ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
ষষ্ঠ পর্ব
দিন দুয়েক পরে আরণ্যক বসুরায় ফোন করলেন কৃষ্ণপুরে গোপালকৃষ্ণকে ।
বললেন - দাদা ! আজ আপনাকে চুক্তিপত্র দেবার কথা ছিল ; কিন্তু কোথায় যে তা' রেখেছি মনে করতে পারছি না । এবার অফিসে খুঁজে দেখব; পেলেই আপনার কাছে যাব ।
কৃষ্ণগোপাল তখন বারান্দায় পায়চারী করছিলেন । ওঁরই কেস নিয়ে ভাবছিলেন।
নিশ্চয় এমন কিছু ঘটেছে যার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েটি উকিলের নোটিশ পাঠিয়েছে । অযথা কেউ কারও নামে কেস দেবে কেন !
ফোন তুলে বললেন - যত শীঘ্র পারো চলে এস। মনে হচ্ছে কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং। অন্তত উকিলের বয়ানে তেমনই মনে হচ্ছে ।
আরণ্যক বললেন - দাদা আমি চাই না আমার সম্বন্ধে কারও কোন ভুল বোঝাবুঝি হোক । আপনি ওই মেয়েটি সম্পর্কে একটা ফাইল তৈরি করুন । তথ্য দিয়ে আমি আপনাকে সাহায্য করব।
এ কি উলটপুরাণ ! গোপালকৃষ্ণ বাবু ভাবলেন মেয়েটি অলরেডি উকিলের নোটিশ পাঠিয়ে দিয়েছে ; এখন কেস না লড়ে ওর সম্পর্কে কি করা যাবে ?
বললেন - আরে ভাই, আইনের কচকচানি তো তুমি শোননি কোনদিন । এখন নিজেকে প্রস্তুত কর কি ভাবে এর মোকাবিলা করবে ?
- দাদা , সে'জন্যই তো আপনার দরজায় গিয়েছিলাম। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রমাণটাই যে হারিয়ে ফেলেছি!
- দেখ ভায়া ! হারিয়ে ফেলেছি বললে তো চলবে না। ওটা একটা দস্তাবেজ। না পেলে তোমারই ক্ষতি। আদালত তো শুধু কথাকলিতে চলে না; সেখানে তথ্য চাই, প্রমাণ চাই, সাক্ষীও চাই। এবার বল তুমি কি করবে ।
- কাগজটা পেয়ে গেলে তো কথা নেই; না পেলে একটা ডুপ্লিকেট বানিয়ে নেব ।
- আর সিগনেচার! ওটা তো জাল প্রমাণ হয়ে যাবে !
- সে ব্যবস্থা করে নেব দাদা । এতদিন ধরে নাম কামিয়েছি। সারা বাংলা আমাকে এক ডাকে চেনে । সাক্ষী-সাবুদ ঠিক জোগাড় করে নেব ।
গোপালকৃষ্ণ বাবু তখন বিরক্ত হয়ে বললেন - যেমন তোমার ইচ্ছে । তবে ভায়া আমি এই কেস নিতে পারব না। তুমি অন্য উকিল দেখে নাও ।
আরণ্যক বসুরায় যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। নিজের মুখে যে কথাটা বলতে বাধছিল; সেটা গোপালকৃষ্ণ স্বয়ং বলে দিলেন এতে তিনি দুঃখ নয় বরং বেশ খুশি হলেন । তবু কত দু:খ পেলেন তা প্রকাশ করতে ভুললেন না।
- দাদা ! অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে গেছলাম । আপনার মত সুযোগ্য উকিল পেয়েছি বলে নয় ; আপনার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা রয়েছে বলে । ঠিক আছে, আপনি যখন নেবেন না তখন বাধ্য হয়ে কোন উকিল ধরতে হবে ।
- এই দেখ ভায়া ! তুমি মিছিমিছি আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিচ্ছ। তুমি একজন সাহিত্যিক, লেখক, কবি। তুমি নিশ্চয় বুঝবে আমার অপারগতার কথা ।
- আমি কিছু মনে করিনি দাদা । সত্যিই তো প্রমাণ ছাড়া তো কেস হয় না । তাই বললাম খুঁজে না পেলে ডুপ্লিকেট তৈরি করিয়ে নেব ।
- শোন ভায়া, অরিজিনাল কপিটা যদি পাও; নি:সঙ্কোচে চলে এসো। আমি জানপ্রাণ লাগিয়ে তোমাকে জয়ী করব - কথা দিচ্ছি।
আরণ্যক বসুরায় দোটানায় পড়লেন । অরিজিনাল চুক্তিটা তাঁর হাতেই রয়েছে ; কিন্তু সেটা তাঁর হাতে তুলে দিতে নিজেকে ঘেন্না করছে । পতি-পত্নীর উভয়ের মধ্যেকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠবে । এমন কাজই তো তিনি করেছেন ।
চুক্তি পত্র অনুযায়ী ললন্তিকা তাঁর রক্ষিতা মাত্র । কোন ভাবেই সে পত্নীত্বের দাবী করতে পারবে না । আর যদি সহবাস মানেই তাকে বিবাহের অধিকার দেয় তো তিনি যে পুরুষত্বহীন নপুংসক তার প্রমাণ পত্র তো আছে।
কিন্তু ভেতরের কথা তো আত্মীয় স্বজন তথা নিজের স্ত্রীকে বলা যায় না ।
অতএব আরণ্যক একজন নতুন উকিল ধরলেন । মিঃ ধূর্জটি সিদ্ধান্ত । হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করেন। সিনিয়ার ব্যারিস্টার । তাঁকে ধরলেন কেস হাতে নিতে ।
- এ বড় গোলমেলে কেস মিঃ রাইটার । আদালতে আপনার সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে পারে । কারণ আপনাকে তো স্বীকার করতেই হবে ললন্তিকা নামের মেয়েটিকে আপনি রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিলেন !
- সে তো তার লেখা প্রকাশ করতে !
- তার জন্য পারিশ্রমিক নিতেই পারতেন । এ ধরণের চুক্তিটাই তো বৈধ নয় ।
- কিন্তু সে ও তো সিগনেচার করেছে।
মিঃ সিদ্ধান্ত বললেন - সে তো তার দুর্বলতার জন্য এমন করেছে। কিন্তু আপনি ? সমাজের প্রতি তো লেখক হিসেবে আপনার কিছু দায় বা কর্তব্য থেকেই যায় । এখন তো আপনার আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব এমনকি জনসাধারণও জেনে যাবেন যে আপনি সুযোগের ব্যবহার করেছেন । শুধু তাই ধয়; পত্নীকেও যে ঠকিয়েছেন তাও প্রমাণ হয়ে যাবে ।
আরণ্যাক এমনিতে বেশ সাহসী। কিন্তু মিঃ সিদ্ধান্তের ভাষ্যে নিজেকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন ।
অসহায়ের মত একরাশ হতাশা নিয়ে বললেন - তাহলে কোর্টে হেরে যাব বলছেন ?
- নট দ্যাট এক্সাক্টলি । জিতেও যেতে পারেন । সব কিন্তু জানাজানি হয়ে যাবে । তাই বলছিলাম আপনারা দু'জনে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে একবার দেখে নিতে পারতেন । প্রয়োজনে ওর উকিল এবং আমি - আমরা দু'জনে আপনাদের সাহায্য করব ।
যুক্তিটা মন্দ নয় । আরণ্যক বললেন - কিন্তু ওর উকিল যদি বেঁকে বসে ?
- নোটিশে তো দেখলাম সামওয়ান মিঃ জগবন্ধু মিত্র সিগনেচার করেছেন । আমার সঙ্গে ওঁর খুব ভালো পরিচয় আছে । এই জগবন্ধু মিত্র যদি একই লোক হন তবে তো অসুবিধা নেই । কিন্তু অন্য কেউ হলে ---
মিঃ সিদ্ধান্ত কিছুক্ষণ ভাবলেন । নোটিশটা আরেকবার দেখে নিলেন । মোবাইল নংও দেওয়া আছে। নিজের ফোনবুক থেকে নাম্বারটা মিলিয়ে নিতেই তিনি বললেন
- যান, আপনার কাজ হয়ে যাবে । আদালতের বাইরেই এর একটা বিহিত করে দিতে পারব নিশ্চয় ।
মিঃ বসুরায় যেন প্রাণ ফিরে পেলেন । মিঃ সিদ্ধান্তকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর পারিশ্রমিক দিয়ে বেরিয়ে গেলেন অফিসে ।
মন এখন বেশ ফুরফুরে । খোশমেজাজে প্রকাশনা সংস্থায় ঢুকলেন । গটগট করে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন । অন্যদিন লিফটের সাহায্য নিতেন।আজ তাঁর মনোবল বৃদ্ধি পাওয়ায় হেঁটে হেঁটে উপরে উঠলেন । লম্বা করিডোর পেরিয়ে একটু ডানদিকে ঘুরলেই প্রথমে যে দরজা রয়েছে সেই তাঁর অফিস।
এখানে অন্য কয়েকজন প্রকাশকের অফিসও আছে।
তিনি রুমে ঢুকে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালেন। সুখটানের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠতে লাগল । শরীর থেকে শোয়েটার খুলে চেয়ারে টাঙিয়ে দিলেন । এ
যাত্রা ঈশ্বর তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ভাগ্যিস চুক্তিপত্রটা গোপালকৃষ্ণ বাবুর থেকে চেপে রেখেছিলেন । নইলে সেদিনই সব সম্পর্কের অবসান হয়ে যেত । গোপালকৃষ্ণ, দিদি এবং সর্বোপরি কনক - কেউ হয়তো কোনদিন মুখদর্শণ করত না ।
কিন্তু বেশীক্ষন এই সুখ কপালে সইল না । চুক্তিপত্র ব্যাগ থেকে বের করে আলমারিতে লকারের মধ্যে রেখে দিলেন এবং তালা বন্ধ করে এসে বসলেন চেয়ারে। ললন্তিকা প্রবেশ করল রুমে এবং মুখোমুখি আর একটা চেয়ারে বসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল - মিঃ আরণ্যক বসুরায় ! কেমন আছো !
ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন মিঃ বসুরায় ।
- তুমি ! তুমি কেন এসেছ এখানে ?
- আমি একা আসিনি। সঙ্গে কনেযাত্রীরাও আছেন ।
আরণ্যক বসুরায় কি করবেন বুঝে ওঠার আগেই একদল মহিলা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল অফিসে । সংখ্যায় তারা এত বেশী যে কয়েকজনকে রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে হল ।
( ক্রমশ )
