলো ! তার হ্যারিকেনটা নিভে আছে কেন ? তেল শেষ হবার তো কথাই নয়।
ছায়ামূর্তি তাকে তখনও কামড়ে যাচ্ছে। একসময় যেন সে নিজেই একটা কঙ্কাল হয়ে গেছে মনে হল । নিজের চেহারা দেখে আবার চেঁচিয়ে উঠতেই তার ঘোর বেড়ে গেল । নিজেই দেখছে নিজে হ্যারিকেন উঁচিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করছে ; শরীর থেকে কেটে নেওয়া মাংস পিণ্ডগুলো তাল তাল হয়ে ওই ছায়ামূর্তির গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে । এখন যেন রমা একটি কঙ্কাল আর সেই ছায়ামূর্তি তার পতি ।
ছায়ামূর্তি এবার এক অন্য মূর্তি ধরিয়ে দিল তার । রমা হয়ে গেল মেয়ে আর ছায়ামূর্তি হল ছেলে।
- মনে পড়ে ঋষিবর ! পুরানো দিনের কথা ?
যেদিন দীঘির পাড়ে দেখিতেছিলে মোরে !
পরিণামে পরিণয়ের সে ব্যাকুল ব্যথা ;
ফুটেছিল আলো হয়ে ঘন অন্ধকারে ?
কত প্রেম নিবেদন করেছ আঁখিতে ,
দাও নাই পরিচয় করিতে স্বীকার ,
পিতার বাধ্য পুত্র আভিজাত্য রাখিতে,
পাঠাইলে যম দ্বারে মনে পড়ে আর !
রমাপতি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো। - এ কি ? স্নিগ্ধা তুমি?
- হ্যাঁ আমি । আমি তোমার সেই গোপন-সঙ্গ-সঞ্চারিণী ।
রমাপতি অবাক । - স্নিগ্ধা ! তোমার এই পরিণতি কে করেছে ?
সব জেনেও রমাপতি নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে ।
অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে স্নিগ্ধা । এখন সে মোটেও স্নিগ্ধা নয়; বরং জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভা ।
শরীরের উত্তাপ বেড়ে যায় তার আর ততই হিমশীতল হতে থাকে রমাপতির দেহ । অস্ফুটে কিছু বলতে যায় । জিভ নড়ে না ; স্বর স্থব্ধ হয়ে আসে ।
স্নিগ্ধা ততই রুক্ষ হয় । এই বুঝি রমাপতি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ভয়ার্ত কন্ঠে চিৎকার করে - আমাকে মেরে ফেললে রে ! কে কোথায় আছো বাঁচাও।
এবার তার চিৎকার শুনে অন্যান্য পাহারাদাররা তার শিবিরের দিকে ধেয়ে আসে ।
দেখে রমাপতি কাটা ছাগলের মত ছটফট করছে। তার সারা গায়ে যেন জ্বরের উত্তাপ বেড়ে চলেছে। চোখে মুখে জল দিতেই রমাপতি দেখে সে তার শিবিরে অটুট রয়েছে। হ্যারিকেনটাও ঠিকই জ্বলছে।
জেগে যেতেই চোখ মেলে রমাপতি । রাউৎরায় মহাশয় পাশেই তাঁবু খাটিয়ে ছিলেন । তিনি দৌড়ে এসে রমাপতিকে বললেন - স্নিগ্ধা কে ?
রমাপতি চুপ করে থাকলেও রাউৎরায় বলেন - চুপ করে রইলি যে ? ও কি সুখদেবের মেয়ে ?
রমাপতি তবু চুপ করে রইল ।
অন্যসময় হলে রমাপতিকে গুলিই মেরে দিতেন । কিন্তু কাকতালীয় ভাবে তিনিও স্বপ্ন দেখেছেন সুখদেবের মেয়ে স্নিগ্ধা বড় পয়মন্ত মেয়ে । ওকে পুত্রবধূ রূপে পেলে তাঁর ব্যবসায় লক্ষ্মীলাভ হবেই । কিন্তু এক চাকরের মেয়ের সাথে রমাপতির প্রেম তিনি মানতে পারেননি বলে স্নিগ্ধাকে গুপ্তহত্যা করিয়ে লাশ পাচার করে দিয়েছেন ।
মাথায় হাত দিয়ে বসলেন রাউৎরায় ।
- আগে যদি জানতাম !
( সমাপ্ত )