নন্দা মুখার্জী

Tragedy Crime Others

3  

নন্দা মুখার্জী

Tragedy Crime Others

আমার জীবনের এত খুশি এত হাসি

আমার জীবনের এত খুশি এত হাসি

5 mins
292



 গরীবের ঘরে জন্ম হলেও জীবনটা ছিল খুব উচ্ছ্বল | বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত সংসারে অর্থের অভাব থাকলেও হাসি,আনন্দ,সুখ আর ভালোবাসার কোন অভাব ছিলনা |অভাব ছিল শুধু অর্থের |

 কোনরকমে মাধ্যমিক টা পাশ করেছিল সুপ্তা |বাবা একটা বিল্ডার্সের দোকানে খাতাপত্র দেখাশুনা করতেন|মা পুরনো কাগজ কিনে এনে ঠোঙ্গা বানাতেন|দুই ভাইবোন সুপ্তারা|সুপ্তা বড় আর ভাই সুকুমার ছোট | সে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে|মাকে ঘরের কাজে সাহায্য ছাড়াও সে মায়ের সাথে ঠোঙ্গা বানায় দোকানে দোকানে দিয়ে আসে|একদিন ঠোঙ্গা দোকানে দিয়ে যখন বাড়ি আসছে মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা তাকে ডেকে নাম,ধাম জিজ্ঞাসা করে ন |বাড়িতে এসে মাকে সেকথা জানায়|মা ব্যাপারটা পাত্তা দেন না|

 পরদিন সন্ধ্যায় সেই ভদ্রমহিলা আর তারই বয়সী একটি মেয়ে আসে তাদের বাড়ি |ভদ্রমহিলা জানান তিনি তার ছেলের জন্য সুপ্তা কে পছন্দ করেছেন |ছেলে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে|বাড়িতে একটা ভাড়া আছে,মেয়ে রঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ,দাদার বিয়ের পরেই রঞ্জনার বিয়ে হবে|সব শুনে সুপ্তার মা জানান,

--- দিদি,সবই তো ঠিক আছে ;তবে দেখতেই তো পারছেন আমরা খুবই গরীব আপনাদের যদি কোন দাবি থাকে তাহলে কিন্তু আমরা পারবো না|

--- না,না আমাদের কোন দাবি নেই |রাস্তায় ওকে দেখে আমার পছন্দ হল তাই ওর কাছ থেকেই বাড়ির ঠিকানা জেনে আপনাদের সাথে কথা বলতে চলে এলাম|

--- ওর বাবা বাড়ি ফিরলে আমি সব জানাবো|তবে মেয়ের হাতে,কানে,গলায় আর একটা আলমারি আমরা দেবো|

 তিনমাসের মধ্যে সুপ্তা তার স্বামী সুকুমারের হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো |শ্বাশুড়ী, ননদ নিয়ে মাস দুয়েক বেশ ভালোই কাটলো |দেখতে দেখতে ননদের বিয়ের দিন এসে গেলো|কিন্তু ননদের বিয়ের খরচ আর সংসারের নেই,নেই আলোচনাটা মা,ছেলে সবসময় সুপ্তার সামনেই করতে থাকে|প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও পরে সে বুঝে ফেলে ওই গলায়,কানে আর হাতের ছ'গাছা চুড়ির জন্যই তার সামনে এই আলোচনা|বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে সুপ্তা|সুপ্তার দিক থেকে কোন সারা না পেয়ে একদিন সুকুমার রাতে তাকে বলেই ফেলে,

--- এখন ও তো আমি রঞ্জনার বিয়ের সব জোগাড় করে উঠতে পারিনি তুমি যদি আমাকে একটু হেল্প করতে তাহলে আমি পরে তোমাকে সব ফেরৎ দিয়ে দিতাম |

 সুকুমার রঞ্জনাকে আদর করতে করতে কথাগুলি বলে |নিজেকে সুকুমারের কাছ থেকে মুক্ত করে সুপ্তা সুকুমারের কাছে জানতে চায়,

--- কি করতে হবে আমাকে?বাবার দেওয়া ওই সামান্য গয়নাগুলো নেবে ?

--- না, মানে বলছিলাম তোমাকে আস্তে আস্তে আমি আবার সব গড়িয়ে দেবো|

 সুপ্তা নিজেকে মনেমনে শক্ত করে বলে,

--- গয়না দিয়ে আর কি হবে আমার?কিন্তু বাবার দেওয়া গয়না তো তাই মনটা খারাপ লাগছে|এরপর তুমি আমাকে যত গয়নায় বানিয়ে দাও না কেন আর তা যতই ভারী গয়না হোক না কেন,বাবার দেওয়া ওই সামান্য কটা গয়না আমার কাছে বহু মূল্যবান|

--- আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আবার সব গড়িয়ে দেবো |

 একটু আমতা আমতা করে সুকুমার বলে ,

--- আর যদি তোমার আলমারিটা ---?

--- তাহলে আমি কোথায় জামাকাপড় রাখবো?

--- যদি কটাদিন কষ্ট করে মায়ের আলমারি তে রাখো কয়েক মাসের মধ্যেই তোমায় আলমারি কিনে দেবো |অফিসে লোনের এপ্লাই করেছি কিন্তু এখনো পেতে বেশ কয়েক মাস লাগবে|শুধু কয়েকটা মাসের জন্য একটু কষ্ট করলেই আমি তোমাকে আরও ভালো আলমারি কিনে দিতে পারবো |

 চোখ ভর্তি জল অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সুপ্তা তার স্বামীকে বলে

--- ঠিক আছে|আমার তো আর কিছু নেই ,তবে বিয়ের বেনারসি টা আছে|যদি দরকার হয় বোলো|

 সুকুমার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর সুপ্তা নিজের চোখের জল লুকাতে পাশ ফিরে শুয়ে পরে|সুকুমার তাকে কাছে টেনে নিতে গেলে সে পাশ ফিরেই তাকে জানায়,

--- হঠাৎ মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে গো ,আজ আর ভালো লাগছে না|

 সুকুমার বুঝতে পারে এটা সুপ্তার রাগের বা কষ্টের বহিঃপ্রকাশ |সেও তাকে আর ঘাটায় না| সেও জয়ের আনন্দে হাসি হাসি মুখে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে|

 সুপ্তা পুরো ঘটনাটা বাপের বাড়ি লুকিয়ে যায়|মাসের পর মাস সুপ্তার না আসে আলমারি না আসে গয়না |স্বামী,শ্বাশুড়ীর তার প্রতি ব্যবহারেরও আমূল পরিবর্তন |চাপা স্বভাবের সুপ্তা নিজমনে সংসারের যাবতীয় কাজ করে চলে | আলমারিটা দিয়ে দেওয়ার পর একটা ভাঙ্গা শোকেসের ভিতর সে তার কাপড়গুলো কোনরকমে গুছিয়ে রেখেছিলো| সুকুমারের জামাকাপড় তার মায়ের আলমারিতেই থাকে | অনেক ভেবেচিন্তে সে একদিন রাতে সুকুমার কে খেতে দিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে,

--- তোমার লোনটা পেতে আরও দেরি হবে ?

--- কিসের লোন?

--- রঞ্জনার বিয়ের আগে বলেছিলে না লোনের এপ্লাই করেছো ,লোনটা পেলে আলমারি কিনে দেবে |শোকেসটা তো ভাঙ্গা সেদিন দেখি ইঁদুর ধুঁকেছে ---|

--- করি তো সামান্য একটা চাকরি | মাইনে যা পাই সংসার চালাতেই হিমশিম। ওই কোম্পানী লোন কাউকে দেয় না।

--- তারমানে আমাকে তুমি মিথ্যা বলেছিলে?

--- এতদিনে যে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছো তাতেই কৃতার্থ হলাম|তোমার বাবাকে বোলো তিনি যেন ভালো দেখে এবার একটা আলমারি তোমায় কিনে দেন |বোনের আলমারিটা ভালো হয়নি তার শ্বশুরবাড়ি থেকে বলেছে | একটা খাট পর্যন্ত তোমার বাবা দেয়নি | আমার পুরনো খাটে রোজ ঘুমাচ্ছো --- বোনকে তো আর আমি খাট না দিয়ে পারিনি আর তাছাড়া ----

 কথা শেষ হওয়ার আগেই চুপচাপ থাকা মেয়েটা হঠাৎ মুখরা হয়ে উঠলো ।

--- তারমানে আমায় বিয়ে করেছিলে আমার বাবার আমাকে দেওয়া জিনিসগুলি নিয়ে বোনের বিয়ে দেওয়ার জন্য ?

--- তাই ছাড়া আবার কি ?তুমি কি ভেবেছিলে ?মা তো ভাবতেই পারেনি ওই রকম পলকা গয়না তোমার বাবা তোমাকে দেবেন |মায়েরও ভীমরতি ধরেছিলো|

--- আমার বাবা তো পলকা হলেও দিয়েছিলেন তোমাদের তো সে মুরোদ ও নেই । এর থেকে আমার বাবার কাছে হাত জোড় করে দাঁড়ালে বাবা কিছুটা অর্থ সাহায্য করলেও করতে পারতেন ---।এককথা দুকথায় ঝামেলা চরমে ওঠে। তেড়ে মারতে যায় সুকুমার সুপ্তাকে ।ঠিক সেই মুহূর্তে শ্বাশুড়ী এসে সুপ্তাকে মারের হাত থেকে বাঁচান | শ্বাশুড়ী চিৎকার করে বলেন ,

--- আমরা তো অনেক আগেই ভেবেছিলাম তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ,তোমার তো আবার গন্ডারের চামড়া ।অনেক তো হল বাপু এবার বিদায় হও ।

--- মানে?

--- তবে শোনো, আমাদের তো জমানো কোন ক্যাশ ছিল না ।এদিকে রঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে তো আর খালি হাতে বিদায় দিতে পারিনা ।তাই অনেক ভেবেচিন্তে সুকুমারের তোমার সাথে বিয়েটা দিই।শুধুমাত্র ওই জিনিসগুলির জন্য।

--- আপনারা এতটা খারাপ !

সুকুমার বলে ওঠে ,

--- সেইজন্যই তো বলছি আমাদের সাথে থেকো না ।তোমার মা,বাবার কাছে চলে যাও|

 স্রোতের মত সময়ও বসে থাকেনা --- সুকুমার এখন জেলে |সেদিন ঝামেলার মধ্যে সুকুমার এক সময় সুপ্তার গলা টিপে ধরে |কোন রকমে ছাড়িয়ে সুপ্তা ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে চলে যায়।পরিচিত একটি দোকান থেকে কিছু টাকা ধার করে সোজা বাড়ি চলে আসে ।কিন্তু সুকুমার ও তার মাকে অনেক চেষ্টার পরে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়।জেলে থাকাকালীন সময়েই হার্ট অ্যাটাকে তার মা মারা যান |সুকুমার বিনা বিচারেই জেলার ঘানি টানছে ।রঞ্জনার শ্বশুরবাড়ি সমস্ত ঘটনা জানার পর রঞ্জনাকে জানিয়ে দিয়েছে দাদার সাথে কোন সম্পর্ক রাখলে সে বাড়ি তাকে ত্যাগ করতে হবে। তাই রঞ্জনাও দাদার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছে ।স্থানীয় পার্টির লোকজন ধরে পঞ্চায়েত অফিসে ক্লাস ফোর এর একটি চাকরি জোগাড় করেছে |কাউন্সিলর তাকে আশ্বাস দিয়েছেন কাজটা পার্মানেন্ট করতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।

 সুপ্তার জীবন নূতন খাতে বইতে শুরু করে।হয়তো একদিন সে তার সমস্ত অতীত ভুলে গিয়ে জীবনের সুখের ঠিকানাটা খুঁজে পাবে। 

       


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy