ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
ললন্তিকা ( ধারাবাহিক)
দ্বিতীয় পর্ব
কনকলতার ( রুদ্রর মাসীমা ) দুর্ঘটনাজনিত অকালমৃত্যুতে তাঁর স্বামী আরণ্যক বসুরায়ের দেখাশুনা করার মত আর কেউ রইল না । তিনি নি:সন্তান । ভ্রাতা বা ভগিনী কেউ নাই। একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় খবর পেয়ে এসেছে তাঁর তদারকি করতে ।
বনলতা দেবীর তা' মোটেও পছন্দ হয়নি । রুদ্রকে এ'ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার নির্দেশ দিলেন ।
- আগে তো বডিটা পুলিশের হাত থেকে উদ্ধার করি ! তারপর শ্মশানে যেতে হবে । এখনই এসব চিন্তা মাথায় আনবেন না মা ।
হিয়ারিং এইড কানে সুবিধামত গুঁজতে গিয়ে কান থেকে ওটা কখন খুলে গেছে; বনলতা দেবী টের পাননি । রুদ্র কি বলল শুনতে না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন
- হ্যাঁ রে, কিছু বললি না যে !
রুদ্রনীল দেখল যন্ত্রটা ঝুলছে; কানে নেই । তড়িৎবেগে ওটা মায়ের কানে গুঁজে দিয়ে বলল - দেখব বললাম তো! আপনি ভাববেন না মা !
- কি জানি বাবা ! কে যে কখন বন্ধুবেশে আসবে আর সর্বনাশ করে দিয়ে যাবে ! এই জন্যেই তোর বাবাকে আসতে বলেছিলাম ।
- আহ্ মা! কি করছেন ? শুনতে পাবে যে !
শুনতে কিন্তু পেয়েছে সেই দূর সম্পর্কের আগন্তুক । এগিয়ে এসে রুদ্রকে বলল - আপনি কি রুদ্রনীল ?
রুদ্র অবাক হল না । চেনে হয়তো ; কিম্বা মাসীর মুখে শুনেছে । আবার ভাবল , তবে কি মাসীর সাথে এর পূর্ব যোগাযোগ ছিল ?
সুতরাং আগন্তুকের প্রশ্নের কোন জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করল না ।
একটু ঘুরিয়ে বলল - আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ।
আগন্তুক বলল - আমি ঋষি । আরণ্যক বসুরায়ের মামাতো দাদার শালা ।
রুদ্র ঠিক বুঝল না । মামাতো দাদার শালা ! মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে না । সে তো কোন সম্পর্কই নয় !
অতএব মায়ের ভাবনাটাই তো ঠিক মনে হচ্ছে ।
ঋষিকে রুদ্র বলল - আপনি কি করেন ?
- টুকটাক জমিজমা আছে, একজোড়া বলদও আছে। তাই দিয়ে কোনক্রমে সংসার চালিয়ে যাচ্ছি । বাসে ফিরছিলাম । হঠাৎ বাঁক নিতেই চৌমাথার মোড়ে দুর্ঘটনা ঘটে গেল । বাস থেকে নেমে দেখি এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা বাস চাপা পড়েছেন । বুকের মাঝখান বরাবর বাসের চাকা গড়িয়ে গেছে । মুখ দিয়ে রক্ত বেরোনো ছাড়া কিছু হয়নি । মুখটাও অক্ষত ছিল । দেখেই চিনেছি কনকবৌদি । ব্যস ! আর তো ছেড়ে যাওয়া যায় না ! কর্তব্যের খাতিরে থেকে গেলাম । আরুদাকে ( আরণ্যক) প্রথম খবরটা আমিই দিয়েছি । তখন উনি আপনাদের নাম্বার দিয়ে জানিয়ে দিতে বললেন ।
- খুব ভালো কাজ করেছেন । এবার চলুন মর্গ থেকে দেহ নিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করি ।
- মাফ করবেন । বাড়িতে আমি একা আছি। বৌ ছেলেপুলেরা সবাই মামাবাড়িতে । ফিরে না গেলে, বলদ জোড়া তেষ্টার জলটুকু পাবে না । তা-ছাড়া আপনি যখন এসে গেছেন, আর তো চিন্তার কারণ দেখি না । প্লীজ একটু ম্যানেজ করে নেবেন । আমি চলি ।
রুদ্র বেশি ঘাঁটাতে চাইল না । বলল
- ঠিক আছে আসুন । বাই দ্য ওয়ে আপনার নাম্বারটা দেবেন ?
- কেন নয় ! লিখে নিন 98322****56 আর নাম অরবিন্দ সরখেল ।
লোকটি চলে গেল । রুদ্র তার কথা-বার্তায় সন্দেহজনক কিছু না দেখে আশ্বস্ত হল ।
কিন্তু না আঁচালে বিশ্বাস নেই ভেবে ফোন নং ও নাম নিয়ে নিল ।
মর্গ থেকে দেহ নিয়ে শ্মশানে যেতে যেতে রুদ্রর চোখে মাসীর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে কালির চিহ্ন দেখে অবাক হয়ে গেল । কেন এই কালি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে দেওয়া হয়েছে তার সম্ভাব্য কারণ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করল
হুবহু একই রকম চেহারা বিশিষ্ট এমন একজন তার মাসীমার বডি ধরে শববাহী গাড়িতে তুলছে যার সাথে বাড়িতে অলরেডি পরিচয় হয়েছে । ভাবল অরবিন্দ সরখেল । ফোন বের করে তার নাম্বারে ফোন করল।
অপর প্রান্ত থেকে অরবিন্দ বলল - হ্যালোৎ! অরবিন্দ বলছি। আপনি কে বলছেন?
- আমি রুদ্রনীল । আপনি বাড়ি পৌঁছে গেছেন ?
- এখনো বাসেই রয়েছি । কেন বলুন তো !
- না , তেমন কিছু নয়। এমনই জেনে নিলাম আপনি ঠিকমত পৌঁছেছেন কি না । আচ্ছা, আপনার কোন যমজ ভাই আছেন ?
অরবিন্দ সরখেল থতমত খেয়ে বলল -:কি যে বলেন আপনি ! আমি একমাত্র সন্তান ।
- ও আচ্ছা , ঠিক আছে রাখলাম । বলে ফোন কেটে দিল । অরবিন্দের হমসকল তখনও শবগাড়িতে ডেডবডি তুলছে। রুদ্র সামনে যাবার জন্য প্রস্তুত হল । পাড়ার জনৈক বাগ্দী নামের ছেলেটিকে বলল - এস তো আমার সঙ্গে ।
নিকটে গিয়ে দেখে সে একজন ডোম । হতবাক হয়ে যায় রুদ্র । তাহলে সে কি চোখে ভুল দেখেছে ! তাই বা কি করে হয় ? দু'টি মানুষকে হুবহু এক মনে হল কেন - ইত্যাদি হাজার প্রশ্ন মনে হচ্ছে ।
অথচ লোকটা সম্পূর্ণ অন্য রকম দেখতে। অরবিন্দের ফর্সা দোহারা যেখানে এই লোকটা ডোম হলেও শীর্ণকায় , ঠিক কেমন অদ্ভুতুড়ে।
নিকটে গিয়ে প্রশ্ন করল - শ্মশান ঘাট কোন দিকে বলতে পার ?
এই রাতের বেলা অন্ধকারে পথ ঘাট ঠিক চেনা যায় না । এমনকি সামনের ডোমকেও দেখা যাচ্ছে না । শ্মশান ঘাট কথাটা শুনে লোকটা সাদা সাদা দাঁত বের করে একচোট হাসল ।
রুদ্রর মনে হল তার সম্মুখে দু পাটি দাঁত তাকে চিবিয়ে খেতে আসছে ।
আবারও একই প্রশ্ন করল রুদ্র ।
- কিছু বলছ না যে ? শ্মশান ঘাটের পথটা কোনদিকে ?
লোকটা আড়ালে সরে গিয়ে দাঁড়াল । পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে দেশলাই জ্বালালো । বিড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে গেলে রুদ্র তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল ।
অরবিন্দ সরখেল । হ্যাঁ, অরবিন্দ সরখেলই তো ! পরিস্কার মনে পড়ছে বাড়িতে যে লোকটা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কথা বলছিল ; সে হঠাৎ এমন পাল্টি খেতে পারে ভাবাই যায় না ।
মনে সাহস এনে রুদ্র এবার ধমকের সুরে বলল - কে তুমি ? তোমাকে তো আমি চিনি । তুমিই তো অরবিন্দ সরখেল ।
বলে ফোন বের করে ওর নাম্বারে ডায়াল করল । এখনই বোঝা যাবে । ফোন বেজৈ উঠলে সব ধরা পড়ে যাবে ।
ফোন বাজল তবে তার সম্মুখস্থ লোকটার থেকে নয় । আপর প্রান্ত ' হ্যালো ' বলতেই রুদ্র ভয়ে ফোন কেটে দিল।
এখন সামনে যে রয়েছে তার সঙ্গে মোকাবিলা হয়ে যাক ; পরে না হয় ফোনে 'সরি' বলবে ।
রুদ্র লোকটার দিকে এগিয়ে গেল । সে যচ এগোয় ; ওই ডোম ততই পিছিয়ে যায় । কেমন এক সম্মোহন করা পরিবেশ । রুদ্রর জেদ চেপে গেল । সে আরও জোরে তার দিকে এগোতে লাগল । আর সেই ডোম ঠিক তত জোরে পিছোতে লাগল ।
এই এগোনো পিছানোর খেলায় রুদ্র না ডোম কে পরাজিত হল তা ভবিষ্যৎ বলবে ।
এগিয়ে যেতে যেতে রুদ্র শ্মশান ঘাটে পৌঁছে গেল । এক ডজন চিতা জ্বলছে । অথচ কেউ কোত্থাও নেই । শুধু প্রাণটুকু নিয়ে দুইটি জীবের লুকোচুরি খেলা চলছে। এমন সময় রুদ্রর পকেটের ফোনে রিং হল । বেশ কিছূক্ষণ বেজে তা আপনা-আপনি কেটে গেল । রুদ্র কি তা শুনতে পায়নি ? না কি অসম্ভব জেদের বশবর্তী হয়ে রুদ্র ইচ্থে করেই ফোন ওঠায়নি ?
চিতায় চিতায় ডজন খানেক শব পুড়ছে। পোড়া মাংসের গন্ধে চারিদিকে এক অদ্ভুত ধরণের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সেই ডোম শববাহী গাড়ি থেকে রুদ্রর মাসীর লাশ কাঁধে নিয়ে একটা চিতায় ফেলে দিল ।
রুদ্র ঝাঁঝিয়ে উঠল ।
- মুখাগ্নি করা হল না ; আর তুমি দেহ চিতায় ছুঁড়ে দিলে কেন ?
পুনরায় দু"পাটি শ্বেতশুভ্র দাঁত বের করে ডোম হাসল ।
- এ তো বে-ওয়ারিশ লাশ ! কে মুখাগ্নি করবে ? তুমি ?
রুদ্রর আপাদমস্তক রাগে যেন লাল হয়ে গেল ।
- বে-ওয়ারিশ হতে যাবে কোন দুঃখে ? উনি আমার মাসীমা । আমি তার মুগাগ্নি করব ।
এমন সময় ফোনটা আবার বেজে উঠল । এবার রুদ্র ফোন তুলে বলল - মি; সরখেল?
অরবিন্দ সরখেল বলল - এত রাতে ফোন করেছিলেন কেন ? কোন বিপদ আপদ হয়নি তো ?
- মি: সরখেল, আপনি কোথায় ?
- কেন? আমার বাড়িতে !
রুদ্রর মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না । অপর প্রান্তের লোকটি তখন বলে যাচ্ছে - ছেড়ে দিন মশাই, নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসুন । ও যা করছে করতে দিন । অযথা ভুতপ্রেতের পাল্লায় পড়েন কেন ?
রুদ্র বাকরুদ্ধ । রাতের নি:সীম আঁধার তাকে যেন ইতিমধ্যে গ্রাস করে ফেলেছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে জ্বলন্ত চিতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।
সে নাভিমূল থেকে একটা আর্ত চিৎকার করে অন্ধকার নিস্তব্ধ রাত্রিকে খানখান করতে লাগল । অদূরে সেই ডোম আরও জোরে গলা ফাটিয়ে বলল - আয়, মুখাগ্নি করবি না ?
( ক্রমশ )
