🔺 মৎস অবতার🍀✍ ঈপ্সিতা দেব

মৎস্য অবতার

আজ আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করি পূর্বে এমন অনেক পৃথিবী ছিল কিন্তু প্রলয়ের মহা তান্ডব এসে সব ধ্বংস হয়ে যায় ।ফলে আবার নতুন করে নতুন পৃথিবীর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আড়ম্ভ হয়েছে।এই নিয়মের মধ্যে দিয়ে আদিকাল হতে সম্পূর্ণ সৃষ্টি চলে আসছে। আজও এর ব‍্যতিক্রম হয়নি।

সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা একদিন সৃষ্টির কাজ শেষ করে নিদ্রা আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন ।ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত থেকে বেদ খসে পড়ে যায় ।সেই সময়ে হয়গ্রীব নামে এক দৈত্য ছিল ।সে বিচরণ করছিল। তার ভয়ংকর চেহারা ছিল এবং শক্তি ছিল অসীম।বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর দেবতাদের ধ্বংস করে তার জায়গায় নিজের রাজত্ব করবে এই ছিল তার মনের আশা। কিভাবে সেই প্রচেষ্টা সফল হবে তা নিয়ে সে সর্বদা ব্যস্ত ছিল ।এমন অবস্থায় ব্রহ্মার হাত থেকে বেদ খানা পড়ে যেতে দেখে দৈত্য হয়গ্রীব তা চুরি করে, নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে। তার ধারনা ছিল এই বেদের সাহায্যে ব্রহ্মা সৃষ্টির কাজ করেন। তাই এই বেদ তার কাছ থেকে নিয়ে নিলে ব্রহ্মার সমস্ত কার্য ক্ষমতা চলে যাবে । ব্যাপারটা হল তাই ।হাত থেকে বেদ পড়ে যাওয়ায় ব্রহ্মদেব সৃষ্টির কাজ বন্ধ হয়ে গেল। ঠিক সেই সময় মহাদেব রুদ্র মূর্তি ধারণ করেন এবং সৃষ্টি ধ্বংস করতে লাগলেন ।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে ব্রহ্মদেব সৃষ্টির কাজ করছিলেন। তখন তার মন থেকে একজন মহান মানুষকে জন্ম হয়েছিলেন বলে তার নাম মনু।এই মনু থেকে আমাদের জন্ম বলে আমরা কিন্তু মানব বলেই পরিচিত ।

শিবকে রুদ্রমূর্তিতে সৃষ্টি ধ্বংস করতে দেখে বিষ্ণু ব‍্যাথিত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন মহাপ্রলয় আসতে চলেছে।এই মহাপ্রলয়ে সমস্ত সৃষ্টির ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে ভাবতে থাকেন কি করে সৃষ্টিকে মহাপ্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা করা যায় ।

   ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু কৃতমালা নামে এক নদীর ধারে বসে তপস‍্যা করতেন। এইতো নদীর তীরে বসে তপস্যা করার আগে তিনি স্নান সেরে ফিরতেন। এইরকম একদিন না স্নান সেরে তর্পণ করার জন্য করার জন্য নদী থেকে অঞ্জলি ভরে জল তুলে নিলেন । দেখতে পেলেন সেই অঞ্জলীর জলের মধ্যে একটা ছোট্ট পুটি মাছ । তাই দেখে যখন মাছটিকে জল ফেলে দেবেন তা ঠিক করলেন ঠিক তখন সেই মাছটি বলল " হে ঋষি আপনি দয়া করে আমাকে নদীর এই ভীষণ স্রোতে ছেড়ে দেবেন না তাহলে আমাকে কোন জলজন্তু খেয়ে ফেলবে।" -মহর্ষি মনের কথা শুনে ভীষণ অবাক হলেন ।তিনি পুঁটিমাছ থেকে কমন্ডুল জলের ভেতর আশ্রমের ফিরে এলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ! সেই ছোট্ট একদিনে এত বড় হলো যে কমুন্ডুলে ভিতরে ধরে না।

-তখন সেই মাছটি বলল " হে দয়ালু মুনিবর! আপনি আমাকে একটি পুকুরে রেখে দিন । 

মনু পুঁটি মাছটিকে একটি পুকুরে রেখে দিলেন। কিন্তু পরের দিন মাছটি পুকুরের ধারে না মহর্ষি মনে তখন সন্দেহ হলো। তিনি ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে এমাছ সাধারণ মাছ না।স্বয়ং নারায়ন, তিনি মৎস্য রূপে অবতীর্ন হয়েছেন।ধ‍্যানমগ্ন অবস্থায় মনু যখন ছিলেন তখন তিনি নারায়ণের এই বাণী শুনতে পেলেন ," মুনিবর তুমি সজ্জন, তাই আমি তোমার নিকট এসেছি , আমাকে তুমি সমুদ্রে রেখে দাও ।আজ থেকে সাতদিন পরে মহাপ্রলয় আসবে তাতে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে ।আমি তোমার দ্বারা এই সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হয়েছি।এই পৃথিবীর রক্ষার্থে আমি মর্ত‍্যে এই মৎস্য রূপে অবতীর্ন হয়েছে । তুমি এই সাতদিনের মধ্যে একটি সুবিশাল নৌকা তৈরী কর।সমস্ত বৃক্ষলতা, বীজ সংগ্রহ করে ঐ নৌকায় আশ্রয় নেবে ।আমি সিঙ্গি মৎস্য রূপে সমুদ্রে অবস্থান করবো।এই মহাপ্রলয়ের সময় তোমাকে সাহায্য করার জন্য স্বয়ং বাসুকির মাথায় সঙ্গে সেই নৌকা বেঁধে রাখবে আর আমার মাথা শৃঙ্গে বাসুকীর লেজ বাঁধা থাকবে ।তাহলে সেই প্রলয়ের প্রচন্ড তরঙ্গেও তোমার নৌকা ভেসে যাবে না।

কালক্ষেপ না করে মহর্ষি মনু মৎস্য রূপী নারায়নের আদেশ শুনে সাত দিনের মধ্যে সমস্ত বৃক্ষ,লতার চারা ও বীজ সংগ্রহ করেন।তিনি একটি প্রকাণ্ড নৌকা নির্মাণের ব‍্যবস্থা করেন।নৌকা নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে তিনি সংগ্রহ কৃত সমস্ত বৃক্ষ,লতার চারা ও বীজ নিয়ে সমুদ্রে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তিনি যে প্রকান্ড নৌকা তৈরি করেছিলেন, সেই নৌকার মধ্যে সমস্ত প্রকার বৃক্ষ,লতার চারা, বীজ যত্নে রেখেছিলেন।

বিষ্ণু অবতার মৎস্যের কথা মতো সাত দিন পর থেকেই শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড় ,বৃষ্টি। যে প্রলয়ের আগাম বার্তা মৎস্যটির কাছ পাওয়া গিয়েছিল তা আড়ম্ভ হতেই তীব্র আকার ধারণ করল।কৃষ্ণ বর্ণ দৈত্যের ন‍্যায় কৃষ্ণ মেঘে সমগ্র আকাশ ছেয়ে গেল।সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাত এবং অবিশ্রান্ত বৃষ্টি আরম্ভ হল।এই মহাপ্রলয়ে সমগ্র পৃথিবী ডুবে গেল ।সমুদ্রে মৎস্য শিঙ্গীসঙ্গে সঙ্গে বাঁধা মহর্ষি মনুর নৌকা খানি,তা ভাসতে লাগলো।তখন চারিদিকে জলমগ্ন ;এই বৃষ্টি বেশ কিছু সময় ধরে চলল।এই প্রবল বর্ষন যখন থেমে গেল তখন মনু নৌকা থেকে নেমে এলেন এবং বৃক্ষ,লতা এবং সকল প্রকার বীজ চারিদিকে ছড়িয়ে দিলেন। এইভাবে সৃষ্টিকে তিনি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। 

এরপর নারায়ণের ধ্যান করতে বসে মনু জানতে পারলেন ব্রহ্মদেবতা হাত থেকে বেদ পড়ে যায় ।আর সেই সময় ওই স্থান দিয়ে হয়গ্রীব নামক এক অসুর যাচ্ছিল।অসুরটি ব্রহ্মদেবের হাত থেকে বেদ পড়তে দেখে ভাবে এটি হরণ করলে ব্রহ্মার সৃষ্টি কার্য থেমে যাবে।আর এটি যদি আমার হস্তগত হয় তবে আমি হবো সর্বশক্তিমান।তাই হয়গ্রীব চুরি করেছে । এবং সেই বেদ চুরি করে নিয়ে পাতালে নিয়ে যায়। এখন ঐ বেদকে পুনরুদ্ধার করাই সবচেয়ে বড় কাজ। মনু স্থির করে এবার থেকে অপহৃত বেদ রক্ষা করার কাজে তিনি মন দেবেন ।কারণ ব্রহ্মার হাতে বেদকে তুলে না দেওয়া পর্যন্ত তিনি সৃষ্টির কাজ শুরু হতে পারবেনা। 

তখন তিনি পাতালে গিয়ে রাক্ষস হয়গ্রীব এর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন । যুদ্ধে হয়গ্রীব কে বধ করেন‌। এবার তিনি সেই বেদ উদ্ধার করে। বেদকে আবার ব্রহ্মার হাতে তুলে দিলেন ।

এই বেদের স্পর্শ পেয়ে ব্রহ্মা নিদ্রা ভঙ্গ হলো ।তিনি আবার নতুন করে পৃথিবীতে সৃষ্টি কার্য শুরু করলেন। 

এইভাবে সমগ্র সৃষ্টিকে রক্ষা করা এবং হয়গ্রীব নামক অসুরের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য ভগবান রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ।

দশ অবতারের ক্রমবর্ধমান বিষয়টা হলো -মাটির পৃথিবীর তখন জন্ম হয়নি ।বহু পূর্বে সৃষ্টির আদিতে কোন জীবজন্তু ,কীটপতঙ্গ , পাহাড়-পর্বত, বন- জঙ্গল এসব কিছুই ছিল না।

দিগন্ত সীমাহীন কূলহীন অনন্ত ফেনিল সমুদ্র ঘেরা ছিল চারিদিক।সেই সময় সমগ্র পৃথিবী জলে থই থই করত।ক্রমে পৃথিবীতে একদিন জীবদেহে সৃষ্টি হলো।জলেই জীবের প্রথম আবির্ভাবের ঘটে। জলে একটা হলুদ রঙের থলথলে পদার্থের সৃষ্টি হয়। বৈজ্ঞানিকদের মতে সেই সময় প্রথম যুগের সূচনা হয়। সেটিও প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর আগে জলের প্রাণীরা জলের বসবাস আদ্যপ্রাণী। এই আদ্যপ্রাণী আসলে প্রোটোজোয়া । অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া প্রাণীদের দেখা যায় না। এরপর এই জলে দেখা মিলল জলের শ্যাওলা ।তারপরে হল মাছ ।বৈজ্ঞানিকদের অনুমান এপ্রায় আজ হতে প্রায় চল্লিশ কোটি বছর আগের ঘটনা।এর পর ধীরে ধীরে গাছপালা ,পক্ষীকুলের আবির্ভাব হয় ।এটিও আজ থেকে প্রায় বা কোটি বছর আগে কথা।আর মানুষ তো এলো সেদিন!! মাত্র আনুমানিক তিন লক্ষ বছর আগে, মানুষ শ্রেষ্ঠ প্রানী।

বিজ্ঞানীদের মতে অনেক রকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রোটোজায়ার সৃষ্টি হয়েছিল।এরপর কেটে যায় অনেকগুলো বছর।

বৈজ্ঞানিকদের মতে প্রায় দশ কোটি বছর পরে জীবজগতের প্রথম ও প্রধান প্রাণী মৎস্যে আবির্ভাব ঘটে ।জলের এই প্রানী জল ছাড়া থাকলে এদের মৃত্যু অনিবার্য।