Maheshwar Maji

Abstract

3  

Maheshwar Maji

Abstract

লক্ষ্মণরেখা

লক্ষ্মণরেখা

11 mins
730


ডাক্তারবাবু প্রথমে রেখাকে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। সেগুলো শোনার পর বলে উঠলেন, তোমাকে মাথায় সিন্দুর লাগানো চলবে না। সিন্দুর নির্মীত রাসায়নিক পদার্থে তোমার হাই এলার্জি রয়েছে।

ত্বকের ঘা শুকোনোর জন্য কয়েকটা ঔষুধ লিখে দিলাম। সময় মত পরিস্কার করে লাগাবে। আর খুস্কির জন্য একটা স্যাম্পু লিখলাম। রোজ মাথাটা একবার করে ধুয়ে নেবে। আর এই ট্যাবলেটগুলো রাতে ঘুমোবার আগে একটা করে খাবে।

এক সপ্তাহের ভেতরেই সমস্যাগুলো চলে যাবে।মাথা ব্যথা, ঘুম ঠিকমত না হওয়ার পিছনে,ওই সিন্দুরের দুষ্প্রভাব একমাত্র দায়ি। তাই সিন্দুরের ছোঁয়া তোমাকে একেবারেই এড়িয়ে চলতে হবে। তা সত্ত্বেও যদি না মানো। তোমার শরীরে ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে। তার জন্য কিন্তু আমাকে দোষ দেওয়া চলবে না। আপনার স্বামী সাথে এলে ভাল হত।বুঝিয়ে বলে দিতাম। যেহেতু আসেননি।তাই সেটা তোমাকেই করতে হবে।

এবার তুমি আসতে পারো।

রাতের দিকে রেখা ডাক্তারবাবুর সমস্ত কথাগুলো লক্ষ্মণকে ফোন করে বলল।

লক্ষ্মণ পরিস্কারভাবে জবাব দিল, তাতে কী হয়েছে?...ডাক্তার যখন মানা করেছেন। তখন নিশ্চয়ই উপযুক্ত কারণ আছে। তাই ওই সিন্দুর, টিন্দুর লাগাতে যেও না।

রেখা মিনমিনে সুরে বলতে লাগল, একি কথা গো!...স্বামীর নামে সিন্দুর পরা বারণ!!...এ কেমন হতভাগী স্ত্রী গো আমি?

লক্ষ্মণ হেসে উত্তর দিল,ভালবাসা এবং বিশ্বাসটাই হল সম্পর্কের মূল স্তম্ভ। বাকি সমস্ত শৃঙ্গার লোক দেখানো। নিজেকে পরিপাটি করার জন্য। এর বেশি কিচ্ছু না। বাজে চিন্তাই একদম মন খারাপ করবে না। মেডিসিনগুলো ঠিকঠাক ব্যবহার করো। আমি আর আঠাশ দিন বাদেই ফিরছি। এইমাত্র মুম্বাই থেকে জাহাজে উঠলাম। ট্রম্বেতে পৌঁছে তোমায় ফোন করব।

শাশুড়ীমায়ের উপবাস করা একদম বারণ। তাই রেখাকেই এখন পুজো, আচারের সমস্ত দায়িত্ব নিতে হয়েছে।

সকলকে উত্তর দিতে, দিতে এই কদিনে একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছে।

আজ তো শিব মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুর পর্যন্ত রেখার খালি সিঁথির দিকে তাকিয়ে অবাকভাবে বলউঠলেন,একি মা!..তোমার মাথায় দৈবসাক্ষী সিন্দুরের অল্প ছোঁয়াও নেই!!...অথচ পুজো,পাশা করছ?...মনে এত ভক্তি!!...আর আর্যরীতি মানো না।...কেন..মা?

পুরোহিতের এমন কথা শুনে রেখার দুচোখ অভিমানে ভিজে উঠে, সব ওই দয়াময় ঈশ্বরের খেলা ঠাকুরমশাই। জানি না কোন পাপের শাস্তি উনি ধার্য করেছেন!...তাই তো স্বামী থাকতেও আজ আমার মাথা শূণ্য।

পুরোহিত মশাই বুঝতে পেরে বলে উঠলেন,ও বুঝেছি।...নিশ্চয়ই ডাক্তারবাবু মানা করেছেন...তাইতো?অনেকেরই এরকম সমস্যা হয়।আজকালকার অসাধু ব্যবসায়ীর দায়ে হিন্দু নারীরা সুহাগিনী হওয়ার সৌভাগ্যটুকু পর্যন্ত হারাতে বসেছে।

চিন্তা করো না মা। ভগবানের কাছে আশির্বাদ চাও। যেন তিনি সর্বদা তোমার স্বামীকে দীর্ঘজীবি করেন।


রেখার শ্বশুরমশাই একটু ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,একি বউমা। তোমার মাথা,টাথা খারাপ হয়েছে নাকি?...তুমি আবার সিন্দুর তুলেছ মাথায়?

ডাক্তার তোমায় মানা করেছেন না?

রেখা মাথা নিচু করে অপরাধীর সুরে বলতে লাগল, আমি আর পারছি না বাবা।সব সময় দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। আপনার ছেলের অমঙ্গলের চিন্তায় আমার ঘুম আসে না। খালি ভাবছি, হয়ত আমার এই অনিয়মের কারণে ওর কিছু হয়ে যাবে। যতই হোক স্ত্রীর মাথার সিন্দুর তো স্বামীর মঙ্গল কামনার্থে।

মাঝ সমুদ্রে সে একা ভেসে বেড়াচ্ছে!

কতরকমেপ বিপদ সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার বিশ্বাস আমার এই সিন্দুর তাকে প্রতিপল রক্ষা করবে।

আগে ও নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরুক তারপর থেকে না হয় ছেড়ে দেব।

তার শাশুড়ী মাও যোগ দিয়ে বলে উঠলেন, রেখার কথাগুলো অবহেলা করার মত নয়। আমি মানছি। এখন ওর মাথায় সিন্দুর ঠেকানো মানা। কিন্তু একজন স্ত্রীর কাছে এর চেয়ে বড় অপমানকর জিনিস আর দ্বিতীয়টি নেই।

ওর যখন মন মানতে চাইছে না। বাঁধা দেওয়াটা ভাল হবে না। লক্ষ্মণ ফিরে আসুক। তারপর ও ওর মত করে বোঝাবে।

ব্যাপারটা তার শ্বশুরমশাই-এর একদম মনঃপূত হল না। কিন্তু জোর করে কিছু বলতেও পারলেন না।

তিনি জানেন। এ সব ক্ষেত্রে মেয়েদের সাথে তর্ক করেও কোন সুফল হয় না।

বরং অশান্তির সৃষ্টি হবে।

এসব তিনি একদম চান না। তাই দমিত অবস্থাতেই বাইরে ইজি চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে পড়লেন।


উপগ্রহ চিত্র থেকে জানা গেছে। এই অবস্থায় জাহাজ ছাড়া মানে বিপদকে মাথায় নিয়ে বয়ে বেড়ান।

ওদিকে কনসাইমেন্ট তাড়াতাড়ি মুম্বই উপকূলে পৌঁছানোর তাগাদা।

লক্ষ্মণের কাজটা হল প্রকৃতির মেজাজ লক্ষ্য করে জাহাজের ক্যাপ্টানকে ঠিকমত অবগত করানো। যাতে জাহাজটি নির্বিঘ্নে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারে।

কোলকাতায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশুনো করার পর হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের অধীনে এই চাকরীটা গ্রহণ করেছে লক্ষ্মণ।

কখনো আসাম,ভাইজাক আবার চেন্নাই-এ ডাক পড়ে। যখন ডিউটি পড়ে।লাগাতার তিন মাস ছুটি পাওয়া যায় না। তারপর একটা দীর্ঘ ছুটির প্রাপ্তিযোগ ঘটে। সেই সময়টা তখন তার একদম সুখের।আগে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডাবাজি আর খাওয়া-দাওয়া চলত।

দামি,দামি মদ ক্যান্টিন থেকে বাগিয়ে আনতো। বন্ধুরাও খুশি হত।

সেটা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার জীবনে রেখার আগমন হওয়ার পর থেকে। দেখাশুনো করেই বিয়েটা হয়েছিল। এত শিক্ষিতা একজন মেয়ে হয়ে যে ধর্মকে এতখানি মন থেকে মানে!!

...লক্ষ্মণ সেই দেখে অবাক হয়ে যায়।দর্শণ শাস্ত্রে স্নাতক রেখা। জীবনকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে শেখানোর মেয়ে রেখা।

অথচ সেই কিনা কাল্পনিক ধ্যান, ধারণায় বিশ্বাসী?

এযে সেই আটলান্টিক আর আর্কেটিক মহাসাগরের জলমিশ্রণের মত বিশ্ময়কর ঘটনা !!

বড্ড ভালবাসতে জানে রেখা। লক্ষ্মণকে কয়েকদিনের সোহাগেই বড় আপন ডোরে বেঁধে ফেলেছে। এ বাঁধন ছিড়তে কোন সুপুরুষের মন চায় না।

কর্তব্যের তাগিদে ছাড়তে হয়। তবে এখন বাড়ি ফেরার জন্য মনটা বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আগে তিন, চার মাস সময়টা সমুদ্রের জল আর আকাশের গাঙচিল দেখেই হুট করে পেরিয়ে যেত।

আর এখন প্রতিদিন ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ আটকে যায়।

আগে মনের ভিতর একটা উদ্যত সাহসী রাক্ষস, সবসময় জেগে থাকত।

তাই সফেন সমুদ্রের টেউ দেখে বুকে অদ্ভুত রকমের রোমাঞ্চ সৃষ্টি হত।

এখন মাঝে, মাঝে ভয় লাগে।

রেখার কথা মনে করে বাঁচার সাধ হয়।ভালবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় পুলকিত হয়ে ওঠে মন, প্রাণ।

এটাকে ঠিক ভীরুতা বলা ঠিক হবে না। এটা হল বিচক্ষণতা। বিচার করে পা বাড়ানো। এসকল মানুষগুলোই জীবনযুদ্ধে বেশি জয়ী হয়। মনে শুধু সাহস থাকলেই হয় না। তারসাথে অল্প ভয়ও থাকতে হয়। তবেই জেতা সম্ভব।এই ভয়টাই আনে বিচক্ষণতা। যার দ্বারা মহাসংগ্রামও জয় করা যায়।

সেটা আসে একটা সুস্থ পরিবার তথা একজন স্ত্রীর কাছ থেকে।


ছোটখাটো একটা ঘূর্ণবলয় দেখে ক্যাপ্টেনকে আজকের মত ট্রম্বেতে থাকার অনুরোধ করেছিল লক্ষ্মণ।

সর্দারজী কথাটাই তেমন আমল দেননি। তাই ইঞ্জিন স্টার্ট করেছিলেন।

ঘন্টা দুয়েক যাওয়ার পরই এলার্ম বেজে উঠল। বিপদ সংকেত।

একটা জোরালো ঘূর্ণিঝড় ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি করে এদিকেই এগিয়ে আসছে।

কী হবে কারু জানা নেই।

ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রাণহানী ঘটাটাও স্বাভাবিক।

লক্ষ্মণের বুকটা জোরে,জোরে বাজতে শুরু করে। দুচোখে তার অনেক স্বপ্ন!

রেখার জন্য অন্তত তাকে বাঁচতেই হবে। মরতে হলে মরবে। তবু সে কেবলমাত্র রেখার কোলে মাথা রেখে।

ওর বুকেই লক্ষ্মণ মানুষের কল্পিত স্বর্গকে প্রত্যক্ষ করেছে। অলীক সুখের সন্ধান পেয়েছে। সেখানে সে মরেও শান্তি পাবে।

এই গভীর অতলান্ত সমুদ্রে, তিমি আর হাঙরের ভোজ্যবস্তু হয়ে সে মোটেও মরতে চায় না।

তাই সে সেভিং বোটের মত বিকল্প কিছু ভাবতে শুরু করল।

সে যখন বিপদ নিয়ে খেলতে শিখেছে তখন বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার কৌশলটাও জানে।


রেখার শুকিয়ে যাওয়া ঘা টা আবার দেখা দিল। মাথার যন্ত্রণাটাও ফিরে এসেছে।

এদিকে দুদিন হয়ে গেছে। লক্ষ্মণের কোন রকম কুশল সংবাদ আসেনি।সেইজন্য মনটাও বিচলিত হয়ে উঠেছে।খাওয়াতে রুচি নেই। অকারণে চোখে জল এসে পড়ে।

কোন কিছুই ভাল লাগে না। ঠাকুর ঘরে মন বসে না। সবসময় একটা আশংকা তাকে কাবু করে দিচ্ছে।

তার শ্বশুরমশাই হেড অফিসে ফোন করেছিলেন। একটা ছোটখাটো দূর্ঘটনা নাকি ঘটেছে। তবে বিপদের কিছু খবর আসেনি।

জাহাজের সকল স্টাফ অল্প, স্বল্প আহত হলেও নিহতের কোন খবর আসেনি।

জাহাজটাকে উদ্ধার করার জন্য টিম গেছে। চিন্তার কোন কারণ নেই।

তিনি এসব কথা বাড়িতে কাউকে বলেননি। মেয়ে মানুষের ধৈর্য কম। অযথা চিন্তা করবে।

আর বউমার তো এমনই যা অবস্থা,এসব শুনলে আবার হার্টফেল না করে বসে!

তাই তিনি বেমালুম চেপে গেছেন।

মুখে নকল হাসি ছড়িয়ে স্ত্রী এবং বউমাকে অনবরত সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন।

আসলে যে তার অন্তরেও চিন্তার ঢেউ উথল,পাথাল করছে।

আর কত ধৈর্য ধরে থাকবেন?


জাহাজের মাস্তুলটা প্রায় ভেঙে পড়েছে।অনেক কাঁচা তেল সমুদ্রের জলে ভেসে গেছে। অর্ধেকের মত ক্ষতি হলেও বাকিটুকু উদ্ধার করে জাহাজটাকে মুম্বাই উপকুলে আনা হয়েছে।

একজন ইঞ্জিনিয়ারকে এখনো উদ্ধার করা যায়নি। খোঁজ করা হচ্ছে। সাথে সেভিং বোট আছে। তাই বেঁচে যাওয়ার নিশ্চয়তা বেশি। তবে আটচল্লিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেলে তৃষ্ণায় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। উদ্ধারকারীরা জোর তল্লাশি চালাচ্ছেন।

ইঞ্জিনিয়ারটি একজন বাঙালি। নাম তার লছমন।

লক্ষ্মণ ভেবেই নিয়েছিল। এই যাত্রাই তাকে দাঁড় টেনে উপকূলে পৌঁছাতে হবে।

সেইমত মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছিল।

খাবার বলতে সামদ্রীক কিছু মাছ হাতের কৌশলে ধরে মুখটা বাদে চিবিয়ে খাওয়া।

এসব ব্যাপারে সে সাতদিনের একটা স্পেশাল ট্রেনিং নিয়েছিল। চেন্নাই-এ থাকাকালীন।

অস্ট্রেলিয়া থেকে টিমটা এসেছিল। তারা মাত্র এগারোজন ইঞ্জিনিয়ার ট্রেনিংটা নিয়েছিল। কী করে আপাদকালীন পরিস্তিতিতে মাঝ সমুদ্র থেকে উপকূলে পৌছাবে? সেইনিয়ে।

তখনই ট্রেনাররা শিখিয়ে ছিলেন সামুদ্রীক নোনা জলকে কীভাবে পানীয়যোগ্য করে বেঁচে থাকা যায়?

তখন থেকে লক্ষ্মণ এরকরকম সাথে করেই ওই ক্যামিক্যালটা নিয়ে ঘুরত। এক বালতির মত জলে দশ ফোটা মিশিয়ে সূর্যের আলোয় আধঘন্টা রেখে দিলে নুনটা নিচে থিতিয়ে যায়। বাকি জলটা মিষ্টি না হলেও পান করে বেঁচে থাকা যায়।

বিশেষ করে রেখা তার জীবনে আশার পর থেকে ক্যামিক্যালটা সাথে নিয়েই ঘোরে।

তবে এক্ষেত্রে দিন দশ পেরিয়ে গেলে আর কিন্তু বাঁচার চান্স থাকে না। তারমধ্যে উদ্ধারকারীর দল বা নিজে উপকুল পৌঁছাতে পারলে ভাল।

লক্ষ্মণ জাহাজ ছাড়ার সময় একটা জিপিএস যন্ত্র সাথে নিয়েছিল। এখন সেটা ঠিকমত কাজ করছে না। হিসেব করে দেখল। বোটিং করে সঠিক দিশা ধরে মোটামুটি তিনদিনে মুম্বাই পৌছানো যাবে ।

নিজের অনুমানকে কাজে লাগিয়ে জাহাজের পথ ধরেই এগুচ্ছিল।

তখনি একদল উদ্ধারকারীর চিৎকার ভেসে আসে।তারা এদিকেই আসছেন।তাদেকে দেখে লক্ষ্মণের বুকটা আনন্দে নেচে উঠেছিল।

অদ্ভুত পাগল ধরণের একটা মেয়ে হল রেখা।

আজ সকাল থেকে পণ নিয়েছে।তার স্বামীর যতক্ষণ পর্যন্ত না কুশল সংবাদ পাচ্ছে।জলগ্রহণ করবে না।

ঠাকুর ঘরে বসে একমনে মালা জপতে লেগে গেছে। আজ সে একরকম পরীক্ষায় বসেছে যেন!

ঐশ্বরিক শক্তি আর আত্মীক বিশ্বাস। কোনটা জেতে?...না সবকিছুর পরাজয় ঘটে মিথ্যার দম্ভটাই জিতবে?...তাই যদি হয় ...তবে হোক।সে এর শেষ দেখেই ছাড়বে।

মায়ের পায়ের ঠেকানো সিন্দুর কী এমনিই রঙিন কোন গুড়ো নাকি বিশ্বাসের আর এক নাম?

সে এক কঠিন মনস্তাত্বিক পরীক্ষায় সকাল থেকে বসে পড়েছে।

এদিকে তার চিন্তাই শ্বশুরমশাই বার,বার পায়চারী করছেন। ডেকেও সাড়া পাননি। তার শাশুড়ীও ধীর পায়ে বাকি কাজগুলো সাঙ্গ করছেন।

তার মনেও পুত্রশোকের ছায়া ঘনীভূত হয়ে উঠেছে।

এমন সময়, বিকেলের দিকে বাড়ির ল্যান্ড ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল।

ওপ্রান্তে লক্ষ্মণের পরিস্কার গলার আওয়াজ শোনা গেল।

তার বাবা ছেলেকে বউমার সমস্ত পাগলামী কাঁদতে,কাঁদতে বলে উঠলেন।

লক্ষ্মণ জানে। এটা অন্য কারু চোখে পাগলামী। কেউ, কেউ ঈশ্বর ভক্তি বলেও ভাবতে পারেন। লক্ষ্মণের কাছে এটাই নর,নারীর মধ্যে প্রকৃত প্রেম।

একে,অন্যের চিন্তায় কাতর হওয়া প্রেমের নামান্তর। এই বিশ্বাস এই চাওয়াটা অনেক সময় সব বাঁধা উপেক্ষা করে একে,অপরকে বাঁচিয়ে তোলে।অনেকেই সেই শক্তিটাকে ঐশ্বরিক বলে ভাবেন। সব নিজের, নিজের ব্যাখ্যা।

      খবর পেয়েই প্রণাম করে রেখা ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে ফোনটা ধরল।

ও প্রান্তে লক্ষ্মণ বলে উঠল, এবার চাট্টি খেয়ে নাও। আমি দু,একদিনের ভেতরেই ফিরছি।

এদিকে ফোন হাতেই রেখা মাথা ঘুরিয়ে দুম করে অজ্ঞান অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেল।

হাই..হাই করে দৌঁড়ে এসে তার শ্বশুরমশাই তাকে দু হাতে তুলে খাটে শুইয়ে দিলেন।

ওদিকে ফোনের স্পীকারে তখনো লক্ষ্মণের আর্ত চিৎকার ভেসে আসছে। তার বাবা বুকের যন্ত্রণাকে মুঠোর বলে জড়ো করে রিসিভারটা খট করে নামিয়ে রাখলেন।

তারপর ডাক্তারকে তাড়াতাড়ি করে ফোন করে আসতে বললেন।

লক্ষ্মণ এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নার্সিংহোমে পৌঁছে দেখল রেখা বেডে শুয়ে আছে।

সকলেই উপস্থিত আছেন। লক্ষ্মণকে দেখে সবাই ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন।

লক্ষ্মণ ব্যস্ত সহকারে বলে উঠল,হঠাৎ করে রেখার কী হল?

তার বাবা চশ্মাটা মুছে বলে উঠলেন,আমি ঠিক জানি না। ডাক্তারবাবুও পরিস্কার করে কিছু বলতে পারছেন না। কয়েকটা পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। রিপোর্টগুলো আসার পরই কিছু বলতে পারবেন। রাতের সময় ঘুমের ঔষুধ দেওয়া হয়েছে। ওর মস্তিস্কের নাকি প্রচুর বিশ্রামের প্রয়োজন। তাই এখনো পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে।জোর করে ওঠাতে মানা করে গেছেন।

লক্ষ্মণ সবাইকে সান্ত্বণা দিয়ে বলে উঠল,..এত চিন্তা করার কিছু নেই।রেখা খুব শীঘ্রই ভাল হয়ে উঠবে। আমি বরং ভেতরে গিয়ে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলছি।


রেখা দু মাসের গর্ভবতী। তবে ভ্রূণটা আদৌ বেঁচে আছে কিনা সে ব্যাপারে ডাক্তার নিশ্চিত হতে পারছেন না।

সেইজন্য একবার ইউ.এস.জি করা একান্ত প্রয়োজন।

লক্ষ্মণ সব কথা শুনে বলে উঠল,কিন্তু ওর পিরিয়ড তো আগের মাসেও হয়েছিল।

ডাক্তারবাবু একটু হেসে জবাব দিলেন, কিছু, কিছু সময় ব্যতিক্রমও দেখা যায়।সিমটমগুলোও রেয়ার টাইপের হয়।বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে।

ওর মাথা ব্যথা,ঘুম না হওয়া,বিচলিত অনুভব করা এসব ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্টের এইসব সিমটমই দেখা যায়। পরীক্ষা না করলে একদম বোঝা যায় না। সতেরো সপ্তাহ শেষে বোঝা যায় সে গর্ভবতী। তার আগে সে নিজেও সিওর হতে পারে না। পিরিয়ডের সময় ব্লিডিং হয়। তবে তা একটু কম। কেউ ধরতে পারে না।

সেটাই হয়েছে আপনার স্ত্রীর ক্ষেত্রে।

যেহেতু আপনারা কেউ এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না। সেহেতু এই সময় যে সব সাবধানতা নেওয়া দরকার সেসব নেওয়া হয় না। তাই এসব ক্ষেত্রে প্রথম ভ্রূণটা নষ্ট

হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।দ্বিতীয়বার সেইমত ব্যবস্থা নিতে হয়।

...তার উপর উনি আবার সারাদিন উপোশ করে ছিলেন। ব্লাডে সুগার লেবেল একদম কমে যাওয়াতে মাথা ঘুরে উপুড় হয়ে পড়েছিলেন। আঘাতটা পেটে ভালরকম লেগেছে। ওনার মেডিসিন হিস্ট্রি চেক করে দেখলাম।আগের ডাক্তারবাবু কয়েকটা মাইগ্রেনের ট্যাব লিখেছিলেন। দুদিনের বেশি খাননি বলেই একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ওগুলো সাতদিন খেয়ে ফেললে এতদিন উনার ব্লিডিং শুরু হয়ে যেত।

আপনি বরং তাড়াতাড়ি করে আপনার স্ত্রীকে ল্যাবে নিয়ে আসুন। সোনোগ্রাফির ডাক্তারবাবুকে বলে দিচ্ছি।উনি তাড়াতাড়ির মধ্যে রিপোর্টটা করে দেবেন।

লক্ষ্মণের তো লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠল। রেখা বাচ্চা মেয়ের মত ভয় পেয়ে তার বুকটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে মুখটা লুকিয়ে রেখেছে।

কিছুতেই ল্যাবে ঢুকতে চাইছে না। তার নাকি কিছুই হয়নি। ডাক্তারবাবু শুধু, শুধু হয়রানি করছেন।

লক্ষ্মণ সাথে গিয়ে পাশে বসল।তবে গিয়ে রেহায়। আধঘন্টার মধ্যেই লক্ষ্মণ ডাক্তারের কাছে ফিরে এলো।

ডাক্তারবাবু রিপোর্টটা দেখে বলে উঠলেন, মুভমেন্ট অল্প পাওয়া গেছে। আশা করা যাচ্ছে, নষ্ট হয়নি। তবে একদম সিওর হতে পারছি না। অনেক সময় দু, চারদিন পর হয়ত দেখা যায়।কেসটা উল্টে গেল। তবে সাবধানে রাখবেন। এই ঔষুধগুলো সময় করে খাওয়ান। ভ্রুনটাকে পুষ্ট করবে।...আর সাবধানে কাজ করতে বলবেন।মিলিত হওয়ার চেষ্টা এখন না করায় ভাল।পুষ্টিকর খাবার খেতে বলুন। আর চিন্তা কম করে ঠিকমত ঘুমোতে বলুন।

এক সপ্তাহ হলে আর একবার আসুন।ফাইন্যালি রিপোর্ট করে আপনাকে রেজা‌ল্টটা জানিয়ে দেব।


আজ রেখা একরকম জোর করেই লক্ষ্মণকে আঁকড়ে ধরে বলে উঠল, আজ তিনদিন হয়ে গেল। একবারও আদর করে আমায় টানলে না।কেন..কীসের এত অভিমান তোমার?...আমার উপর রাগ করেছ বুঝি?

লক্ষ্মণ আস্তে করে পেটের চাপটা সরিয়ে বলে উঠল, তোমার উপর রাগ করেছি আমি?..পাগল নাকি?

---তাহলে আমায় তুমি আদর করছো না কেন? আজ তিনদিন হয়ে গেল। কপালে একটা চুমু এঁকে মাথায় বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছ যে!! এরকম কেন করছ তুমি? আমার বুঝি আদর খেতে মন চাই না? আর কিচ্ছুটি চাই না আমি। শুধু তোমার বুকের উপর শুয়ে তোমাকে বিভোরভাবে দেখতে চাই। এইটুকুও কী সুযোগ তুমি আমায় দেবে না?

লক্ষ্মণ আসল কারণটা সবার কাছে চেপে গেছে। রেখার গর্ভবতী হওয়ার খবরটা এখন জানাতে চায়নি। ডাক্তারের মুখে ফাইন্যালি রিপোর্টটা না জানা অব্দি চুপ থাকার মনস্থির করেছে।

আজ আর থাকতে পারল না।

না হলে শুধু, শুধু রেখা মন খারাপ করবে। দুশ্চিন্তা বাড়াবে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে।

তাই লক্ষ্মণ বলে উঠল,তুমি হয়ত জানো না রেখা। আসলে তুমি গর্ভবতী।সেইজন্যই আমি তোমাকে এখন সবসময় চোখে, চোখে রাখছি।ভেবেছিলাম,পরে বলব। আর একবার সোনোগ্রাফির রিপোর্টটা পাওয়ার পর।

...যদি খারাপ কিছু খবর আসে।তখন সবাই ভেঙে পড়বে। তাই বলতে চাইনি।আজ তোমাকে সত্যিটা বললাম।সেইজন্যই তোমার পেটের চাপটা বার,বার এড়িয়ে যাচ্ছি।

রেখার মুখটা খুশিতে উজ্বল হয়ে উঠল,তুমি সত্যি বলছ?

---হ্যাঁ.. গো..হ্যা। এত উত্তেজিত হও না। তিনদিন পর রিপোর্ট করতে হবে। তারপর আসল ব্যাপারটা জানা যাবে।

----সেকি!...আমি গর্ভবতী আর আমি নিজে সে কথা জানব না?

----তোমারটা নাকি ব্যতিক্রম। এ সব ক্ষেত্রে প্রায় পাঁচ মাসের পর প্রেগন্যান্টের সিমটমগুলো বোঝা যায়। সময় মত জানতে পারলাম তাই রক্ষে। না হলে এসব ক্ষেত্রে প্রথম ভ্রূণটা নষ্টই হয়ে যায়। জানতে না পারার কারণে।

রেখা আস্তে করে লক্ষ্মণের বুকে মাথা রেখে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠল, ঈশ্বর আমাকে এতবড় শাস্তি দেবেন না, জানি। একে আমি জিতিয়ে পৃথিবীর আলো দেখাতে চাই গো।

লক্ষ্মণ ওর চুলে বিলি কেটে বলে উঠল, নিশ্চয়ই দেখবে।


---পুরোহিতমশাই আজ আমার ভাবী সন্তানের মঙ্গল কামনার্থে পুজো দিন তো। ও যেন ভালমত এই পৃথিবীতে আসতে পারে।

----আচ্ছা মা। তুমি পুজোর সামগ্রী রাখো। আমি শুরু করছি।

পুজো শেষে পুরোহিতমশাই রেখাকে ডেকে বললেন, এই নাও মা। তোমার সিঁথির জন্য আমি এই সিন্দুরটা বাড়িতে ফিটকিরি, হলুদ আর চন্দন ঘষে কেশর সহযোগে তৈরি করেছি।

রঙটা এত গাঢ় না হলেও তোমার ত্বকের কোন ক্ষতি করবে না।

পুজোর ফুল ঠেকিয়ে দিয়েছি। আজ থেকে এটা তুমি বিনা বাঁধায় মাথায় তুলতে পারো। কোন পাপ লাগবে না।

হিন্দু সধবা নারীদের শূণ্য সিঁথি দেখতে যেমন ভাল লাগে না। তেমনি বৈবাহিক সম্পর্কেও নানা রকম বিঘ্ন ঘটে।

রাঙা সিঁথির মধ্যে এক অদ্ভুত ঐশ্বরিক শক্তি লুকিয়ে থাকে। যা দেখে স্বামীর মন স্ত্রীর প্রতি সর্বদা ঢলে থাকে।

সম্পর্ক নিবীড়তর হয়।

সংসারে সুখ এবং সমৃদ্ধি বর্ধিত হয়।

স্বামী স্বৈরাচারি,বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

পর নারী আকৃষ্টের পূর্বে নিজের স্ত্রীর মাথায় দেওয়া সিন্দুরের কথা মনে পড়ে যায়।

মনের মধ্যে অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রীর মাথায় লক্ষ্মণরেখাটি দীপ্তমান হয়ে ওঠে।

এ শুধু এক চিলতে সিন্দুর নয় মা। এ হল স্বামীর মনে সংযত জীবনযাপনের একটা শক্তিশালি লক্ষ্মণরেখা। একে সর্বদা, সম্মানের সহিত ধারণ করো।

    রেখা বাড়ি ফিরে দেখল তার সোনোগ্রাফি রিপোর্টটা লক্ষ্মণ হাসিমুখে খুটিয়ে দেখতে বসেছে।

ওইটুকু চিত্রে সে যেন তার সন্তানের পুরো চেহারাটাই পড়ে নিল।

রেখা মনে, মনে অল্প হাসল।

মুখে বলল, আগে প্রসাদটা নাও। তারপর স্বপ্ন দেখো কেমন!    


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract