ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
পঞ্চম পর্ব
রাত গড়িয়ে সকাল হল ; বেলা বাড়ছে অথচ রুদ্র শ্মশান ঘাট থেকে ফিরেনি । বনলতা দেবী শঙ্কিত হলেন । মায়ের মন তো ! সবসময় সন্তানের প্রতি এক অন্য ধরণের অনুভূতি কাজ করে ।
আজ কিন্তু তা' শুধু অনুভবে সীমাবদ্ধ রইল না । অজানা আশঙ্কায় মাতৃহৃদয় কম্পিত হতে লাগল। তিনি হাতের ফোন থেকে রুদ্রকে ফোন করতে যাবেন অমনই অরবিন্দ সরখেল এসে হাজির হল ।
- কা'কে ফোন করছেন মাসীমা ? রুদ্রবাবুর ফোন তো চুরি হয়ে গেছে !
বনলতা চমকে উঠলেন। ফোন চুরি হয়ে গেছে ! তা-ও আবার রুদ্রর মত সাবধানীর ছেলের থেকে !
বললেন - তুমি ? হঠাৎ এই সময়ে ?
একমুখ হেসে অরবিন্দ বলল - তবে চিন্তা করবেন না মাসীমা । রুদ্রবাবু এক্ষুণই এসে পড়বেন । আসলে রাতের বেলায় যে সব অলক্ষুণে কাণ্ড ঘটে গেছে তাতে রুদ্রবাবুর যে এখনও মাথাটা ঠিক আছে সেটাই আশ্চর্য্যের ।
বনলতা দেবী তাঁর শঙ্কা যে অমূলক নয় ; তা' বেশ টের পেলেন । নইলে অন্তত একবার ফোন করে খবর নিত । আর তিনিও তো করেননি। অযথা বিরক্ত হবে বলে ।
বনলতা দেবী বললেন - তা কি ঘটেছিল বাছা, একটু যদি বল !
মুখের হাসি অক্ষুণ্ণ রেখে অরবিন্দ বলতে লাগল - সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা । তবে সব কিছুর মূলে ওই ডোমটা । জানেন মাসীমা ! রুদ্রবাবু ভেবেছেন আমিই নাকি এ সবের হোতা । তাই বারবার আমাকে ফোন করে চলেছেন । এত রাতে ফোন করেই চলেছেন; আমি কিন্তু একবারও বিরক্ত হইনি । ওঁকে শুধু সাহস জুগিয়ে গেছি।
বনলতার মনে হল সব কিছু যেন হেঁয়ালির মত । এই তো বলল ফোন চুরি গেছে। আবার বলছে রাতভর ফোন করে গেছে।
রেগেমেগে বলেই দিলেন - দূর হ হতচ্ছাড়া পাজী !
অরবিন্দ হেসে হেসে বলে - রেগে যাচ্ছেন কেন মাসীমা ? ফোন তো তখন চুরি হয়নি । চুরি হয়েছে তো লাশটা। রুদ্রবাবু তাঁর মাসীর মরদেহে প্রণাম করতে গিয়েই তো বিপত্তি। ফোন রেখে দিয়েছেন শবের উপর । আর ওই ডোমটা তা নিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে নিজের পকেটে।
- তারপর ? তুমি ওটা উদ্ধার করেছ ?
হো হো করে হাসে অরবিন্দ সরখেল ।
- আমি ? হা হা হা ! আমি তো তখন বাড়িতে ! আর ওরা শ্মশানে । আমি কি ভাবে উদ্ধার করব?
- তবে?
এবার আর কোন কথা নয় । অরবিন্দ সরখেল রুদ্রর ফোনটা মাসীমার হাতে দিয়ে বলে - এই নিন ফোন। একবার ফোনে মুখ রেখে জোরে জোরে রুদ্র রুদ্র বলে ডাকুন । শুনুন রুদ্র কি বলে ?
- নাহ্ এ ছোঁড়াটা দেখছি আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছে। রুদ্রর ফোন আমার হাতে আবার বলে কি না রুদ্রর সাথে কথা বলুন !
অরবিন্দ বলে - যা বলছি করে দেখুন । নইলে ---
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে অরবিন্দর । একটা কঠোরতার আভাস লক্ষ্য করা যায় তার চোখে মুখে । ভয় পেয়ে যান বনলতা দেবী ।
ফোনটা মুখের সামনে এনে রুদ্রর নাম ধরে ডাকতে থাকেন ।
- এসে গেছি মা ! এই তো তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
ভরাট গলার রুদ্রর কন্ঠস্বর শুনে বনলতা দেবী আশ্বস্ত হন ।
রুদ্র এসে বলে - আর কখনও শ্মশানে যাব না মা । যা ভয়ংকর ভুতের পাল্লায় পড়েছিলাম ; ভাগ্যিস অরবিন্দ বাবুকে ফোন করেছিলাম । উনি যথাসময়ে শ্মশানে না পৌঁছলে আমি হয় তো ---
- দুর্গা দুর্গা। এ কি বলছিস তুই ? অরবিন্দ যে বলল তোর ফোন চুরি গেছে !
- ঠিক কথাই বলেছে মা ! আমি যখন মাসীকে প্রণাম করছি ; আমার মনে হল কেউ যেন আমার পকেটে হাত ঢুকিয়েছে । চেয়ে দেখি এক ত্রিশ বত্রিশের মহিলা ঘনঘন আমার বুকে নি:শ্বাস ফেলছে। ভুত ভেবে ডোমকে ডাকলাম । সে একটা বিকট হেসে মুখ থেকে দাঁত বের করে আমাকে ধরিয়ে দিল । মেয়েটা ফোন নিয়ে পালাচ্ছে। এমন সময় অরবিন্দ এসে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল । কিছুটা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লাম । অরবিন্দের সঙ্গে ডোম আর ওই মেয়েটার কথা কাটাকাটি শুরু হল । আমি কিন্তু ওদের কথাবার্তা কিছুই শুনতে পাইনি । শেষে ওরা অরবিন্দের হাতে ফোনটা তুলে দিয়ে পালিয়ে গেল ।
আমি অরবিন্দের কাছে ফোন চাইলাম । অরবিন্দ বলল - এটা এখনই আপনাকে দেওয়া যাবে না। আমি হাতে ওর করে বাড়ি নিয়ে যাই। আপনি আপনার মায়ের হাত থেকে ফোন নেবেন ।
- এ কি ভুতুড়ে কাণ্ড রে বাবা ! নে এবার স্নানটান করে শুদ্ধ হয়ে নে । চল আমরা বাড়ি যাই।
- কিন্তু মেসোমশাইকে ছেড়ে যাওয়া কি ঠিক হবে ? আবার ওনাকে সিফ্ট করাও তো ভীষণ রিস্কি ।
- যে করে হোক আমাদের যেতে হবে । এখানে থাকতে পারছি না । যা সব ঘটনা ঘটছে !
অরবিন্দ সরখেল এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল । বলল - তা যা বলেছেন মাসীমা ! আরও যে কত কিছু ঘটতে পারে বেশ বুঝতে পারছি। তবে আপনারা যেতে পারেন। আমি স্যারকে দেখব - কথা দিচ্ছি ।
রুদ্র বলল - সত্যি করে বলুন তো ! আপনার সঙ্গে মেসোমশায়ের কি ধরণের সম্পর্ক আছে যাতে আপনি বিপদ উপেক্ষা করে থেকে যেতে চাইছেন ,?
অরবিন্দ হাসল । বলল - শুনতে চান ? ঠিক আছে খাওয়া দাওয়া করে নিন , তারপর সব বলব ।
বনলতা দেবী ফল আর মিষ্টির প্যাকেট বের করে সবাইকে খেতে দিলেন ।
রুদ্র বলল - এবার শুরু করুন। ইপনার গল্প শুনতে অধীর হয়ে উঠেছি ।
একটি সেগুন কাঠের শয্যায় শুয়ে আরণ্যক বসুরায় তখন ঘামতে শুরু করেছেন । এই দৃশ্য বনলতা দেবী বা রুদ্রর নজরে না আসারই কথা । তবে তৃতীয় ব্যক্তির চোখে তা এড়িয়ে যেতে পারেনি । অরবিন্দ সরখেল বলল - ওই দেখুন, স্যার ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছেন। আপনারা খেয়ে নিন। আমি দেখছি ওনার কি অসুবিধা হচ্ছে ।
রুদ্রনীলের সন্দেহ হল । কাছাকাছি থাকা সত্বেও সে বা তার মা ঘামের ব্যাপারটা দেখতে পায়নি। অথচ একই স্থান থেকে সরখেলের নজরে তা এল কেমন করে !
রুদ্র খাওয়া ছেড়ে মেসোমশায়ের নিকটে গিয়ে দেখে অরবিন্দ যা বলেছে তা' সত্য । উপরন্তু তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত অস্থিরতা লক্ষ্য করল । কিছু যেন বলতে চাইথেন। অথচ বলতে পারছেন না ।
প্রতিবেশীদের ডেকে আনল । তারাও এই দশা দেখে খুব অবাক হল ।
রুদ্র বলল - আপনারা কেউ এই লোককে চেনেন ?
বলে সরখেলের দিকে তাকাতেই দেখল সরখেল সেখানে নেই ।
প্রতিবেশীরা বললেন - কার কথা বলছ বাবা ! এখানে তো বাইরের কেউ নেই।
- ও আচ্ছা । আমি তা বলতে চাইনি । বলছিলাম অরবিন্দ সরখেল বলে কাউকে আপনারা চেনেন বা দেখেছেন তাকে ?
- কে এই অরবিন্দ সরখেল? তাকে দেখা তো দূর; এমন নামও কেউ শোনেনি। আর বসুরায়ের সাথে তো ওনার ড্রাইভার ছাড়া অন্য কাউকে তো কোনদিন দেখিনি !
বনলতা দেবী বললেন - বুঝেছি । ওরে রুদ্র, আমার সন্দেহ তবে ভুল নয় । লোকটা কোন মানুষ নয়; আমার মনে হয় কোন প্রেতাত্মা।
রুদ্র ধমকে উঠল - আপনি ছাড়ুন তো মা ! ওসব ভুত প্রেতে আমার কোন বিশ্বাস নেই । আমার সন্দেহ অন্যরকম ।
- তুই আবার কি সন্দেহ করছিস ?
রুদ্র - আমার মনে হয় লোকটা মেসোমশাইকে অনেকদিন ধরে চেনে । তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য তার গোচরে । আর সুযোগ বুঝে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করতে আসছে। মনে হচ্ছে গোটা ঘটনাটাই পূর্বপরিকল্পিত। আমাদের বসে থেকে বিপদকে আহ্বান করার কোন মানে হয় না ।
তারপর প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলল - আপনারা কেউ আমার সঙ্গে থানায় চলুন । একটা জেনারেল ডায়েরী করে আসি।
তখন কেউ বলল 'চলুন' , কেউ বা বাড়ির দিকে রওনা দিল ।
( ক্রমশ )
