নন্দা মুখার্জী

Abstract Others

3  

নন্দা মুখার্জী

Abstract Others

আশ্রিতা

আশ্রিতা

2 mins
295



--- কি গো মা এখনও চা টা খেয়ে পারোনি ?

 সর্বক্ষণের সঙ্গী চঞ্চলা এসে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা মিশ্রিত বকা দিয়ে উঠলো শোভনাদেবীকে | বহু বছর ধরে এই মেয়েটা তার বাড়িতে রয়েছে | চোখ বুজলেই আজও রাতের সেই বিভীষিকাময় ঘটনাটার কথা তার মনেপড়ে | অনেক রাতে স্বামীর সাথে বাপেরবাড়ি থেকে শেষ ট্রেন ধরে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন | মাঘমাসের শীত | লোকজন খুবই কম স্টেশনে | তারা ট্রেন থেকে নেমেই প্লাটফর্ম ধরে হাঁটতে শুরু করেন | চোখ দুটি ছাড়া সবই গরম পোশাকে ঢাকা | ঠিক সেই মুহূর্তে  অপূর্ব দেখেন  একটি মেয়েকে জোর করে দুটি ছেলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে | তার গোঙানীর আওয়াজ শুনেই জাঁদরেল পুলিশ অফিসারের বুঝতে একটুও ভুল হয়না কলকাতার বুকে আর একটা ধর্ষণ ঘটতে চলেছে | স্ত্রীকে কিছু বলার সুযোগও তিনি পান না | দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে দুটিকেই ঘায়েল করে মেয়েটিকে উদ্ধার করেন | ছেলেদুটি পালিয়ে যায় | তিনিও তাদের পিছে ধাওয়া করেন | কিন্তু অন্ধকারের ভিতর অচেনা রাস্তায় তাদের কোন হদিস না পেয়ে তিনি মেয়েটির কাছে ফিরে এসে দেখেন ততক্ষণে তার স্ত্রী সেখানে পৌঁছে মেয়েটির মুখের বাঁধন খুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন | তিনিও হাত লাগান এই কাজে | মেয়েটির কাছ থেকে জানতে পারেন মদ্যপ স্বামী সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে দিয়েছে | তাও সে জানতে পেরেছে ওই লোকদুটির কথা থেকে | বাপেরবাড়িতে কেউ নেই | একটা মেয়ে ছিল তিনমাসের | একদিন স্বামী তার মদ খেয়ে এসে তাকে মারধর করতে করতে মেয়েটিকে আছাড় মেরে মেরে ফেলে দিয়েছে | পুলিশে ধরেও নিয়ে গেছিলো | নিজেই মিথ্যে স্বাক্ষী দিয়ে তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছিল যদি এবার তার পরিবর্তন হয় | কিন্তু ফিরে এসেই সে স্বমূর্তি ধারণ করে | মেয়েটির নাম মরিয়ম | 

 শোভনাদেবী ও অপূর্ববাবু মহাফ্যাসাদে পরে যান | এখন মেয়েটিকে নিয়ে কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেননা | মরিয়ম কেঁদে বলে ," আমাকে একটু আশ্রয় দেবে তোমরা ?আমি বাড়ির সব কাজ করে দেবো | বিনিময়ে একটু মাথাগোঁজার ঠাঁই আর দুবেলা আধপেটা খেয়েও থাকতে পারবো |" কথাটা শুনে শোভনাদেবীর খুব মায়া হয় মরিয়মের প্রতি | তিনি স্বামীকে অনুরোধ করেন তাকে সাথে নিয়ে যেতে | কিন্তু অপূর্ববাবুর মনে একটা ভয় কাজ করতে থাকে | মায়ের গোপাল রয়েছে বাড়িতে | জাতিতে মুসলিম একটি মেয়েকে নিয়ে গেলে তিনি কিছুতেই তাকে বাড়িতে থাকতে দেবেন না | কথাটা তিনি তার স্ত্রীকে বলেন | শোভনাদেবী সেই মুহূর্তেই মরিয়মের নাম পাল্টে চঞ্চলা রেখে দেন আর স্বামীকে বলেন ,

--- মাকে বলবো ওকে আমার বাপেরবাড়ির কাছ থেকেই নিয়ে এসেছি | 

 মন থেকে মানতে না পারলেও এই মুহূর্তে এই যুবতী মেয়েটাকে তিনি রাস্তায় তো আর ছেড়ে যেতে পারেন না | তাই তাকে সাথে করেই বাড়ি ফেরেন | কিন্তু শোভনাদেবী মরিয়মকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছিলেন সে যেন মায়ের ঘরে না ঢোকে আর তার পুরনো কোন কথা যেন আর কাউকেই না বলে | সেই থেকে মরিয়ম চঞ্চলা হয়েই শোভনাদেবীর বাড়িতে | চঞ্চলার গুনে শ্বাশুড়ি মা ও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন | তার ঘরে ঢোকা , অসুস্থ্য সময়ে তার সেবাযত্ন করা , খাইয়ে দেওয়া - সবকিছুই করেছে | কিন্তু তিনি বারবার বলা স্বর্তেও কোনদিন ঠাকুরের সিংহাসন সে ধরেনি | নানান অজুহাতে এড়িয়ে গেছে | 

 শোভনাদেবীর এক ছেলে ও এক মেয়ে | তারাও মানুষ হয়েছে চঞ্চলার হাতে | মায়ের থেকে যেন চঞ্চলাদিই ছিল তাদের খুব কাছের বন্ধু | আর শোভনাদেবীও তার সন্তানদের ব্যাপারেই শুধু নয় সংসারের যাবতীয় ব্যাপারে চঞ্চলার উপর ছিলেন নির্ভরশীল | বাজারঘাট করার সময় চঞ্চলা গিয়ে যখন তার মায়ের কাছে টাকা চেয়েছে শোভনাদেবী তখন আঁচল থেকে চাবিটা খুলে তার হাতে দিয়ে বলেছেন ," তোর বাজার করতে যা লাগবে নিয়ে যা |" ভালোবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে চঞ্চলা এ বাড়ির একজন হয়ে উঠেছিল | 

 ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে | মেয়ে শ্বশুরবাড়ি আর ছেলে কর্মসূত্রে দিল্লী | বাড়িতে এখন সে আর তার মা শোভনাদেবী | অপূর্ববাবু যেদিন মারা যান তার পায়ের কাছে চঞ্চলা বসে কেঁদেই চলেছিল | সবাই যখন শেষ মুহূর্তে তার মুখে জল দিচ্ছে শোভনাদেবীর ছেলেমেয়ে বারবার তাদের চঞ্চলাদিকে বাবার মুখে জল দিতে বলে | চঞ্চলা ঠায় বসে আছে দেখে শোভনাদেবী নিজেই তাকে ধমক দিয়ে বলে ওঠেন ,

--- চঞ্চলা ওঠ , বাবার মুখে জল দে |

 অপূর্ববাবুর মৃত্যুতে সকলের মত চঞ্চলা এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিল যে সে প্রায় মাসাধিক কাল খাবার মুখেই তুলতে পারেনি | পরিণামে লো প্রেসার | হাসপাতালে তিনদিন ভর্তি থেকে কয়েকটা স্যালাইন টেনে বাড়িতে ফেরা | সে সময় মেয়ে সোমদত্তা এসে মায়ের কাছে ছিল আর সেই হাসপাতালে ছুটাছুটি করেছে তখন | তারপর সে সুস্থ্য হয়ে উঠলে সোমদত্তা শ্বশুরবাড়ি ফেরে |

 এখন সংসারে বসে থাকাই শোভনাদেবীর কাজ | বিকালে ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে বসে পুরনো কথা ভাবতে শোভনাদেবীর খুব ভালোলাগে | বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না চঞ্চলার শাসনে | তার উপর এখন আবার একটু একটু ঠান্ডা পড়ছে | কিছুক্ষণ আগে চা দিয়ে গিয়ে হাতের কাজ সেরে হাতে একটা গায়ের চাদর নিয়ে এসে মায়ের গায়ে চাপাতে চাপাতে সে তার মাকে মৃদু ধমক দিয়ে ওঠে | শোভনাদেবীও ছোট শিশুর মত ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি চা টা শেষ করেন | 

 সেদিন যদি একটা সামান্য মিথ্যে স্বামী স্ত্রী মিলে না বলতেন তাহলে চঞ্চলার জীবনটাই হারিয়ে যেত কোন অন্ধকার গলিতে | চঞ্চলার ভিতর যে একটা দেবীমূর্তি আছে তার প্রকাশ কোনদিনও হত না |

   


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract