নন্দা মুখার্জী

Abstract Others

4  

নন্দা মুখার্জী

Abstract Others

সেই ব্যালকনিটা

সেই ব্যালকনিটা

2 mins
320



  প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও লক্ষ্মীপূজার দিনে সকাল থেকেই সৃজিতার মন খারাপ | নির্জন বাড়িতে আটফুট বাই চারফুট ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে সেই বিকেল থেকে বসে | না এই পুজোর দিনেও কোন ঘরে তার আলো জ্বলছেনা | এই লক্ষ্মীপুজোর দিনেই তো তার জীবনের সব আলো মুছে গেছে |

বাড়ি থেকেই উঠে গেছে ঈশ্বর বিশ্বাসী নিত্য পুজো দেওয়ার ঠাকুরের আসন | চেতন বা অবচেতনে  কখনোই তার আর আসেনা " মা মঙ্গল করো |" 


 প্রচন্ড ধর্মভীরু সৃজিতা কখনোই কেউ দিব্যি দিয়ে কথা বললে অবিশ্বাস করেনি | মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল সে | দেখতে ছিল প্রচন্ড সুন্দরী |


স্কুল কলেজে পড়ার সময় কত ছেলে যে প্রপোজ করেছে তার হিসাব রাখলে একটা ছোটোখাটো খাতার  প্রতিটা পাতা ভর্তি হয়ে যেত | কিন্তু বাবার আদরের দুলালী বাবাকেই এসে হাসতে হাসতে সেই গল্পগুলি করতো | তিনিও শুনে হাসতেন আর বলতেন ," খুব সাবধান আগে পড়াশুনাটা শেষ হোক তারপর নাহয় পছন্দসই হলে সারা দিও |" মা শুনে রাগে গজগজ করতে করতে বলতেন ," আদিখ্যেতা দেখো বাপ মেয়ের | গল্প করছে যেন সমবয়সী দুই বন্ধু |" মায়ের কথা শুনে সৃজিতা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলতো ," বাবা আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড |" দিনগুলি এভাবেই হাসি আর আনন্দে কেটে যাচ্ছিলো | 

 বাবা মায়ের সাথে সৃজিতা তার বাবার অফিস কলিগের মেয়ের বিয়েতে গেছিলো বেশ সেজেগুজেই | এমনিতেই সুন্দর চেহারা তার উপর বিয়ে বাড়ির সাজ | সবাই তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো | একসময় বাবার বন্ধু রনেশকাকু বাবাকে বললেন ,

--- তোর সাথে একটা খুব দরকারি কথা আছে |

--- হ্যাঁ বল কি কথা | 

--- মেয়ের বিয়ের পরেই আমি আমার ছেলে অভিমানের বিয়ে দিতে চাই | ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার | এই বাড়িঘর বিষয় সম্পত্তি সবই ওই ছেলের | বেশ ভালো মাইনেও পায় | 

--- সবই ঠিক আছে তা আমাকে এসব আজ বলছিস কেন ?

--- তার কারণ তোর মেয়েটাকে আমি আমার ছেলের জন্য চাই |

--- তোর ছেলে আজ বিয়ে বাড়িতে আছে ?

--- দেখবি তাকে ? দাঁড়া ডাকছি | নিজের ছেলে বলে বলছিনা রে আজকের দিনে এরকম ছেলে দেখা যায়না |

--- শোন তুই ছেলেকে ডেকে নিয়ে আয় | আমিও আমার মেয়ে আর তার মাকে ডেকে আনি | কিন্তু ওদের সামনে শুধু পরিচয়টাই করাস | ওরা দেখে যাক বাকি কথা নাহয় আমরা আলোচনা করেই তোকে জানাবো | মেয়ে তো আর আমার একার না ওর মা কি বলে দেখি | আমার যদি তোর ছেলেকে পছন্দ হয় তবে ধরে নিবি আমার মেয়েরও পছন্দ হবে | 

 এই ঘটনার ছমাসের মধ্যেই সৃজিতার সাথে অভিমানের বিয়ে হয়ে যায় | শ্বশুর ,শ্বাশুড়িকে নিয়ে বেশ মানিয়ে গুছিয়ে সৃজিতা তার সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে লাগলো | অভিমান ছুটির দিন হলেই সৃজিতাকে নিয়ে বাইক চেপে এদিকওদিক ঘুরতে যায় | তবে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকা আর হয়না কারণ শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাকে যেন চোখে হারান | আর অভিমান তো অফিস থেকে ফিরে তাকে সঙ্গে সঙ্গে দেখতে না পেলে অভিমানেই তার মুখ হাড়ি হয়ে যায় | মাঝে মাঝে সৃজিতা ভাবে এতো সুখ জীবনে পাবো তা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি | দুবছরের মাথায় তার আর অভিমানের ভালোবাসার সন্তান শ্রেষ্ঠা আসে তাদের জীবনে | বাড়িতে যেন খুশির বন্যা বয়ে যায় | 

 বিয়ের পর থেকেই সৃজিতা দেখে আসছে লক্ষ্মীপূজার দিন তার শ্বশুরবাড়িতে বিশাল বড় করে পুজো হয় | চারকাঠা জমির উপর এই মস্তবড় বাড়িটাকে টুনি লাইট দিয়ে সাজানো হয় | আর সেই লাইট খোলা হয় কালীপূজার পর | বাড়িটা অভিমানের পিতৃপুরুষের | যখন যে এর মালিকানা স্বত্ব পায় সেই তার নিজের মত করে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নেয় | এই করতে করতে বাড়িটা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে চারকাঠা জমির উপর | অভিমানদের বসত ভিটেই হচ্ছে বাইশ কাঠা জমি | বাড়িতে সমস্ত রকম সব্জী চাষ হয় এই কলকাতা শহরের উপর থেকেও | তারজন্য লোক রাখা আছে | বিশাল গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখে দুপাশে ফুলগাছের সমারোহ | কোন পুজোতেই বাইরের থেকে ফুল কেনার প্রয়োজন হয়না | বাড়ির বাগানের অজস্র ফুঁটে থাকা ফুল দিয়েই পুজো হয়ে যায় | 

  বিয়ের চারবছর পরে --- মেয়ের বয়স তখন দুবছর | সেদিন ছিল লক্ষ্মীপুজো | বাড়ির সকলেই কাজে ব্যস্ত | আয়োজন যেহেতু বিশাল তাই পুজোর কাজে সহায়তা করার জন্য পাড়ার কিছু বৌ , মেয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় | তখনও পূর্ণিমা লেগে পারেনি | সে বছর সন্ধ্যা সাতটার পরে পূর্ণিমা লেগেছিলো | নারুকাকু যিনি বারোমাস অভিমানদের জমিতে সব্জি চাষ করেন তিনি এসে অভিমানকে জানালেন ,

--- ছোটবাবু তালের যে আঠিগুলি এনেছেন সেগুলি সবই পঁচা | আপনি আমাকে টাকা দিন আমি নিজে গিয়ে দেখে নিয়ে আসছি | 

--- আরে তোমাকে যেতে হবেনা | তুমি বরং এদিকটা সামলাও আমি বাইকে গিয়ে এক্ষুণি নিয়ে আসছি |

  এই অসময়ে বেরোনোটা সৃজিতার একদম ভালো লাগেনি | সে কৃতিম রাগ দেখিয়ে বলেছিলো ,

--- যে কটা আছে তাই দিয়েই পুজো হয়ে যাবে | তোমাকে এখন যেতে হবেনা |

--- দূর পাগলী কত লোক আসবে | কেউ যদি খেতে চায় তাকে বলবে 'নেই ?' তাই হয় নাকি? আমি যাবো আর আসবো | দশ থেকে পনের মিনিট লাগবে |

--- মনে থাকে যেন | পনের মিনিটের মধ্যেই কিন্তু আসা চাই |

 অভিমান সৃজিতার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো ," পাক্কা প্রমিস |"  

  বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো | পূর্ণিমা তখন লেগে গেছে | বাড়ির তিনটে প্রাণীই অস্থির হয়ে পড়ছে | ঠাকুরমশাই নারায়ন নিয়ে পুজোর জন্য এসে পড়েছেন | হঠাৎ একটি পাড়ার ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে খবর দিলো, "অভিমানদা একসিডেন্ট করেছে |" পাগলের মত সৃজিতা ছুঁটে বেরিয়ে গেলো মেয়েকে শ্বাশুড়ির কাছে রেখে | রনেশবাবু দ্রুত বেরোতে গিয়ে শোনেন এক প্রতিবেশিনী ঠাকুরমশাইকে বলছেন ," আপনি কোনরকমে পুজোটা করে ফেলুন |" রনেশবাবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন | তিনি গম্ভীর গলায় বললেন ," এবারে আর পুজোটা করতে হবেনা ঠাকুরমশাই | মা ঐভাবেই আমার ঘরে থাকবেন | আমার অভি সুস্থ্য হয়ে ঘরে ফিরুক আগামীবার এই প্রতিমাকেই আমি পুজো করবো | আর যদি ----|" তিনি বিড়বিড় করতে করতে দ্রুত  বেরিয়ে গেলেন |

  মনের অবস্থা মোটেই ভালোনা | দুরন্ত নাতনীকে  নিয়ে এই পরিস্থিতিতে অভিমানের মা হিমশিম খাচ্ছেন | পরিস্থিতি মনেহয় মানুষকে শক্ত করে তোলে | স্বামী , বৌমা সেই বেরিয়েছে রাত এখন অনেক | কেউ এখনো ফেরেনি | দুধের শিশুকে মাঝেমধ্যেই দুধ করে খাওয়াচ্ছেন মলিনাদেবী | স্বামীর ফোনের সুইচ অফ আর সৃজিতা তো তার ফোন নিয়েই যায়নি | সেই সন্ধ্যাতেই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই বাড়ির সমস্ত আলোর সাজ নিভে গেছে | দু একজন প্রতিবেশী অনেক রাত অবধি মলিনাদেবীর কাছে ছিলেন | খবর পেয়েই সৃজিতার বাবা , মা রাত দশটা নাগাদ চলে এসেছেন | সারাটা রাত তিনটে প্রাণীই জেগে কাটিয়েছেন | 

  ভোর পাঁচটা নাগাদ ফিরে এলেন আলুথালু বেশে রনেশবাবু আর তার বৌমা | ফিরলোনা শুধু অভিমান | সে এখন ঠান্ডাঘরে | আকাশ বাতাস মথিত করে বাড়ির সকলে চিৎকার চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করছে | কে কাকে শান্তনা দেবে ? কি বলে শান্তনা দেবে ?শুধু কিছু পাড়াপ্রতিবেশী এই পাগল প্রায় মানুষগুলিকে দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে | তাদের চোখেও অবিরাম জলের ধারা |

  অনেক চেষ্টা করেও মেয়ে নাতনীকে নিয়ে যেতে পারেননি সৃজিতার বাবা , মা | তাদের দেখতে ইচ্ছা করলে তারাই এসেছেন তার শ্বশুরবাড়িতে | শ্বশুর আবার নুতন করে সৃজিতাকে তার জীবনটা নিয়ে ভাবতে বলেছিলেন বারবার | কিন্তু সে রাজি হয়নি | 

      অভিমানের একসিডেন্টের খবর শোনার পরেই সৃজিতার বুকের উপর যে ভারী পাথরটা চেপে বসেছিল আজও তা বর্তমান | মেয়েকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে বিয়ে দিয়েছে ডাক্তার ছেলের সাথে | বিয়ে ঠিক করতে গিয়ে জেনে এসেছিলো ছেলে বাইক চালায় কিনা | সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই তবে সে মেয়ের বিয়ের পাকা কথা দিয়েছিলো | আগে দু দুটো বিয়ে নাকচ করেছে ছেলে বাইক চালায় শুনে | মেয়ে শ্বশুরবাড়ি | মাঝে মধ্যে আসে মায়ের কাছে | এখন সে সম্পূর্ণ একা | বছর দুয়েক হল শ্বশুরমশাই ও গত হয়েছেন | বেশ কয়েক বছর আগেই চলে গেছেন একেএকে বাবা , মা আর শ্বাশুড়ি | সময় মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ওষুধ | অন্য দিনগুলি যেমনতেমন কিন্তু এই লক্ষ্মীপুজো আসলেই পঁচিশ বছর আগের স্মৃতিগুলি বারবার অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় | তখন এই ব্যলকনিটাই বসে আপনমনে অভিমানের শেষ বলা কথাগুলো ভাবতে থাকে | সেদিন যে এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই অভিমান তাকে কথা দিয়েছিলো পনের মিনিটের মধ্যেই সে ফিরে আসবে | তাই আজও সৃজিতা সেই অপেক্ষায় বসে যদি একবার সে এসে তার সামনে দাঁড়ায় ---| গতানুগগতিক জীবনের বাইরেও এমন কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা মেলেনা | আর সেগুলিই তো অলৌকিক | বাকি জীবনে সেই অলৌকিক কিছু ঘটার আশায় লক্ষ্মীপুজোর দিনে বিকেল থেকে সারারাত কাটে সৃজিতার এই ব্যালকনিতে |

   



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract