লালী
লালী
একখানি রুমাল মুখে করে নিয়ে লালী ছুটতেই থাকে একটা গাড়ির পিছনে।ছুটছে তো ছুটছেই।গাড়িটিও তার গতিতে ছুটছে।হঠাৎ একটি প্যান্ডেলয়ালা বড় মাঠের কাছে গাড়িটি থামে।চুপচাপ বসে থাকে লালী।হয়তো কারও প্রতীক্ষায়!
লালীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মায়ের মৃতদেহটা।খুব কেঁদেছিল সেদিন লালী।সেই থেকে সে সবসময়ই কাঁদে ওই রাস্তার পাশে ঝুপড়িটার পাশে বসে।ওই ঝুপড়িটাতেই যে তার মা থাকতো।কিন্তু ওই অসভ্য,বর্বর মানুষগুলো তার মায়ের উপর অত্যাচার করে তাকে মেরে ফেলে।না-লালী কোন মানুষ নয়।কিন্তু তার মা একজন মানুষ।মা হওয়ার জন্য তো শুধু পেটে ধরতেই হয়না।সন্তান স্নেহে কাউকে ছোট থেকে সযত্নে লালিত করে তার অসুখ-বিসুখে সেবাযত্ন করে সুবিধা-অসুবিধাগুলি নিজের মনে করে দূর করতে পারলেই মা হওয়া যায়।ঠিক এভাবেই অনিমা মা হয়ে উঠেছিলো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা একটি কুকুরছানার।
ঝুপড়িতে যদি কোনদিন ভাত রান্না হয় ঝুপড়িবাসীরা সেই ভাতের ফ্যানটুকুও ফেলেনা।ঠিক তেমনই অনিমার মা,বাবা আর অনিমা সেই ফ্যানটুকু খেয়ে নিতো সকালের খাবার হিসাবে।কিন্তু সাত বছরের অনিমা মা,বাবার চোখ এড়িয়ে তার ভাগের অর্ধেক ফ্যান তার আদরের কুকুর ছানার জন্য নিয়ে লুকিয়ে খাওয়াতো।রাতে নিজের কাছে নিয়ে শুতো।ছোট্ট লালী তখনও ভাত খেতে শেখেনি।মা তাকে দুটি বিস্কুট দিলে একটা লালীকে জলে গুলে খাইয়ে নিজে একটা খেতো।এইভাবেই অনিমা আস্তে আস্তে লালীর মা হয়ে উঠেছিলো।
অনিমা যেখানেই যেত লালী তার সাথে যেত।একদিন রাতে এক বিয়েবাড়িতে অনেক খাবার ফেলে দেওয়ায় অনিমা লালীকে নিয়ে যায় সেই খাবার খাওয়াতে।লালী তখন বেশ বড়।আর সেদিনই ঘটে লালীদের সংসারে এক অঘটন।এক মদ্যপ গাড়ি চালাতে চালাতে গাড়িটাকে তুলে দেয় কিছু ঝুপড়িবাসীদের ঘাড়ের উপর।অনেকের সাথে সেদিন অনিমার মা,বাপ ও চিরতরে চলে যান।এসব ঘটনার বিচার হয়না-কারন এদের টাকা নেই।অনিমা হয়ে যায় একা।আর তার পাহারাদার হয়ে ওঠে লালী।
ভিক্ষাবৃত্তিই একমাত্র উপায় অনিমার বেঁচে থাকা আর তার লালীকে বাঁচিয়ে রাখার।একটা রুটিও যদি কোনদিন জোগাড় করতে পারে অনিমা তার অর্ধেক লালীর আর অর্ধেক নিজে খায়।আর লালীটাও হয়েছে এমন যতক্ষণনা তার মা খাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে খাবারে মুখই লাগাবেনা সামনে নিয়ে অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে।
এখন অনিমার বয়স দশ।লালী বিন্দুমাত্র সময় অনিমাকে ছাড়েনা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময়টুকু ছাড়া।লালী লক্ষ্য করে এই ছোট্ট মেয়েটার উপর অনেকেরই লোলুপদৃষ্টি।কিন্তু সদা সতর্ক সে।এমন বিশ্বস্ত পাহারাদার মানুষ তো দূরহস্ত অন্য কোন পশুও হতে পারেনা।একদিন অনিমার খুব জ্বর হয়েছিলো।উঠতেই পারছিলোনা। লালী কোন দোকান থেকে একটা পাউরুটি চুরি করে অনিমার সামনে এনে রাখলে অনিমা ওকে দুর্বল শরীর নিয়েও খুব বোকেছিলো।সেদিন লালী অনিমার পায়ের উপর শুয়ে অনেক কেঁদেছিল।কথা হয়তো লালী বলতে পারেনি কিন্তু অনিমাকে সে বুঝিয়ে দিয়েছিলো তার দুর্বল শরীরে এই রুটিটা সে চুরি করতে বাধ্য হয়েছে এবং অনিমা এটা খেলে তার ভালো লাগবে।অনিমা একটা রুটির টুকরো জল দিয়ে খেয়ে আর একটি রুটি লালীর সামনে দেয়।লালী তার মায়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকে। তার রুটিতে সে মুখই দেয়না। অনিমা বুঝতে পেরে বলে,কি রে আর একটা খেতে হবে?লালী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।মানে একটা রুটির টুকরো খেলে হবেনা।অনিমাকে আরও এক টুকরো রুটি খেতে হবে। এইভাবেই একটা মানুষ ও একটা পশুর মধ্যে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যে বন্ধুত্বে কোন চাহিদা নেই আছে শুধু ভালোবাসা আর বিশ্বাস।
এমন অনেক পশু আছে যাদের কায়দা-কানুন সব মানুষের মত।অথচ অনেক মানুষ আছে যারা আজীiবন মানুষের মধ্য থেকেও মানুষের গুনাগুন রপ্ত করতে পারেনা।তাদের আচরণ হয় জঙ্গলে বাস করা পশুর সমতুল্য।
সেদিন রাতে লালী একটু সময়ের জন্য ঝুপড়ি ছেড়ে খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছিল।আর ঠিক তখনই মানুষ রুপী এক পশু ছোট অনিমার শরীরটাকে ছিড়ে খুবলে খায়। গরীব,অসহায়, দূর্বল অনিমা বাঁধা দিয়েও কিছু করতে পারেনি।সে বহুবার তার আদরের লালীর নাম ধরে ডেকেছে।সেই ডাকের আওয়াজ লালীর কর্ণগোচর হওয়ার সাথে সাথেই লালী তার মুখের খাবার ফেলে তার মায়ের কাছে উদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে চলে আসে।কিন্তু ততক্ষণে অনিমার যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে।লালী হাফাতে হাফাতে এসে যখন তার মায়ের কাছে দাঁড়ায় তখন তার মায়ের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন।অনিমা খুব কষ্টে তার একটি হাত লালীর গায়ে উঠিয়ে বলে,"লালী তুই এর প্রতিশোধ নিস।আমাকে তোর কাছ থেকে যে সরিয়ে দিলো তুইও তাকে এই পৃথিবীতে থাকতে দিবিনা।" আস্তে আস্তে অনিমার হাতটা নীচুতে পড়ে যায়।অনিমা তার আদরের লালীকে ছেড়ে চিরতরে চলে যায়।
তারপর কতকিছু লালী দেখেছে ওই ঝুপড়ির ঘরে।কত লোক এসেছে তার মাকে দেখতে,কত পুলিস এসেছে,আশেপাশের মানুষজনকে কত কথা জিজ্ঞাসা করছে পুলিস।কিন্তু লালী তো কথা বলতে পারেনা।তাই কেউ তাকে কোন কথায় জিজ্ঞাসা করেনি।সে চুপটি করে ঝুপড়ির বাইরে বসে আছে তার চোখ থেকে অবিরাম জল পরে চলেছে।লালী তার মায়ের মাথার কাছেই বসে ছিলো কিন্তু একজন পুলিস তাকে সেখান থেকে বের করে দিয়েছে।লালীর রাগ হলেও সে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।সে খুব ভালোভাবে ওই পুলিশটাকে লক্ষ্য করেছে।তাকে চিনে রেখেছে।তার মাকে একটা সাদা কাপড়ে বেঁধে নিয়ে যখন ভ্যানরিক্সাটা এগিয়ে চলেছে লালীও সেই ভ্যানরিক্সার পিছুপিছু যেয়ে দেখলো একটা বড় গেট দেওয়া বাড়ির মধ্যে ঢুকে তার মাকে একটা ঘরের তালা খুলে ঢুকিয়ে আবার তাতে তালা লাগিয়ে দেয়।লালী কি করে জানবে এবার তার মায়ের ছোট্ট শরীরটা কেটে ফালাফালা করবে।সে ভাবলো এটাই বুঝি এখন থেকে তার মায়ের থাকার জায়গা।যেখানে তার কোন প্রবেশাধিকার নেই।
লালী ফিরে এলো আবার সেই ঝুপড়িতে।ঘরের এদিকে ওদিকে ঘুরে ঘুরে গন্ধ শুকতে শুকতে সে একটি রুমাল দেখতে পেলো।বিছানায় যে গন্ধ রুমালটিতেও সেই একই গন্ধ পেলো।সে রুমালটি মুখে করে বাইরে নিয়ে এসে সারাটা রাত ওটাকে সাথে নিয়েই রাত কাটিয়ে দিলো।না সে খাবারের সন্ধানে গেলো না কেউ তাকে ওই জায়গা থেকে সরাতে পারলো।
সকাল তখন প্রায় দশটা হবে। একজন গাড়ি করে এলেন।লালী তখন ঘুমাচ্ছে।লোকটি ঝুপড়ির কাছে এক চায়ের দোকানে চা খেতে যেয়ে কাল ঝুপড়ির ভিতরে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা শুনে বেশ দুঃখিত হলেন।দেশের পরিস্থিতি দিনকে দিন কোথায় পৌঁছাচ্ছে তা নিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।এই চিৎকার আর হৈ-হট্টগোলের মধ্যে লালীর গেলো ঘুম ভেঙ্গে।আর ঠিক তখনই লালীর সম্মুখ দিয়েই লোকটি তার গাড়ির উর্দেশ্যে রওনা দিলো।মুহূর্তে লালীর চোখ, কান আর নাক সজাগ হয়ে উঠলো।সে লোকটির পিছনে ডাকতে ডাকতে গাড়ির দরজা পর্যন্ত যেয়ে লোকটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।কিন্তু লোকটির গাড়ির ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পড়ে থাকা একটি লাঠি নিয়ে সজোরে লালীকে আঘাত করে।আর ঠিক এই ফাঁকে লোকটি গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করে দেয়।লালী দৌড়ে এসে রুমালটা মুখে করে চলন্ত গাড়ির পিছনে ছুটতে শুরু করে।
লালী তখনও গাড়ির পিছনে লুকিয়ে আছে।আসলো বিশাল পুলিশ ভ্যান।লালী ঠিক যা ভেবেছিল তাই।সেদিনের সেই পুলিশ অফিসারও আছেন সকলের সাথে।লালী সকলের কথা শুনে বুঝলো আজ এখানে একটি বড় রাজনৈতিক সভা হবে যেখানে বক্তৃতা করবেন বড় বড় রাজনীতিবিদরা।ভিতরে লালী কিছুতেই ঢুকতে পারছেনা।সকলে ভিতরে ঢুকে গেছে।লালী একবার প্যান্ডেলের চারিপাশটা ভালোভাবে দেখে আসলো।কোথাও কোন সুবিধা করতে পারলোনা। আবার চলে এলো গেটের সামনে।হঠাৎ দেখে সেই পুলিশ অফিসারটি বেরিয়ে আসছেন একজনের সাথে কথা বলতে বলতে।লালী ছুটে যেয়ে অফিসারের পরা প্যান্টটি ধরে টানতে লাগলো।দুদে অফিসারের বুঝতে বাকি থাকলোনা যে এই সারমেয়টি তাকে কিছু বলতে চায়।তিনি সারমেয়টির কাছে নিচু হয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে জানতে চান,"কি রে আমায় কিছু বলবি তুই?"লালী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।লালী রুমালটি অফিসারের হাতে দেয়।তিনি গ্লাভস পরে ওটিকে একটি প্লাস্টিকে ভরে বলেন,"চল, কোথায় যেতে হবে?"
লালী ছুটছে আগে, পিছনে পুলিশ ভ্যান।অনেক্ষণ ছুটে এসে লালী ঝুপড়ির কাছে থামলো।পুলিশ অফিসার গাড়ি থেকে নেমে আসলেন।লালী ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে পাগলের মত ছটফট করতে থাকে।অফিসার কি বুঝলেন তিনিই জানেন।লালীকে বললেন,"চল-আমার সাথে।"তিনি এসে গাড়ির দরজা খুলে লালীকে গাড়িতে তুললেন।ছুটলো গাড়ি আবার মিটিংএ।
পুলিশ অফিসারটি গাড়ির ভিতর লালীকে বললেন, "তোকে নিয়ে আমি ভিতরে ঢুকবো, তুই কিন্তু কোন আওয়াজ করবিনা।শুধু যে মানুষটি দোষী তার কাছে একটু ঘুরঘুর করবি।তখন তো সবাই তোকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দেবে।তুই বাইরে বেরিয়ে এসে আমার গাড়ির কাছে অপেক্ষা করবি"।লালী মন দিয়ে অফিসারের কথাগুলো শুনলো এবং সেইমতো কাজও করলো।কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসে সে পুলিশ অফিসারের নয় তার মায়ের খুনির গাড়ির কাছে ঘাপটি মেরে বসে থাকলো।নেতা বেরিয়ে গাড়িতে উঠলেন লালীও তাকে অনুসরণ করলো।আপনজনের মৃত্যুতে কিছু কিছু মানুষ যেমন আইনের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেনা, এক একটা ক্ষণকে মনে করে এক একটা বছর;লালীর মানষিক পরিস্থিতিও এখন সেইরূপ।
গাড়ির পিছনে ধাওয়া করে লালী পৌঁছে যায় নেতা অমলেন্দু সাহার বাড়িতে।প্রাচীর টপকে বাড়ির ভিতরে ঢোকে।দরজা খোলা দেখে আস্তে আস্তে ঘরের ভিতর ঢুকে একটা খাটের তলায় লুকিয়ে থাকে।অধিক রাতে সেখান থেকে বেরিয়ে নীচুর ঘরগুলোতে খুনিকে দেখতে না পেয়ে চুপিচুপি উঠে যায় দোতলার ঘরে।নেতা তখন ঘুমে অচেতন। ঘুমের মধ্যেই লালী নেতাকে আক্রমন করে।প্রথমেই লালী কামড়ে দেয় নেতার গলা।চিৎকার করার বিন্দুমাত্র সময় সে নেতাকে দেয়না।অমলেন্দু সাহা যখন নেতিয়ে পড়ে চুপিসারে লালী পূর্বের জায়গায় এসে লুকিয়ে থাকে আর সকালে সদর দরজা খোলা হলে সকলের অলক্ষে বেরিয়ে প্রাচীর টপকে বাইরে এসে অপেক্ষায় থাকে।বারবার তার চোখের সামনে মায়ের বলা শেষ কথাগুলো ভেসে উঠতে থাকে।
পুলিশভ্যান ভর্তি পুলিশ।নেতার মৃত্যুতে জনারণ্য।কারও চোখে জল,কেউবা আড়ালে হাসছে। হঠাৎ পুলিশ অফিসারের নজরে পড়ে লালীকে।সকলের চোখ এড়িয়ে লালীর গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,"এরজন্য আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হত।শেষ পর্যন্ত পারতাম কিনা তাও জানিনা।যা করেছিস ঠিক করেছিস।আইনের ফাঁক গলে খুনি তার অর্থ আর প্রভাব খাটিয়ে ঠিক বেরিয়ে যেত।তুই চলে যা এখান থেকে।কেউ বুঝাতে পারলে তোকে মেরে ফেলবে।" অসহায় দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে থেকে লালী সেই স্থান ত্যাগ করলো।হয়তোবা আবার কোন অসহায় নারীর প্রতি হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে।কারন মাতৃহীন পৃথিবীতে এটাই তার এখন একমাত্র লক্ষ্য।
শেষ (প্রকাশিত)